বেদ ও মাতৃভূমি: যা মাতৃভূমির প্রতি কল্যাণের,সত্যের পথের, থাকার আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করে।

বেদ ও মাতৃভূমি: পৃথিবীতে বেদই বোধহয় একমাত্র ধর্মগ্রন্থ যেখানে মাতৃভূমির প্রতি কল্যাণের পথে, সত্যের পথের, থাকার আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করে একটি বৃহৎ অধ্যায়ই আছে। আমরা সনাতন ধর্মাবলম্বীরা পৃথিবীর যে দেশেই থাকিনা কেন,  আমরা আমাদের দেশকে ভালবাসি; মাতৃভূমিকে ভালবাসি।তাইতো বেদমন্ত্রে বলা আছে :

       ভূমে মাতর্নি ধেহি মা ভদ্রয়া সুপ্রতিষ্ঠিতম।
       সংবিদানা দিবা কবে শ্রিয়াং মা ধেহি ভূত্যাম।
                  ( অথর্ববেদ : দ্বাদশ কাণ্ড, প্রথম অনুবাক)

হে মাতৃভূমি, তুমি আমায় কল্যাণের পথে সদা সুপ্রতিষ্ঠিত কর। হে জ্ঞানস্বরূপা কাব্যময়ী মাতৃভূমি, তুমি দিনের আলোর ন্যায় আমায় উদ্ভাসিত করে সদা শ্রীযুক্ত এবং পশু-পাখি, মানব সহ পৃথিবীর সকল ভূতজগতের সাথে সদা যুক্ত রেখ।

অথর্ববেদের ৬৩ টি মন্ত্রের এই অনুবাকে প্রত্যেকটি মন্ত্রের প্রত্যেকটি শব্দে শব্দে মাতৃভূমির প্রতি একবুক ভালবাসার ফল্গুধারা উৎসারিত হয়েছে। আমরা দেশদ্রোহী নই।

তাইতো ১৯৭১ সালে একবুক রক্তস্নানের পরেও শুধুমাত্র হিন্দু সম্প্রদায়ের থেকেই কোন দেশদ্রোহী রাজাকারদের জন্ম হয়নি। অন্যান্য সম্প্রদায়ের সাধারণ মানুষ থেকে  ধর্মীয় নেতাদের একটা অংশ  দেশদ্রোহের সাথে সরাসরি যুক্ত ছিল।

গোলাম আজম,  নিজামী, মুজাহিদ, সাইদির কথা আর কি বলবো! বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ধর্মীয় নেতা কমলাপুর বৌদ্ধবিহারের সংঘনায়ক বিশুদ্ধানন্দ মহাথেরও সরাসরি ৭১ সালে পাকিস্তানীদের পক্ষে ছিলেন।

পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী বৌদ্ধদের সর্বোচ্চ নেতা চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় চৌধুরীও ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের পক্ষে সকল কর্মকাণ্ড করে আমৃত্যু পাকিস্তানে থেকে বছর কয়েক আগে পাকিস্তানেই মারা গিয়েছেন। ( এই বিষয়ে বিস্তারিত জানার জন্যে পড়তে পারেন অধ্যাপক আহমদ শরীফ সম্পাদিত -‘একাত্তুরের ঘাতক দালালরা কে কোথায়?’ এ বইটি)

খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের কথা আর কি বলবো! তাদের পাদ্রিদের  একটা অংশ পাকিস্তানীদের হয়ে কাজ করেছে ১৯৭১ সালে।

বরিশাল, খুলনাসহ দক্ষিণাঞ্চলের বহু হিন্দুকে তারা সেই সময়ে সুযোগে ধর্মান্তরিত করেছে। খ্রিস্টান পাদ্রিদের সেই অংশটা তখন বলে বেড়াতো, 

পাকিস্তান সরকারের পক্ষে যেহেতু  আমেরিকা আছে, তাই  পাকিস্তানি সৈন্যরা আমাদেরই লোক; তোমরা হিন্দুরা যদি খ্রিস্টান হও তবে পাকিস্তানি সৈন্যরা তোমাদের একচুলও ক্ষতি করবে না।

আমার মামাবাড়ি বরিশালের বহু আত্মীয় স্বজনেরা পাদ্রিদের এই ধর্মান্ধতার শিকার হয়েছিলেন,  যার অসংখ্য তথ্য প্রমাণ আমাদের কাছেই আছে।

আমার মনে হয় ১৯৭১ সালের মানুষের বিপদের দিনে অসহায় মানুষদের সুযোগে ধর্মান্তরকরণ নিয়ে একটা পরিপূর্ণ গবেষণা হওয়া প্রয়োজন ; কারণ এই বিষয়টা আমাদের ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের  ইতিহাসের একটা অংশ। আমি ঠিক জানি না এ বিষয়ে কোন গবেষণা হয়েছে কিনা?

১০০% রাজাকার মুক্ত আমরা হিন্দু সম্প্রদায়ের এই আমাদেরই  ৭১ এ লক্ষ লক্ষ মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছিলো, অসংখ্য মা-বোনের সম্ভ্রমহানি হয়েছিলো এবং  লক্ষ লক্ষ মানুষকে ঘর-বাড়ি ছেড়ে শরণার্থী হয়ে ভারতে আশ্রয় নিতে হয়েছিলো। যাদের অনেকেই শেষ পর্যন্ত  আর দেশে ফেরেননি বা ফিরতে পারেনি ।

একবুক রক্ত দিয়ে এদেশের স্বাধীনতার লাল- সূর্যের পতাকা  আনার পরেও যদি এই ২০২০-২১ সালে এসেও আমাদের আবার শরণার্থী হতে হয়; তবে এর থেকে লজ্জার আর কিছুই নেই। মুক্তিযুদ্ধে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সংগ্রাম করেও আজ  হিন্দু সম্প্রদায়কে দেশছাড়া হতে হচ্ছে।

ধর্মনিরপেক্ষতার দাবিদার  সরকারের আমলেও প্রতিনিয়তই  নিরুদ্দেশ হচ্ছে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষেরা।

পরিস্থিতি এমনই যে- আগামী দু’তিন দশক পরে এদেশে হিন্দু ধর্মাবলম্বী কোনও মানুষ আর খুঁজে পাওয়া যাবে না ‘বাংলাদেশে কৃষি-ভূমি-জলা সংস্কারের রাজনৈতিক অর্থনীতি’ সংক্রান্ত গবেষণা রিপোর্টে এমনই উদ্বিগ্নজনক তথ্য উঠে এল৷

গবেষণাটি করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সর্বজন শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক আবুল বারকাত৷ তার দাবি, বিলুপ্ত হতে চলেছেন বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের
মানুষেরা।

অধ্যাপক আবুল বারকাতের দাবি, ১৯৬৪ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত মোট ১ কোটি ১৩ লক্ষ হিন্দু ধর্মাবলম্বী দেশত্যাগ করেছেন বা বাধ্য হয়েছেন। পাঁচ দশকের এই হিসেব ধরলে প্রতিবছর গড়ে ২ লক্ষ ৩০ হাজার ৬১২ জন হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষ নিরুদ্দিষ্ট বা দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছেন। সেই হিসেবে প্রতিদিন দেশ ছেড়েছেন গড়ে ৬৩২ জন হিন্দু৷

তবে একবুক রক্তে স্নান করে কি পেলাম আমরা! আজ আমরা প্রতিনিয়ত দেশত্যাগের হুমকি পাচ্ছি। মন্দিরের পুরোহিত, ব্যবসায়ী, চাকুরীজীবী সহ বিভিন্ন পেশার সংখালঘুদের প্রতিনিয়ত দেশত্যাগ অথবা ধর্মত্যাগের হুমকি দিয়ে চিঠি দেয়া হচ্ছে।

সারাদেশে শহরের সাথে প্রত্যন্ত এলাকার হিন্দুদের মাঝে দেশত্যাগের আতংক বিরাজ করছে। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলবাসী বহু মানুষের মাঝে দেশত্যাগের প্রস্তুতি চলছে বলে শোনা যাচ্ছে । সবার মনেই একটি প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে- আমরা শেষপর্যন্ত এদেশে থাকতে পারবো তো?

আমরা বলছি – হ্যা পারবো, অবশ্যই পারবো।  কারণ এ লড়াই বাচার লড়াই,তাই এই লড়াইয়ে আমাদের জিততেই হবে।

চোরের উপরে রাগ করে তো আমরা মাটিতে ভাত খেতে পারিনা! এর জন্যে আমাদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে অস্তিত্বের সংগ্রামে যুক্ত হতে হবে এবং এর সাথে যুগপৎ  রাষ্ট্র ও রাষ্টযন্ত্রেকেও আরো সক্রিয়ভাবে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পাশে দাড়িয়ে তাদের আত্মবিশ্বাসী করে তুলতে  হবে;

তবেই এই অমানিশার অন্ধকার কেটে গিয়ে নতুন অহনাকালে এক নতুন সূর্যোদয় হবে।এবং সেই নতুন  সূর্যোদয়ের দিনে এদেশ শুধুমাত্র মুখে নয়, সত্যি সত্যিই ৭১ এর অসাম্প্রদায়িক  চেতনায় ফিরতে পারবে। আমরা তাই একবুক আশা এবং স্বপ্নাতুর চোখে তাকিয়ে আছি সেই দিনেরই প্রতিক্ষায়।

জয় বাংলা!
জয় হোক বাংলার লাঞ্ছিত, নিপীড়িত, অসহায় মানুষের।

লেখক- শ্রীকুশল বরণ চক্রবর্ত্তী

আরো পড়ুন……….