অমরত্বের সন্ধানে মানব সভ্যতার প্রচেষ্টা (নিলয় নীল সহ সকল অগ্নি সেনানীর জন্য শ্রদ্ধার্ঘ )

অমরত্বের সন্ধানে মানব সভ্যতার প্রচেষ্টা
(নিলয় নীল সহ সকল অগ্নি সেনানীর জন্য শ্রদ্ধার্ঘ )

এই মহাবিশ্বে এতো স্বল্পায়ু মানব জীবন অথচ এতো সম্ভাবনাময় আমরা। আরো একটু বেশি আয়ু হলে কি হতো ? না হয় সংখ্যাবৃদ্ধি কম হতো ! এরপর অবধারিত ভাবে ভাবি এই জীবন গেলে চলে আসে না আবার। সত্যই জীবন এতো ছোট ক্যানে ! সেই ভাবনার থেকে খুঁজি বিজ্ঞানের রাস্তায় কি কিছু নেই যা মানুষকে অমরত্ব এনে দিতে পারে ? দুটো সম্ভাবনা কে সেই সূত্রে বড় গ্রহণযোগ্য মনে হয়। এক হলো মস্তিষ্কের সংরক্ষণ আর দ্বিতীয় হলো জিন টেকনোলজির ব্যবহার। জিনের ব্যবহার এবং রোগ প্রতিরোধ বা বার্ধক্য রোধের উপর লিখবো পরের পর্বে। আজ মস্তিস্ক সংরক্ষণ কে নিয়ে আপনাদের একটু কান এর মাথা খাবো।

এই যে অমিত সম্ভাবনা নিয়ে আসা তাজা প্রাণগুলো সত্যের জন্য , আলোর পথে চলার জন্য প্রাণ দিলো এদের চলে যাওয়ার ক্ষতিপূরণ কে করবে ? কেমন হয় যদি আমরা মানুষকে আর হারিয়ে না যেতে দিই ? আজকে নিলয় , রাজীব ,অভিজিত এর মতো অজস্র প্রাণ কে যদি আবার ফিরিয়ে আনতে পারতাম ? তাদের কাছের মানুষগুলোর কাছে ক্ৰমশঃ ধূসর হয়ে যাওয়া স্মৃতি অথবা পুরোনো ছবির এলবাম ,পোশাক ইত্যাদি তো তাদের ফিরিয়ে আনবে না। বিজ্ঞান কি আমাদের এই সম্ভাবনার দরজায় নিয়ে যেতে পারে ?  উত্তর হলো হ্যা পারে। জীন তত্বের এই ফিরিয়ে আনা নিয়ে অন্য  পর্বে আলোচনা করবো উপরে যেমন বলেছি , আজ মস্তিস্ক সংরক্ষণ এর  কথাই বলি। প্রসঙ্গত বলা যায় এই হারিয়ে যাওয়া অমূল্য মানুষগুলোকে ফিরিয়ে নেওয়া হয়তো এতে হবে না তবে পুনুর্ভব হওয়ার রাস্তা নিয়েই বলবো।

এই প্রসঙ্গে বলে রাখি , আত্মা ইত্যাদি কিন্তু অসাড় বস্তু তা আপনি মানেন বা না মানেন। মস্তিষ্কের মৃত্যু (তার কোষের জীবিত থাকা ) না হলে ওই NDE মানে NEAR DEATH EXPERIENCE ইত্যাদি যাই বলুন তাতে কোনো ফারাক আসে না। এই প্রসঙ্গে  অন্য কোনো এক আলোচনায় কথা বলবো। আমার আপনার স্বকীয়তা ,মনন , চেতনা সব নিয়ন্ত্রণ করে আমাদের মস্তিস্ক। স্মৃতি থেকে কার্যবিধি সব কিছুই ওই খুলির মধ্যেই আছে। এখন ওটার একটা ব্যাকআপ হলে তো অধিকাংশ কাজটাই হয়ে যায় তাই না ?
ডিএনএ বা স্টেম সেলের কারিগরি দিয়ে তো জীবের ক্লোনিং সম্ভব কিন্তু স্মৃতি আর সেই মৃত মানুষের মৃত্যুকালীন মানসিক অবস্থান কে কি ভাবে ফিরিয়ে আনা যায় ? একটা জড় শরীর যার ওই মানুষটির স্মৃতি বা বৈশিষ্টর পুরো আধার থাকবে না তার উপস্থিতি আমাদের কোন কাজে লাগবে ? এই জন্য  বিজ্ঞান।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নিউরোলোজিস্টরা (মস্তিস্ক বিশেষজ্ঞ বলতে পারেন ) আমাদের মস্তিষ্কের একটা মানচিত্র বানাচ্ছেন। এরই সাথে নিউরন  এর কাজের সমন্ধে পুরো খবর সংগ্রহ করছেন। এই নিউরন কি করে মানব দেহে অভ্যন্তরীণ বার্তা বিনিময় /তথ্য বিনিময় করে , কি করে আমাদের স্মৃতি তৈরী হয় , কি করে এই নিউরন এর পারস্পরিক সংযোগ আর দেহস্থ প্রোটিন এই তথ্য সঞ্চয়ে সাহায্য করে তার সমন্ধে তাদের গবেষণা আমাদের ক্ৰমশঃ একের পর এক বন্ধ দরজা খুলে দিচ্ছে।

আমরা জানতে পারছি আমাদের জীববিজ্ঞানের ভাষায় এই  ‘চেতনা ‘ বিষয়টা কি। ইতিমধ্যেই ইঁদুরের মস্তিষ্কের স্মৃতি মুছে দেওয়া অথবা স্মৃতি রোপন করার কাজ কিন্তু মানুষ করে ফেলেছে !  এর উপর তথ্যসূত্র নিচে দেওয়া হলো , সূত্র নম্বর : ১ 

ব্রেনের তথ্যসঞ্চয় এর আঁধার কত ওটা রহস্য বা বাধা না ,কারণ আমরা জেনেছি যে একটা স্বাভাবিক মানুষের মস্তিস্ক কয়েক গিগাবাইট তথ্য জমা রাখতে পারে। ধাঁধা হলো এই সঞ্চয় আর ফিরিয়ে আনার জন্য নিউরোন কি ভাবে কাজ করে। দাঁড়ান , দাঁড়ান , ওই গিগাবাইট শুনে আমার কলার ধরবেন না , ব্রেনের ওপার বিস্ময় ওই নিউরন। প্রতিটি নিউরোন একাই ১০০০ সংযোগ তৈরী করে। এই সংযোগের সময় স্মৃতি চলাচল হতে থাকে এই নিউরন থেকে নিউরনে। এই হিসাবে বিজ্ঞানীরা মস্তিষ্কের স্মৃতি আধার হয়  ২.৫ পেটাবাইট ( ২.৫ মিলিয়ন গিগাবাই ,ভাবুন ! ) , এই তথ্যভান্ডার এর পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসেবে রাখা আর সঠিক সঞ্চয় করা এবং আবার সময়ে ফিরিয়ে দেওয়া অতীব দুরহ কাজ।  সূত্র নম্বর : ৯

এ ছাড়া ও সমস্যা আছে , মস্তিস্ক এই স্মৃতির একটা গুরুত্ব আরোপ করে। কোনো স্মৃতি উজ্জ্বল হয়ে ওঠে আর কোনটা প্রলেপ পরে যায়। এর রোমন্থন করা এবং তার সঠিক সংরক্ষণ কি জটিল কাজ তা আমাদের মতো সাধারণ মানুষের ভাবার বাইরে। মানুষের মাতৃ জঠরের স্মৃতি ও মানুষের থাকে কিন্তু তার ফিরিয়ে নেওয়া বড় কঠিন ,আরো মজার হলো এই এই স্মৃতি কোষ এর সৃষ্টি হতে থেকে আমাদের কৈশোর অবধি।

তা হলে উপায় ?

এই কাজে এগিয়ে এসেছে একাধিক প্রতিষ্ঠান ,এর মধ্যে আমাদের গুগল অগ্রগণ্য। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ,একটি অন্তর্জালের মাধ্যমে সংরক্ষণ (গুগল ক্লাউড ) এবং আরো অনেক বৈজ্ঞানিক কাজের সমাহার নিয়ে ২০১২ থেকে কাজ করছে এই প্রতিষ্ঠান। এই কাজকে বলা হচ্ছে ব্রেনের একটি প্রতিলিপির মতো করা বা কপি করা।

এই কাজের অগ্রগণ্য প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজের আগে বলা দরকার , অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির এন্ডার্স স্যান্ডবার্গ এর লেখা তাত্বিক লেখনীর কথা। ২০০৮ এর এই বর্ননা থেকে আমরা দেখতে পাই , সবে মানুষ পা ফেলেছে এই কাজে। তার বর্ননা মতে জানতে পারি আমরা শুধু ইঁদুরের মতো প্রাণীর ব্রেনের কাজের একটা নকল তৈরী করতে সক্ষম হয়েছি। এই পদক্ষেপ কে স্বাগত জানিয়ে এর বাধা গুলো ও তিনি তুলে ধরেছেন।  মুশকিলের সর্বপ্রথম ধাপ হলো মস্তিস্ক আর কম্পিউটার এর সরাসরি সংযোগ স্থাপন করা। ব্রেনের বিবিধ অংশের তাৎক্ষণিক ক্রিয়া আর তার বৈদ্যুতিন রূপের ধারণ করা এখনো মানুষের সাধ্যে আসে নি।

যাইহোক ,গুগল এর কাজের ক্ষেত্রে ফিরে যাই। গুগল এই বিষয়ের পথিকৃৎ Ray Kurzweil কে দায়িত্ব দেয় ২০১২ সালে গুগল ব্রেন প্রজেক্ট এর জন্য। উনি এই বিষয়ে কর্মরত বিজ্ঞানীদের মধ্যে পুরোধা এক ব্যক্তিত্ব। তার ধারণা , ২০৪৫ এর মধ্যেই মানুষ এই নকল করার কাজ করতে পারবে। এই কাজের সাথে কয়েক মাসের মধ্যেই Geoff Hinton ও যোগ দেন। উনি একজন ব্রিটিশ কম্পিউটার বিশেষজ্ঞ এবং নিউরোন বিশেষজ্ঞ ,বিশেষত মানুষের চিন্তার কর্মপদ্ধতির উপর অগাধ পন্ডিত। গুগলের কাজের উপর জানতে লিংক নম্বর ১০ দেখুন 

শুধু গুগল ই না , একজন রাশিয়ান উদ্যোগপতি , দিমিত্রি ইৎসকভ Ray Kurzweil এর ওই ভবিষ্যৎবাণীকে সম্মান দেখিয়ে শুরু করেছেন ‘ The 2045 Initiative ‘ মানে ২০৪৫ এর উদ্যোগ। এই কাজের সঞ্চয় ও সেই ক্লাউড তবে বাকি সব কিছু ধোঁয়াটে।

আরো একটু বিস্তারিত পাবেন আর এক উদ্যোক্তার ওয়েব সাইটে। Randal A Koene হলেন এই পথের ওপর পথিক। উনার কোম্পানির নাম হলো কার্বন কপি। খুব চিত্তাকর্ষক ভাবে তিনি এই বিষয় নিয়ে ব্যাখ্যা দিয়েছেন ,ভাবুন আমি আপনি এই নশ্বর শরীরের বাইরে অবয়ব হীন এক অবস্থায় যার জন্য  কোনো বস্তুগত বাধা নেই বিচরনের। সত্যি বলতে একটি সম্পূর্ণ সত্বা যদি কম্পিউটার এর শক্তিতে শক্তিমান হয়ে এগোয় তা হলে তার শরীরের দরকার হয় না। অবশ্য শারীরিক চাহিদার উপর তার বক্তব্য জানতে পারি নি। তবে বিষয়টা কিন্তু অবিনশ্বর এক অবস্থার কাছাকাছিই যায়।

তত্বকথা তো শুনলেন এবার একটু এর উপর কিছু সরল কথাবার্তা বলি। খেয়াল করবেন , জীবজগতের বিবিধ যুগ এসেছে ,প্রত্যেকটি যুগের কিছু সময় এর ধাপ আছে। প্রথম ভাগে প্রাণ এর সৃষ্টি থেকে মানুষের বিবর্তন এর ধারায় কেটেছে কয়েক কোটি বছর। মানুষ এসেছে কয়েক লক্ষ বছর। এরপর ধাপগুলো বড্ড ছোট হয়ে এসেছে। ১০ হাজার বছরের কাছাকাছি মানুষ কৃষি কাজ শিখেছে। মজার হলো কয়েকশো বছর আগে মানুষ বিজ্ঞানের অসম্ভব উত্তরণ ঘটিয়েছে। অর্থাৎ এই যুগের ধারার পর্ব গুলো ছোট হয়ে গিয়েছে।

এখন আসছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আর রোবোটিক্স এর সময়। এই মস্তিষ্কের কপি বা সমান্তরাল সৃষ্টি আমাদের কি কি লাভ এনে দিতে পারে :

১. এই বিশাল মহাবিশ্বের নানান প্রান্তে যাওয়ার জন্য আমাদের শরীর এক বড় বাধা। কৃত্রিম শরীর এর সাথে এই মস্তিষ্কের বৈদ্যুতিন যোগাযোগ আমাদের সর্বব্যাপী করে তুলতে সাহায্য করবে।
২. টেলিপোর্টেশান (আগের লেখা দেখুন ) এর সুবিধা পাবে কারণ শারীরিক ভাবে এক জায়গা থেকে ওপর জায়গায় যেতে হবে না।
৩. রোবোটিক্স এর উন্নতি তৈরী করবে অজস্র যন্ত্র যা কাজ করবে যা নিয়ন্ত্রণ করবে আমাদের এই মস্তিস্ক।
৪. এই কাজ করতে ব্রেনের একটা পুরোপুরি স্ক্যান দরকার ,প্রত্যেকটি কোষের কাজের গতিবিধির স্ক্যান এবং তার একটা দ্বিমাত্রিক ছবি কম্পিউটারে ধারণ করা।
৫. অমিত শক্তিশালী কম্পিউটার ,যা তৈরী হচ্ছে এবং আরো উন্নত হবে। ওটার উপর কোনো সন্দেহ নেই।
৬. মস্তিষ্কের প্রতিটি কাজের পুঙ্খানুপুঙ্খ রেকর্ড যা ডাউনলোড হবে কম্পিউটারগুলোতে। এই কাজটি এখনো শৈশব অবস্থায় আছে।
৭. মানুষ বার্ধক্য কে অতিক্রম করবে।

সবই কি ভালো ?

না , দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে , খারাপ বেশ কিছু বস্তু আছে। তার সবচেয়ে ভয়ংকর জিনিস হলো , এই কপি ব্রেন গুলো অবশ্যই হবে অসাধারন সব বুদ্ধিমান মানুষদের। ফলে , সাধারণ মানুষের থেকে তাদের বুদ্ধিমত্তা এবং সঙ্গে শারীরিক ভাবে সক্ষম রোবট বা সাইবর্গ তাদের সরক্ষমতা সম্পন্ন করে তুলবে।

মাথায় রাখবেন , আরো ২৫০ বছর এর পর মানুষের সংখ্যা জ্যামিতিক হারে কমবে। এর ফলে মানুষের যেমন একদিকে বুদ্ধিমত্তার বৃদ্ধি হবে অনেক বেশি তেমনি দরকার পরবে অনেক বেশি রোবট বা সাইবর্গ। এই যন্ত্রগুলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন হবে। মানুষের থেকে দ্রুত এদের মস্তিস্ক উন্নতি করবে।  নিজেদের সংখ্যা নিজেরাই বৃদ্ধি করতে পারবে যদি ,হ্যা যদি না মানুষ এই কাজের  চাবি নিজের কাছে রাখে। আর এই রাখার কাজ ও হবে  ওই শরীর বিহীন মস্তিষ্কের দ্বারা।

আবার সদর্থক জায়গায় ফিরে যাই। আমার ধারণা ওই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার রোবটের পক্ষে সম্ভব হবে না মানুষের বিরুদ্ধে কিছু করার কারণ মূল প্রোগ্রাম এ তাদের এক অলঙ্ঘনীয় আবর্তে রেখে দেবে যে তোমার প্রভু মানুষ।

আবার সেই মানবিক অংশে ফিরে যাই।  ওই বিজ্ঞানের পথে , যুক্তির পথে অবিচল থাকা অসাধারন মানুষগুলো কে শেষ করেছে মানুষ নামের কিছু প্রাণী। একদিন আর এই মানুষ কে শেষ করা যাবে না। পুনুর্ভব হয়ে সে তার পথে চলবে ,সভ্যতার আলোকিত পথে। সঙ্গে নেবে নতুন প্রজন্মকে।

রক্তমাখা অস্ত্রের ধারক আর থাকবে না।হাস্যকর কোনো ধর্মের আর দরকার হবে না। মৃত্যুর দরজা কে অতিক্রম করবে অমৃতের পুত্র কন্যারা। সেইদিন আমরা থাকবো না , তবে হয়তো সেই দিনের মানুষ এই লড়াই কে সম্মান করবে।

তথ্যসূত্র :
১. http://www.fhi.ox.ac.uk/brain-emulation-roadmap-report.pdf
২. http://www.huffingtonpost.com/james-stoddah/could-we-be-reborn_b_9567606.html
৩. https://www.theguardian.com/science/2017/mar/25/animal-life-is-over-machine-life-has-begun-road-to-immortality
৪. https://www.youtube.com/watch?v=CNF9U_Bvo50
৫. http://2045.com
৬. https://intelligence.org/2014/03/20/randal-a-koene-on-whole-brain-emulation/
৭. https://www.carboncopies.org
৮.http://www.sciencealert.com/scientists-have-figured-out-how-to-to-erase-your-painful-memories
৯. https://www.scientificamerican.com/article/what-is-the-memory-capacity/
১০. https://research.google.com/teams/brain/