একজন খ্যাতনামা বিজ্ঞানী কিশোরীমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় …………………।।

কিশোরীমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় ( ১৮৭৭১৯২৯ ) ব্রিটিশ ভারতের একজন খ্যাতনামা বিজ্ঞানী ও স্যার রোনাল্ড রস-এর সহ-গবেষক ছিলেন । রোনাল্ড রস
ম্যালেরিয়ার বীজানুবাহী হিসাবে অ্যানোফিলিস মশাকে চিহ্ণিত করে ১৯০২ সালে
নোবেল পুরস্কার পান । কিশোরীমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়কে ১৯০৩ সালে সম্রাট সপ্তম
এডোয়ার্ডের স্বর্ণপদক দ্বারা পুরস্কৃত করা হয় ।

জন্ম ও পরিবার

কিশোরীমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতা শহরের এনটালি পাড়ায় মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন । তাঁর পারিবারিক আদিনিবাস ছিল বর্তমান বাংলাদেশ-এর যশোর জেলায় । মহারাজা প্রতাপাদিত্যের পতনের পর বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবার পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগণা জেলার বৈষ্ণব অধ্যুষিত তদানীন্তন পানিহাটি
গ্রামে বসবাস আরম্ভ করেন । তাঁর পিতামহ দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় একজন
খ্যাতনামা আয়ুর্বেদাচার্য এবং সাংখ্য দর্শনে পারঙ্গম ব্যক্তি ছিলেন ।
কিশোরীমোহনের বাবা ননীলাল চট্টোপাধ্যায় ছিলেন ফার্সি ও সংস্কৃত ভাষার
শিক্ষক । পানিহাটিতে তাঁদের নিবাস ছিল ‘নিলামবাটি’ নামে একটি বিশাল বাড়ি
যা পরবর্তিকালে তাঁরা বিক্রয় করে দিয়েছিলেন । বর্তমানে নিলামবাটীর
নামফলকটি থাকলেও, কিশোরীমোহনের পরিবারের সদস্যরা পানিহাটির বাইরে বসবাস
করতে চলে গেছেন । কিশোরীমোহনের দুই অগ্রজ ভ্রাতা লালমোহন ও হরিদাস সংস্কৃত ও
বাংলা ভাষার শিক্ষক ছিলেন । নিলামবাটীর বিপরীতে তাঁর বন্ধু অনাদি
চট্টোপাধ্যায়ের বোন ক্ষেত্রপ্রসাদীকে তিনি কুড়ি বছর বয়সে বিবাহ করেন
কিশোরীমোহন । কিশোরীমোহনের তিন পুত্রের মধ্যে কনিষ্ঠ লক্ষীকান্ত
বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতার এরিয়ান এবং উয়াড়ি ফুটবল ক্লাবের
খ্যাতনামা খেলোয়াড় ছিলেন । তিনি ছিলেন ছেনি বাঁড়ুজ্জে নামে পরিচিত ।
কিশোরীমোহনের দুই দৌহিত্র, জেষ্ঠ্য কন্যা অমিতার ছেলেরা, সমীর রায়চৌধুরী এবং মলয় রায়চৌধুরী বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত হাংরি আন্দোলন-এর জনক ।

শিক্ষা

পানিহাটিতে প্রাথমিক শিক্ষার পর কিশোরীমোহনকে কলকাতার মাতুলালয়ে ইংরেজি
স্কুলে পড়ার জন্য পাঠানো হয় । স্কুলের প্রতিটি পরীক্ষায় তিনি ভালো
ফলাফল করতেন । মাতুলালয় থেকেই তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজে বিজ্ঞানের স্নাতক
হন । রোনাল্ড রস তাঁর পরীক্ষার ফলাফল ও সমাজসেবামূলক কাজকর্মের অভিজ্ঞতার
জন্য বহু ছাত্রের ইনটারভিউ এবং হাতেনাতে গবেষণাগারে কাজ দেখার পর
কিশোরীমোহনকে নির্বাচন করেছিলেন । এতদ্ব্যতীত পানিহাটি থেকে রোনাল্ড রস-এর
মহানাদস্হিত গবেষণাগারে নৌকায় যাবার সুবিধা ছিল । পানিহাটি সংলগ্ন
গ্রামাঞ্চল থেকে জ্বরে আক্রান্ত রোগীদের কিশোরীমোহন রোনাল্ড রসের কাছে
চিকিৎসার জন্য নিয়ে যেতেন । রোগীদের মধ্যে অধিকাংশই ছিল কিশোরীমোহনের
আয়ুর্বেদাচার্য ঠাকুরদার রোগী । কিশোরীমোহন নিজেও তাঁর নবলব্ধ বিজ্ঞানের
শিক্ষা ও ঠাকুর্দার আয়ুর্বেদের ঔষধের সঙ্গে সামঞ্জস্য খোঁজার প্রয়াস
করতেন, এবং স্বদেশি ও বিদেশি ঔষধের এই মেলবন্ধনও তদানীন্তন ইউরোপীয়
ডাক্তারদের তাঁর প্রতি আগ্রহান্বিত করেছিল ।

কর্মজীবন

ঠাকুর্দার সঙ্গে থাকার সময়ে, যখন কিশোরীমোহন প্রাথমিক শিক্ষার স্তরে
ছিলেন, তিনি আয়ুর্বেদের সঙ্গে পরিচিত হয়ে উঠছিলেন । গরিব ও দুস্হ রোগীদের
অবস্হায় তিনি বিপন্ন বোধ করতেন । কলকাতায় যাবার পর গরিব ছাত্রদের
নিঃশুল্ক গৃহশিক্ষা দিতেন । বিজ্ঞানে স্নাতক হবার পর তিনি রোনাল্ড রসের
সঙ্গে মহানাদ ও কলকাতায় তাঁর সহগবেষকরূপে চাকুরি করেছেন । রস স্বদেশে চলে
যাবার পর কিশোরীমোহন ম্যালেরয়া রোগ সম্পর্কে বাংলার গ্রামে-গ্রামে
প্রচারের কাজ নেন । সেই সূত্রে তাঁর বন্ধু বিধানচন্দ্র রায় তাঁকে স্বদেশী
আন্দোলনে যুক্ত করে নেন এবং কিশোরীমোহন আন্দোলনকারীদের বার্তাবাহক হয়ে
ওঠেন । ম্যালেরিয়া-বিরোধী প্রচারের জন্য কিশোরীমোহন ম্যাকিজ লন্ঠনের
সাহায্যে গ্রামে-গ্রামে স্লাইড প্রদর্শন করতেন । স্লাইড তৈরিতে তাঁকে
সাহায্য করতেন গঙ্গার অপর পারের ফোটোচিত্র শিল্পী লক্ষীনারায়ন রায়চৌধুরী,
যিনি ছিলেন ভারতের প্রথম ভ্রাম্যমাণ ফোটো-আর্টিস্ট ।

রাজনীতিতে যোগ দেবার পর ১৯২৩ সালে বঙ্গীয় ব্যবস্হাপক সভার নির্বাচনে কিশোরীমোহন বিধানচন্দ্র রায়-এর প্রচার কর্তা নিযুক্ত হন ; নির্বাচনে বিধানচন্দ্র রায় সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়কে পরাজিত করেন।

ম্যালেরিয়া-বিরোধি অভিযানে কিশোরীমোহন গ্রামাঞ্চলের দুস্হ গরিব চাষি
তাঁতি জেলে কামার কুমোরদের আর্থিক অবস্হার প্রতিকার হিসাবে পানিহাটির
কয়েকজন বাল্যবন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে স্হাপন করেন পানিহাটি কোঅপারেটিভ ব্যাংক
যা আজ একটি সমৃদ্ধ প্রতিষ্ঠান । তিনি বিশেষ করে তাঁতিদের সম্পর্কে চিন্তিত
ছিলেন । বিলাত থেকে মিলে তৈরি কাপড় আসার পর তাঁতিদের প্রায় ধ্বংস করে
দেয়া হয়েছিল । কিন্তু মিলে তৈরি কাপড়ের মশারি হয়না বলে গরিবদের পরিবারে
ম্যালেরিয়া প্রতিরোধে অত্যন্ত চিন্তিত ছিলেন তিনি ।

অত্যধিক কর্মকাণ্ডের দরুন তাঁর স্বাস্হ্যে অবনতি ঘটতে থাকে এবং ১৯২৯ সালে তিনি ম্যানেনজাইটিস রোগে মারা যান ।

সম্মাননা

রোনাল্ড রস নোবেল পুরস্কার পাবার পর কলকাতার বুদ্ধিজীবীদের এক প্রতিনিধিদল উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারীর নেতৃত্বে লর্ড কার্জনের সঙ্গে দেখা করে কিশোরীমোহনকেও আবিষ্কারের জন্য সম্মানিত করার অনুরোধ জানান । প্রতিনিধি দলে ছিলেন জগদীশচন্দ্র বসু, ব্রজেন্দ্রনাথ শীল, শিবনাথ শাস্ত্রী, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং প্রফুল্লচন্দ্র রায়
। লর্ড কার্জন বিষয়টি ব্রিটিশ সরকারের গোচরে আনলে দিল্লি দরবারের সময়ে
দিল্লিতে গণ্যমান্য ব্যক্তিদের উপস্হিতিতে ১৯০৩ সালে ডিউক অফ কনট
কিশোরীমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে সম্রাট সপ্তম এডওয়ার্ডের স্বর্ণপদক
তুলে দেন । পরবর্তীকালে কলকাতার সেনেট হলে বিজ্ঞানীদের পক্ষ থেকে
কিশোরীমোহনকে সম্বর্ধিত করা হয় । সম্বর্ধনা সভার সভাপতি ছিলেন চিত্তরঞ্জন
দাশ । প্রধান বক্তৃতা দেন উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী । অন্যান্য বক্তাদের অন্যতম ছিলেন বিধানচন্দ্র রায় যিনি পরবর্তীকালে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হন ।

রাস্তার নামকরণ

পানিহাটি শহরে মিউনিসিপাল কর্তৃপক্ষ একটি রাস্তা কিশোরীমোহনের নামে নামকরণ করেছেন কিশোরীমোহন ব্যানার্জি রোড

তথ্যসূত্র

  • উলি বিজেল এবং ক্রীস্টোফে বোয়েটে । দি ফ্লাইং পাবলিক হেল্হ টুল :
    জেনেটিকালি মডিফায়েড মসকিটোজ অ্যান্ড ম্যালেরিয়া কন্ট্রোল । সায়েন্স
    অ্যাজ কালচার, ল্যানকাসটার, ২০১৩
  • অ্যান এইচ কেলি এবং উলি বিজেল । নেগলেকটেড ম্যালেরিয়াজ : দি
    ফ্রন্টলাইন অ্যান্ড ব্যাক অ্যালিজ অফ গ্লোবাল হেল্হ । বায়োসোসাইটিজ,
    সংখ্যা ৬ । লন্ডন স্কুল অফ ইকোনমিক্স, ২০১১
  • শাশ্বত সিকদার । ছ্যান । হরিণাহরিণী পত্রিকা । কোয়ার্ক পাবলিশার্স । কলকাতা, ২০০৪
  • বারবারা রোমানিক । ট্র্যান্সফরমিং দি কলোনিয়াল সিটি : সায়েন্স
    অ্যান্ড দি প্র্যাক্টিস অফ ডোয়েলিং ইন ‘দি ক্যালকাটা ক্রোমোজোম’ । মোজাইক
    ৩৮ নং সংখ্যা, ২০০৫
  • ক্লেয়ার চেম্বার্স । পোস্টকলোনিয়াল সায়েন্স ফিকশান : অমিতাভ ঘোষেজ
    ‘দি ক্যালকাটা ক্রোমোজোম’ । দি জার্নাল অফ কমনওয়েলথ লিটারেচার, সংখ্যা ৩৮,
    লন্ডন, ২০০৩
  • অমিতাভ ঘোষ । ‘দি ক্যালকাটা ক্রোমোজোম’ । ২০০১
  • মলয় রায়চৌধুরী । ছোটোলোকের ছোটোবেলা । চর্চাপদ প্রকাশনী, কলকাতা ২০০০

আরো দেখুন……………

 

 

 

বহিঃসংযোগ