হযরত মুহাম্মদের সময়কালে নযর বিন হারেস নামের একজন আরবের বাইরে দূরদূরান্তের রাজা বাদশাহর গল্পগাঁথা, অনেকটা আমাদের দেশের পুঁথি পালাগানের মত সাহিত্য নিয়ে এসে পরিবেশনের ব্যবস্থা করতেন। সাধারণ মানুষ তো গান বাজনা শুনতেই বেশি আগ্রহী হবে সেটাই স্বাভাবিক। হযরত মুহাম্মদও লোকদের ডেকে তার কুরআনের কথা সুর করে করে লোকদের শোনাতেন। নযর বিন হারেস ব্যবসায়ী হওয়ার কারণে দেশ বিদেশ ঘুরে দূর দেশের রূপকথা কিংবদন্তির প্রচুর কাহিনী জানতেন। কুরআনের আ’দ সামুদ জাতির গল্পকে তিনি বস্তাপঁচা বাসি গল্প বলতেন এবং এরচেয়ে ঢের ভাল আকর্ষণীয় গল্প তার কাছে আছে বলতেন। হারেস আরেকটা কাজ করেছিলেন, তিনি দাবী করেছিলেন মুহাম্মদের কুরআনের গল্পগুলো আসলে পারস্যদের রূপকথা থেকে চুরি করা! (সিরাতুল মুসতাফা, মাওলানা ইদ্রীস কান্দালভী, প্রথম খণ্ড, পৃঃ ১৮৮)।
ঠিক এসব কারণে কোন মানুষকে কি হত্যা করা যায়? তিনি মুহাম্মদের কুরআনের সমালোচনা করেছিলেন। স্রেফ এ কারণে তাকে হত্যার কালো তালিকাভুক্ত করাকে পৃথিবীর কোন নৈতিকতার নিক্তিতে পরিমাপ করা যাবে কি?
হারেস যে ভালই ঝামেলায় ফেলেছিলেন প্রফেট মুহাম্মদকে সেটা হারেসকে নিয়ে কুরআনের সুরা নাযিল হওয়া থেকে বুঝা যায়। সে সময় আয়াত নাযিল হয়েছিল, ‘এক শ্রেণীর লোক এমনও আছে যারা বিভ্রান্তিকর চিত্তবিনোদনমূলক কিচ্ছা-কাহিনী কিনে আনে, যাতে করে তা দ্বারা না জেনে বুঝে মানুষকে বিপথগামী করতে পারে এবং তাদেরকে উপহাস করতে পারে।’ (সূরা লুকমানঃ ৬)।
কুরআনের এই সুরাটিকে পরবর্তীকালে গান বাজনা শিল্পকর্ম হারামের দলিল হিসেবে গ্রহণ করা হয়। লোকজন কবিগান আর গাইকাদের গানে মজে থাকলে, বিশেষত কাব্য সাহিত্যের রসে সঞ্চিত থাকলে ইসলাম ধর্ম প্রচারে বিঘ্ন ঘটবে। জিহাদ করে ইসলাম কায়েমের সুপ্ত বাসনা তাহলে কি করে মুহাম্মদ বাস্তবায়ন করবেন? এসময়ই মুহাম্মদ কবিদের এবং শিল্প সাহিত্যের প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ হয়ে পড়েছিলেন সেটা বুঝা যায়।
বদর যুদ্ধে হারেস ছিল কুরাইশদের পতাকাবাহী। তাকে আটক করা হয়েছিল। মুহাম্মদ কুরাইশদের কাছ থেকে মুক্তিপন আদায় করে তাদের সবাইকে ছেড়ে দিলেও হারেসকে হত্যা করার আদেশ দেন। মুহাম্মদের নির্দেশে শেরে খোদা হযরত আলী নযর বিন হারেসকে হত্যা করেন (সুনানে আবু দাউদ, সরহে আওনুল মাবুদ, ৩য় খন্ড পৃ. ১২)।
ইসলামের গান বাজনা শিল্প সাহিত্যের প্রতি বিরাগ, নারী পুরুষের একই মঞ্চে বসে গান, নৃত্য নিষিদ্ধের নেপথ্যে ইসলামের প্রাথমিক যুগের হারেসদের মত সংগীত প্রেমিদের গানবাজনার আসর আয়োজনই মূল হেতু তাতে কোন সন্দেহ নেই।
কুরআন আর হাদিস থেকে রেফারেন্স দেয়া হলো যেখানে স্পষ্ট ভাষায় সংগীত সাহিত্য শিল্পকে নিষদ্ধ করা হয়েছে। কুরআনের বনী ইসরাঈল সুরায় বলা আছে, ‘এবং তাদের মধ্যে যাদেরকে পার পর্যায়ক্রমে বোকা বানাও তোমার গলার স্বরের সাহায্যে…’ (সূরা বনী ইসরাঈল, ৬৪)।
এই আয়াত দ্বারা কি অর্থ বুঝানো হয়েছে তা ইবনে কাসিরের তাফসির থেকে জানা যায়। তিনি লিখেছেন, ‘যে কোন আওয়াজ, যা আল্লাহর অবাধ্যতার দিকে আহবান জানায়, তার সবই এই আয়াতে বর্ণিত আওয়াজের অন্তর্ভুক্ত (তফসীর ইবন কাসির, সুরা বনী ইসরাঈল)।
এছাড়া সুরা লোকমানে সরাসরি গান, কবিতা, সাহিত্য, শিল্পচর্চাকারীদের লাঞ্ছনা করা হবে বলে আল্লাহ হুংকার দিয়েছেন, ‘এবং মানুষের মাঝে এমন কিছু লোক আছে যারা আল্লাহর পথ থেকে (মানুষকে) বিচ্যুত করার জন্য কোন জ্ঞান ছাড়াই অনর্থক কথাকে ক্রয় করে, এবং একে ঠাট্টা হিসেবে গ্রহণ করে, এদের জন্য রয়েছে লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি’ (সূরা লোকমান, ৬)।
এ সম্পর্কে হাদিসে আরো আছে, রাসূলুল্লাহ(সা.) বলেছেন, ‘আমার উম্মাতের মধ্যে কিছু লোক হবে যারা ব্যভিচার, রেশমী বস্ত্র, মদ এবং বাদ্যযন্ত্রকে হালাল বলে জ্ঞান করবে’ (বুখারী)।
এ সম্পর্কে হাদিসে আরো আছে, রাসূলুল্লাহ(সা.) বলেছেন, ‘আমার উম্মাতের মধ্যে কিছু লোক হবে যারা ব্যভিচার, রেশমী বস্ত্র, মদ এবং বাদ্যযন্ত্রকে হালাল বলে জ্ঞান করবে’ (বুখারী)।
স্বয়ং নবী মুহাম্মদ শিল্পচর্চাতে রাগান্বিত হয়ে উঠতেন সেটা জানা যায় এই হাদিসটি থেকে। আয়িশা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জন্য প্রাণীর ছবিযুক্ত একটি বালিশ তৈরি করেছিলাম। যেন তা একটি ছোট গদী। এরপর তিনি আমার ঘরে এসে দু’দরজার মাঝখানে দাঁড়ালেন এবং তাঁর চেহারা বিবর্ণ হয়ে গেল। তখন আমি বললাম, ইয়া রাসুলাল্লাহ আমার কি অপরাধ হয়েছে? তিনি বললেন, এ বালিশটি কেন? আমি বললাম, এ বালিশটি আপনি এর উপর ঠেস দিয়ে বসতে পারেন আমি সে জন্য তৈরি করেছি। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, (‘হে আয়িশা) (রা) তুমি কি জান না? যে ঘরে প্রাণীর ছবি থাকে, সেখানে (রহমতের) ফিরিশতা প্রবেশ করেন না? আর যে ব্যক্তি প্রাণীর ছবি আঁকে তাকে কিয়ামতের দিন শাস্তি দেয়া হবে? তাকে (আল্লাহ্) বলবেন, ‘তুমি যে প্রাণীর ছবি বানিয়েছ, এখন তাকে প্রাণ দান কর।’ (সহী বুখারী, পঞ্চম খণ্ড, হাদিস নং ২৯৯৭ – ইসলামী ফাউন্ডেশন)।
এর নাম ইসলাম ধর্ম। আফগানিস্থানে এ কারণেই কামান দেগে বুদ্ধমূর্তিগুলো গুড়িয়ে দিয়েছিলো তালেবানরা। আইএস সিরিয়ার জাদুঘরে রক্ষিত প্রাচীন মূর্তি ও ভাস্কর্য ভেঙ্গে ফেলেছিলো। বাংলাদেশের মাদ্রাসার ছাত্ররা লালন ভাস্কর্য, বকের ভাস্কর্য, জাস্টিসিয়াসহ মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্যগুলোকে গুড়িয়ে দেয়…।
এবার বলেন, ইসলাম গান হারাম জানলে কি আপনারা আর গান শুনবেন না? নাকি পৃথিবীতে যারা গান গায় আর শোনে তাদের মেরে ফেলবেন না হলে জেলে ভরবেন? শরিয়ত বয়াতী ইসলামে গান হারাম মানলেও গান গাইতেন কারণ তার ভেতরে বাউল আছে। বিভ্রান্তের কিছু নেই। ইসলামে গান বাজনা মায় সংগীত হারাম। কুরআন হাদিস সব দিক দিয়েই হারাম। নযর বিন হারেস যখন তার সংগীতের আসর দিয়ে আরবদের মাত করত তখন মুহাম্মদ দেখলেন তার কুরআনের কথা শুনতে কেউ আসে না। উল্টো হারেস দাবী করেছিলো মুহাম্মদের কুরআনের গল্পগুলো তার বয়ে আনা দূর দেশের রূপকথা থেকে চুরি করা! ব্যস, হারেসই কেবল না, গোটা সংগীত জিনিসটার উপরই ক্ষিপ্ত হয়ে যান মুহাম্মদ।