দিনাজপুরে বিরল কলেজের শিক্ষিকার হিন্দু ছাত্রীদের কৌশলে গরুর মাংস খাইয়ে দেয়া বা পঞ্চগড়ের আওয়ামী লীগ নেতা হিন্দুদের গরুর মাংস খাওয়ানোর মধ্যে ইতিহাসের একটা ধারা আছে। উপমহাদেশের মুসলমানদের কাছে গরুর মাংস আর দশটা পশুর মাংস কখনই ছিলো না। আগে লেখা এই রচনাটি হয়ত সাম্প্রতিককালে উপরক্ত দুটি ঘটনাকে বুঝতে সহায়তা করবে।
খুলনার খান জাহান আলীর মাজার ও ষাট গম্বুজ মসজিদের কথা কে না জানে। প্রতি বছর খান জাহান আলীর ওরস পালিত হয় এবং লক্ষাধিক ধর্মপ্রাণ মুসলমান সেই ওরসে যোগদান করেন। খান জাহান আলী ১৪১৮ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা আক্রমণ করে এখানে ইসলাম প্রচার ও স্থানীয় প্রশাসক হিসেবে শাসন কার্য শুরু করেন। তাকে নিয়ে নানা রকম বীরত্বপূর্ণ কিংবদন্তি চালু খাকলেও প্রতারিত করে ধর্মান্তরিত করার ইতিহাস লোকচক্ষুর আড়ালেই রাখা হয়। অথচ অনেকখানি গুরুত্ব বহন করে এই ইতিহাস আমাদের সাম্প্রদায়িক সমাজকে বুঝতে ও জানতে।
মুঘল আমলে স্থানীয় হিন্দুরা সরকারী দপ্তরে নিজেদের স্থান পেতে মুসলিম আমলাদের সঙ্গে সখ্যতা করতে শুরু করে। এতে করে প্রশাসনে তাদের সুযোগও মিলে যায়। খান জাহান আলীর একজন হিন্দু কর্মচারী ছিলেন নাম গোবিন্দলাল রায়। একদিন রোজার দিন খান জাহান ফুলের ঘ্রাণ নিতেছিল, গোবিন্দলাল জানত মুসলিম শাস্ত্র অনুযায়ী ঘ্রাণে রোজা ভঙ্গ হবার কথা আছে। সেকথা খান জাহানকে মনে করিয়ে দিলে খান জাহান আলী বিব্রত হোন। পরে ঈদের দিন অতিথি আপ্যায়নের জন্য খান জাহান আলী গরুর মাংস পরিবেশ করলে গোবিন্দলাল নাকে রুমাল চেপে ধরেন। খান জাহান আলী তখন গোবিন্দলালকে ঘ্রাণে অর্ধভোজন স্মরণ করিয়ে দিয়ে তাকে ইসলাম গ্রহণের আহ্বান জানান। কুলিন ব্রাহ্মণ সমাজ গোবিন্দলালের গরুর মাংসের ঘ্রাণ নাকে যাবার কথা জানতে পেরে তাকে জাতিচ্যুত করে। গোবিন্দলালের আর কোন উপায় সনাতন হিন্দু সমাজ তখন আস্ত রাখেনি। অগত্যা মুসলিম মনিবের প্রতারণার কাছে নতি স্বীকার করে তিনি ইসলাম গ্রহণ করে নতুন নামধারণ করেন ‘আবু তাহের’। ( দেখুন: সেরা মুসলিম মনীষীদের জীবনকথা-১, নাসির হেলাল, সুহৃদ প্রকাশন,/ রবীন্দ্রনাথ ও ঠাকুর বাড়ীর ইতিকথা, সৈয়দা মকসুদা হালিম/ যশোহর খুলনার ইতিহাস. ১ম খন্ড ৩৩৩ পৃষ্ঠা, শ্রী সতীশ চন্দ্র মিত্র, /সুন্দরবনের ইতিহাস, ২য় খন্ড, ১১৮ পৃষ্ঠা-এ.এফ.এম. আবদুল জলীল)।
আবু তাহেরে মাধ্যমেই ইতিহাসের বিখ্যাত ‘পীরালি ব্রাহ্মণ’ বলতে আমরা যা বুঝি তার সূচনা হয়েছিল। গোবিন্দলাল ইসলাম গ্রহণ করে আবু তাহের হওয়ার পর অতি ধার্মীক ও নিষ্ঠাবাণ মুসলিম হওয়ায় খান জাহান আলী তাকে ‘পীর অলী’ বলে আখ্যা দেন যা কালক্রমে অপভ্রংশ হয়ে ‘পীরালি’ নামকরণ হয়ে উঠে। এদের সূত্রেই ‘পীরালি ব্রাহ্মণ’ হয়ে উঠে সমাজচ্যুত অভিশপ্ত এক সম্প্রদায়। বংশের কেউ গোবিন্দলালের মত মুসলিম হলে তার দায়ে বাকীদেরও একইভাবে সমাজচ্যুত করে ছাড়ত কুলিণ ব্রাহ্মণ সমাজ। ব্রাহ্মণদের এই সমাজচ্যুতের ঠেলায় বাংলায় ব্রাহ্মণ ক্ষৈত্রিয় শূন্য হয়ে যাবার প্রমাণ মধ্যযুগের কবিতায় পাওয়া যায়। যেমন-পীরাল্যা গ্রামেতে বৈসে যবেত যবন।/উচ্ছন্ন করিল নবদ্বীপের ব্রাহ্মণ।।/ব্রাহ্মণ জবনে বাদ যুগে যুগে আছে।/বিষম পীরাল্যা গ্রাম নবদ্বীপের কাছে।।“।( দেখুন: সেরা মুসলিম মনীষীদের জীবনকথা-১, নাসির হেলাল, সুহৃদ প্রকাশন)।
নওমুসলিম আবু তাহের স্বজাতির এই পাষান্ড আচরণে ক্ষুব্ধ ছিলেন। উপরন্তু ইসলাম গ্রহণ করায় তাকে খান জাহান আলী বিপুল ধনসম্পদের মালিক বানিয়ে দেন। তার নামে কয়েকটি জাইগির পাইয়ে দেন। গুরুর দেখনো পথে তিনিও হিন্দু কলিণ পরিবারগুলোকে প্রতারণা করে জোরপূর্বক ইসলাম গ্রহণের চেষ্টা করেন এবং সফল হতে থাকেন। কামদেব ও জয়দেব নামের দুই ভাই আবু তাহরের দপ্তরে চাকরি করতেন। এই দুই ভাই ছিল আবু তাহেরের বিশেষ নেক নজরে। পরবর্তীতে এই দুইভাইকে গরুর মাংসের ঘ্রাণ দিয়ে ‘জাত মেরে’ বাইরে সেটা প্রচার করে সনাতন হিন্দু সমাজের কাছে তাদের জাতিচ্যুতির প্রমাণ দেখান। তৎক্ষণাৎ হিন্দু সমাজ কামদেব ও জয়দেবসহ তাদের আরো দুই ভাইকে সমাজচ্যুত করে। অন্য দুইভাই কোন ‘অপরাধ’ না করেও একই ফল লাভ করে। কামদেব ও জয়দেব ইসলাম গ্রহণ করে যথাক্রমে কামালউদ্দিন খানচৌধুরী ও জামালউদ্দিন খানচৌধুরী নামধারণ করেন। তাদের অপর দুইভাই হিন্দু থেকে যাবার পরও ‘পীরালি ব্রাহ্মণ’ হিসেবে চিহিৃত হয়ে একঘরে হয়ে যান। তাদের ছেলেমেয়েদের বিয়ে দেয়াই কঠিন হয়ে পড়ে। দেখা গেছে এই কঠিন অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে পরবর্তীকালে অনেকে স্বেচ্ছায় ইসলাম গ্রহণ করেছিল। খান জাহান আলী বা আবু তাহেরের মত নওমসুলিমরা নব মুসলিমকে প্রচুর ধনসম্পদসহ শাসনকার্যেও স্থান দিয়ে সামাজিকভাবে উচু তলায় তাদের তুলে দিতেন। বাংলায় সুফিদের হাতে ধর্মান্তকরণের এই হচ্ছে একটি দগদগে চিত্র।
ইতিহাসে বাংলার এই সময় যে ধর্মান্তরিত করার রাজনৈতিক ও ধর্মীয় হিংসার সূচনা হয়েছিল তা থেকে রক্ষা করতে আমরা তাই দেখতে পাই বৈষ্ণব ধর্মের প্রবক্তা শ্রীচৈতন্যদেবে আগমণ ঘটে। হিন্দু ধর্মের সংস্কার ঘটিয়ে তিনি এইসব ‘জাতিচ্যুত পীরালি ব্রাহ্মণ ও ক্ষৈত্রিয়সহ অন্যান্য হিন্দুদের রক্ষা করেছিলেন।(দেখুন: খুলনা জেলায় ইসলাম, ৬৯ পৃ.-মুহাম্মদ আবূ তালিব)।
ব্রাহ্মণ সমাজ নৃশংস ছিল বলেই খান জাহান আলী মত দস্যুরা তার সুযোগ নিয়েছিলেন মাত্র। খান জাহান আলীদের যে প্রক্রিয়ায় ধর্মান্তরিত করে গোবিন্দলাল থেকে আবু তাহেরে রূপান্তরিত করেছিলেন তাতে নবদিখ্যিত মুসলিমদের মধ্যে ছিল তাদের পরিত্যাগ করে আসা ধর্ম ও সমাজ সম্পর্কে ক্ষোভ, প্রতিশোধ আর জাতিচেতনা। যে কারণে আমরা দেখতে পাই আবু তাহের একইভাবে অন্যান্য বর্ণহিন্দুদের চালাকি করে তাদের ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করেন। সঙ্গে বৈষিক লোভ দেখিয়ে তাদের বশে আনে। এতে করে বাংলায় হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে মুঘল আমলেই যে একটা অসহিষ্ণু সম্পর্ক ও শত্রুতার সম্পর্ক গড়ে উঠে সেটা সহজেই অনুমেয়। আবু তাহের দেশীয় বাঙালী হিন্দু হলেও তার উত্তরসূরীরা এইসব হিংসার কারণে নিজেদের খান জাহান আলীদের মত আফগান কিংবা তূর্কী পুরুষদের বংশধর বলে নিজেদের বিশ্বাস করত। মাওলানা আকরাম খাঁ ছিলেন ‘পীরালী’ মুসলিম’। তার পূর্বপুরুষ এইভাবে ব্রাহ্মণ থেকে মুসলিম হয়েছিলেন। আশ্চর্য যে আকরাম খানদের বংশধররা নিজেদের বাঙালী বলে স্বীকার করতেন না! নিজেদের মনে করতেন বহিরাগত! এর ভয়ংকর ও লজ্জাজনক চিত্র আমরা দেখতে পাই ইংরেজ আমলে। যখন গোটা ভারতবর্ষে অসহযোগ আন্দোলন চলছে তখন ভারতীয় সাধারণ মুসলিমরা এসব থেকে বিচ্ছিন্ন। উল্টো তুরষ্কের খেলাফত রক্ষা করতে তারা ‘খিলাফত’ আন্দোলন শুরু করেছিল। কোথায় স্বদেশের মুক্তির জন্য অসহযোগ আন্দোলন, কোথায় স্বদেশী আন্দোলন আর কোথায় তুরষ্কের খলিফার সিংহাসন রক্ষার জন্য আন্দোলন! এই শূন্যতা, এই অন্তঃসারশূন্য ভাবাবেগ যে ধর্মান্তরিত মুসলিমদের চিন্তা জগতকে আচ্ছান্ন করে রেখেছে তার দায় যেমন খান জাহান আলীদের মত জিহাদী দস্যুদের তেমনি নৃশংস ব্রাহ্মণ সমাজের। কোন কোন ক্ষেত্রে তাদেরই দায়টা বেশি।