একটা কথা ছোটবেলায় শুনতাম – ‘টু মাচ ইস্ট ইজ ওয়েস্ট’। পৃথিবী তো গোল, তাই আপনি যত হনহনিয়ে পূর্ব দিকে যেতে থাকবেন, একটা সময় পর স্বাভাবিক নিয়মেই পশ্চিমের কোলে গিয়ে আশ্রয় নেবেন। বাঙালি বাম ঘরনার কিছু লোকের জন্য যেন এই আপ্তবাক্যটা হাড়ে হাড়ে প্রযোজ্য। এরা যত বামে ‘কাঞ্চি মেরে’ সরতে থাকে তত বেশি দেখি তারা গুটিসুটি মেরে ডানের দিকে এগুতে থাকে। সারাজীবন, মার্ক্সিজম, মাওবাদ আর গ্রামসির ‘হেজিমনি’র চর্চা করে অবশেষে হজ্জ্ব করে ‘হাজিমনি’ হতে যাচ্ছেন রাশেদ খান মেনন আর হাসানুল হক ইনু । এ আমাদের চিরচেনা অতিবামাদর্শী জাম্বুবানদের পল্টি খাওয়ার জম্পেশ দৃশ্য।
পারভেজ আলমকে বাম ঘরনার এক প্রগতিশীল লেখক বলেই জানতাম। মুসলিম জ্ঞানতত্ত্ব নিয়ে শাহবাগের রাষ্ট্রপ্রকল্প নিয়ে জ্ঞানগর্ভ দুটো বই আছে তার। আমি উদ্যোগী হয়ে বইদুটো সংগ্রহ করেছি, পড়েছি, অন্যদেরও উৎসাহিত করেছি একসময়। ভদ্রলোক আরজ আলী মাতুব্বর পাঠাগার আন্দোলনের সাথেও যুক্ত। তার পাঠাগারের জন্য আর্থিক সহায়তা দরকার জেনে তাকে একসময় সাহায্যও করেছিলাম মনে পড়ে। তবে সেটা কথা নয়।
পারভেজ আলম নামের এই ভদ্রলোক এ বছরের প্রথমদিকে (জানুয়ারি মাসে সম্ভবত) আমাদের সাইবার বিরিঞ্চিবাবা ডিজিটাল ফতোয়াবাজ ম্যানিয়াক ফারাবীর হত্যা হুমকি খেলেন। কারণ হচ্ছে, বাংলাদেশের রাজশাহীতে একবার নিলুফা নামের এক চল্লিশ বছর বয়স্কা নারী রুবেল নামের এক পঁচিশ বছর বয়স্ক যুবককে বিয়ে করে গ্রামবাসীর জুতাপেটা সহ অন্যান্য নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। পারভেজ তার লেখায় বলেছিলেন, হয়তো আজ পঁচিশ বছর বয়সী মুহম্মদ বাংলাদেশে থাকলে চল্লিশ বছরের খাদিজাকে বিয়ে করার অপরাধে এমনি জুতাপেটা খেতেন। পারভেজ মিথ্যে কিছু বলেননি। কিন্তু কোথাকার কোন নিলুফার সাথে খাদিজার তুলনা! ফারাবীর ঈমানদণ্ড কি আর শান্ত থাকতে পারে? পারভেজের বাসা কোথায়, কোথায় সে সন্ধ্যের সময় আড্ডা মারে সব কিছু তুলে দিয়ে ‘এই পারভেজ আলম কে হত্যা করা বাংলার মুসলমানদের জন্য এখন ফরজ হয়ে দাঁড়িয়েছে’ বলে স্ট্যাটাস (পড়ুন ফতোয়া) প্রসব করে ফারাবী। সেই একই স্ট্যাটাসে মহামতি ফারাবী পারভেজকে ‘সাজেশন’ দিয়ে বলেছিল, ‘সুবর্ণা মুস্তফা যাকে বিয়ে করেছেন উনার নাম হচ্ছে বদরুল আনাম সৌদ। উনি একজন নাট্যনির্মাতা ও সুবর্ণা মুস্তফা উনার Husband বদরুল আনাম সৌদ এর থেকে ১৫ বছরের বড়। তাই পারভেজ আলম রুবেল নিলুফার বিয়ের সাথে সুবর্ণা মোস্তফা আর সৌদের বিয়ের তুলনা করতে পারত’। ঠিকি তো! নিলুফার সাথে সুবর্না ফুবর্নার তুলনা হতে পারে, খাদিজার সাথে হইবে কেন। যাহোক, এর পরদিন দেখলাম শান্ত সুবোধ বালকের মতো পারভেজ আলম, মুহম্মদের বদলে বদরুল আনাম সৌদ আর খাদিজার বদলে সুবর্ণা মুস্তফার নাম উল্লেখ করে স্ট্যাটাস দিয়ে ফারাবীর ‘রক্তচক্ষু’ থেকে নিষ্কৃতির চেষ্টা করেন।
এরপর থেকেই দেখি পারভেজ আলম আর ফারাবীকে বেশি ঘাঁটায় না। বরং ফারাবীকে নিয়ে কেউ কিছু লিখলেই তিনি নিধিরাম সর্দারের মতো অদৃশ্য ঢাল তলোয়ার নিয়ে বুক চিতিয়ে দাঁড়ান। জান বাঁচানো স্ট্র্যাটিজি বলে কথা। অবশ্য কোন কোন দুর্মুখ আবার বের করেছেন ফারাবীর সাথে নাকি আলম সাহেবের আসলে দুঃসম্পর্কের আত্মীয়তার সম্পর্ক রয়েছে। মুসলমান মুসলমান ভাই ভাই টাইপের আত্মীয়তা না, আসলেই আত্মীয়তা। কে জানে!
এ বছর বইমেলার সময় আমার একটা বই বের হয়েছিল ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’ নামে।সে বইটি প্রকাশ হবার পর থেকেই ফারাবী আমাকে বেশ কয়েকবার হত্যা-হুমকি দেয়। হুমকি দেয় অনলাইন বই-বিক্রির প্রতিষ্ঠান রকমারিকে। রকমারির প্রধান সোহাগ সাহেব ফারাবীর পেইজে গিয়ে হাত কচলিয়ে ক্ষমাপ্রার্থনার নাটক করে, যেমনটা একবার করেছিল প্রথমালুর মতিউর বায়তুল মোকারমের খতিবের কাছে গিয়ে। রকমারি আমার সকল বই তাদের লিস্ট থেকে তুলে নেয়, আমাকেও তাদের লেখকের তালিকা থেকে সরিয়ে দেয়। তবে তাতে আমার কিছু যায় আসেনি। আমার বই তো আর রকমারির উপরে নির্ভরশীল না। তবে সে সময়টা ছিল প্রবল এক উত্তাপের সময়,অনেক ব্লগার এবং ফেসবুক ইউজারই আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। অনেকে নিজেদের প্রকাশিত প্রথম বইটি পর্যন্ত রকমারি থেকে তুলে নিতে চেয়েছিলেন। যদিও আমার অনেক শুভানুধ্যায়ী এবং বন্ধু লেখক পাঠকেরা পেপারে, ব্লগে, কিংবা ফেসবুকে এ নিয়ে অনেক লেখা লিখেছেন, আমি ইচ্ছে করেই আগুনে ঘি ঢালার চেষ্টা করিনি, পত্রপত্রিকায় বা ব্লগে কিছু লিখিনি সে সময়।
মাস খানেক পর একটু ঠাণ্ডা হয়েছে ব্যাপারটা, তাই আমি অনেকদিন পরে ইংরেজিতে একটি লেখা লিখলাম। তাও লেখাটা মূলত: আমেরিকার (নিউইয়র্কের) একটি বিখ্যাত মুক্তচিন্তার পত্রিকার অনুরোধে। লেখাটা পাঠানোর সময় ভেবেছিলাম মুক্তমনার ইংরেজি ব্লগেও দেয়া যাক। ফারাবীর সে সময়কার কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি আইসিস এবং আইসিসের ব্যাপারে ওবামার স্ট্যান্ড ইত্যাদি মিলিয়ে লেখাটা প্রকাশ করেছি ‘From Farabi to ISIS: The Virus of Faith is Indeed Real!’ নামে (প্রথম কমেন্টে লিঙ্ক আছে)। সেটাই বোধ হয় কাল হল। নিধিরাম সর্দার সাহেব যথারীতি তার ঢাল তলোয়ার নিয়ে দাঁড়ালেন ফারাবীর সমর্থনে। তবে ভাসুরের নাম নেয়া যেহেতু বারণ, তাই ফারাবীকে সোজাসুজি সমর্থন না জানিয়ে আমাকে বানালেন, ‘সালাফি সেক্যুলার’।
আমাকে আক্রমণ অবশ্য করা সহজ। আমি ফারাবীর মতোন পারভেজ আলমকে হত্যার হুমকি দেই না, থাবা বাবাকে কুপিয়ে রাস্তায় ফেলে রাখি না, হুমায়ুন আজাদকে মেরে রক্তাক্ত করি না, বুকে ওড়না না পড়ে মাথায় পরার জন্য কোন মেয়েকে শরিয়া মোতাবেক পাথর মারি না, বিমান নিয়ে টুইন টাওয়ারের উপর ঝাপায় পড়ি না, মসজিদ-মন্দির ভাঙাভাঙি করি না। বরং কেউ বিপদে পড়লে সাহায্যই করি যতটুকু পারি। কোন মুক্তচিন্তার ব্লগার আক্রান্ত হলে তাকে দেশের বাইরে কিভাবে পাঠানো যায় তা চিন্তা করি, দেশের এবং বাইরের মানবতাবাদী সংগঠনের সাথে পরিচয় করিয়ে দেই, এমনকি পাঠাগার গড়তে কারো সাহায্য লাগলে এগিয়েই যাই। আমি ‘সালাফি সেক্যুলার’ না হলে হবে কে! ফারাবী? নাকি আইসিস?
আইসিস এদিকে সমানে সাংবাদিক আর এইডওয়ার্কারদের গলা কাটছে। কিন্তু পারভেজ সাহেবদের মতে এটাকে সহি ইসলাম বলা যাবে না। পবিত্র কোরানেই কিন্তু আছে, ‘যখন তোমরা কাফেরদের সাথে যুদ্ধে অবতীর্ণ হও, তাদের গর্দানে আঘাত করো’(৪৭.৪) কিংবা ‘কাফেরদের গর্দানের উপর আঘাত হান এবং তাদেরকে কাট জোড়ায় জোড়ায়’ (৮:১২) ধরণের আয়াত। ওয়েল, হয় কোরান সুন্নাহ মানার কারণেই, অর মে বি বাই যাস্ট কো ইন্সিডেন্স – ইসলামের জন্মস্থান সৌদি আরবে মুরতাদদ্গিরি সহ বিভিন্ন ‘অপরাধে’ ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট হিসেবে ‘শিরচ্ছেদের’ বন্দোবস্ত আছে, এখনো। ২০১১ সালে বাংলাদেশের এগারো জন শ্রমিককে উন্মুক্ত স্থানে তলোয়ারের আঘাতে শিরোচ্ছেদ করা হয়েছিল – অনেকেরই বোধ হয় মনে আছে। আমরা তো বটেই, বাংলাদেশ থেকেও অনেক চেষ্টা তদবির করা হয়েছিল এটা ঠেকাতে। যায়নি। কারণ সৌদিদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল এটাই ইসলামী শরিয়া আইন। কিন্তু সৌদিরা কি ইসলামের কিছু জানে? তাদের ইসলাম তো সহি ইসলাম নহে।
আর সৌদি আরবেই বা যাওয়া লাগে কেন। নবী মুহম্মদের সময়েই এবং তার উপস্থিতিতেই তো বানু কুরাইজার প্রায় ৬০০ থেকে ৯০০ বন্দিদের পিছমোড়া করে বেঁধে পরিখার সামনে নিয়ে শিরচ্ছেদ করে কুপের মধ্যে ফেলে দেয়া হয়েছিল। ইসলামের প্রাথমিক উৎস ইবনে ইসহাকের কিংবা তাবারির গ্রন্থে এই ঘটনার বিবরণ পাওয়া যায়। কিন্তু নবীজীই কি স্বয়ং সহি ইসলাম মানতেন? কে জানে!
প্রসঙ্গত ‘অবিশ্বাসের দর্শন’ নামে একটা বই লিখেছিলাম এর আগে। সেখানে একটা পরিসংখ্যান দিয়ে লিখেছিলাম, হিন্দু ধর্মগ্রন্থগুলোতে বর্ণিত সতীদাহর মাহাত্ম্যকে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে শুধু ১৮১৫ সাল থেকে ১৮২৬ সালের মধ্যেই ভারতবর্ষে সতীদাহের স্বীকার হয়েছিল ৮১৩৫ জন নারী। এমনকি ১৯৮৭ সালে রূপ কানোয়ার নামে একটি মেয়েকে রাজস্থানে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল ‘সতী মাতা কী জয়’ধ্বনি দিয়ে। বইটার প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হবার পর মুসলিমদের মত কিছু হিন্দু মননকেও আহত করে ফেলেছিল। এক ‘মডারেট’ হিন্দু বইটার রিভিউ করতে গিয়ে একটা ব্লগ সাইটে লিখে দিলেন – সতীদাহের পুরো ব্যাপারটাই নাকি সাংস্কৃতিক, ধর্মগ্রন্থে নাকি সতীদাহের কোন অস্তিত্ব নেই। আসলে এই ‘মডারেট’ হিন্দুরা নিজের ধর্মগ্রন্থটাও ঠিকমত পড়ে দেখেন না। এরা জানেন না তাদের ধর্মগ্রন্থে ‘স্বামী মারা গেলে বিধবাকে স্বামীর চিতায় আগুনে পুড়ে মরে সতী হওয়ার’ সুস্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে। যেমন, ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের ১৮নং সূক্তের ৭ নং ঋক (১০/১৮/৭) –
इमा नारीरविधवाः सुपत्नीराञ्जनेन सर्पिषा संविशन्तु |
अनश्रवो.अनमीवाः सुरत्ना आ रोहन्तु जनयोयोनिमग्रे ||
শ্লোকটির ইংরেজি হচ্ছে : ‘Let these women, whose husbands are worthy and are living, enter the house with ghee (applied) as collyrium (to their eyes). Let these wives first step into the pyre, tearless without any affliction and well adorned.’।
অথর্ববেদে রয়েছে : “আমরা মৃতের বধূ হবার জন্য জীবিত নারীকে নীত হতে দেখেছি।” (১৮/৩/১,৩)। পরাশর সংহিতায় পাই, “মানুষের শরীরে সাড়ে তিন কোটি লোম থাকে, যে নারী মৃত্যুতেও তার স্বামীকে অনুগমন করে, সে স্বামীর সঙ্গে ৩৩ কোটি বৎসরই স্বর্গবাস করে।” (৪:২৮)। দক্ষ সংহিতার ৪:১৮-১৯নং শ্লোকে বলা হয়েছে, “যে সতী নারী স্বামীর মৃত্যুর পর অগ্নিতে প্রবেশ করে সে স্বর্গে পূজা পায়”। এই দক্ষ সংহিতার পরবর্তী শ্লোকে (৫:১৬০) বলা হয়েছে, “যে নারী স্বামীর চিতায় আত্মোৎসর্গ করে সে তার পিতৃকুল, স্বামীকুল উভয়কেই পবিত্র করে।”কেবল আমি নই, যুক্তি পত্রিকার সম্পাদক অনন্ত বিজয় দাসও তার একটি লেখায় এই শ্লোকগুলো পুংখানুপুঙ্খভাবে উল্লেখ করেছিল। কিন্তু তারপরেও সতীদাহ নাকি ‘সহি হিন্দুইজম’ নয়! কি আর করা।
আরেকটা উদাহরণ। ১৪০০ সালের পর থেকে চার্চের নির্দেশে হাজার হাজার নারীকে ‘ডাইনি’ সাব্যস্ত করে পুড়িয়ে মারা শুরু হয়েছিল। এই ডাইনি পোড়ানোর রীতি এক ডজনেরও বেশি দেশে একেবারে গণহিস্টেরিয়ায় রূপ নেয়। প্রায় ২০ লক্ষ নারী এই ডাইনি হিসেবে সাব্যস্ত হয়ে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ডাইনি পোড়ানোকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট ধর্মীয় উন্মত্ততা সেসময় অতীতের সমস্ত রেকর্ডকে ম্লান করে দিয়েছিল। কিন্তু এখন মডারেট খ্রিস্টানেরা দাবী করেন, ডাইনি পোরানো সহী খ্রিস্টানিটি ছিল না। অথচ, বাইবেলেই কিন্তু আছে, Kill The Witches! : “Thou shalt not suffer a witch to live. Whoever lieth with a beast shall surely be put to death. He that sacrificeth unto any god, save to the LORD only, he shall be utterly destroyed.” (Exodus 22:18-20)। কিন্তু বাইবেলে থাকলে কি হবে, আধুনিক মডারেট ধার্মিকেরা যখন বলছে, তখন নিশ্চয় উহা ‘সহি ধর্ম’ নয়।
ঠিক আছে। ‘সালাফি সেক্যুলার’ বলে ট্যাগ যখন খেয়েছিই, তখন কিছু সহি বচন দিয়ে যাই ‘সহি ইসলাম’ নিয়ে :
*******************
– মক্কা বিজয়ের পর, মহানবী নাকি কাবার সমস্ত মূর্তি ধ্বংস করেছিলেন। তালিবানরাও প্রায় একই কায়দায় আফগানিস্তান দখলের পর ঐতিহাসিক বৌদ্ধমূর্তি ধ্বংস করেছিল। কিন্তু ‘সহি ইসলাম’ এর সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই।
– বাংলাদেশে পূজার সময় যেভাবে প্রতিমা ভাঙা হয়, এর সাথে ‘সহি ইসলাম’ এর সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই।
– ইসলামী জিহাদের নামে গত বারো শতক ধরে সারা পৃথিবীতে মিলিয়নের উপর মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু ‘সহি ইসলাম’ এর সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই।
– সৌদি আরবে মেয়েদের বাইরে কাজ করার অধিকার নেই, স্বাধীনভাবে চলাফেরার অধিকার নেই, ড্রাইভিং এর অধিকার নেই, নেই পুরুষদের সমান সাক্ষ্য কিংবা উত্তরাধিকারেও। কিন্তু ‘সহি ইসলাম’ এর সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই।
– ইসলামে বহু বিবাহের বৈধতা আছে,মুসলিম বিশ্বে একই সাথে একাধিক স্ত্রী রাখারও বিধান আছে। কিন্তু তাতে কি। ‘সহি ইসলাম’ এর সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই।
– ইরানে সম্প্রতি দত্তক নেয়া কন্যা শিশুকে বিয়ে করার আইন পাশ হয়েছে, কিন্তু ‘সহি ইসলাম’ এর সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই।
– মুসলিম দেশে গার্ল উপভোগ, কিংবা যুদ্ধের সময় তাদের যুদ্ধবন্দিনী ধর্ষণ, মালে গনিমত হিসাবে বিধর্মীদের স্ত্রী-কন্যাদের দখল – কোন কিছুর সাথেই ‘সহি ইসলাম’ এর সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই।
– পাকিস্তানে এত দিনের সিয়া সুন্নি বিরোধ, মারামারি, হানাহানি, লোকক্ষয় – ‘সহি ইসলাম’ এর সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই।
– আল্ কায়দা, ইসলামিক জিহাদ, হামাস, হরকত-উল-জিহাদ, হরকত-উল-মুজাহিদিন, জেইস-মুহম্মদ, জিহাদ-এ-মুহম্মদ, তাহ-রিখ-এ-নিফাজ-সারিয়াত-এ-মুহম্মদ, আল-হিকমা, আল-বদর-মুজাহিদিন, জামাতে ইসলামিয়া, হিজাব-এ-ইসলামিয়া, জমিয়াতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি), হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামি বাংলাদেশ (হুজি) নিষিদ্ধ হয়; শাহাদাত ই আল হিকমা ও জাগ্রত মুসলিম জনতা বাংলাদেশ (জেএমজেবি), আনসারুল্লাহ বাংলা টিম, শাহাদাত-ই আল হিকমা, হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামি, শহীদ নসুরুল্লাহ আল আরাফাত বিগ্রেড, হিজবুত তাওহিদ, জামায়াত-ই ইয়াহিয়া, আল তুরাত, আল হারাত আল ইসলামিয়া, জামাতুল ফালাইয়া তাওহিদি জনতা, বিশ্ব ইসলামী ফ্রন্ট, জুম্মাতুল আল সাদাত, শাহাদাত-ই-নবুওয়ত, আল্লাহর দল, জইশে মোস্তফা বাংলাদেশ, আল জিহাদ বাংলাদেশ, ওয়ারত ইসলামিক ফ্রন্ট, জামায়াত-আস-সাদাত, আল খিদমত, হরকত-এ ইসলাম আল জিহাদ, হিজবুল্লাহ ইসলামী সমাজ, মুসলিম মিল্লাত শরিয়া কাউন্সিল, ওয়ার্ল্ড ইসলামিক ফ্রন্ট ফর জিহাদ, জইশে মুহাম্মদ, তা আমীর উদদ্বীন বাংলাদেশ, হিজবুল মাহাদী, আল ইসলাম মার্টায়ারস বিগ্রেড ও তানজীম – এত শত জঙ্গিদল ইসলাম কায়েমের বাসনা নিয়ে জিহাদ, কতল সবই করে যাচ্ছে, কিন্তু এদের কারো কর্মকান্ডের সাথেই ‘সহি ইসলাম’ এর সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই।
– ২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর আমেরিকার টুইন টাওয়ারের ওপর আল কায়দা আত্মঘাতী বিমান হামলা চালায়। এই হামলায় টুইন টাওয়ার ধ্বসে পড়ে। মারা যায় ৩০০০ আমেরিকান নাগরিক। আক্রমণকারীদের নেতা মোহাম্মদ আতা নিজেও তার সুটকেসে কোরআন বহন করছিলেন। ধ্বংসাবশেষ থেকে উদ্ধারকৃত আতার কাছ থেকে পাওয়া তার শেষ নির্দেশাবলীগুলোও সেই সাক্ষ্যই দেয় যে, তারা পবিত্র আল্লাহ এবং ইসলামের প্রেরণাতেই এই জিহাদে অংশ নিয়েছিলেন (Last words of a terrorist, Guardian UK দ্রঃ)। কিন্তু তাতে কি! ‘সহি ইসলাম’ এর সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই।
– ২০০২ সালে বালি বোম্বিং, ২০০৫ সালে লণ্ডন পাতাল রেল বোম্বিং, দিল্লিতে ২০০৮ সালে বোম্বিং, বোস্টন ম্যারাথন বোম্বিং, নিদাল হাসানের শুটিং – কোন কিছুর সাথেই ‘সহি ইসলাম’ এর সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই।
– ২০০৪ সালের ২৭শে ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের প্রথা-বিরোধী লেখক হুমায়ুন আজাদের উপর হামলা চালায় মৌলবাদী একটি দল। চাপাতি দিয়ে ক্ষত-বিক্ষত করে ফেলা হয় তার দেহ, যা পরে তাকে প্রলম্বিত মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। কিন্তু ‘সহি ইসলাম’ এর সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই।
– ২০০৪ সালের ২রা নভেম্বর চিত্র পরিচালক থিও ভ্যান গগকে প্রকাশ্যে রাস্তায় গুলি এবং ছুরিকাহত করে হত্যা করা হয়; নারীবাদী লেখিকা আয়ান হারসি আলীকেও মৃত্যু পরোয়ানা দেওয়া হয়। কিন্তু ‘সহি ইসলাম’ এর সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই।
– ২০১২ সালের অক্টোবর মাসে কাজী মোহাম্মদ রেজওয়ানুল আহসান নাফিস নামের একুশ বছরের যে যুবক জিহাদ করতে এসে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে গ্রেফতার হয়ে বিশ্বব্যাপী পত্র-পত্রিকার আলোচিত খবর হয়েছিলেন। কিন্তু ‘সহি ইসলাম’ এর সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই।
– ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসের একটি ঘটনা। সৌদি আরবের এক হতভাগ্য নারী তার এক স্কুল-বন্ধুর কাছে থেকে একটি ছবি আনতে গিয়ে সেই বন্ধু আর তার ৬ জন সাঙ্গপাঙ্গদের দ্বারা ধর্ষিত হন। সৌদি আইনে (যার মূল ভিত্তি হচ্ছে ইসলামের শরিয়া), হতভাগ্য নারীটিই উল্টে বিচারের রায়ে দুশোটি বেতের আঘাত পেয়েছেন, কারণ, তিনি সুরা নিসায় (৪:১৫) বর্ণিত ‘চারজন লোকের ইতিবাচক সাক্ষ্য’ আনতে পারেননি। তাই শরিয়া মতে – ‘বিনা প্রমাণে’ ধর্ষনের অভিযোগ উত্থাপনের মাধ্যমে আসলে প্রকারান্তরে স্বীকার করে নেন যে তিনি ‘বিবাহ বহির্ভূত যৌন সম্পর্কে’ জড়িত ছিলেন। কিন্তু তাতে কি, এটার সাথে ‘সহি ইসলাম’ এর সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই।
– ২০১৩ সালে শাহবাগ আন্দোলনের উত্তাল সময়ে রাজীব হায়দার শোভনকে জবাই করে হত্যা করা হয়। ধৃত অপরাধীরা স্বীকার করে ‘ঈমানী দায়িত্ব’ পালনের জন্য ইসলামবিদ্বেষী এই ব্লগারকে তারা হত্যা করেছে। কিন্তু ‘সহি ইসলাম’ এর সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই।
– ২০১৪ সালের মে মাসে নাইজেরিয়ার বোর্নো এলাকা থেকে ২২৩ জন স্কুলছাত্রীকে অপহরণ করে মুসলিম জঙ্গি দল বোকো হারাম। বিবৃতিতে তারা বলে, ‘মেয়েদের স্কুলে যাওয়া উচিৎ না। বরং তাদের বিয়ে দিয়ে দেয়া উচিৎ। কিন্তু ‘সহি ইসলাম’ এর সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই।
– আইসিস আজ কোরান এবং সুন্নাহ মতাবেক বিধর্মীদের ধরে ধরে জবাই করছে। কিন্তু ‘সহি ইসলাম’ এর সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই।
…
…
**************
আমার মনে কেন যেন সন্দেহটা ক্রমশঃ ফুলে ফেঁপে উঠছে — ইসলামের সাথেই বোধ হয় ‘সহি ইসলামের’ কোন সম্পর্ক নেই।