প্রকৃতিতে তারও প্রয়োজন আছে। নইলে খাদ্য হবে কে ?

হিংস্রতার অনুশীলন ছাড়া কোনো জাতিই তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারেনা। প্রকৃতি থেকেই আমরা এই সহজ শিক্ষাটি গ্রহণ করতে পারি। একদিকে বাঘ সিংহের, মত হিংস্র প্রাণির উপস্থিতি যেমন রয়েছে, তেমনই আছে ভেড়া এবং হরিণের মত ভীরু এবং অহিংস চতুষ্পদ। জঙ্গলের আধিপত্য কার দখলে থাকে আশা করি বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রখ্যাত ইংরেজ কবি উইলিয়াম ব্লেক তাঁর Songs of Innocence and  of Experience  গ্রন্থটিতে টাইগার এবং ল্যাম্ব শীর্ষক কবিতায় এই পরস্পর বিরোধী বৈশিষ্ট্যের আবশ্যিক সহাবস্থান নিয়ে অসাধারণ পর্যবেক্ষণ রাখেন। উদারতা, মহত্ত্ব, অহিংসার পূজা করতে গিয়ে তিনি একবারও বলেন নি সৃষ্টিতে বাঘের প্রয়োজন নেই। আত্মরক্ষা এবং আক্রমণ উভয়ের জন্য হিংসার অনুশীলন অত্যন্ত জরুরী। কি বললেন ? আপনি সভ্য হয়েছেন তাই আর হিংসাকে সমর্থন অথবা অনুশীলন করেন না ? আপনি গণতন্ত্রপ্রেমী, উদার মানবতাবাদী? ভুল করে ফেললেন বন্ধু। একটু ভাবলেই বুঝতে পারবেন আপনি আদৌ হিংসা বর্জন করেন নি। সভ্য, গণতান্ত্রিক হওয়ার পর আপনি হিংসা অনুশীলনের দায়িত্বটি নিজের হাতে না রেখে সেনা বাহিনী এবং পুলিশের উপর ন্যস্ত করেছেন।  আর ভাবছেন বাহ আমি কত সভ্য, উদার, মহান। আমার হাতে এক ফোঁটাও রক্ত লেগে নেই। আমি মাংস খাই বটে, কিন্তু প্রাণি হত্যা করিনা। ঘরে বাইরে অস্ত্র হাতে পাহারাও দিই না। আমি আপাদমস্তক এক সভ্য, অহিংস নাগরিক। হা হা হা ! এভাবে অন্যের উপর আক্রমণ আর প্রতিরক্ষার কাজটি ছেড়ে দিয়েই আমরা সভ্য হয়েছি। কিন্তু অহিংস হইনি। অহিংস হলে আপনার আমার অস্তিত্বই থাকত না। জাতিটিও কবেই বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যেত। হ্যাঁ, অপ্রিয় হলেও এই সত্যকে অস্বীকার করা যায়না। আদিম মানুষ প্রত্যেকেই হিংসার অনুশীলন করত। করতে বাধ্য হত। প্রত্যেকের হাতেই অস্ত্র থাকত। সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে আমরা এই “অপ্রীতিকর, পাশবিক” দায়িত্বটি অন্যদের [সেনা বাহিনী এবং পুলিশ] দিয়ে ক্রমে ক্রমে “ভদ্রলোক” হয়ে উঠেছি আর ভাবছি “যাকনা এমন করে যায় যদি দিন যাক না !

কিন্তু বাস্তবটি কি তাই ? এভাবেই কি অনন্তকাল টিকে থাকা সম্ভব ? সেনা বাহিনীর বাজেট বাড়িয়ে, অত্যাধুনিক অস্ত্র শস্ত্র মজুত করে বহিঃশত্রুদের হাত থেকে বেঁচে যাওয়া সম্ভব। কিন্তু আভ্যন্তরীণ শত্রু ? গৃহশত্রু ? তাদের হাত থেকে কিভাবে মুক্তি পাবেন ? কোনো সভ্যতা নিছক বহিঃশত্রুর আক্রমণে ধ্বংস হয়না। শেকড়ে ঘুণ ধরে গেলে সামান্য বাতাসে মহীরুহেরও পতন হয়। রোম্যান সাম্রাজ্যের পতনের কারণও নিছক মুসলমান সুলতান দ্বিতীয় মাহমুদ অথবা বর্বর নেতা ওডোয়াসারের আক্রমণের ফলে হয়নি। রোম্যান সম্রাট মার্কাস অরিলাসের সময় থেকেই সাধারণ রোম্যানরা বড় বেশি আত্মকেন্দ্রিক, দুর্নীতিপরায়ণ এবং তথাকথিত “ভদ্রলোক” হয়ে উঠেছিলেন।  অরিলাস নিজেও কঠোর প্রশাসক হওয়ার পরিবর্তে ক্রমশ দার্শনিক হয়ে উঠেছিলেন। বারোটি খণ্ডে লেখা Meditations [ ধ্যান] তাঁকে সম্রাট হিসেবে নয়, দার্শনিক, চিন্তাবিদ হিসেবেই বেশি পরিচিত করে তুলেছে। [সম্রাট অশোকের কথা মনে পড়ছে ? অত্যধিক অহিংসা চর্চার পরিণতি হিসেবে মৌর্য সাম্রাজ্যের পতন ত্বরান্বিত হয়েছিল]

সেনাবাহিনী, পুলিশ যতই শক্তিশালী হোক, আধুনিক সভ্যতায় আপনি সুরক্ষিত নন। কারণ আপনার সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদটিই আপনার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা। কি বলুন তো ? গনতন্ত্র মশাই, গণতন্ত্র। যাকে নিয়ে আমি আপনি দিনরাত গর্ব করি। বাক স্বাধীনতা, উদারতা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি। আত্মরক্ষার দায়িত্ব অন্যের উপর দিয়ে নাকে তেল দিয়ে ঘুমোনো। ইউরোপও এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। এই গণতন্ত্র, মানবাধিকার ইত্যাদিকে ব্যবহার করেই আপনার আমার শত্রুরা তাদের শক্তি বৃদ্ধি করে। এই অশুভ শক্তির মিলিত আস্ফালনের সামনে গনতন্ত্র, সভ্যতা বড় অসহায়।

জয়পুরের মহারাজা ঈশ্বরী সিংহকে চেনেন ?  ১৭৫০ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে তিনি আত্মহত্যা করেন। কথিত আছে একটি গোখরো সাপের ছোবল গ্রহণ করে তিনি মৃত্যুকে আমন্ত্রণ জানান।কেন বলুন তো ?পিতা  দ্বিতীয় জয় সিংহের মৃত্যুর পর তিনি সিংহাসনে বসেন। কিন্তু মারাঠা হানাদারের  দল তাদের জুলুম অব্যাহত রেখেছিল। চৌথ এবং সরদেশমুখী নামক দুটি কর আদায়ের নামে তারা রাজ্যের প্রায় ৩৫% সম্পদ ছিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। চৌথ হল ফসলের চার ভাগের এক ভাগ। সরদেশমুখী দশ ভাগের একভাগ। বলাই বাহুল্য ঈশ্বরী সিংহ এই দাবী মেটাতে অপারগ ছিলেন। ১৭৫০ খ্রিষ্টাব্দে  এই কর আদায়ের উদ্দেশ্যে মারাঠা সেনা জয়পুরে প্রবেশ করে। অক্ষম রাজা আত্মহত্যা করতে বাধ্য হন। তারিখটি ছিল ডিসেম্বর ১২, ১৭৫০ । তাঁর মৃত্যুর পর প্রথম মাধো সিংহ সিংহাসনে বসেন। মারাঠারা তাঁর রাজত্বের কম পক্ষে এক চতুর্থাংশ দাবী করে বসে। এমন অযৌক্তিক এবং অন্যায় দাবী মেনে নেওয়া অসম্ভব।মারাঠা জনতা অত্যন্ত ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। ফলশ্রুতি হিসেবে ১৭৫১ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে জয়পুরে হাজার হাজার মারাঠা হানাদারকে হত্যা করা হয়। জনগণের এই আকস্মিক প্রতিরোধে হতভম্ব মারাঠা সেনা পালাবার পথ পায়না। কিছু বুঝলেন? এই জন্যই বিশ্বের অনেক দেশে জনগণের জন্য সামরিক শিক্ষার প্রচলন আছে। কিছু দেশে বাধ্যতামূলক।
রাজস্থানের জয়পুরে যাওয়ার দরকার নেই। দেশভাগের প্রাক মুহূর্ত থেকে শুরু হওয়া, রক্তপাত, উচ্ছেদের যন্ত্রণার কথা মনে আছে ? — বলুন তো কোন সেনাবাহিনী কোন  পুলিশ সেদিন আপনার পাশে দাঁড়িয়েছিল ? কাদের উপর আত্মরক্ষার ভার সমর্পন করে আপনি নিশ্চিন্তে কাল যাপন করছিলেন ? আত্মরক্ষা মানে আত্ম অর্থাৎ নিজেকে বাঁচানো। যুগ যুগ ধরে সেটা নিজেকেই করতে হয়। এখন তো শুনছি পৌরাণিক দেবদেবীর মূর্তির হাত থেকেও টিনের অস্ত্র খুলে নিচ্ছেন।  কি বললেন ?বাঘ নয়, ভেড়া হবেন ?
বেশ তো। প্রকৃতিতে তারও প্রয়োজন আছে। নইলে খাদ্য হবে কে ?