বেদে কি গো হত্যা নিষিদ্ধ

বেদে কি গো হত্যা নিষিদ্ধ, বেদে কি গোমাংস খাওয়ার কথা আসলে আছে?

বেদে কি গো হত্যা নিষিদ্ধ, বেদে কি গোমাংস খাওয়ার কথা আসলে আছে? হিন্দুরা গো মাংস ভক্ষণ করে না কেন? প্রথমেই বলি কে কার বাড়িতে কি খাবার খাবে সেই বিষয় নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই, যে যার ঘরে যা কিছু খাক তাতে আমার কিছু যায় আসেনা। যেমনটি সৃজিত বাবু তাঁর মুসলিম শ্বশুর বাড়ি গিয়ে গরু খেয়ে আপ্লুত হয়ে ফেসবুকে পোস্ট করেছেন তাতে আমার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই,

সমস্যাটা হল অপদার্থ সৃজিত নিজের গরু খাবার ব্যাপারটাকে যুক্তি যুক্ত দেখাবার জন্য একদম বেদের রেফারেন্স টেনে দিয়েছে তাতেই এই ব্যাপারে আমার আগ্রহ জন্মেছে কারণ সৃজিতের এইপ্রকার অপদার্থ মার্কা মিথ্যাচারের প্রতিবাদ না করলে অনেকেই বেদে গোমাংস ভক্ষণ নিয়ে ভুল বুঝতে পারে তাই এই লেখার অবতারণা। আসলে কি জানেন বেদকে সাক্ষী রেখে কেবল আজকে নয় প্রাচীন যুগ থেকেই স্বার্থান্বেষী মানুষরা নিজেদের মতো করে নিজেদের উদ্দেশ্য ও স্বার্থ সিদ্ধি করে এসেছে, নিজেদের অবৈদিক ও অসামাজিক কর্মকাণ্ডকে সামাজিক ভাবে প্রতিষ্ঠা দেবার চেষ্টা করে এসেছে।আসুন আলোচনা শুরু করি।

প্রথমেই আমাদের জেনে রাখা উচিৎ যে বৈদিক ঋষিরা গোখাদক ছিলেন না, বেদে অশ্ব বা গো হত্যার কথা কোথাও নেই। বেদ বুঝতে হলে যেমন অনুশীলন, স্বাধ্যায়ের প্রয়োজন হয়, তেমনি মহর্ষি পাণিনির ব্যাকরণ, মহামুনি যাস্কের নিরুক্ত, নিঘন্টু ও ব্রাহ্মণ গ্রন্থগুলি গুরুজনদের কাছে পড়তে হয়, নাহলে বৈদিক শব্দের মর্ম বোঝা যায় না। পাশ্চাত্ত্য পন্ডিতরা, ছাগল নায়করা বা সৃজিত বাবুদের মত লোকরা যখন ভারতীয় সংস্কৃতি কে হেয় করার জন্য সায়ণ, মহীধর, উবটের বিকৃত বেদব্যাখ্যার আশ্রয় নেন, তখন বুঝতে হবে তারা যতই পণ্ডিত হোকনা কেন তাদের উদ্দেশ্য অসৎ।

এটা ভারতবর্ষ এখানে গো কে সভ্যতার অন্যতম সম্পদ হিসাবে মান্য করা হয়, তার প্রতিদানের জন্য মানুষরা গো’কে ভগবতী জ্ঞানে পূজা করেন, যুগযুগের এই সংস্কারকে যারা বিদ্রূপ বা বিকৃত করে তারা আমাদের চোখে ম্লেচ্ছ, যবন ছাড়া আর কিছুই না।

প্রাচীনকালে আমাদের দেশে অশ্বমেধ, গোমেধ যজ্ঞ করা হত। তাই বিকৃতকামী পাশ্চাত্ত্য পণ্ডিত এবং তাদের উচ্ছিষ্টভোজী সৃজিত বাবুরা মনে করেন যে, ঐসব যজ্ঞকালে যথেচ্ছভাবে অশ্বহত্যা ও গোহত্যা করা হত। এই অপদার্থদের যদি জিজ্ঞসা করা হয়, আমাদের শাস্ত্রে তো পিতৃযজ্ঞ ও অতিথি যজ্ঞের উল্লেখ আছে তাহলে কি বুঝতে হবে ঐ সব যজ্ঞে মাবাপ এবং অতিথিবর্গকে হত্যা করা হত?
নিঘন্টুতে যজ্ঞের একটা প্রতিশব্দ হচ্ছে অধ্বর(৩/১৭) অধ্বর শব্দের নিরুক্তি করতে গিয়ে যাস্ক লিখেছেন ” অধ্বর ইতি যজ্ঞানাম্।ধ্বরতি হিংসাকর্মা, তৎপ্রতিষেধ, তৎপ্রতিষে।

১/৮ এর অর্থ হল, অধ্বর শব্দটি দুটিভাগ,, অধ্বর। “অ” এর অর্থ নিষেধ, “ধ্বর ” এর অর্থ হিংসা করা।কাজেই অধ্বর শব্দের অর্থ হল হিংসা না করা।কাজেই যজ্ঞ শব্দের সার্থক প্রতিশব্দ “অধ্বর” ব্যবহার করে যজ্ঞকালে প্রাণী হত্যা বা যে কোন রকমের হিংসা যে নিষিদ্ধ তা বৈদিক ঋষিরা স্পষ্ট করে দিয়েছেন।তাছাড়া যজুর্বেদ ১৩/৪২ নং মন্ত্রে উল্লেখ আছে “অশ্বং না হিংসীঃ”। কাজই অশ্বমেধ যজ্ঞ মানে যে অশ্ব বধ নয় তা প্রমাণিত হল, আসলে অশ্বমেধ হল রাজশক্তি সূচক, রাজা তার রাজ্য বিস্তারের নিমিত্তে একটি অশ্বকে সৈন সমেত প্রেরণ করতেন অন্য রাজ বিজয়ের উদ্দেশ্যে। এখন দেখাযাক ঋষিরা গরু খেতেন কিনা, সেই নিয়ে বিচার করা যাক্।

নিঘুন্টু অনুসারে ‘গো’ শব্দের প্রতিশব্দ যা পাওয়াযায়,,অঘ্ন্যা,অদিতি,উস্ত্রা,উস্ত্রিয়া,মহী,জগতি ইত্যাদি(২/১১), এইবার অদিতি শব্দের মানে দেখা যাক,,,নদ্যতি অখণ্ডনীয়, অর্থাৎ যার অঙ্গ ছেদন অনুচিত। অ+দিতি অখণ্ডনীয়া।”গো” শব্দের প্রতিশব্দ হিসাবে অদিতি শব্দের প্রয়োগ মনে রেখে এবার যজুর্বেদের দুটি মন্ত্র দেখা যাক।

 

“গাং মা হিংসীরদিতিং বিরাজম্।১৩/৪৩ মানে, গরু অদিতি, তা বধের অযোগ্যা, তাকে হিংসা কোর না। আবার, ঘৃতং দুহানামদিতিং জনায়াগ্নে মা হিংসী পর মে ব্যোমন্।১৩/৪৬ মানে মানুষকে যে ঘৃতদান করে তার নাম অদিতি, কাজেই তাকে হিংসা কোরো না। আবার নিরুক্ত ২/৫ গো শব্দের অর্থ পাওয়া যায় প্রত্যক্ষ ভাবে, অর্থাৎ বেদে গো শব্দটি গরুর একদেশ অর্থাৎ দুধ সম্মন্ধে প্রযুক্ত, যাস্ক গোভিঃ শ্রীণীতমৎসরম মন্ত্রভাগ উপস্থিত করেছেন, যার মানে, গো অর্থাৎ দুধের সঙ্গে সোম পাক কর।এইটা আয়ুধ সূচক, এবার যদি কোনো বিকৃতকামী গরুর মাংসের সঙ্গে মদ রান্না বোঝায় তাহলে, বুঝে দেখুন।

অপদার্থরা ঋগ্বেদের ১০/৮৫/১৩ মন্ত্র, সূর্যায়া বহতুঃ প্রাগাৎ সবিতা যমবাসৃজৎ।অঘাসু হন্যতে গাবো অর্জুন্যোঃ পর্যু্যহ্যতে।এই মন্ত্রে হন্যতে দেখেই পাশ্চাত্ত্য পণ্ডিত এবং তাদের উচ্ছিষ্টভোজী চামচারা প্রমাণ করতে চায় যে বৈদিক দেবতারা গুষ্টিসুদ্ধ মিলিত ভাবে গরু খেতেন।।

 

বাস্তবে এই মন্ত্রের দেবতা সূর্য এটি সূর্যসুক্তের অন্তরগত মন্ত্র এখানে সূর্য, পৃথিবী প্রভৃতির আকর্ষণ বিকর্ষণ এবং নানা বৈজ্ঞানিক তথ্য মানুষের সামাজিক, বিবাহদি প্রথার কর্তব্যের ব্যাপারে উল্লেখ আছে।আর “হন” ধাতু কেবল বৈদিক অর্থে বোঝায় না, হন্ ধাতু অর্থ গতি(নিঘন্টু২/১৪) জ্ঞান, গমন,চালনা করা, তাড়না করা,প্রেরণা দান প্রভৃতিও বুঝায়।‘অঘাসু হন্যতে গাবঃ এই মন্ত্র উচ্চারণের সঙ্গে আমার পাশ্চাত্ত্য পণ্ডিতদের উচ্ছিষ্টভোজী সৃজিতবাবুদের কথা মনে আসে, যারা বৈদিক বিবাহে গরুর মাংস খাবার প্রথার উল্লেখ করে অপদার্থের মত।

বেদে কি গোমাংস খাওয়ার কথা আসলে আছে
বেদে কি গোমাংস খাওয়ার কথা আসলে আছে

অঘাসু হন্যতে গাবঃ কথাটার লৌকিক সরল অর্থ হল, বৈদিক যুগে গরুই ছিল আর্যদের প্রধান সম্পদ, বিবাহাদিতে যৌতুক হিসাবে গরুই দান করা হত। মঘা নক্ষত্রে সূর্যের কিরণ মন্দীভূত হয়, কাজেই কন্যার পিতৃপ্রদত্ত গবাদি পশু ঐ সময়েই বরের গৃহে তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হত আর অর্জুন্যো পর্য্যুহ্যতে মানে ফাল্গুনী নক্ষত্রে কন্যা স্বামী গৃহে যাত্রা করতেন।

 

আশা করি বুঝতে পারছেন গোঘ্নঃ শব্দেরটিও গোহত্যা না, অঘ্ন শব্দের অর্থই ন হন্তব্য, যা নিধনের যোগ্য নয়। যাস্ক অঘ্ন্যা শব্দের অর্থ কেরছেন, অঘ্ন্যা অহন্তবা (নিরুক্ত)।কাজেই গো শব্দের সঙ্গে অঘ্ন্য যুক্ত আছে বলেই বরং গোহত্যার কথা স্বপ্নেও কল্পনায় আনা উচিৎ নয়।

এবার দেখুন মাতা রুদ্রাণাং বসূনাং স্বমাদিত্যনামমৃ তস্য নাভিঃ প্র নু বোচং চিকিতুষে জনায়,মা গামনাগামদিতিং বধিষ্ট।( ঋ ৮/১০১/১৫) এর অর্থ হল গরু হল বসু, রুদ্র আদিত্যদের কন্যা, মা ও ভগিনীর সমান।গরু দুধ অমৃত দান করে।সকলে জেনে রাখ গরু,,যার অদিতি,তাকে বধ করো না।মা বধিষ্ট। এইবার ভাবুন বৈদিক যুগে সমাজ গোমাংসভোজী ছিল, এটা যারা প্রচার করে তারা কতখানি গর্দভ অপদার্থ পাষণ্ড। এর সঙ্গে বেদের শাসনবাক্য শুনুন অন্তকায় গোঘাতম। (গোঘাতকের দণ্ড বিধান যজু ৩০/১৮) আরে তে গোদনমুত পুরষঘ্নম।(গোহত্যাকারী ও নরহত্যাকারী দূর হও।।ঋ ১/১১৪/১০ আরেকটা কথা প্রাচীন ভারতে গো হত্যাকারীদের পশ্চাৎপটে ধাতব দণ্ড গুঁজে দেবার ব্যবস্থা ছিল।

 

আশাকরি বেদের গোহত্যার মিথ্যা প্রোপাগাণ্ডার ব্যাপারে আপনাদের বোঝাতে পেরেছি এইবার আসুন কিভাবে ভারতীয় উপমহাদেশে গোমাংসের ভক্ষণে প্রচলন হল তা নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক। ভারতে মুসলিম বিজয় একদিনে হয়নি আরব ও তুর্কিদের ভারত বিজয় করতে মোটামুটি ৩০০ বছর সময় লেগে ছিল যেটা মহম্মদ বীন কাসেমের সময় থেকে বখতিয়ার খিলজির আমলের হিসাব নিলেই পাওয়া যায়।

গো মাংস ভক্ষণ কিন্তু আরব বা তুর্কিদের হাত দিয়ে ভারতে আসেনি কারণ আপনি এখনো দেখতে পারবেন মধ্যপ্রাচ্যে গোমাংস ভক্ষণের রেওয়াজ আজও তেমন নেই যতবেশি ভারতীয় উপমাহাদেশে আছে৷ আসলে মুসলিম আক্রমণের বহু আগের থেকে বৌদ্ধরা যথেচ্ছভাবে গরু খেতেন তবে তখন হত্যা করে নয়,তখন তারা মৃত গরুর মাংস খেতেন, আমার কথা বিশ্বাস না হলে আপনি বৌদ্ধ দেশ ভূটানের ব্যাপারে একটু খবর নিন।

হিন্দু ধর্ম ও গোমাংস
হিন্দু ধর্ম ও গোমাংস

যাইহোক মুসলিমরা ভারতীয় উপমহাদেশে প্রবেশ কর পশ্চিম দিক থেকে মূলত আফগানিস্তানের দিক থেকে যা সেইসময় ছিল বৌদ্ধ জনপদ মুসলিমরা ব্যপক ভাবে তাদের ধর্মান্তরিত করে বৌদ্ধ থেকে নব্য মুসলিমদের কাছ থেকেই জানতে পারল হিন্দুদের গো-অনুভূতির ব্যাপারে তারপরের ইতিহাসে দেখা যায় যে কেবল গোমাংসের ভয়ের সাহায্যেই মুসলিমরা হাজারো হাজারো হিন্দুদের মুসলিম বানিয়েছে এইভাবেই উপমাহাদেশে হিন্দু বিরোধী একটি অস্ত্র হিসাবে গোমাংস ব্যাপক ভাবে প্রতিষ্ঠা পায় যা সরাসরি হিন্দু অনুভূতিকে আঘাত করে সক্ষম, যে অস্ত্র আজও হিন্দু ফোবিকরা সাধারণ হিন্দুদের আঘাত করতে সবসময় ব্যবহার করে থাকে।

শেষে বলি গরু মাংস খেলে মারাত্মক ভাবে উন্মাদনা বৃদ্ধি পায় কারণ গোমাংস মস্তিষ্কে বেশিমাত্রায় ফসফরার বৃদ্ধি করে, যার ফলে মানুষ উন্মত্ত আচরণ করে তখন কেবল উলুবেড়িয়া স্টেশন ভাংচুর হয় তা নয়, তখন আইন অমান্য করে সংরক্ষিত অঞ্চলেও ড্রোন উড়িয়ে শুটিং করতে ইচ্ছা করে যেমনটা সৃজিত করেছে।

 

মনে রাখবেন কে তার ঘরে গরু খেল এটা বড় কথা নয়, বড় কথা সেটাই কে আপনাকে আঘাত করবার জন্য গরু খেল সেটা বড় ব্যাপার,সেই আমাদের আদত শত্রু। যেহেতু আমরা উন্মত্ত অসভ্য নই তাই নিজেদে শত্রুদের মস্তিষ্ক দিয়ে নির্মূল করতে হবে অন্য কিছু দিয়ে নয়।
ধন্যবাদ।
ভালো থাকবেন।

 লিখেছেন বিরিঞ্চি বন্দোপাধ্যায়

আরো পড়ুন….