খোড়া যুক্তি দিয়ে ক্রাইস্টচার্চের হামলাকে ব্যাখ্যা করবেন না। হামলাটিকে খ্রিস্টান ধর্মীয় হামলা বলার কোন সুযোগ নাই।

কোন মৃত্যুই তুচ্ছ নয় কিন্তু কেন আমাদের প্রতিক্রিয়া সব সময় উঠানামা করে?

ক্রাইস্টচার্চের রক্তের রঙ কি বেশি লাল? নিউজিল্যান্ড প্রেসিডেন্ট মাথায় হিজাব বেধে মুসলিমদের সহমর্মিতা জানাতে গেলেন। রাসেল ক্র, জিম ক্যারির মত হলিউড তারকাকে কাঁদতে দেখেছে বিশ্ব। এমনও হতে পারে ক্রাইস্টচার্চের হামলার দিনটিকে জাতিসংঘ ‘মুসলিম দিবস’ ঘোষণা করে সর্বত্র পালনের আহ্ববান জানাবে। সম্ভবত সব রক্তের রঙ লাল নয়? সব মৃত্যুও আমাদের কাছে সমান দু:খজনকও নয়। ২০১৭ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানে সুফি দরবেশ লাল শাহবাজ কালান্দার মাজারে আত্মঘাতি বোমা হামলায় ৭০ জন মারা গিয়েছিলো মুহূর্তের মধ্যে। হামলা চালিয়েছিলো ইসলামিক জঙ্গি গ্রুপ আইএস। মাজারেও সেদিন মুসলমানরা তাদের তড়িকার বিশ্বাস অনুযায়ী ইবাদাত করছিলো। ৭০ জন মানুষের রক্ত লাল ছিলো না? ২০১০ সালের নভেম্বর মাসে পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে একটি সুন্নি মসজিদে আত্মঘাতী বোমা হামলায়(সেদিনও শুক্রবার ছিলো এবং জুম্মার নামাজ চলাকালে) দাররা আদম খেল এলাকার মসজিদে ৫০ জন নিহত হয়েছিলো৷ ঘটনার দায় স্বীকার করে বার্তা পাঠায় পাকিস্তান তালেবান ইসলামিক গ্রুপ। যদি ইতিহাসের আরো পেছনে যাই তাহলে একদিনে দেড় হাজার কাদিয়ানী মুসলিমকে হত্যা করেছিলো সুন্নী মুসলমানরা ১৯৫৩ সালে পাকিস্তানের লাহরে। মসজিদে বোমা হামলা নতুন কিছু নয়। মসজিদে বোমা মেরে মানুষ মারা মুসলিমদের বাঁ হাতের খেল। ‘মুনাফিকদের মসজিদ’ কুরআনের একটি বিশেষ অভিধা। যখনই মুসলমানরা মনে করবে মুনাফিকরা মসজিদ তৈরি করে ইসলামের সহি তড়িকার চর্চা করছে না তখন সবল মুসলিমদের দায়িত্ব হচ্ছে সেই মসজিদে হামলা করে ধ্বংস করে দেয়া। কুরআনে এরকম ‘মুনাফিক মসজিদের’ কথা বলা আছে। মদিনাবাসী যে মসজিদ তৈরি করেছিলো সেটিকে নবী মুহাম্মদের নির্দেশে ধ্বংস করে সেখানে মলমুত্রের স্থান করা হয়। কাজেই সাতশ ইদুর মেরে এখন সন্ন্যাসী বিড়াল সাজার কোন সুযোগ নেই। একটা উগ্র হোয়াইট সুপ্রিমিটি ইউরোপীয়ানের হামলাকে খাটো করার কোন ইচ্ছা আমার নেই কারণ নিজেকে আমি মানুষ বলে মনে করি। কিন্তু এই ঘটনাকে মুসলিমরা যে বড় ধরণের সুবিধা আদায় করে নিচ্ছে সেই দিকটি অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে। তারা নিজেদের মজলুম বানানোর চেষ্টা করছে। তারা এখন তাকিয়াবাজী শুরু করবে। তারা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শান্তির ধর্ম অনুসারী হিসেবে বিশ্ববাসীর সহানুভূতি আদায়ের মতলব আটছে। ইউরোপ-আমেরিকার অভিবাসী মুসলিম হিজাবধারী আর দাড়ি টুপির মুসলিমদের বড় একটা অংশ চরমভাবে পাশ্চত্য সংস্কৃতির প্রতি ঘৃণা প্রশন করে। তাদের তরুণ অংশ পাশ্চত্যে বাংলাদেশের রোহিঙ্গা মুসলিমদের মতই যাদেরকে কক্সবাজারের স্থানীয়রা এড়িয়ে চলে এবং ভয় পায়। এখন ভাবখানা এমন যেন পৃথিবীতে খালি মুসলমানদের মসজিদের উপরই অমুসলিমরা হামলা চালায়। নিজেরাই কত রকম দাবী করে মসজিদের হামলায় চালায় সেই খতিয়ান রেখে সাম্প্রতিককালে মুসলমানদের হাতে গির্জা মন্দির মঠে হামলার কিছু চিত্র দেখা গেলে শিউরে উঠতে হবে। মুসলিম প্রধান নাইজেরিয়া, ইরাকে, মিশরে, পাকিস্তানে, আফগানিস্থানে, ইন্দোনেশিয়া, বাংলাদেশে গির্জা, মন্দির মঠে আত্মঘাতি বোমা হামলা চালিয়ে হত্যা করেছিলো সাধারণ ধার্মীক প্রার্থনারত মানুষকে। ২০০২ সালে ইন্দোনেশিয়ার বালি দ্বীপে আল কায়দা একটি নাইটক্লাবে আত্মঘাতি বোমা হামলা চালিয়ে ২০০ মানুষকে হত্যা করার পর বিশ্ব বিবেক কি এভাবে কেঁদেছিলো? কোন মৃত্যুই তুচ্ছ নয় কিন্তু কেন আমাদের প্রতিক্রিয়া সব সময় উঠানামা করে?

আমি ভাবছি যারা টুইন টাওয়ার ধ্বংসে উল্লাস করেছেন,লন্ডনের মেট্রোরেলে বোমা বিস্ফোরণে মুচকি হেসেছেন, ফ্রান্সে সন্ত্রাসী হামলায় করতালি দিয়েছেন,ভারতের বোম্বে ম্যাসাগারে তৃপ্তির হাসি হেসেছেন,ভারতে একটার পর একটা সন্ত্রাসী হামলায় কোন প্রতিবাদ করেনি এমনকি ঢাকার হলি আর্টিজান হত্যাকান্ডেও যাদের কোন প্রতিক্রিয়া ছিল না তাদের এবার  নিউজিল্যান্ডের ক্রাইসচার্যে মসজিদে সন্ত্রাসী হামলায় তাদের প্রতিক্রিয়া জানতে ইচ্ছে হয়।

জানি কথাটা অমানবিক কিন্ত অনেকের মনের কথাটাই আমি অকপটে বলে দিলাম।নিউজিল্যান্ডের সন্ত্রাসী হামলায় যারা নিহত হয়েছেন তাদের পরিবার যে যন্ত্রণা ভোগ করছেন ঠিক একই যন্ত্রনা ভোগ করেছেন সারা পৃথিবীর সন্ত্রাস পীড়িত ভুক্তভোগীরা।অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু কখনো সুখের হতে পারে না। যে মা তার সন্তান হারিয়েছেন যে স্ত্রী তার প্রিয়তমকে হারিয়েছেন একমাত্র তিনিই জানেন প্রিয়জন হারানোর কি যন্ত্রণা।তাই কোন হত্যাই সমাধান নয়।

খুশী হতাম যদি মসজিদে ঢুকে নিরিহ নিরস্ত্রদের হত্যা না করে সন্ত্রাসী  ঘাটিতে গিয়ে বীরত্বটা দেখাত। এই ধরনের কাপুরুষোচিত হামলার নিন্দা জানাই। বিশ্বের সাধারন মানুষ শান্তি কামনায় দিনাতিপাত করলেও বৈশ্বিক রাজনীতি স্বার্থ আর কৌশলের মার প্যাচে দিনে দিনে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে সন্ত্রাসবাদ।

কারোই ভাবা উচিত নয় আঘাতের প্রত্যাঘাত হবে না। নিউটনই বলে গিয়েছেন To every action there is an equel and opposite reaction. যতদিন পর্যন্ত অন্য জাতি বা ভিন্ন মত পালন কারিদের নিধন করে সারা বিশ্ব জয়ের অলিক কল্পনা মানুষের মন থেকে মুছে না যাবে ততদিন প্রতিহিংসার আগুনে নিরিহ নিরস্ত্র সাধারণ মানুষকে তার ফল ভোগ করতে হবে।

তারপর প্যারিসে হামলা চলল। সুইডেন, লন্ডন… শহরের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। সর্বত্রই মুসলিম ধর্মীয় জঙ্গিরা এই হামলা চালিয়েছিলো। আজকে ক্রাইস্টচার্চের মসজিদে হামলার পর ইহুদী খ্রিস্টান হিন্দু শিখদের আর্থিক সহায়তা চাপে নিউজিল্যান্ডের একটি সহায়তা সংস্থার সাইট ডাউন হয়ে গেছে! ফুলে ফুলে ভরিয়ে ফেলেছে অমুসলিমরা ক্রাইস্টচার্চ মসজিদকে। কিন্তু যখন প্যারিসে হামলা হয়েছে, সুইডেনে, আমেরিকায়, বালিতে তখন মুসলমানরা এসব ঘটনার পিছনে আমেরিকার হাত, ইজরাইলের হাত, ভারতের হাত আবিস্কার করে উল্টো ভিকটিমকেই ব্লেইম দিয়েছে। যখন প্রমাণ তথ্যকে সামাল দিতে পারেনি তখন হামলাকারীদের অমুসলমান, প্রকৃত ইসলাম অনুসারী নয়, মুসলিমরা জঙ্গি নয় এরকম প্লেকার্ড টাঙ্গিয়ে নিজেদের রক্ষা করতে ব্যস্ত থেকেছে। পৃথিবীর কোন বড় আলেম মাওলানা এ ধরণের হামলার পর দু:খ প্রকাশ করে তাদের পাশে থাকার ঘোষণা দিয়েছে? তারা নাকি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে? ইসলামে নাকি সন্ত্রাস নেই? পোপ কিন্তু ক্রাইস্টচার্চের ঘটনায় তৎক্ষণাত দু:খ প্রকাশ করে আক্রান্তদের পাশে থাকার ঘোষণা দিয়েছে? তাহলে প্রকৃত শান্তিবাদী কারা?

ঐ যে বলেছিলাম শিক্ষিত আধুনিক মানুষ দেখলেই তাকে ধর্ম সম্পর্কে উদাসিন, নাস্তিক, অজ্ঞেয়বাদী, সেক্যুলার মনে করে ফেলি আমি। মুসলমানদের মধ্যে এরকম খুঁজতে গিয়ে বারবার হোঁচট খাই। ক্রাইস্টচার্চ মসজিদে হামলার পর এইরকম মুসলমানরা একের পর এক তাদের মুসলমানিত্ব নিয়ে হাজির হচ্ছেন। এরা এখন যে প্রশ্ন তুলছেন তার নমুনা এরকম: মুসলমানরা হামলা চালালে বলা হয় ওরা জঙ্গি, আর ইউরোপীয়ান বা অমুসলিমরা হামলা চালালে বলা হয় অসুস্থ পাগল। এবার নাকি প্রমাণ হয়েছে অমুসলিমরাও জঙ্গি হয়…। আমি অনেক লেখাতে বলেছিলাম এই যে ইসলামিক আক্রমন চলছে এর পাল্টা আঘাত খেতে মুসলিমদের প্রস্তুত থাকতে হবে। ইট মারলে পাটকেল খেতে হবে। আপনি রাতদিন মসজিদে ইহুদীনাসারাদের অভিশাপ দিবেন খোদ তাদের দেশে বসেই, আপনি লরি উঠিয়ে দিবেন তাদের পথচারিদের উপর আর আপনার ভাই-বেরাদাররা ব্যাখ্যা দিতে বসবে এগুলো পশ্চিমা কলোনীয়াল যুগের নিপীড়নের ফিডব্যাক, অভিমানি মুসলমানরা কলোনীয়ান যুগের অবহেলা বৈষম্যের কারণে ক্ষুব্ধ ছিলো। কিংবা কাস্মিরে জঙ্গি দলে যোগ দিয়ে সেনা মারা যুবকের হয়ে যখন অরুন্ধতীর মত বুদ্ধিজীবীরা বলেন ভারতীয় শাসনই এইসব তরুণদের বাধ্য করছে চরমপন্থায় নামতে। তাদেরও অধিকার আছে অস্তিত্ব রক্ষায় প্রতিরোধ করার। তো এরকম থিউরী কি এখন ক্রাইস্টচার্চের খুনিটির জন্য ব্যবহার করা যাবে? প্যারিস-সুইডেন হামলাই তাকে অভিমানী করে তুলেছিলো্? মসজিদগুলো খুদবা তাকে ক্ষুব্ধ করে তুলেছিলো? এগু্লো তো আপনাদের থিউরী- ভিকটিম ব্লেইম।

ক্রাইস্টচার্চের হামলাটিকে কি খ্রিস্টান ধর্মীয় হামলা বলা যাবে? একদমই নয়। হামলাকারী কোন দিক দিয়েই ধার্মীক খ্রিস্টান নয়। সে ধর্মের ধারই ধারে না। কিন্তু জাকির নায়েকের ফ্যানের তালিকায় ফারুক ওয়াসিফ, মুস্তফা সরওয়ার ফারুকদের থাকা বিচিত্র কিছু নয়। জাকির নায়েক একটা জিনিস মুসলমান ও বামপন্থিদের শিখিয়ে দিয়ে গেছে, কেমন করে কুযুক্তি দিয়ে আসর মাত করতে হয়। হিটলার, মাও সেতুং, স্টাইলিনদেরকে খ্রিস্টান বৌদ্ধ হিসেবে জাকির নায়েক তাদের শাসনে হাজার হাজার মানুষ হত্যার পরিসংখ্যান দিয়ে প্রশ্ন তুলছিলো, তাহলে কেন শুধু মুসলমানদের সন্ত্রাসী বলা হয়? হিটলার ছিলো সমাজতন্ত্রী জাতীয়তাবাদী, মাও, স্টালিন দুজনই কমিউনিস্ট ছিলেন। বুশ, ট্রুম্যান দুজনই আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তারা পারিবারিকভাবে খ্রিস্টান হলেও তাদের রাজনীতি, তাদের যুদ্ধ আর হত্যাগুলো কোন ধর্মীয় রাজনীতির অংশ নয়। এমনকি ইসলামিক পাকিস্তান যখন ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের উপর গণহত্যা ধর্ষণ চালালো সেটাকেও মুসলিম হিসেবে নিয়াজী-ইয়াহিয়া-ভুট্টকে বিবেচনা করা যাবে না কারণ এই যুদ্ধ ইসলামিক খেলাফত ও জিহাদের ঘোষণা দিয়ে হয়নি। কিন্তু যে দলগুলো পরিচালনা করে মাদ্রাসার মুফতি-মাওলানারা, যারা বিশ্বব্যাপী ইসলামিক খিলাফত প্রতিষ্ঠার জন্য সরাসরি কুরাআন হাদিস থেকে তাদের রাজনীতি পরিচালনা করে সেটা পুরোটাই ইসলামিক জঙ্গিবাদ। আমেরিকাকে খ্রিস্টান বানিয়ে ইসলামিক জঙ্গিবাদের সমান্তরাল করাটা বুদ্ধি প্রতিবন্ধীতার লক্ষণ। হোয়াইট সপ্রিমিটি ক্রাইমগুলোকে কি তাদের দলগুলো তাওরাত, বাইবেল, গীতার শ্লোক দিয়ে হামলাগুলোকে বৈধতা দেয় এমন কোন নজির আছে? আমেরিকার এক মানসিক রোগী নিজের রাইফেল নিয়ে স্কুলে ঢুকে হত্যা করেছে অনেক মানুষকে। এরকম ঘটনাগুলোকে ‘খ্রিস্টান সন্ত্রাস’ হিসেবে দেখানো আর শামিম ওসমান, জয়নাল হাজারীর মত গডফাদারদের পারিবারিক ধর্মীয় পরিচয় ধরে তাদের ‘মুসলিম সন্ত্রাসী’ বলাটা যেরকম ছাগলামী হবে আজ বাংলাদেশে সাংবাদিকতায় যারা রয়েছেন, লেখক, বুদ্ধিজীবী, সেলিব্রেটি তারা সকলেই এরকম যুক্তি প্রকাশ করে নিজেদের ছাগলামী প্রকাশিত করে তুলছেন। খোড়া যুক্তি দিয়ে ক্রাইস্টচার্চের হামলাকে ব্যাখ্যা করবেন না। দাবী করছেন অমুসলমানদেরও জঙ্গি বলতে হবে। তারা আসলে নিজেরাই জানেন না যে শাকের আড়ালে তাদের মাছ বেরিয়ে পড়ছে! মানুষ এক সময় প্রশ্ন করবে- জঙ্গিদের জঙ্গি বললে তাদের গায়ে লাগত কেন?
#Susupto Pathok

Scroll to Top