পূর্ব পাকিস্তান বা পূর্ববাংলার ১৯৫০এর হিন্দু নিধনযজ্ঞে।

এপার বাংলার দক্ষিণ ২৪ পরগনার দিকে একটা বেশ বিখ্যাত জায়গা হচ্ছে বাটানগর |  বাটা কোম্পানির কারখানা থাকার ফলে | এই  বাটানগর হল ট্রেন পথে বজবজ লাইনে |  বাটানগর থেকে স্বল্প কিছু দূরেই সারেঙ্গাবাদ |  ১৯৫০ এ,  এই সারেঙ্গাবাদ গ্রামেই ঠাই হয়েছিল আমার বাবাদের | কথাগুলো বললাম তার পেছনে একটা কারণ আছে |  পূর্ব পাকিস্তান বা পূর্ববাংলার ১৯৫০এর হিন্দু নিধনযজ্ঞে এই বাটানগর বজবজ লাইনের মুসলমানদের একটা বিশেষ ভূমিকা ছিল |  ঢাকা-বরিশালের দাঙ্গার  পরিপ্রেক্ষিতে চট্রগ্রাম অশান্ত হয়ে ওঠে |   বেশ কিছু সংখ্যক এপার বাংলার  বজবজ বাটানগর লাইনের  বাঙালি মুসলমান তখন চট্টগ্রামে উপস্থিত ছিল, যারা সক্রিয়ভাবে গুজব রটিয়েছিল ফজলুল হকের হত্যার বানোয়াট ঘটনা এবং তারা এটাও রটিয়েছিল যে পশ্চিম বাংলায় মুসলমানদের উপর চরম নিপীরন নেমে এসেছে,  শিয়ালদা স্টেশনে লাশের স্তুপ, আর বোধহয় পশ্চিমবাংলায় মুসলমান  একজনও বাঁচবেনা | পাঠক, এবারে আসুন ১৯৫০ এ চট্টগ্রামের বাঙালি মুসলমানের গৌরবগাঁথা একটু জেনে নিই:

ঢাকা ও  বরিশালের মুসলমানরা একতরফা হিন্দুনিধনে সোনার মেডেল,রুপোর মেডেল নিয়ে যাবে আর চট্টগ্রামের মুসলমানরা কি চুপচাপ বসে থাকবে ?  তাই তারাও এই গৌরবময় অধ্যায়  বুক বেঁধে নেমে পরল |  অপূর্ব সুন্দর জায়গা চট্টগ্রাম |  একদিকে যেমন নীল সমুদ্র,  অপরদিকে ঢেউখেলানো পাহাড় |  ১৯৪৬ এ দেশভাগের প্রাক্কালে, যখন নোয়াখালী, কলকাতা রক্ত হোলিতে ডুবে আছে,  তখন কিন্তু চট্টগ্রামের হিন্দু মুসলমান যথেষ্ট সম্প্রীতিতে একসাথে বাস করছে |  তাহলে দেশ ভাগের তিন বছর পরে কি এমন হলো,  যে চট্টগ্রামের মুসলমান হিন্দু নিধনে ঝাঁপিয়ে পরলো ?  সে সময় চট্টগ্রামে ২২ লক্ষ মানুষের বাস,  যার মধ্যে ১৬ লক্ষ মুসলমান আর বাকিরা হিন্দু-বৌদ্ধ মিলিয়ে-মিশিয়ে | এতদিন তারা সুখে দুঃখে এক সাথেই ছিল |  এবার পাগলা ঘন্টি বাজলো !  পূর্ব পাকিস্তানে ঢাকার পরেই চট্টগ্রামের স্থান বাণিজ্য নগরী, বন্দর নগরী হিসেবে |  পাঠক আমি একটু আগেই উপরের লিখেছি গুজব ছড়ানোর ব্যাপারটা |  এতে করে চট্টগ্রাম উত্তপ্ত হয়েছিল কোন সন্দেহ নেই |  বাঙালি মুসলমানের ভিতরে লুকিয়ে থাকা আরবীয় সন্ত্রাস বিলাসী সত্তা জেগে উঠলো !  ইতিমধ্যে ঢাকা বরিশালে  হিন্দু নিধন শুরু হয়ে গেছে | ১১ই ফেব্রুয়ারি পরিবেশ বেশ গরম হয়ে উঠল, দু-তিনজন হিন্দু ছুরিকাহত হয়ে প্রান হারাল |  ১২ তারিখ, চট্টগ্রামের পাড়ায় পাড়ায় বাঙালি মুসলমান অস্ত্র হাতে বেরিয়ে পরলো, শুরু হয়ে গেল নিধনযজ্ঞ ! অফিস কাছারিতে  যারা কাজে বেরিয়ে ছিলেন, বাড়ি ফেরার পথে কোপ খেলেন, প্রাণ গেল বেশকিছু | পথে-ঘাটে  উন্মত্ত বাঙালি মুসলমানের অস্ত্র হাতে ঘোরাফেরা,  আর হিন্দু বৌদ্ধ নরনারী প্রাণভয়ে যেখানে পারছে লুকোচ্ছে | হিন্দু নিধনে  চট্টগ্রামের বাঙালি মুসলমান  একটি অভিনব পন্থা অবলম্বন করেছিল | প্রথমে বাড়িতে আগুন,  ভয়ার্ত মানুষজন আগুনে পুড়ে মরার হাত থেকে বাঁচতে যেইনা বাড়ির বাইরে পা রাখা, ওমনি জবাই ! ১২ তারিখ, পূর্ণ চৌধুরীর ভাই হীরেন্দ্রলাল চৌধুরী  ছুরির কোপে প্রাণ হারালেন,  জবাই হলেন শহীদ সূর্যসেনের ভাই, ফনী সেনও |  খবরগুলো শহরে ছড়িয়ে পরলো |  এতসব ঘটনা ঘটছে , অথচ পুলিশের কোনো দেখা নেই !  রাত্রির নারকীয়তার স্মৃতি নিয়ে জেগে থাকা হিন্দু নরনারী সকাল হলে ভাবে আজকে বোধহয় সব ঠাণ্ডা হবে | কিন্তু না!  হত্যা লুঠপাট বাড়তেই থাকলো |  ১৩ তারিখ কলকাতা থেকে মেইল ট্রেন এসে থামল চট্টগ্রাম স্টেশনে |  হিন্দুদের ট্রেনের কামরা থেকে নামিয়ে কুপিয়ে জবাই করা হল,  মালপত্র সব লুট করা হল | ট্রেনের যাত্রীদের মধ্যে ছিলেন যদু দাশগুপ্ত ও তার ছেলে মলয় |  রক্তে মাখামাখি হয়ে পরে রইল দুজনের দেহ | শহরের বিভৎসতা থেকে বাঁচতে হিন্দুরা শাম্পান নৌকায় গ্রামের দিকে পা বাড়ালো |  কর্ণফুলীর উপর আক্রান্ত হলো প্রতিটা নৌকা |  বাঙালি মুসলমান হিন্দু ধরে, কাটে  আর কর্ণফুলীতে ফেলে দেয় |  কর্ণফুলীর জল লাল হয়ে উঠল !  গ্রামের ভিতরের  খাল-বিলগুলোতেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি |  মানুষের আর্ত চিৎকারে চারিপাশ কেঁপে উঠলো |  কিন্তু সেদিনের সেই অসহায় মানুষগুলোকে বাঁচানোর জন্য একজন বাঙালি মুসলমানও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়নি,  তারা ভুলে গিয়েছিল তারা এতদিনের সৌহার্দ্যপূর্ণ প্রতিবেশী ! আসলে ইসলামিক রাষ্ট্রে জিম্মিদের  জীবনের স্থায়িত্বের কোন নিশ্চয়তা নেই | কত হিন্দু সেদিন প্রাণ হারিয়েছিল তার ইয়ত্তা নেই,  যেমন জে এম সেন ইনস্টিটিউট স্কুলের  অধ্যাপক চন্দ্র সেনের ছেলে ধীরেন্দ্র সেন, মার্কেন্টাইল ব্যাংক অফ ইন্ডিয়ার  সহকারী ক্যাশিয়ার অনিল শীল প্রভৃতি | প্রফুল্ল শীল ব্যাংক একাউন্টেন্ট, টিফিন করতে চায়ের দোকানে ঢুকে ছিলেন | বাঙালি মুসলমান তাকে সেখানেই কুপিয়েছিল ! কুমিরা গ্রামের এক মুসলিম স্কুলছাত্র তার হেড মাস্টার মশাইকে ডেকে নিয়ে গিয়ে বলল :’ স্যার আপনি আমায় শিক্ষা দিয়েছেন, এতদিন গুরুদক্ষিণা দিতে পারিনি,  আজ দেব |’  গুরুদক্ষিণা হিসেবে ছাত্র হেড মাস্টার মশাই কে জবাই করলো ! পাঠক, একবার ভাবুন মনের ভিতরে কি পরিমান জিঘাংসা থাকলে কেউ এই কাজ করতে পারে |

এই ইতিহাস লিখতে আমার বিন্দুমাত্র ভালো লাগছে না,  কিন্তু পাঠক,  লিখতে তো হবেই ! সেদিনের বাঙালি মুসলমানের এই লুক্কায়িত গৌরবগাঁথার কথা  না তুলে ধরলে, বাঙালির প্রকৃত ইতিহাসের  অনেকটাই জানা যাবেনা |  দিনের পর দিন এই  জিঘাংসার ইতিহাসকে কৌশলে লুকিয়ে রাখা হয়েছে আর তুলে ধরা হয়েছে তিতুমীরের মতো মৌলবাদীর  ভুয়া স্বাধীনতা সংগ্রামের কথা |  কিন্তু আর না !  এবার সবটা সকলকে জানতে হবে,  গ্রহণ করবেন কি করবেন না সেটা আপনাদের উপর পাঠক |