যুধিষ্ঠিরের স্বর্গারোহণ: কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পর যুধিষ্ঠিরের হাতে রাজ্যভার অর্পণ করে শ্রীকৃষ্ণ দ্বারকায় চলে গেলেন। রানী গান্ধারীর অভিশাপে নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ করে যদুবংশ নির্মূল হয়ে গেল। বলরাম যোগাসনে বসে দেহত্যাগ করলেন। পরামর্শ দাতা শ্রীকৃষ্ণও জরা নামক শিকারির তীরের আঘাতে দেহত্যাগ করলেন।
দারুক সারথির মাধ্যমে খবর পেয়ে অর্জুন দ্বারকায় গিয়ে দেখলেন শ্রীকৃষ্ণ ও বলরাম দুই ভাইই দেহত্যাগ করেছেন। তারপর শ্রীকৃষ্ণের পারলৌকিক ক্রিয়া অর্জুন নিজে সম্পন্ন করে হস্তিনাপুরে ফিরে আসেন।
আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও শ্রীকৃষ্ণের শোকে পান্ডবদের আর রাজ্য শাসনের কথা মনে ছিল না। যুধিষ্ঠিরের পরামর্শে সবাই ঠিক করলেন যে তাঁরা মহাপ্রস্হানে যাবেন। দ্রৌপদীর জেদে অগত্যা তাঁকেও সঙ্গে নিতে হলো।
পরীক্ষিতের হাতে রাজ্যভার দিয়ে স্বর্গপথে রওনা হলেন। পূর্বমুখে তাঁরা অগ্রসর হলে অগ্নিদেব এসে পথ রোধ করে কিছু খাদ্য চাইলে অর্জুন তাঁর গান্ডীব ধনুসহ সব দিব্য অস্ত্র অগ্নিকে প্রত্যর্পন করলেন।
তারপর কত বন, কত পর্ব্বত, কত নদী অতিক্রম করে মেঘনাদ পর্ব্বতে গেলেন। সেখানে দানবদের যুদ্ধে পরাস্ত করে তাঁরা কেদার পর্ব্বতে আরোহন করলেন। এবার উত্তরমুখে রওনা হলে পথে এক ভীষণা রাক্ষসী তাঁদের পথ আটকালে ভীম অবলীলাক্রমে রাক্ষসীকে নিপাত করেন।
এবার পান্ডবরা ভদ্রকালী পর্ব্বতে এলে এখানকার কালীমূর্ত্তি ভদ্রকালী যুধিষ্ঠিরকে বর প্রার্থনা করতে বললে যুধিষ্ঠির জোড়হাতে কালীর নিকট কলিকালে জাগ্রত থাকার বর চাইলে মা কালী বললেন তথাস্ত্ত।
এরপর তাঁরা হরিপর্ব্বতে এলে এখানকার হিমশীতলতায় দ্রৌপদী কিছুক্ষণের মধ্যেই দেহত্যাগ করলেন। ভীম ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে প্রশ্ন করলেন কোন পাপে দ্রৌপদীর মৃত্যু হলো। ধর্মরাজ বললেন, পঞ্চ স্বামীর মধ্যে অর্জুনের প্রতি তাঁর আকর্ষণ বেশি থাকার পাপে দ্রৌপদীর মৃত্যু হলো।
আবার শুরু হলো পথচলা। বদরিকাশ্রমে গিয়ে তাঁরা দেখা পেলেন দ্রোনপুত্র অমর অশ্বত্থামার। সেখানে কিছুকাল বিশ্রামের পর সহদেবের মৃত্যু হলো। ভীমের প্রশ্নে যুধিষ্ঠির বললেন, জ্যোতিষীরূপে ভাই সহদেবের ভূত, ভবিষ্যৎ ও বর্তমান সবই জানা ছিল। পাশা খেলায় আমার হার হবে জেনেও সে আমাকে সাবধান করে নি। বারণাবতে আমাদের পুড়িয়ে মারা হবে জেনেও আমাদের সতর্ক করে দেয়নি — এই তার পাপ।
এরপর তাঁরা এলেন চন্দ্রকালী পর্ব্বতে। এখানে নকুলের মৃত্যু হলো। পরবর্তী বিশ্রামস্হল নন্দীঘোষ পর্ব্বতে অর্জুন তনুত্যাগ করলেন।
ভীমের প্রশ্নে যুধিষ্ঠির বললেন — কর্ণের সঙ্গে যখন আমার যুদ্ধ হয় তখন নকুল আমার কাছে ছিল। কিন্তু আমি যুদ্ধ করতে করতে দুর্বল হয়ে পড়েছিলাম দেখেও আমার সাহায্যে অগ্রসর হয় নি। এই ছিল তার পাপ। আর অর্জুনের পাপ হলো — সে আমার চেয়ে বেশি ভালবাসতো দ্রৌপদীকে আর সব কিছুকে সে হেয় জ্ঞান করতো।
এবার ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির একা ধীরে ধীরে স্বর্গের পথে অগ্রসর হতে লাগলেন। গন্ধর্ব পর্ব্বত আরোহণের সময় হিমালয়বাসী মুনি ঋষিগন এক এক করে দেখা করতে আসলে তিনি প্রত্যেককে প্রণাম করে আশীর্বাদ প্রার্থনা করলেন।
এইভাবে চলতে চলতে স্বর্গের দ্বারদেশে উপনীত হলেন। দ্বারপাল দেবরাজ ইন্দ্রকে সংবাদ দিলে ইন্দ্র রথ নিয়ে চলে আসেন। কিন্তু দেবরাজের ইচ্ছা হলো ধর্মরাজকে একবার পরীক্ষা করতে। তাই তিনি এক বৃদ্ধ ব্রাহ্মনের রূপে যুধিষ্ঠিরের সম্মুখে উপস্থিত হলেন।
ইতিমধ্যে কুকুরের রূপ ধরে স্বয়ং ধর্ম সেখানে উপস্থিত হয়ে ব্রাহ্মনকে কামড়াতে গেলে ব্রাহ্মন হাতের লাঠি দিয়ে নির্মমভাবে কুকুরকে প্রহার করলেন।
তখন কুকুররূপী ধর্ম যুধিষ্ঠিরকে ব্রাহ্মনের প্রহার থেকে তাঁকে উদ্ধার করতে বললেন। তখন যুধিষ্ঠির হাতজোড় করে কুকুরটিকে না মারতে বলায় বৃদ্ধ ব্রাহ্মনের রাগ আরো বেড়ে যায় এবং বলেন আমার হাতে কুকুরের পরিত্রাণ নাই। যুধিষ্ঠির তখন কুকুরটির প্রাণ ভিক্ষা চেয়ে তার সঞ্চিত পুন্যের অর্ধেক ব্রাহ্মনকে দান করলেন।
এইবার ধর্ম নিজের রূপ পরিগ্রহ করে স্বীয় পরিচয় দিলে ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির তৎক্ষণাৎ লুটিয়ে পড়লেন তাঁর চরণে। ধর্ম বললেন, বৎস তুমি আমার পুত্র। আমার ঔরসে কুন্তীর গর্ভে তোমার জন্ম। ততক্ষণে পাশে দাঁড়ানো জনের দিকে চেয়ে বললেন, ইনি দেবরাজ ইন্দ্র।
ইনি রথ নিয়ে এসেছেন তোমাকে স্বর্গে নিয়ে যাবার জন্য। পদব্রজে অনেক ক্লেশ সহ্য করেছ পুত্র। এবার রথে আরোহণ কর। দেবরাজের ইঙ্গিতে সারথী রথ নিয়ে এলে সকলে তাতে আরোহণ করে স্বর্গাভিমুখে অগ্রসর হলেন।
স্বর্গপুরে বিরাট সম্বর্ধনার মধ্যে যুধিষ্ঠিরকে স্বাগত জানানো হলো। যুধিষ্ঠির দেখলেন যে সেইখানে কৌরবরা রয়েছেন। কিন্তু পাণ্ডবদের তিনি দেখতে পেলেন না।
তাঁরা কোথায় তা জানতে চাইলে যমরাজ বললেন তাঁরা সবাই নরকে। যুধিষ্ঠির অবাক হয়ে জানতে চাইলেন কৌরব স্বর্গে আর পাণ্ডবরা নরকে কেন ? যম জবাব দিলেন যে কুরুক্ষেত্রের পুণ্যভূমিতে সত্যিকারের ক্ষত্রিয়ের মতন প্রাণ বিসর্জন দিয়ে তাদের অক্ষয় স্বর্গলাভ হয়েছে। যুধিষ্ঠির আকুল হয়ে নিজ প্রিয়জনকে দেখতে চাইলেন। যম বললেন তবে চলুন।
তাঁরা নরকে এসে পৌঁছতে যুধিষ্ঠির নরক দর্শন করে শিউরে উঠলেন। অর্ধগলিত সব, পুঁতিগন্ধ, ঘোর অন্ধকার, শৃগাল আর ভয়ানক প্রাণী প্রেতাত্মাদের কামড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে। কাউকে গরম তেলে ভাজা হচ্ছে। কাউকে শূলে চড়ানো হয়েছে। শূলবিদ্ধ অবস্থায় তাঁরা হাহাকার করে কাঁদছে।
প্রেতদের এই দুরবস্থা দেখে যুধিষ্ঠির আর সহ্য করতে পারলেন না। তিনি ফেরত যেতে চাইলে অনেকগুলি আওয়াজ ভেসে এলো – হে মহারাজ ! দয়া করে কিছুক্ষন দাঁড়ান। আপনার গা থেকে আসা সুগন্ধ আমাদের তৃপ্তি দিচ্ছে।
আমরা নরক যন্ত্রণার মধ্যে একটু শান্তি পাচ্ছি। যুধিষ্ঠির জিজ্ঞেস করলেন – কিন্তু আপনারা কে ? সেই অন্ধকার থেকে ভেসে এলো ! “আমি কুন্তী ! আমি ভীম ! আমি অর্জুন ! আমি কর্ণ ! আমি পাঞ্চালি ! আমি ভীষ্ম ! আমি ধৃতরাষ্ট্র !”
যুধিষ্ঠির বিস্ফোরিত নেত্রে দেখলেন পাঞ্চালির জিভ দুইটি ইঁদুর অল্প অল্প করে খাচ্ছে, যম বললেন “পাঞ্চালি দুর্যোধনকে অন্ধপুত্র বলে অপমান করেছিলেন ! এটি শুধু দুর্যোধনের নয়, বরং ধৃতরাষ্ট্রের ও অপমান ! এটি তারই পরিণতি।”
তারপর হতবাক হয়ে যুধিষ্ঠির অর্জুনকে দেখলেন জ্বলন্ত কয়লার ওপর দাঁড়িয়ে থাকতে ও যন্ত্রনায় চিৎকার করতে। যম বললেন – “খাণ্ডব বন জ্বালাবার সময় বহু নিরীহ প্রাণী অর্জুন হত্যা করেছিলেন, এটি তার শাস্তি !”
স্তব্ধ হয়ে যুধিষ্ঠির দেখলেন, ভীমসেন কে – তার হাত এবং পা দুইজন অতি ভয়ঙ্কর যমদূত মুচড়ে ছিঁড়ে নিচ্ছে। “প্রয়োজনের অতিরিক্ত ক্ষমতা দেখতে গিয়ে ভীম নিষ্ঠুর হয়ে শত্রুহত্যা করতেন, এটি তার শাস্তি !” তারপর তিনি যুধিষ্ঠির কে জিজ্ঞেস করলেন। “বাকীদের দেখতে চাও” ?
নিজ আত্মীয়ের মর্মান্তিক পরিণতি দেখে যুধিষ্ঠির আর স্থির থাকতে পারলেন না। তিনি কান্নায় ভেঙে পড়লেন। যম রাজ তাকে বললেন – “হে ধর্মপ্রাণ মহাত্মা ! চলুন ! আপনার স্বর্গে গমনের সময় আগত !
” অশ্রুশিক্ত হয়ে তিনি যমকে বললেন “এ কেমন বিচার হে ধর্মরাজ ! আমার অগ্নিরূপ তেজস্বী পবিত্র এবং ধার্মিক নিকট ব্যক্তিদের এই ভীষণ পরিণতি ! আর আমাকে আপনি বলছেন এদের ত্যাগ করে স্বর্গসুখ ভোগ করতে ! কক্ষনো নয় !
যতদিন পর্যন্ত এঁরা এইখানে থাকবেন ! আমিও এঁদের সাথে থাকবো ! আর এদের অতি নিকট হবার জন্য আমিও এদের পাপের ভাগী। আমাকেও শাস্তি দিন !” যম জিজ্ঞেস করলেন – “এটিই কি আপনার শেষ সিদ্ধান্ত ?” যুধিষ্ঠির শান্ত, দৃঢ় ভাবে বললেন – হ্যাঁ। আমি এই নরকেই আমার প্রিয়জনদের সাথে থাকবো।
যুধিষ্ঠিরের কথা শেষ হবার সাথে সাথে নরক অন্তর্হিত হলো। যুধিষ্ঠির অবাক হয়ে দেখলেন তিনি স্বর্গের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে। “হে ধর্মরাজ !”- যম বললেন ! “কুরুক্ষেত্রে আপনি একটি মহাপাপ করেছিলেন, পুত্রশোকে কাতর এক পিতা আপনার কাছে সত্যকথার আশা করেছিল। কিন্তু সেই দ্রোনাচার্যকে আপনি মিথ্যা বলেন !
তাঁকে অর্ধসত্য বলে মায়া ছলনা করেন ! অশ্বত্থামা নামে হাতীর মৃত্যুকে উপলক্ষ করে — “অশ্বত্থামা হত” বলে দ্রোণকে হত্যা করেছ। ‘ইতিগজ’ কথাটা নিম্নকন্ঠে বলার জন্য মহামতি দ্রোণ তা শুনতে পাননি। তাই সেই পাপে আজ আপনার নরক দর্শন হলো !
আমি আমারই মায়া বলে আপনাকে নরক দর্শন করালাম ! এইবার আসুন ! আপনার সমস্ত আত্মীয় স্বর্গে আছেন, তার আগে আপনি পবিত্র ঝর্ণায় স্নান করে শুদ্ধ হন ! তারপর তাদের সাথে দেখা করবেন !”
অতঃপর যুধিষ্ঠির যমরাজকে সঙ্গে করে স্বর্গে উপস্থিত হলেন। যম বললেন, মহারাজ ! আপনার স্বর্গে আগমনের সাথে দ্বাপর যুগের লীলাখেলা সাঙ্গ হলো ! দেখুন ! অষ্টবসুর জ্যেষ্ঠ দ্যহো কে !
যিনি ভীষ্ম রূপে পৃথিবীতে অবতরণ করেন। দেখুন বৃহস্পতিপুত্র দ্রোনাচার্যকে। আমারই একটি অংশ বিদূর হয়ে পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়। দেখুন চন্দ্রদেবপুত্র বুধ যিনি অভিমন্যু হয়ে পৃথিবীতে জন্মান। দেখুন ১২জন আদিত্যের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বিশাখ অর্থাৎ কর্ণকে।
দেখুন গন্ধর্বরাজ ধৃতরাষ্ট্র কে। দেখুন বিষ্ণুর দ্বার রক্ষক নর কে – যিনি আপনার ভাই অর্জুন হয়ে জন্মান। দেখুন কলিপুত্র দুর্যোধন এবং শকুনিকে ! তাদের শ্রীবিষ্ণু পৃথিবীতে পাঠান এই বোঝাতে যে কলি যুগে বেশিরভাগ মানুষই এদের চরিত্রের অধিকারী হবেন ! আর তাদের পরিণতি কি হবে !
আসুন মহারাজ ! ইনি হলেন শ্রী ! ইনি দ্রৌপদী রূপে পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছিলেন, কেবল মাত্র আপনাদের পাঁচভাইকে একসূত্রে গেঁথে রাখার জন্য। পার্বতিসখী জয়া কুন্তী রূপে এবং বিজয়া গান্ধারী রূপে পৃথিবীতে এসেছিলেন।
- মার্কিন সৈন্যের একটি অনুসন্ধানী দল মহাভারতের একটি বিমান আবিষ্কার করেছে?
- ভারতবর্ষের ৮ জন শক্তিশালী হিন্দু শাসক, যাদের খ্যাতির ইতিহাস মুছে ফেলা হয়েছে।
- পুষ্যমিত্র শুঙ্গ: ভারতে বৈদিক ধর্মের পুনঃপ্রতিষ্ঠাতা। বৌদ্ধধর্মের শাসন সমাপ্তি করেছিল মৌর্য সাম্রাজ্যের সাথে!
- উপমহাদেশের রত্নগর্ভা তক্ষশীলা,পৃথিবীর প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়।-দুরর্ম