‘মানব ধর্ম সূত্র’ এবং ‘মনু সংহিতা’
ডাঃ মৃনাল কান্তি দেবনাথ
(৪) চতুর্থ পরিচ্ছেদ
বেদ, ব্রাহ্মনসাহিত্য এবং ঊপনিষদ ইত্যাদি সুপ্রাচীন বৈদিক গ্রন্থে যে ‘মনু’ র উল্লেক দেখা যায়। তিনিই যে বর্তমান ‘মনু সংহিতা’ র রচয়িতা সেটা মেনে নেওয়া বা তার সমালোচনা করা যুক্তি যুক্ত নয়।
ইতিহাসের দিক দিয়ে বিচার করলে, হিন্দু ধর্মীয় বিশ্বাস জনিত আবেগ দূরে সরিয়ে রেখে নিরপেক্ষ দৃষ্টি দিয়ে বিচার করলে, এই ধারনা বদ্ধমুল হওয়াটাই স্বাভাবিক যে প্রাচীন কালে মানব সমাজে একটি অতি জ্ঞান সম্মৃদ্ধ ধর্ম শাস্ত্র প্রচলিত ছিলো যার নাম ছিলো ‘মানব ধর্ম সূত্র’। এই গ্রন্থের প্রনেতা বা সংকলক কে সে কথা আজ আর জানা বা বলা সম্ভব নয়। পন্ডিতেরা কিন্তু এই বিষয়ে প্রায় একমত যে, একটি সুপ্রাচীন ধর্ম শাস্ত্র যা আজ সম্পুর্ন বিলুপ্ত সেই ধর্ম শাস্ত্র এক সময় সমগ্র মানব জাতির আধ্যাত্মিক এবং আর্থ- সামাজিক জীবন নিয়ন্ত্রিত করতো। পরবর্তিতে সেই প্রাচীন ধর্ম শাস্ত্র কে অবলম্বন করে ‘মনু সংহিতা’ রচনা করা হয় এবং সেই রচয়িতা ‘সায়ম্ভুব মনু’। সায়ম্ভুব মনুর সৃষ্ট সংহিতা সংক্ষিপ্ত করে সংকলন করেন ভৃগু মুনি এবং তা প্রচার করেন দশ জন ঋষি যাদের কথা পরে বলা হচ্ছে।
আজ থেকে দেড়শো বছর আগে, এক খ্রীষ্টান ধর্ম যাজক, চার্লস ডারউইন বললেন যে গুহা বাসী মানুষের আবির্ভাব হলো বানর থেকে, বানর লেজ খসিয়ে মানুষ হলো। সেই বানরাকৃতি মানুষ (লেজ হীন ) গুহাতে বাস করলো, প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়ম অনুযায়ী বেচে থাকার সংগ্রাম (ধস্তাধস্তি—struggle for exhistance) করলো ( Theory of Evolution) এবং শক্তিধর গুলো বেচে রইলো আর দুর্বলেরা শেষ হয়ে গেলো (Natural selection)। মানুষ প্রাকৃতিক শক্তি গুলিকে ভয় পেয়ে এক কল্পিত ঈশ্বরকে সৃষ্টি করলো নিজেদের মনের ভয় থেকে, যার কাছে অভয় প্রার্থনা করতে পারে।
আধুনিক বৈজ্ঞানিক রা সেই মত কে এক আকাট্য তত্ব হিসাবে নিয়ে নিলেন এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে তৈরী হলো এক নাস্তিক শ্রেনী। এদের প্রাথমিক এবং সর্ব শ্রেষ্ট কাজ (বলুন ধর্ম ) হলো যারা প্রাচীন সনাতনী চিন্তা ধারা প্রসুত ধারনা এবং বিশ্বাস নিয়ে চলে তাদের বিনা দ্বিধায় অকথ্য গালিগালাজ করা এবং সেটা এক সম্মিলিত ব্যাবস্থায় (ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক দল তৈরী করে)।
পৃথিবীর এক প্রান্তে , যার নাম জম্বু দ্বীপ এবং ভারপ্ত খন্ড, সেখানে, সাধারন জীবন ধারনকারী, প্রকৃতির সংগে মিলে মিশে বাস করে এক শ্রেনীর সাধক ধ্যান মার্গে বিশ্বসৃষ্টি কর্তার সংগে যোগাযোগ স্থাপন করে (যোগ সাধনা ), বিশ্বে প্রবহমান জ্ঞান ভান্ডার থেকে জানলেন অন্য কথা। তারা বললেন, এই সৃষ্টিতে সমস্ত ধরনের জীব এবং জঙ্ঘমের প্রয়োজন জীবন ধারনের জন্য। তাই সৃষ্টী কর্তা সব কিছুকে আলাদা ভাবেই সৃষ্টি করেছেন। সেই সৃষ্টিতে মানুষই সর্বাধিক চৈতন্যের (consciousness) অধিকারী। সেই মানুষ নিজ বুদ্ধিবলে সমাজ সৃষ্টি করেছে এবং সেই সমাজের একটি সংবিধান রচনা করেছে। সেই সংবিধান মানুষের সার্বিক উন্নতির কথা বলে।
মানূষ এই পৃথিবীতে আসার পর পরই তাই তৈরী হয় এক “মানব ধর্ম সুত্র”, সে অনেক যুগ আগের কথা। সনাতনী জ্ঞান ভান্ডার কে তাই তিন ভাগে ভাগ করতে হবে——-
১) সুপ্রাচীণ কালের (সৃষ্টির আদি থেকে ১০০০০ বছর আগে অবধি)
২) বৈদিক যুগের (বিগত প্রায় ১০০০০ বছর থেকে ২৫০০ বছর)
৩) আধুনিক যুগের (২৫০০ বছর থেকে শুরু করে বর্তমান কাল অবধি)।
এই কালের শুরু আলেকজান্ডার ভারত আক্রমন করে ইরান ঈরাক এবং বর্তমান বালুচিস্থান থেকে শুরু করে উত্তর পশ্চিম ভারত এবং সিন্ধু নদের দুই তীর বর্তী এলাকায় যে ধংস লীলা চালিয়েছিলেন এবং তার পরবর্তি কালে ৭১২ সাল থেকে শুরু করে সতেরো শতাব্দী অবধি আরবী এবং তুর্কিরা যে সার্বিক ধংস এবং অন্য ধর্মমত চাপিয়েছে। এরও পরে ঈংরেজী শাসন কালে অতি চালাকি করে ম্যাকুলিয়ানরা এবং খ্রীষ্টান ধর্ম যাজকেরা যেভাবে সনাতনি চিন্তা ভাবনাকে বিকৃত করে হিন্দুদের কাছে তুলে দিয়েছে।
একেবারে হাল আমলে আর এক শ্রেনী, যারা রাশিয়া চীন থেকে সব কিছু ধার করে তাদের জীবন জীবিকা নির্বাহ করে এবং মানসিক, শারীরিক সুখ খুজে বেড়ায় তাদের নিরলস প্রচেষ্টা, আর সেই সংগে যুক্ত হয়েছে বিদেশী অর্থ পুষ্ট এক তথা কথিত বুদ্ধিজিবী, সাংবাদিক, লেখক শ্রেনী এবং রাজনীতি বিদেরা। সনাতনী চিন্তা ভাবনা এবং সেই চিন্তা ভাবনায় চলা মানুষ গুলোকে মানসিক আঘাত করে করে পঙ্গু করে দিয়ে তাদের মহা সর্বনাশ করেছে।
সুপ্রাচীন কালে ছিলো “মানব ধর্ম সুত্র”।
সেই সুত্র অবলম্বন করে বৈদিক কালে সায়ম্ভুব মনু তৈরী করেন এক গ্রন্থ ১০০০০০ শ্লোকের যার নাম “মনু সংহিতা”। ভৃগু মুনি সেই ১০০০০০ শ্লোক সংক্ষিপ্ত করে বৈদিক যুগে প্রচলন করেন “মনু সংহিতা”।
আধুনিক কালে, আরবী, তুর্কি, শক, হুনদের ক্রমাগত অত্যাচারে নষ্ট হয়ে যায় বৈদিক সভ্যতার প্রায় সমস্ত পীঠস্থান। গুরুকুল, শিক্ষাজগত তছ নছ হয়ে যাওয়ার পর, বলতে পারেন অনেকটা পেটের দ্বায়ে এক ব্রাহ্মন শ্রেনী শুরু করেন ভৃগু মুনি প্রচারিত ,বৈদিক সভ্যতার ধারক বাহক “মনু সংহিতা” তে, সমাজে নিজেদের প্রাধান্য বজায় রাখার জন্য নানা সুত্র প্রক্ষিপ্ত করা। আমরা আজ যাকে বলি ‘ব্রাহ্মন্য বাদ’ যা কিনা ‘পতিত ব্রাহ্মন’ দের দ্বারা তৈরি এক ‘বিকৃত বাদ’, সেই সমাজ বিধান এর জন্য প্রাচীন মুনি ঋষিদের এবং আরো অনেক জ্ঞানী জ্ঞুনী চিন্তাবিদ দের, আর্য্য সভ্যতা এবং সেই সংগে সমগ্র “বৈদিক সভ্যতা’ কে গাল পেড়ে কোনো লাভ নেই। সেটা সামগ্রিক ভাবে সত্যের অপলাপ।
গাল যদি পাড়তেই হয় তাহলে আগে পড়ুন আলেকজান্ডারের ২ বছরের “তান্ডব লীলা”, প্রায় ৮০০ বছরের আরবী/তুর্কিদের “সার্বিক ধংস লীলা”, ঈংরেজ আমলের সুচতুর “পরিবর্তন লীলা” এবং হাল আমলের সর্ব হারাদের সংগ্রামের নামে “ভাওতা লীলা” কে। তারপর ভাবুন কাকে গাল পাড়বেন।