ভারতের মুসলমান খ্রিস্টান বৌদ্ধ জৈন… সকলেই আসলে এই সভ্যতার সন্তান, তারা সকলে ‘হিন্দু’।

মূল লেখা পড়ার আগে ভূমিকাটা পড়ে নেয়া ভালো।
[শরৎচন্দ্র ‘বামুনের মেয়ে’ উপন্যাসে কুলিন ব্রাহ্মণদের ইতিহাস তুলে ধরেছিলেন যেখানে দেখানো হয়েছিলো একেকজন ব্রাহ্মণ পণের টাকা নিয়ে ৪০-৫০টি পর্যন্ত বিয়ে করত। এসব বউদের সঙ্গে বছরে একটিবার এসে দেখা করে যেতো ব্রাহ্মণ ঠাকুরটি। কিন্তু সারা বছর একজনের পক্ষে এতগুলো শ্বশুড়বাড়ি ঘুরে আসাটা সেযুগে চাট্টিখানি কথা ছিলো না। বুড়ো ব্রাহ্মণ তাই লোক ফিট করত যারা তার হয়ে প্রক্সি দিয়ে আসত শ্বশুড়বাড়ি। এরা বছরে একবার গিয়ে রাত কাটিয়ে এসে শ্বশুড় মশাইয়ের প্রণামি নিয়ে চলে আসত। ব্রাহ্মণ ঠাকুর নাপিত, ডোম জাতীয় তথাকথিত নিচু জাতের লোকদের দিয়ে এই কাজটা করাতো। উপন্যাসের নায়িকা ব্রাহ্মণ হিসেবে এতখানি জাতাভিমানী ছিলেন যে নায়ক তার চাইতে নিচু জাতের বলে বিয়েতে রাজি ছিলেন না। শেষে দেখা যায় সে নিজেই ব্রাহ্মণ মায়ের গর্ভে নাপিতের সন্তান ছিলো। ইতিহাসের এই কলঙ্কজনক অধ্যায়ে কি কোন ব্রাহ্মণ তার প্রক্সি হয়ে কোন মুসলমানকে পাঠায়নি তা কে বলে দিবে? ফেইসবুকের ভট্টাচার্যটির লেখা পড়লে, তার প্রচন্ড ভারত ও হিন্দু বিদ্বেষ দেখলে মনে সন্দেহ হতেই পারে! প্রবাদ আছে, বাপকা বেটা, সিপাই কি ঘোড়া…।]

এবার মূল লেখায় আসি। রবীন্দ্রনাথ জমিদারী হারানোর ব্যথায় ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি লিখেননি। অবিভক্ত ভারতবর্ষে ইংরেজদের প্রধান মাথা ব্যথার কারণ ছিলো কোলকাতার শিক্ষিত হিন্দু শ্রেণী। এই শ্রেণীকে দুর্বল করতে পূর্ব বাংলাকে ভাগ করতে পারলে তাদের জব্দ করা যাবে এই ছক করে ঢাকার ঋণগ্রস্ত নবাবকে দিয়ে বঙ্গভঙ্গ করার জন্য মুসলমানদের দিয়ে দাবী উঠায়। এই বঙ্গভঙ্গকে বাংলাদেশের ভ্রুণ যারা বলে তারা পরিস্কারভাবে দ্বিজাতি তত্ত্বকে সমর্থন করছে। দ্বিজাতি তত্ত্ব পরিস্কারভাবে মুসলমানদের জন্য পৃথক দেশের কথা বলেছে। এই দেশ বাস্তবায়ন ঘটার ফলে কেবল মাত্র ধর্মীয় পরিচয়ে পূর্ববঙ্গের হিন্দুরা নিজেদের দেশ হারিয়েছে। তারা তাদের সহায় সম্বল হারিয়ে ভারতে চলে গেছে। কোন হিন্দু কমিউনিটির লোক যখন বলবে ১৯৪৭ সালে মুসলমানদের প্রস্তাব কেন কোলকাতার হিন্দুরা মেনে নেয়নি, কেন তারা পাকিস্তানে যোগ দেয়নি- তখন বামুনের মেয়ে উপন্যাসের নায়িকার জন্ম পরিচয়ের কথা স্মরণ হতেই পারে!

পূর্ব বঙ্গের মুসলমান একবার ভুল করেছে বলে বারবার ভুল করবে কেন? দ্বিজাতি তত্ত্ব আর রবীন্দ্রনাথ একসঙ্গে যায় না। পাকিস্তান ভেঙ্গে যাওয়াটা বাংলাদেশের মানুষ মেনে নিতে পারেনি। আমি আগেই আপনাদের দেখিয়েছি প্রিয়া সাহার ঘটনার পর এদেশের স্বাধীনতা পক্ষ আর বিপক্ষ শক্তিদের অভিন্ন প্লাটফর্মটাকে। ৯ মাসের একটা যুদ্ধ রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তান ভেঙ্গে গেলেও দ্বিজাতি তত্ত্বকে ধারণ করতে কোন বাধা নেই। সেখানে রবীন্দ্রনাথ হচ্ছে প্রবল বাধা। বাংলা সাহিত্যের দিকপালদের বাদ না দিলে, শিল্পকলার বাংলার আকাশের তারাদের মুছে না দিলে বাংলাদেশের মুসলমানদের কৃত্রিম জাতিসত্ত্বা নির্মাণের চেষ্টা সম্ভব হয় না। কেন রবীন্দ্রনাথ বার বার এখানে আক্রান্ত হন, কেন সলিমুল্লাহ-কলিমুল্লাহ, রাইসু-রইসউদ্দিন, ছফা-রাজ্জাকদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিলেন সেটা রবীন্দ্রনাথের লেখার কারণেই। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন,  ‘হিন্দুসমাজের লোকেরা কী বলে সে কথায় কান দিতে আমরা বাধ্য নই; কিন্তু ইহা সত্য যে কালীচরণ বাঁড়ুজ্যে মশাই হিন্দু খ্রীস্টান ছিলেন। তাঁহার পূর্বে জ্ঞানেন্দ্রমোহন ঠাকুর হিন্দু খ্রীস্টান ছিলেন। তাঁহারও পূর্বে কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় হিন্দু খ্রীস্টান ছিলেন। অর্থাৎ তাঁহারা জাতিতে হিন্দু, ধর্মে খ্রীস্টান। খ্রীস্টান তাঁহাদের রঙ, হিন্দুই তাঁহাদের বস্তু। বাংলাদেশে হাজার হাজার মুসলমান আছে। হিন্দুরা অহর্নিশি তাহাদিগকে ‘হিন্দু নও হিন্দু নও’ বলিয়াছে এবং তাহারাও নিজেদিগকে ‘হিন্দু নই হিন্দু নই’ শুনাইয়া আসিয়াছে; কিন্তু তৎসত্ত্বেও তাহারা প্রকৃতই হিন্দুমুসলমান’।

অর্থ্যাৎ কেউ ইসলাম গ্রহণ করে মুসলমান হলে কিংবা খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করে খ্রিস্টান হয়ে গেলেই সে আরব কিংবা ইউরোপের ইতিহাস সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করে না, সে আসলে ‘হিন্দুই’ থাকে। ভারতের মুসলমান খ্রিস্টান বৌদ্ধ জৈন… সকলেই আসলে এই সভ্যতার সন্তান, তারা সকলে ‘হিন্দু’। এই হিন্দু মানে পুজাআচ্চা জপতপ ব্রত পালন করা কোন সনাতন ধর্মালম্বী নন। এমন কি এই ধর্মের অনুসারীরা নিজেদের একমাত্র ‘হিন্দু’ ভেবে বসে থাকলেও যে কিছু যায় আসে না সেটাই রবীন্দ্রনাথ বললেন। এটা কি দ্বিজাতি তত্ববাদীরা মনে করেন? শেরে বাংলা, ভাষানী- কেউ কি এভাবে নিজেদের ভাবতেন? লাহোর প্রস্তাবকারীরা যে নিজেদের মুসলমান বলে ভিন্ন এক জাতি মনে করতেন সেটা তো লুকানো কিছু নয়। মাওলানা আকরাম খাঁ পিরালী বামুন ছিলেন। তার পূর্ব পুরুষ প্রতারিত হয়ে মুসলিম হয়েছিলেন। তারপর তাদের পারিবারিক ভাষা বাংলা থেকে কয়েক প্রজন্মে উর্দুতে পরিণত হয়েছিলো। আকমার খাঁ দাবী করতেন তাদের পূর্ব পুরুষ আরব থেকে এসেছিলো। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ বলেন, ধর্মান্তরিত মুসলমান খ্রিস্টান সবাই এই মাটির সন্তান এবং একই সংস্কৃতি ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী। দ্বিজাত তত্ত্ব জন্মই নিতো না যদি মনসামঙ্গল, মহাভারতের মত সাহিত্যকে ভারতবর্ষের মুসলমানরা নিজেদের পূর্বপুরুষদের কীর্তি মনে করত। রবীন্দ্রনাথ স্পষ্টত বলেছেন, ‘হিন্দু ধর্মের’ লোকজন কি মনে করে তাতে কিছু আসে যায় না। কারণ রবীন্দ্রনাথ নিজে হিন্দু ছিলেন না। কিন্তু এই ভূখন্ডের অতিতের সমস্ত কীর্তিকে তিনি গর্বের সঙ্গে গ্রহণ করেছিলেন। কবি মাইকেল মধূসদনের কথা চিন্তা করুন। খ্রিস্টান হবার পরই তিনি মেঘনাদ বধ কাব্য লিখলেন। হিন্দু মিথলজিকে অবলম্বণ করে কাব্য লিখলেন তিনি। কিন্তু মীর মোশাররফ হোসেন লিখলেন নবী মুহাম্মদের নাতির কারবালা কাহিনী নিয়ে মহাকাব্য। মধূসুদন মুসলমান হলে কি রামায়ন নিয়ে মহাকাব্য লিখতে পারতেন? বিরাট প্রশ্ন। কেননা দ্বিজাতি তত্ত্ব মুসলমানদের আরব তুর্কী আফগানদের ঐতিহ্যকে নিজেদের বলে বিশ্বাস করতে বলে। রবীন্দ্রনাথকে কটাক্ষ করে পাকিস্তান আমলে লেখক আবুল মনসুর আহমদ তার ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’ বইতে লিখেছিলেন, ‘হাজার বছর মুসলমানরা হিন্দুর সাথে একদেশে একত্রে বাস করিয়াছে। হিন্দুদের রাজা হিসেবেও, প্রজা হিসেবেও। কিন্তু কোনও অবস্থাতেই হিন্দু-মুসলমানে সামাজিক ঐক্য হয় নাই। হয় নাই এই জন্য যে, হিন্দুরা চাহিত আর্য-অনার্য, শক, হুন যেভাবে ‘মহাভারতের সাগর তীরে’ লীন হইয়াছিল, মুসলমানেরাও তেমনি মহান হিন্দুসমাজে লীন হইয়া যাউক। তাহারা শুধু ভারতীয় মুসলমান থাকিলে চলিবে না, ‘হিন্দুমুসলমান’ (হিন্দুরূপী মুসলমান) হইতে হইবে। এটা শুধু কংগ্রেসী বা হিন্দুসভার জনতার মত ছিল না, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথেরও মত ছিল’।

আবুল মনসুর আহমদদের পাকিস্তান কায়েম হবার পর এদেশে তাদেরকে প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী হিসেবে গণ্য করা হত। যেমন আবুল ফজলের নাম নেয়া যায়। যিনি পূর্ব পাকিস্তানের পাঠ্যপুস্তকে সমস্ত হিন্দু লেখকদের লেখা বাদ দেয়ার কথা বলেছিলেন কিন্তু পাকিস্তানকে প্রগতিশীল দেশ হিসেবে দেখতে চাইতেন। তিনি লিখেছিলেন, মুসলমান বলতে কোন জাতি হয় না- এ কারণেই আরবদেশ ছোট ছোট রাষ্ট্রে ভাগ হয়ে গিয়েছে। অর্থ্যাৎ দ্বিজাতি তত্ত্ব ইসলামপন্থি ও প্রগতিশীল মুসলমান- দুই পক্ষের লোকজনই গ্রহণ করেছিলেন। রবীন্দ্র বিদ্বেষ তাই কেবল চরমোনাই পীর বুকে বহন করেন না, প্রচুর প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী বুকে বহন করে চলেন। পূর্ববঙ্গের মুসলমান কমিউনিস্টরা বরাবরই ইসলামপন্থিদের জায়গাটা মজবুত করে গেছেন তাদের রাজনীতি দিয়ে। ১৯৪৮ সালে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেসে ভবানী সেন কমিউনিস্টদের জন্য সাংস্কৃতিক তত্ত্ব (ফতোয়া) দেন যাতে রবীন্দ্রনাথকে প্রগতিবিরোধী বুর্জোয়া হিসেবে আখ্যা দিয়ে তাকে বর্জন করার ঘোষণা দেয়া হয়। এই তত্ত্বকে স্বাগত জানান মুনীর চৌধুরী, আখলাকুর রহমান, আবদুল্লাহ আল-মুতী, আলাউদ্দিন আল আজাদ। যদিও মুনির চৌধুরী ১৯৬৭ সালের রবীন্দ্রনাথ নিষিদ্ধের প্রতিবাদে যে বিবৃতি সাক্ষর হয় তাতে নিজে অংশগ্রহণ করেছিলেন। পাকিস্তান হবার পর পূর্ব পাকিস্তানে মুসলিম লীগের জয়জয়কার। পাকিস্তান আন্দোলনে মুসলিম জাতীয়তাবাদী বুদ্ধিজীবীদের রবীন্দ্র বিরোধীতা, তাকে পরিত্যাগের কাজটি সহজ হয়েছিলো যখন কমরেড মুনীর চৌধুরী, আখলাকুর রহমান, আবদুল্লাহ আল-মুতী, আলাউদ্দিন আল আজাদ মত প্রভাবশালী বাম লেখকরা রবীন্দ্র বিরোধী অবস্থান নিয়েছিলেন। সেই ভূমিতেই দাঁড়িয়ে লেখক সৈয়দ আলী আহসান বললেন, আমাদের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য এবং জাতীয় সংহতির প্রয়োজনে আমরা রবীন্দ্রনাথকেও অস্বীকার করতে প্রস্তুত।

নোবেল তো দুধে বাচ্চা! ফেইসবুকের ভটাচার্য সম্ভবত বামুনের মেয়ে কেস। আসল কথা হচ্ছে এদেশের প্রগতিশীল দাবীদারদেরই তো ঠক বাছতে গা উজার দশা হবে! দ্বিজাতি তত্ত্ব না থাকলে বাংলাদেশ থাকে না। রবীন্দ্রনাথের গানে মুসলমানদের খেজুর গাছ নাই। উটের পালের কথা নাই। তার গানে আমের ঘ্রাণের কথা আছে। ধান ক্ষেত, আকাশ ভরা বর্ষার মেঘ… বাংলার জল বাংলার মাটির ঘ্রাণ…। মুসলমানিত্বের সঙ্গে এগুলো ঠিক যায় না!

Scroll to Top