হিন্দুরা পৌত্তলিক। পৌত্তলিক মানে কি?

আমরা ছোটোবেলা থেকে পড়ে এসেছি – হিন্দুরা পৌত্তলিক। পৌত্তলিক মানে কি? যে পুতুল পুজো করে। কখনো ভেবেছেন যে,  হিন্দুরা পুতুল পুজো করে কিনা?
   পৌত্তলিক শব্দটির মধ্যে ঘৃণা লুকিয়ে আছে। সৈয়দ মুজতবা আলী বলেছেন (কোন বইতে বলেছেন তা এখন মনে নেই) – পৌত্তলিক শব্দটি অপমানজনক অতি নিকৃষ্ট শব্দ ও তা সর্বদা বর্জনীয়।
   হিন্দু পুতুল পুজো করে না। প্রতিমার মধ্যে নিয়ন্ত্রকের আরাধনা করে। বস্তুত পৃথিবীর সব ধর্ম কোনো কিছুকে কল্পনা/লক্ষ্য করে উপাসনা করে। খৃষ্টানরা যীশুর মূর্তি বা ক্রুশ, মুসলিমরা হজরে অসওয়াদ, শিখরা গুরুগ্রন্থসাহিব, বৌদ্ধরা বুদ্ধমূর্তি, পার্সীরা অগ্নি ইত্যাদি সামনে রেখে উপাসনা করে। সবাই কিছু না কিছুর প্রতি মন বা দৃষ্টিকে আবদ্ধ রাখে। সাধারণ মানুষের পক্ষে এটাই ঠিক। আধ্যাত্ম সাধনার উচ্চস্তরে উঠলে তখন এর প্রয়োজন হয় না। নিরাকার ব্রহ্মের উপাসনা তখনই একমাত্র সম্ভব। মূর্তির রূপ কল্পনা বা প্রতিমা স্বয়ং ঐসকল দেবতা নন তাঁদের প্রতীক, চিহ্ন বা রূপকল্প। এগুলো রূপকল্প হতে পারে কিন্তু তা মনকে স্থির করতে সাহায্য করে এবং ঈশ্বরের বিভিন্ন গুন সম্পর্কে ধারনা দেয়।
    যেকোনো হিন্দু জানে যে ঈশ্বর নিরাকার। তাকে আপন করে নেওয়ার জন্য মূর্তিকল্পনা।

    আচার্য রামানুজের কাছে একদিন এক মূর্তি পূজায় আস্থাহীন ব্যক্তি এসে উপস্থিত হন। তিনি আচার্যকে জিজ্ঞেস করেন, ব্রহ্ম বিশ্ব ব্যাপী, তাকে পূজা করার জন্য আপনি ছোট ছোট কতগুলি পিতলের মূর্তি রেখেছেন কেন? আচার্য বললেন, আমার ধুনি জ্বালাবার জন্য আগুনের দরকার, আপনি গ্রাম হতে আমাকে আগুন এনে দিন , তারপর আপনার প্রশ্নের জবাব দেব।
    ঐ লোকটি একখানা কাঠে আগুন নিয়ে উপস্থিত হলেন। আচার্য তাকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি এক খণ্ড দগ্ধ কাঠ এনেছেন কেন? যা বলেছি তাই আনুন। আগুন বলেছি আগুন আনুন। আগুন সকল বস্তুর মধ্যেই আছে। আপনার হাত ঘষে দেখুন, হাতের মধ্যেও আগুন আছে। আপনি আমার জন্য একটু খাটি আগুন আনুন। পোড়া কাষ্ঠ চাই না।
   আচার্যের কথা শুনে লোকটি বললেন, অগ্নি সব বস্তুর মধ্যেই আছে কিন্তু আপনার নিকট আনতে হলে কাষ্ঠ ছাড়া উপায় দেখি না।
    তখন আচার্য বললেন, সকল বস্তুর মধ্যে নিহিত অগ্নিকে আমার নিকট আনতে হলে কাষ্ঠ ছাড়া উপায় দেখেন না- আমিও সেই রূপ সর্বভুতস্থ সর্বব্যাপী পরম ব্রহ্মকে আমার নিকটতম আনতে চাইলে, মূর্তিকে আরোপ ছাড়া উপায় দেখি না। আপনার হাতের কাষ্ঠ খানা আগে ছিল কাষ্ঠ কিন্তু তাতে অগ্নি ধরাবার পর তা হয়ে উঠেছে অগ্নি, তেমনি আমার নিকটস্থ এই ঠাকুরটি এক সময় ছিলেন পিতল নির্মিত মূর্তি এখন সেটি চিন্ময় ব্রহ্ম। ইহা সচ্চিদানন্দ বিগ্রহ।

“পুতুল পূজা করে না হিন্দু, কাঠ-মাটি দিয়ে গড়া!
মৃন্ময় মাঝে চিন্ময় হেরে, হয়ে যায় – আত্মহারা !!”
                                             – স্বামী বিবেকানন্দ