সূফীবাদ ও ইসলাম

বাঙালি মুসলমান কি সূফীবাদের প্রেমেই ইসলাম গ্রহণ করেছিল ? দুরর্ম

বাঙালি মুসলমান কি সূফীবাদের প্রেমেই ইসলাম গ্রহণ করেছিল ? কিছুদিন আগে ‘roar’ বাংলাতে প্রাচীন ভারতে আগত সুফী নিজামুদ্দিন আউলিয়ার দিল্লিতে আসা ও তার মহিমা বিস্তারের কথা সবুজ পাক মখমলে পেশ করা হয়েছে । পড়লে অনেকেরই ইসলামের সহনশীল সুফিবাদে হৃদয় গলে যাবে । আসলে ইসলামের এক মূল স্তম্ভ হলো তাকিয়া । তাকিয়া ছাড়া ইসলাম অচল, তাই সূফিবাদকে সহনশীল, দেখানোর এবং ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলামের বিস্তারে সুফিবাদের সহনশীল ধর্মাচারের মাহাত্য ফলাও করে প্রচার করে কট্টর থেকে মডারেট সকল ইসলামিস্ট ।

উপরোক্ত লেখাটিও তার ব্যতিক্রম নয়, যেখানে সুফী নিজামুদ্দিন আউলিয়াকে মহাত্মা দেখাতে লেখক কোনো কসুর ছাড়েনি । পাঠক, সত্য লুকোনো আজকের ইন্টারনেটের দুনিয়াতে বেশ শক্ত, তাই এই ইসলামিস্টরা তাদের তাকিয়া মোড়া প্রচারে বারেবারেই ধরা খায় । আসুন একটু সুফিবাদ ও ভারতীয় উপমহাদেশে আগত সুফী মহাত্মা নিজামুদ্দিন আউলিয়ার সত্য জানার চেষ্টা করি :

 

‘আল্লাহ জিহাদকে মুসলিমদের জন্য অবশ্য পালনীয় কর্তব্য করেছেন, যার জন্য তারা যুদ্ধ করতে থাকবে যতদিন না সমগ্র পৃথিবীতে মানব জীবনের সর্বজনীন ও সর্বোৎকৃষ্ট দিক নির্দেশক ইসলাম একমাত্র ধর্মরূপে প্রতিষ্ঠিত হবে ।’ (কোরান ২:১৯৩ , ৮:৩৯) ।। সুফিবাদের পূর্বসূরী বা ভিত্তি এই জঙ্গী ইসলামী ধর্মান্ধতা বা গোঁড়ামির মধ্যে প্রোথিত ছিল । উমর উদ্দিনের মতে : ‘দার্শনিক ও যুক্তিবাদীদের বুদ্ধিমত্তাবাদ এবং শাসকশ্রেণীর ঈশ্বরহীন চালচলনের বিরুদ্ধ প্রতিক্রিয়া হিসেবে সুফীবাদের উদ্ভব হয় ।’ আব্বাসীয় শাসকরা তখন আরব বা ইসলামি সংস্কৃতিকে ঠেলে পেছনে ফেলে দেয় এবং ইসলাম তখন পারস্য সভ্যতার আগের ‘জাহলিয়া’ আচার আচরণ শুরু করে যা ছিল অনৈতিক ।

 

উমর উদ্দিন আরো বলছে: ‘ এর বিরোধিতা করার জন্যই সুফিবাদের উদ্ভব এবং কোরান ও নবী আর তার সাহাবাদের জীবন হলো সুফীবাদের আচরণবিধির ভিত্তি ।’ কিছু কিছু সূফী সম্পূর্ণরূপে ইসলামের পথ থেকে বিচ্যুত হলেও অধিকাংশই গোঁড়া বা মূলপন্থী থেকে যায় । দ্বাদশ ‎শতকে গাজ্জালী মুসলিম সমাজে সূফীবাদের বিজয় ঘটাতে সক্ষম হন । তিনি মূলত ভ্রষ্ট ধারণা ও আচারসমূহকে ‎অপসারিত করে সূফীবাদের দেহে ইসলামী গোঁড়ামিকেই বুনে দিয়েছিলেন, যার ফলে সূফীবাদ মুসলিমদের মাঝে ‎গ্রহণযোগ্যতা পায় । সুতরাং ইমাম গাজ্জালীর কারণে সূফীবাদের গোঁড়া অংশটাই মুসলিম সমাজে স্বীকৃতি পেয়েছিল । ‎পথভ্রষ্ট বেশরীয়া সূফীদেরকে নানা নির্যাতন ভোগ, এমনকি মৃত্যুবরণও করতে হয়েছে !

 

‎গাজ্জালীর খাঁটি বা কট্টর ‎সূফীবাদ মুসলিম সমাজে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল এবং মুসলিম হামলাকারীদের পথ ধরে ভারতে সূফীদের ‎আগমন ঘটে ব্যাপকভাবে । ভারতের বিখ্যাত সূফী দরবেশ – যেমন নিজামউদ্দিন আউলিয়া, আমীর ‎খসরু, নাসিরুদ্দিন চিরাগী, খাজা মঈনুদ্দিন চিশ্‌তী ও জালালুদ্দিন – এরা সবাই ‎গোড়া ও অসহিষ্ণু মতবাদী ছিলেন ! তারা গোঁড়া ইসলামী পণ্ডিত বা উলেমাদেরকে ‎উচ্চ মূল্য দিতেন এবং তাদের শিষ্যদেরকে ধর্মীয় আইন ও সামাজিক আচরণ ‎সম্পর্কে উলেমাদের রায় অনুসরণ করে চলার পরামর্শ দিতেন ।

 

এবারে আসি roar বাংলায় তুলে ধরা সুফী মহাত্মা নিজামউদ্দিন আউলিয়া সম্পর্কে । ইসলামী তাকিয়ার মোড়কে পরিবেশন করা এই সুফীর মাহাত্য এবারে সত্যের আলোকে দেখি: নিজামুদ্দিন আউলিয়া (১২৩৮-১৩২৫): নিজামুদ্দিন আউলিয়া গোঁড়া মুসলিমদের মতামত অবলম্বনে হিন্দুদেরকে ‎নরকের আগুনে পোড়ার জন্য অভিশপ্ত করেন। তিনি বলেন: ‘বিধর্মীরা মৃত্যুকালে শাস্তি পাবে। সে মুহূর্তে তারা ‎ইসলামকে সত্য বলে স্বীকার করবে, কিন্তু তাদের তখনকার সে বিশ্বাস গ্রহণযোগ্য হবে না; কারণ সেটি হবে না ‎অদৃশ্যের প্রতি বিশ্বাস। সুতরাং একজন বিধর্মীর মৃত্যুকালীন বিশ্বাস অগ্রহণযোগ্য থেকে যাবে।’

 

তিনি দৃঢ়ভাবে ঘোষণা ‎করেন: ‘পুনরুত্থানের দিন বিধর্মীরা শাস্তি ও নিদারুণ যন্ত্রণার মুখোমুখি হয়ে ইসলাম গ্রহণ করবে, কিন্তু তা কোন কাজে ‎আসবে না। তারা নরকেই যাবে, যদিও বিশ্বাসী হিসেবে।’ তার ‘খুৎবা’য় নিজামুদ্দিন আউলিয়া বিধর্মীদেরকে ‎অপকর্মকারী পাপী হিসেবে নিন্দা করে বলেন: ‘আল্লাহ বিশ্বাসী এবং অবিশ্বাসীদের জন্য যথাক্রমে স্বর্গ ও নরক সৃষ্টি ‎করেছেন, পাপীদেরকে তাদের অপকর্মের প্রতিদান দিতে মাত্র।’‎

অমুসলিমদের বিরুদ্ধে জিহাদ সম্পর্কে নিজামুদ্দিন আউলিয়ার চিন্তাভাবনা কুরআনের প্রথম ‘সূরা ফাতিহা’ সম্পর্কে তার ‎বিবৃতি থেকে পাওয়া যেতে পারে। তিনি বলেন: সূরা ফাতিহায় ইসলামের দশটি মৌলিক ভিত্তির মধ্যে দু’টি অন্তর্ভুক্ত ‎হয়নি। তা হলো: ‘অবিশ্বাসীদের সাথে যুদ্ধ করা এবং স্বর্গীয় বিধিবদ্ধ আইন প্রতিপালন করা।’ এবং সে মুতাবেক ‎হিন্দুদের বিরুদ্ধে এক যুদ্ধে নাসিরুদ্দিন কিবাচার বিজয়ে তিনি সাতিশয় সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছিলেন এবং তার শিষ্য ‎শাহ্‌জালালকে ৩৬০ জন জিহাদী সাথীসহ প্রেরণ করেছিলেন সিলেটের রাজা গৌর গোবিন্দের বিরুদ্ধে লড়াই করতে।

 

দক্ষিণ ভারতে মালিক কাফুরের নেতৃত্বে পরিচালিত জিহাদের সম্ভাব্য সফলতা সম্পর্কে কাজী মুঘিসুদ্দিন যখন ‎আউলিয়ার কাছে জানতে চান, আউলিয়া তখন আবেগাপ্লুতভাবে বলে উঠেন: ‘এ বিজয় তো কি, আমি আরো বিজয়ের ‎অপেক্ষায় আছি।’ নিজামুদ্দিন আউলিয়া সুলতান আলাউদ্দিনের জিহাদ অভিযানে লুণ্ঠিত মালে গণিমত থেকে বিপুল ‎পরিমাণ উপহার গ্রহণ করতেন ও তার খানকায় বা আশ্রমে তা গর্বের সাথে প্রদর্শন করতেন।

আজকের বাঙালি মুসলমানদের পূর্ব পুরুষরা কি এই সূফীবাদের প্রেমেই ইসলাম গ্রহণ করেছিল ?
আরো পড়ুন…