খুবই উপযোগী। তার কেবল এই একটি অবদানই পদার্থবিজ্ঞানে এতো গুরুত্বের
দাবীদার যে অনেকে তাকে ভারতীয় উপমহাদেশের সর্বকালের অন্যতম সেরা পদার্থ
বিজ্ঞানীর কাতারে রাখেন। রায়চৌধুরী সমীকরণ
বাংলাদেশের মাটিতে জন্ম নেওয়া যে কয়েকজন মহাবিজ্ঞানী বা
পদার্থবিজ্ঞানীর কীর্তি সারা বিশ্বে সাড়া ফেলেছে, তাঁদের মধ্যে অন্যতম
প্রধান বিজ্ঞানী অমল কুমার রায়চৌধুরী। এই অমর বিজ্ঞানীকে নিয়ে তাঁর
মৃত্যু দিবসকে সামনে রেখে লিখার অন্যতম কারণ আমাদের নতুন প্রজন্মের তরুণেরা
এমনকি ব্লগাররাও হাহুতাশ করে গর্ব করার লোকের অভাব বলে। অথচ আমাদের গর্বের
তালিকা এতই সুবিশাল যে আমাদের ছাত্ররা খুব ভালভাবেই তাদের আদর্শ খুঁজে
নিতে পারবে অথবা নিজের গর্বের ও প্রেরনার ব্যক্তিকে পাবে প্রায়
জ্ঞান-বিজ্ঞানের সব ক্ষেত্রে। আজ এই মহান বিজ্ঞানীর অর্জন ও কাজের পরিধি
নিয়ে একটু পাঠককে জানাব।
রায়চৌধুরী বর্তমান বাংলাদেশ এবং তদানীন্তন ব্রিটিশ ভারতের বরিশাল
অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা সুরেশচন্দ্র রায়চৌধুরী একজন স্কুলশিক্ষক
ছিলেন, তিনি ছিলেন গণিতের শিক্ষক। বাবাকে দেখে অনুপ্রাণিত হয়েই ছোটবেলা
থেকেই অমল গণিত বিষয়ে আগ্রহী ছিলেন, গণিতের সমস্যা সমাধান করতে ভালবাসতেন।
১৯৪২সালে তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে স্নাতক এবং ১৯৪৪ সালে কলকাতা
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। এরপর তিনি Indian Association
for Cultivation of Sciences (IACS) এ যোগ দেন। কিন্তু সুদীর্ঘ চার বছর
গবেষণা করে কোন তাৎপর্যপূর্ণ ফলাফল না পেয়ে তিনি বেশ হতাশ হয়ে পড়েন।
তিনি তখন আশুতোষ কলেজে প্রভাষক হিসেবে শিক্ষকতা করতেন আর অধ্যাপক এন আর সেন
সেখানে আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্ব পড়াতেন। অমল অধ্যাপক সেনের সান্নিধ্যে
আপেক্ষিকতা তত্ত্ব শিখতে শুরু করেন এবং তাঁর সাহায্যেই প্রথম কয়েকটি
গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। এর জন্যে তিনি নিজ উদ্যোগে ডিফারেন্সিয়াল জিওমেট্রি
নিয়ে পড়াশুনা করেন। পরবর্তীতে তিনি একাই গবেষণা চালিয়ে যেতে থাকেন।
গবেষণার এক পর্যায়ে তিনি তাঁর বিখ্যাত সমীকরণটি আবিষ্কার করেন। একই সময়েই
তিনি IACS এ দ্বিতীয় দফায় গবেষণা সহযোগী হিসেবে যোগ দেন।
অমল কুমার রায়চৌধুরী তাঁর সমীকরণটি ১৯৫৩ সালে বের করলেও তা আন্তর্জাতিক
জার্নালে প্রকাশ করার জন্য তাঁকে আরও দুই বছর অপেক্ষা করতে হয়। ১৯৫৫ সালে
তাঁর গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয় বিখ্যাত জার্নাল ফিজিক্যাল রিভিউ –তে। এই
গবেষণা প্রবন্ধের হাত ধরেই অমল আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে পরিচিত হয়ে ওঠেন।
তখনো কিন্তু তিনি ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেননি। তাঁর পিএইচডি সম্পন্ন হয়
১৯৫৯ সালে।
রায়চৌধুরী সমীকরণের অবতারণা আইনস্টাইনের জেনেরাল রিলেটিভিটি (General
Relativity) এর প্রেক্ষাপটে। তাই আগে জেনেরাল রিলেটিভিটি নিয়ে কিছু কথা
বলে নেওয়া প্রয়োজন। আমরা এখন জানি, এই বিশ্বে মূলতঃ চার রকমের বল বা
ফোর্স (Force) কাজ করে (বিস্তারিত জানতে এই লেখাটা পড়ুন);
এর মধ্যে আমাদের কাছে সবচেয়ে পরিচিত হল মহাকর্ষ বা গ্রাভিটি (Gravity)।
যার জোরে পৃথিবী ভনভন করে সূর্যের চারিদিকে ঘোরে। ফলে ঋতু পরিবর্তন হয় আর
গাছের কাঁচা আপেল পাকে এবং শেষমেষ তা টুপ করে পড়ে নিউটনের মাথায়। জেনেরাল
রিলেটিভিটি এই মহাকর্ষেরই আধুনিকতম থিয়োরি (Theory) বা তত্ত্ব।
১৯১৫ সালে আইনস্টাইন জেনেরাল রিলেটিভিটি-র প্রস্তাবনা করেন। এই প্রস্তাব অনুযায়ী স্পেস এবং টাইম (Space and Time)
অর্থাৎ স্থান এবং কাল এর স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নেই; যা আসলে আছে তা হল
স্পেস-টাইম বা স্থান-কাল। পদার্থ বা বস্তুর উপস্থিতি এই স্থান-কাল কে
ডিফর্ম (Deform) বা বিকৃত করে। স্পেস-টাইম বা স্থান-কাল কে যদি কোনো
জ্যামিতিক আকার কল্পনা করা হয় তাহলে তার বিকৃতি কেমন হবে তা সম্পূর্ণভাবে
নির্ধারিত হয় উপস্থিত বস্তুর আচার-আচরণ দিয়ে। খুব সাধারণভাবে বলতে গেলে,
এই আচার-আচরণ হল বস্তুর ভর বা মাস (Mass) এবং তার ডিস্ট্রিবিউশন
(Distribution) বা বিতরণ। বস্তুর উপস্থিতিতে স্থান-কালের বিকৃতি যে গাণিতিক
ভাষায় প্রকাশ করা হয় তাকে বলে আইনস্টাইন ফিল্ড সমীকরণ (Field Equation)।
রায়চৌধুরী সমীকরণ পদার্থের উপস্থিতিতে বিকৃত স্থান-কাল-এ একঝাঁক জিওডেসিক (Geodesic)
এর সামগ্রিক গতিবিধি সংক্রান্ত এক জ্যামিতিক বা গাণিতিক সম্পর্ক।
আলাদা-আলাদা ভাবে পদার্থকণার জিওডেসিক সম্পর্কে আমরা জানতেই পারি, কিন্তু
তাদের সামগ্রিক গতিপ্রকৃতির বিশ্লেষণে রায়চৌধুরী সমীকরণ এক প্রয়োজনীয়
এবং সুবিধেজনক গাণিতিক হাতিয়ার। সহজে স্থূলভাবে বলতে গেলে এইরকম উদাহরণ
দেওয়া যায়ঃ ধরা যাক মানুষের শরীরে রক্তপ্রবাহের কথা। এই প্রবাহ বর্ণনা
করতে আমাদের জানা প্রয়োজন শিরা-ধমনীর প্রত্যেক বিন্দুতে ভেলসিটি ভেক্টর
(Velocity vector) অর্থাৎ রক্তপ্রবাহ কত জোরে এবং কোন দিকে বইছে। এই
ভেলসিটি ভেক্টর জিওডেসিক সমীকরণ মেনে চলে। আমাদের শরীরের বিভিন্ন অংশে
শিরা-ধমনী কোথাও অপেক্ষাকৃত মোটা আবার কোথাও অপেক্ষাকৃত সরু হতে পারে। সহজ
কথায় বলতে গেলে, এই সরু বা মোটা হওয়া যে সমীকরণ দিয়ে নির্ধারিত
রায়চৌধুরী সমীকরণ তেমনই এক সম্পর্ক। আসলে একে রায়চৌধুরী আইডেন্টিটি
(Identity) বলা উচিত, কারণ গাণিতিক দিক থেকে এই সম্পর্ক সব সময়েই সত্য।
অমল কুমার রায়চৌধুরী কসমোলজি (Cosmology) সম্পর্কিত গবেষণায়
রায়চৌধুরী সমীকরণ আবিষ্কার করেন। কসমোলজি হল মহাবিশ্বের উৎপত্তি এবং তার
বিবর্তন সংক্রান্ত গবেষণার বিষয় আর সেখানেই জেনেরাল রিলেটিভিটি অপরিহার্য।
১৯৬০-এর দশকের শেষ দিক থেকে জেনেরাল রিলেটিভিটি এবং কসমোলজি সংক্রান্ত
গবেষণায় রায়চৌধুরী সমীকরণ এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। খুব সহজ
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়ঃ রায়চৌধুরী সমীকরণ ব্যবহার করে দেখানো যায় যে
রোটেশন (Rotation) অর্থাৎ আবর্তন এর অনুপস্থিতিতে মহাকর্ষের আকর্ষণ বিভিন্ন
পদার্থের জিওডেসিক-কে কেন্দ্রীভূত করে থাকে। অর্থাৎ, সমস্ত বস্তু শেষ
পর্যন্ত একটি বিন্দুতে জমা হতে চায়। আসলে এর মধ্যে আশ্চর্যের কিছু নেই।
মহাকর্ষের নিয়মই হল সমস্ত পদার্থ একে অপরকে আকর্ষণ করে। সুতরাং তারা সকলেই
যে শেষ পর্যন্ত একটি বিন্দুতে মিলিত হবে এমনটাই স্বাভাবিক।
রায়চৌধুরী সমীকরণের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল রয়েছে। আমরা জানি যে এই
মহাবিশ্বের শুরু হয়েছে বিগ ব্যাং নামক এক বৃহত বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে।
ধরে নেওয়া যাক আমি কোন একটি বস্তুর সমগ্র জীবনের ইতিহাস জানতে চাই। তাহলে
আমাকে যেটা করতে হবে সেটা হলো চার মাত্রার জগতে বস্তুটা যে পথে চলেছে সেই
পথ ধরে সময়ে পেছন দিকে যেতে থাকতে হবে। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো- এই
পেছাতে পেছাতে যখন আমরা বিগ ব্যাং এর কাছাকাছি সময় গিয়ে পৌঁছাব তখন আর
বলতে পারব না এর আগে কী হয়েছিল। অর্থাৎ আমাদের জগতের যেকোন বস্তুর চলার
শুরু ঐ বিগ ব্যাং থেকেই, এর আগের কিছু জানা আমাদের জন্য সম্ভব নয়। যখনই
জগতের কোন এক জায়গায় আমরা এভাবে আটকে যাই আমরা বলি সেখানটায় একটা
সিঙ্গুলারিটি (Gravitational singularity)
আছে। প্রশ্ন হলো- জগত সৃষ্টি হওয়ার তত্ত্বে এই সিঙ্গুলারিটিকে কি কোনভাবে
এড়ানো সম্ভব? আইনস্টাইনের তত্ত্ব থেকে আমরা এমন কোন বিশ্বজগতের ধারণা কি
পেতে পারি যেখানে কোন সিঙ্গুলারিটি নেই। এই প্রশ্নের উত্তর সম্পর্কে প্রথম
ধারণা পাওয়া যায় রায়চৌধুরী সমীকরণ থেকে। সেখান থেকে এটা দেখানো যায় যে
আমাদের মহাবিশ্বে যেকোন দুটি বস্তুকণার চলার পথ ধরে সময়ে পেছন দিকে যেতে
থাকলে সেগুলো একটা জায়গায় গিয়ে জড়ো হতে চাইছে আর সেটাই বিগ ব্যাং। অমল
কুমার রায়চৌধুরীই প্রথম ধারণা দেন যে সিংগুলারিটি এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব
নয়। পরে ১৯৬০-৭০ এর দিকে স্টিফেন হকিং এবং রজার পেনরোজ রায়চৌধুরী
সমীকরণের উপর ভিত্তি করেই এ ব্যাপারটা গাণিতিকভাবে প্রতিষ্ঠা করেন।
একজন মেধাবী বিজ্ঞানী হবার পাশাপাশি অমল কুমার রায়চৌধুরী একজন
প্রাণবন্ত শিক্ষকও ছিলেন। মৃত্যুর মাত্র এক বছর আগে তাঁর শেষ গবেষণাপত্রটি
প্রকাশিত হয়। বই পড়তে ভালবাসতেন, ছিলেন রবীন্দ্রসংগীতের ভক্ত। রাজনীতি
নিয়ে আগ্রহ রাখতেন, প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ না করলেও বিভিন্ন প্রবন্ধে নিজের
রাজনৈতিক মতাদর্শের কথা উল্লেখ করেছেন। এইখানে উল্লেখ্য অমল কুমার
রায়চৌধুরী হচ্ছে একমাত্র বাঙ্গালী বিজ্ঞানী যিনি শুধুমাত্র ভারতীয়
উপমহাদেশের শিক্ষায় ব্রত ছিলেন। তাঁর শিক্ষায় ও গবেষণায় বহির্বিশ্বের
কোন সাহায্য বা অবদান ছিল না আথচ অমল রায়চৌধুরীই প্রথম ধারণা দেন যে
সিংগুলারিটি এড়িয়ে যাওয়া পদার্থ বিজ্ঞানের পক্ষে সম্ভব নয়। যার উপর
ভিত্তি করে হকিং – পেনরোজ বিগ ব্যাং-কে গাণিতিক ব্যাখ্যা প্রতিষ্ঠা করেন।
“বাংলার আইনস্টাইন : অমল কুমার রায় চৌধুরী”-শরীফ মাহমুদ ছিদ্দিকী-বইয়ের প্রচ্ছদ
আপেক্ষিকতাভিত্তিক সৃষ্টিতত্ত্ব’ (Relativistic Cosmology) -এ তিনি
মৌলিক অবদান রেখেছেন। সৃষ্টিতত্ত্বে তাঁর নামে একটি গানিতিক সমীকরনও
রয়েছে যা আজ ‘ রায় চৌধুরী সমীরকন’
(Raychudhury Equation) নামেই সুপরিচিত। এটি যে একজন পদার্থ বিজ্ঞনীর কত
বড় সাফল্য তা বিজ্ঞানের সমঝদার লোক মাত্রই বুঝবেন। একজন মানুষের কাজের
সাথে তাঁর নাম যখন যুক্ত হয়ে যায় তখন অনুধাবন করা যায় মানুষটি কোন মাপের
! আজ তাঁর মৃত্যু দিবসের দু-দিন পূর্বেই পরম শ্রদ্ধা ভরে তাঁকে স্মরণ
করছি। নিজেকে জানুন নিজেদের অর্জনকে জানুন ও গর্ব করুন…
কীর্তিমানের মৃত্যু নাই, আপনি বেঁচে থাকবেন কাজের মাঝে…
তথ্যসুত্রঃ
ক) উইকিপিডিয়াঃ অমল কুমার রায়চৌধুরী
খ) ওয়ার্ডপ্রেসঃ একটি (রায়চৌধুরী) সমীকরণ, একটি সাক্ষাৎকার
গ) মাইক্রোসফট এঙ্কারটা প্রিমিয়াম ২০০৯
ঘ) “বাংলার আইনস্টাইন : অমল কুমার রায় চৌধুরী”-শরীফ মাহমুদ ছিদ্দিকী।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শরীফ ভাই আর নোমান
ভাইয়ের কাছেই এই মহান বিজ্ঞানীর সম্পর্কে আমার জানা। তাঁদের অশেষ
ধন্যবাদ। মজার ব্যাপার উনারা দুজন যথাক্রমে পদার্থ বিজ্ঞান ও গনিতের লোক।
ফেসবুকে অমল কুমার রায়চৌধুরী কে নিয়ে একমাত্র গ্রুপ বিদ্যমান যা আমি খুলেছিলাম ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১২ তে।
তথ্যসূত্র
আরো পড়ুন
- Dadhich, Naresh (২০০৫)। “Amal Kumar Raychaudhuri (1923–2005)”। Current Science 89: 569–570।
- Narlikar, J. V. (জানুয়ারি ২০০৬)। “Amal Kumar Raychaudhuri”। Biographical Memoirs of Fellows of the Indian National Science Academy: 169।
- Sen, Parongama (এপ্রিল ২০০৮)। “The Legacy of Amal Kumar Raychaudhuri”। Biographical Memoirs of Fellows of the Indian National Science Academy: 309–309।