ধর্ম ও বিজ্ঞান: ধর্মকে যখন কেউ বিজ্ঞান হিসেবে উপস্থাপন করতে চায় তখন মানব সভ্যতার অনেক ক্ষতি হয়ে যায়।

ধর্ম ও বিজ্ঞান: ধর্মকে যখন কেউ বিজ্ঞান হিসেবে উপস্থাপন করতে চায় তখন মানব সভ্যতার অনেক ক্ষতি হয়ে যায়। শরীরকে সব সময় খাবার দিলে হবে না, মাঝে মাঝে না খাইয়েও রাখতে হবে। এই “মাঝে মাঝে না খাইয়ে রাখা” বলতে কী বুঝতে হবে? সপ্তাহে একদিন, পনেরো দিনে একদিন? মাসে একদিন? “না খাওয়া” বলতে পানিও খাব না, কিছুই খাব না?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক (একাউন্টিং বিভাগের) দেখলাম ধর্মের সাথে বিজ্ঞান মিলিয়ে অযৌক্তিক একটি বিশ্লেষণ তৈরি করে গোষ্ঠীগতভাবে তা প্রচার করছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক প্রচার করায় মানুষ তা গ্রহণও করেছ কোনো বাছবিচার না করে।

একাউন্টিংয়ের ঐ শিক্ষকের বক্তব্য হচ্ছে, ২০১৬ সালে যেহেতু বিজ্ঞানী ইয়োশিনোরি ওহশোমি নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন অটোফেজি নিয়ে গবেষণা করে, অতএব এটা ধর্মীয় সফলতা।

তার এ লেখা পড়ে আমার এক হিন্দু ধর্মীয় বন্ধু দাবী করলেন, এটা বেদান্তীয় সফলতা। কারণ, সনাতন ধর্মে উপবাস প্রথা আরো অনেক বেশি প্রাচীন এবং সে নিয়ম-কানুন নাকি আরো বেশি বৈজ্ঞানিক।

প্রাচীনকালে বিজ্ঞানটা সুস্পষ্ট ছিল না, অনেকটা দর্শন নির্ভর ছিল, এই কারণেই এরিস্টটল এত কিছুর আবিষ্কারক হিসেবে স্বীকৃত। তবে তখনও মানুষের পরীক্ষা-নিরীক্ষা বা গবেষণা ছিল বলে জানা যায়। তাই প্রাচীন যে কোনো গ্রন্থের ঐতিহাসিক মূল্য আছে, সেগুলোর মধ্যে সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞানের উপাদান থাকবে এটাই স্বাভাবিক।

আর সকল আবিষ্কারই একটি ধারাবাহিকতার ফসল। পূর্বসুরীদের অবদান সেখানে থাকে। তাই বলে কোনো আবিষ্কারকে ধর্মীয় বা ঐশী বলে প্রচার করা মূর্খতা ছাড়া কিছু নয়। আবিষ্কার মানে প্রকৃতি থেকে খুঁজে নেয়া, প্রকৃতিকে যুথবদ্ধ করা বা কতগুলো উপাদান টেনে এনে একসাথে করে নতুন কিছু সৃষ্টি করা। তাই চাইলে সবকিছুই ঐশ্বরিক ভাবা যায় এবং এটাই ঈশ্বর বিশ্বাসের মূল কথা।

তাই বলে প্রকৃতিতে সবই আছে বলে চুপ করে বসে থাকলে কি কাজ হবে? এমন হলে আকাশে বিমান চলবে, এটা তো প্রাকৃতিক নিয়ম, তাতে কি আকাশে আপনা আপনি বিমান চলবে?

যাইহোক, আরেকটু স্পষ্ট করে অটোফেজির কথা বলি। অনেক অনলাইন পত্রিকা দেখলাম, অটোফেজি অর্থ করছে রোজা বা উপবাস। আসলে অটোফেজি অর্থ রোজা বা উপবাস নয়। রোজা বা উপবাস অর্থ না খেয়ে থাকা, অটোফেজি অর্থ নিজেকে খাওয়া।

বিষয়টা সহজ ভাষায় এরকম, আপনি যখন কিছু খাবেন না, তখনও কোষগুলো পুষ্টি চাহিদা মেটাতে চাইবে এবং নিজেদের মাঝে খাবার খুঁজবে। এটা করতে গিয়ে শরীরের অনেক অনিষ্টকারী উপাদান খেয়ে ফেলবে (সেখান থেকে পুষ্টি উপদান বাছাই করবে) এবং বিপাকীয় ক্রিয়ায় শরীরের বর্জ্য বের করে দিবে।

এক গবেষণায় দেখা গেছে আমাদের গ্রহণ করা প্রোটিনের একটা অংশ কাজে লাগে না, সেগুলো বিভিন্নভাবে কোষে জমা থাকে, সেগুলো মাঝে মাঝে বের করে দিতে পারলে ভালো।

বেলজিয়ামের বিজ্ঞানী ক্রিস্টিয়ান ডে চিকিৎসা বিজ্ঞানে ১৯৭৪ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন লাইসোসোম আবিষ্কারের কারণে। এরও এক দশক আগে বিজ্ঞানীরা কোষের মধ্যে এক ধরনের ঝিল্লির কথা বলেছিলেন যা বর্জ্য পদার্থ বা বাড়তি উপাদান আটকে রাখে। তবে সুস্পষ্টভাবে সেখানে কীভাবে কার্যপ্রণালী নিয়ন্ত্রিত হয় তা বিজ্ঞানীদের তখন জানা ছিল না। তিনি এবং আরো অনেক গবেষক দেখতে পান কোষ নিজের ভেতরে একটি আবরণ তৈরি করে তার মধ্যে অনেক অপ্রয়োজনীয় উপাদান আটকে রাখে। ক্রিস্টিয়ান ডে ঝিল্লি-আবৃত এ অংশটির নাম দেন লাইসোসম।

মেডিকেল ফাস্টিং (অটোফেজি)
মেডিকেল ফাস্টিং (অটোফেজি)

জাপানের বিজ্ঞানী ইয়োশিনোরি ওহশোমি ক্রিস্টিয়ান ডে-এর আবিষ্কারের সীমাবদ্ধতা বা তাত্ত্বিক দিকের প্রায়োগিক জায়গায় এসে কাজ করেছেন। এবং তিনি যে জিনটি এই অটোফেজি প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে সেটি শনাক্ত করেছেন।

অটোফেজির কারণে অনেক কোষ মরে যায়, স্বাভাবিকভাবেই দুর্বল ও রোগাক্রান্ত কোষগুলোই মারা পড়ে, তাই ক্যান্সারসহ বার্ধক্যজনিত নানাবিধ রোগের গবেষণায় ইয়োশিনোরির অটোফেজি নিয়ে এ গবেষণার বিশেষ ভূমিকা রয়েছে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, অটোফেজির প্রয়োজনীয়তার সাথে এক মাস বা তার ৪০ দিন একটানা রোজা রাখা প্রাসঙ্গিক হয় কিনা। ধর্মীয়ভাবে কেউ রোজা রাখে বা উপবাস করে সেটি আলাদা বিষয়। কিন্তু ধর্মকে যখন কেউ বিজ্ঞান হিসেবে উপস্থাপন করতে চায় তখন মানব সভ্যতার অনেক ক্ষতি হয়ে যায়। ক্ষতি হয়ে যায় কারণ, তখন এই ভ্রান্ত বোধ তৈরি হয় যে সবই তো গ্রন্থে আছে তাহলে আমি শুধু ‘সম্রাটই’ থাকি, কাজ করার দরকার নেই।

ধর্মগ্রন্থগুলোকে ধর্মীয় বলা হয়েছে বলেই তা শুধু ধর্মগ্রন্থ। পৃথিবীতে হাজার হাজার গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ রয়েছে যেগুলো থেকে মানব সভ্যতার অনেক গুরুত্বপূর্ণ দিক নির্দেশনা এসেছে। গ্রন্থগুলোকে নামহীন করে দিয়ে সেগুলোকে কি আমরা ধর্মগ্রন্থ বলব?

বিজ্ঞানের প্রথম দিকের অনেক নোবেল পুরস্কারই দর্শন নির্ভর। আইনস্টানের নোবেলটাই তো একদম তাত্ত্বিক। অপ্রমাণিত অনুকল্পের উপরও নোবেল দেয়ার ইতিহাস আছে। আচ্ছা, ধর্মগ্রন্থ ঐশী মানলে এটাও তো মানতে হবে বিজ্ঞানীরা আধুনিক যুগের ঈশ্বরের দূত, ঈশ্বর কানে কানে তাদের বলে দিয়ে যায় তারপর তারা আবিষ্কার করে, নাকি?

রোজার উপকারিতা নিয়ে মহা ধুমধামে প্রচারণা চলছে। মূলত ফাস্টিং বা মেডিকেল ফাস্টিং এর উপকারিতা গুলো গুগল করে সেগুলোকে রমজানের ফাস্টিং বা রোজার উপকারিতা বলে চালানো হচ্ছে। রোজার তথা একটানা বারো-পনেরো ঘন্টা পানি না খেয়ে থাকার শারীরিক ক্ষতি বা মানসিক ক্ষতি ও সামাজিক-অর্থনৈতিক প্রভাব নিয়ে এই লেখা নয়। এখানে কেবল রোজার সাথে মেডিকেল ফাস্টিং এবং অটোফ্যাজির পার্থক্য তুলে ধরা হল।

আমাকে আরো অবাক করেছে প্রথম আলোতে একজন কার্ডিলজিস্ট (ডাক্তার) ডাঃ রেয়ান আনিস যিনি বলছেন রোজা থাকলে ব্লাড প্রেসার কমে, রক্তে সুগার কমে, হার্টের ডিজিস কমে!তার কাছে আমার প্রশ্ন বাংলাদেশে প্রচুর ব্লাড প্রেসার এবং হার্টের রোগী আছে।

বাংলাদেশের কোন ডাক্তার ট্রিটমেন্ট হিসাবে কোন রোগীকে (ব্লাড প্রেসার এবং হার্টের রোগী) রোজা থাকার পরামর্শ দিয়েছেন জীবনে ? একজন ডাক্তার যখন এভাবে কথা বলেন তখন তার পেশা সম্পর্কে প্রশ্ন তোলা খুবই বাঞ্চনীয়। হ্যা, রোজা বা উপবাসের কিছু কিছু উপকারিতা আছে। তবে সে রোজা ইসলামী বিধানের রোজা নয়। সেই রোজার মধ্যে অল্প খাওয়া বাধ্যতামূলক। আর একজন ফিজিওথেরাপিস্ট ঢাকা থেকে QUORA তে লিখেছেন এভাবে। আমি বলি এরা ডিগ্রী পায় কিভাবে ?

টোফেজির মূল পার্থক্য হলো রোজার সময় কিছুই খাওয়া যায় না। অন্যদিকে অটোফেজির সময় অল্প কিছু খাবার এবং জল বা জুস খাওয়া বাধ্যতামূলক। নিচেই দুটি জিনিস বিশ্লেষণ করা হলো। কারো প্রশ্ন থাকলে কমেন্ট বক্সে করুন।

রোজা:

১। আল্লাহর নামে শুরু ও শেষ হয়। এখানে মেডিকেল কোন ভালো দিক চিন্তা করে করা হয় না।
২। একমাত্র আল্লাহকে কত ভালবাসে তা প্রমাণ করার জন্য করতে হয়।
৩। কোন খাবারই গ্রহণ করা যায়না।
৪। স্বাভাবিক কাজকর্ম চালিয়ে যেতে হয়।
৫। রোজা সূর্য ওঠার আগ সূর্য অস্ত পর্যন্ত। কোথাও ৬ ঘন্টা কোথাও ২৩-২৪ ঘন্টা! অবস্থান হিসেবে আলাদা, ব্যক্তি বিশেষে নয়।
৬। সারাদিন না খেয়ে সারা রাত যত খুশি যত খুশি খাওয়া যায়।
৭। টানা এক মাস করতে হয়।
৮। আল্লাহর নামে চলিলাম, মরি বাঁচি! নানা ধরণের মানসিক ও শারীরিক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে কিন্তু সেগুলো সহ্য করাই আসলে পরীক্ষা!
৯। অতি প্রাচীন কাল থেকেই নানা ধর্মে বা অঞ্চলে নানাভাবে প্রচলিত এবং কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই।

মেডিকেল ফাস্টিং (অটোফেজি):

১। বিশেষজ্ঞের পরামর্শে শুরু ও শেষ হয়।
২। প্রধানত নানা রকম টেস্ট করতে, ওজন কমাতে, চিকিৎসার প্রয়োজনে করতে হয়। সুস্থ থাকতেও করা যেতে পারে। সাধারণত সপ্তাহে এক দিন যা সারা বছর করা যেতে পারে।
৩। পানি, নানা তরল খাবার বা ওষুধ এমনকি সামান্য খাবার গ্রহণ করা যায়।
৪। নির্দিষ্ট ব্যায়াম/কাজকর্ম করতে হয় বা এড়িয়ে চলতে হয়।
৫। ব্যাক্তি ও চাহিদা অনুযায়ী সময় নির্ধারিত হয়। ৪ ঘন্টা থেকে ১৬ ঘন্টা হতে পারে।
৬। নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট খাবার খেতে হয়।
৭। নির্ধারিত সময়ে করতে হয়।
৮। কোন সমস্যা দেখামাত্র প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়।
৯।এটা বিজ্ঞানসম্মত ।

এটা একেবারেই আলাদা বিষয়, এটা আসলে রোজার সাথে এক করা যায়না। এটা হয় কারণ এটা শারীরিক স্ট্রেসের একটা রেসপন্স। এর শাব্দিক অর্থ হল নিজেকে খাওয়া। খাবার না পেয়ে কোষগুলো নিজেই নিজেকে খেয়ে ফেলে, বিশেষত বর্জ্য গুলো, এবং সেখান থেকেই পুষ্টি উপাদান আলাদা করে নেয়।

অনেক প্রাণীতে এটা হয় এমনকি উদ্ভিদেও। জাপানী নোবেল প্রাপ্ত বিজ্ঞানী এটা আবিস্কারও করেননি, তিনি আবিস্কার করেছেন ইস্টের একটি জিনকে যেটা তাতে অটোফ্যাজি ট্রিগার করে। আর তিনি বলেনও নি যে উপবাস থাকতে হবে কিনা বা কতক্ষণ করতে হবে। আদৌ কীভাবে কতদিন উপবাস করতে হবে এবং সেটা উল্টো ক্ষতিকর হবে কিনা সেসব নিয়েও তিনি গবেষণা করেন নি।

অথচ পানি বা ফলমূল খেলেও অটোফ্যাজি ট্রিগার হয়। চিকিৎসাবিজ্ঞানের একদম প্রাথমিক কথা এটা যে একটানা দীর্ঘক্ষণ পানি না খেয়ে থাকা শরীরের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। কেবল নির্দিষ্ট মেডিকেল টেস্টের বা নির্দিষ্ট চিকিৎসা গ্রহণের পূর্বে সেটা বলে দেয়া হয়।

এটার সাথে রোজাকে এক করে দেখা আর দশটা ধর্মীয় অপপ্রচারের মত একটি ছাড়া কিছুই নয়।অটোফেজি কি? কিভাবে কাজ করে আমাদের শরীরে? আমাদের দেহের কোষগুলি নিয়মিত ভাঙ্গে এবং তারপরে তাদের নিজস্ব অংশগুলিকে ক্রমাগত পুনঃচক্র (recycle) করে। ২০১৬ সালে, জাপানের ড: ইয়োশিনোরি ওহসুমি (Dr. Yoshinori Ohsumi), এই প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত মেকানিজম (যা অটোফেজি (autophagy) নামে পরিচিত) আবিষ্কারের জন্য ফিজিওলজি বা মেডিসিনের উপর নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন।

আমাদের দেহের অধিকাংশ টিস্যু নিয়মিতভাবে তাদের কোষগুলিকে নতুন করে প্রতিস্থাপন করে। প্রতিটি অঙ্গ সম্পূর্ণরূপে নিজেকে নবায়ন করার জন্য নিজের মত সময় নেয়। তবে, অন্যান্য টিস্যু তাদের কোষ প্রতিস্থাপন না।জাপানের কোষ জীববিজ্ঞানী ড: ওহসুমি কয়েক বছর ধরে অধ্যয়ন করেন মানব কোষ তাদের কিভাবে বজ্রকে আবার ব্যবহারের উপযোগী করে তোলে তার উপর।এই প্রক্রিয়া বৈজ্ঞানিকভাবে অটোফেজি (autophagy) নামে পরিচিত ।

এটি গ্রিক শব্দদিয়ে গঠিত। “অটো” যার অর্থ “স্ব” এবং “ফেজিন” যার অর্থ “খাওয়া” হিসাবে অনুবাদ করা যেতে পারে। এটি একটু বিরক্তিকর শোনাচ্ছে, কিন্তু এই প্রক্রিয়াটি আপনাকে স্থিতিশীল রাখতে সহায়তা করে।লাইসোসোমের (lysosome) সাহায্যে (অন্ত্রবৃত্তান্ত্রিক উপাদান হ্রাসের জন্য দায়ী যে গুলি), আপনার শরীর বিভিন্ন প্রোটিন কাঠামো ভাঙ্গতে পারে এবং তাদেরকে অ্যামিনো অ্যাসিড রূপান্তর করতে পারে।

পরে, এটি আরও কোষ (cell) তৈরি করতে পারে ।আমাদের শরীরে ক্ষতিগ্রস্ত কোষ এবং ব্যাকটেরিয়া আকারে সংরক্ষিত থাকা প্রোটিন থেকে নিজস্ব প্রোটিন ব্যবহার করতে পারে। এক ব্যক্তি গড়ে প্রতিদিন প্রায় ৭০ গ্রাম প্রোটিন খায় যা নতুন কোষ তৈরি করতে যথেষ্ট নয়। “প্রোটিন বর্জ্য” ব্যবহার করে আমাদের শরীর প্রয়োজনীয় পরিমাণ পুষ্ট লাভ করে। যখন প্রাকৃতিক পুনর্ব্যবহারযোগ্য প্রক্রিয়া কাজ করে না তখন ক্ষতিগ্রস্ত কোষ এবং তাদের উপাদান শরীরের মধ্যে জমা হতে শুরু করে।

সুতরাং, ক্যান্সার কোষ এবং বিপজ্জনক ব্যাকটেরিয়া এবং ভাইরাস সংক্রামিত কোষগুলি নিরপেক্ষ করা সম্ভব নয়। এই জন্য আমাদের শরীরে অনেক গুরুতর রোগের আক্রমণ হতে পারে ।তার সমস্ত গবেষণায়, ডাঃ ওহসুমী বিষাক্ত কোষ ভেঙে ফেলার জন্য এবং সমস্ত বর্জ্য পরিত্রাণ পেতে, শরীরকে উত্তেজিত করার জন্য উপবাস করেছিলেন। আপনি যখন উপবাস করেন আপনার কোষ আরও দীর্ঘজীবী হয় এবং আরো শক্তি উত্পাদন করে । আপনার শরীরের কম প্রদাহ (inflammation) হয়।

উপরন্তু যদি আপনি শরীরে ক্যালোরি কমাতে চান তবে আপনার শরীরের নাইট্রিক অক্সাইডের মাত্রা বৃদ্ধি পাবে – এটি একটি অণু (molecule) যা শরীর হতে টক্সিক উপাদান রিমুভ করতে এবং দেহকে পুনরুজ্জীবিত করতে সহায়তা করে। বিরতি নিয়ে উপবাস (Intermittent fasting), যা বলতে বুঝায় উপবাসের মধ্যে অল্প করে খাওয়া যা শরীরকে পরিষ্কার (রাসায়নিক বা জৈবিক বজ্র) করতে সাহায্য করে । উপরন্তু, এটি ওজন কমাতে এবং বিপাক (metabolism) ক্রিয়া বা তাড়াতাড়ি হজম করতে সাহায্য করে। এভাবে উপবাস করার সুবিধা অনেক।

এর ফলে হার্ট জনিত রোগ, নিউরোলজিকাল সমস্যা এবং ডায়াবেটিসের ঝুঁকি, এবং প্রদাহ, অক্সিডেটিভ স্ট্রেস এবং রক্তচাপ কমায় । আপনি যদি এই পদ্ধতিটি গ্রহণ করেন তবে আপনি সাধারণত একদিনে যেমন খান তেমনি খাবেন এবং পরবর্তী দিনে উপবাস করবেন। এর অর্থ এই নয় যে উপবাসের সময় আপনি মোটেও খাবেন না । যদি আপনি নিয়মিত দিনে 2,000 ক্যালোরি খান তবে আপনার উপবাসের দিনে 500 ক্যালোরি খাবেন ( তার মানে অল্প খাবেন )।

আপনি যদি জীবনে এই প্রথম উপবাস শুরু করেন একবারের জন্য খাবার বাদ দেয়া আপনার কাছে একটু ভীতিজনক মনে হতে পারে। সাধারণত, প্রতিদিন এক বার খাবার এড়াতে (না খেলে) পারলে আপনার বিপাককে বাড়িয়ে দেয় এবং আপনার শরীরের পরিষ্কারকরণ প্রক্রিয়াগুলি সক্রিয় হয় । মনে রাখবেন যে যদি আপনি কোন একবার খাবার ছাড়েন ( না খান ) তবে আপনাকে পরবর্তীতে অতিরিক্ত খেতে হবে না।সীমিতউপবাস হলো ব্রেক (intermittent) দিয়ে উপবাস ।

এটি অনুসরণ করার জন্য, প্রতিদিন দিনে ৮ ঘন্টা অন্তর খেতে হবে। এই পদ্ধতিটির আরেকটি নাম “উপবাস ১৬/৮” কারণ আপনি বাকী 16 ঘন্টার মধ্যে খেতে পারবেন না। আপনি যদি এই পদ্ধতিতে নতুন হন তবে কম কঠোর পরিকল্পনার চেষ্টা করুন। আপনি সকাল ৮ টায় সকালের নাস্তা করতে পারেন এবং সন্ধ্যা ৬ টায় ডিনার করতে পারেন। সুতরাং, আপনি শুধু ১0 ঘন্টা না খেয়ে থাকবেন । যখন আপনি এর সাথে অভ্যস্ত হবেন তখন উপবাসের টাইম বাড়াতে হবে (মনে আছে আমাদের টার্গেট এখানে ১৬ ঘন্টা )।

আপনি যদি এই কৌশল অনুসরণ করার সিদ্ধান্ত নেন, তবে সপ্তাহের একদিন নির্বাচন করুন! মনে রাখবেন উপবাসের মধ্যে ফ্রেশ জল এবং চিনি ছাড়া জুস অবশ্যই পান করতে হবে । এই জন্য বসন্ত সেরা সময় কিন্তু আপনি সারা বছর ধরে এই খাদ্য অনুসরণ করতে পারেন।

কয়েকটি প্রশ্ন রেখে এই লেখা শেষ করি-

১। অটোফেজি দরকার মাঝে মাঝে, তাহলে সেই “মাঝে মাঝে” বলতে আপনি কী বুঝবেন? একটানা একমাস? তিনদিনে একদিন? সাতদিনে একদিন? পনেরো দিনে একদিন? মাসে একদিন?

২। ইয়োশিনোরি ওহশোমির গবেষণার সারসংক্ষেপ যদি একটু বোঝার চেষ্টা করি তাহলে দেখব, এখানে বলা হচ্ছে-

কোষ নিজেদের মধ্যে খাওয়া খাওয়ি করবে কারণ শরীর সচল রাখতে হলে তার পুষ্টি লাগবেই, তার মানে বিপাক ক্রিয়া বন্ধ হচ্ছে না, বিপাক বন্ধ না হওয়ার মানে হচ্ছে পানি লাগবে।

অর্থাৎ, গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে- তাহলে বৈজ্ঞানিক ভিত্তি থেকে যদি আপনি রোজা রাখেন বা উপবাস থাকেন তাহলে কি একদমই না খেয়ে থাকবেন, নাকি অন্তত পানি খাবেন?

একজন মানব শিশুর (এক বছর) শরীরের ৭৮% পানি, এরপর ক্রমান্বয়ে তা কমতে কমতে ৬০% এ এসে থিতু হয়। অর্থাৎ একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের শরীরে ৬০ ভাগ পানি থাকে।

কোনো খাদ্য না খেয়ে তিন থেকে চার সপ্তাহ পর্যন্ত একজন সুস্থ সবল লোক বেঁচে থাকতে পারে, কিন্তু পানি না খেয়ে বেঁচে থাকা সম্ভব মাত্র ৩ থেকে ৭ দিন। এটা নির্ভর করে স্থানের তাপমাত্রা এবং বাতাসের আদ্রতার উপর। অর্থাৎ অানুপাতিকভাবে চিন্তা করলেও বোঝা যায় খুব বেশিক্ষণ পানি না খেয়ে থাকাটা শরীরের জন্য ক্ষতিকর।

শরীরে পানি কী কাজ করে সেটিও জানলে বুঝতে ‍সুবিধা হবে-

মোটা দাগে পানি কয়েকটি কাজ করে, যেমন, বিপাক ক্রিয়ার জন্য পানি অত্যাবশ্যকীয়, আমাদের হাড়ের সংযোগস্থলে যে লুব্রিকেন্ট রয়েছে তাতে পানি লাগে, শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য পানি লাগে ইত্যাদি।

৩। একটানা কতক্ষণ না খেয়ে থাকা অটোফেজির জন্য বিজ্ঞান সম্মত, সে নির্দেশনা ইয়োশিনোরির গবেষণায় নেই। আসলে তিনি কোনো নির্দেশনাই দেননি, বিজ্ঞান সেটি কখনো করেও না। তিনি মূলত শুধু অটোফেজির জন্য দায়ী জিনটি শনাক্ত করেছেন। তাহলে তার গবেষণা কীভাবে উপবাস প্রথার সাথে প্রাসঙ্গিক হয়?

একটানা কতক্ষণ না খেয়ে থাকলে তবে তা সেক্ষেত্রে শরীরে ঘটা অটোফেজি অনিষ্টকর না হয়ে উপকারী হয়?

এই প্রশ্নের উত্তরটা দিতে দয়া করে একটা গবেষণা করুণ যেকোনো অপপ্রচারের আগে। প্রমাণ করুণ যে সেটি দৈনিক একটানা নির্জলা ১২ থেকে ১৫ ঘণ্টা এবং তা করতে হবে বছরে টানা এক মাস বা তার বেশি।

যদি ফলাফল ভিন্ন হয়, মানে দেখা গেল, অটোফেজির জন্য ৭ দিনে একদিন উপবাস থাকা ভালো বা সেটি কাকতালীয়ভাবে মিলে গেল বা কাছাকছি হল অন্য কোনো ধর্মের নিয়মের সাথে, তখন আপনি কী বলবেন?

বেলজিয়ামের বিজ্ঞানী ক্রিস্টিয়ান ডে চিকিৎসা বিজ্ঞানে ১৯৭৪ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন লাইসোসোম আবিষ্কারের কারণে। এরও এক দশক আগে বিজ্ঞানীরা কোষের মধ্যে এক ধরনের ঝিল্লির কথা বলেছিলেন যা বর্জ্য পদার্থ বা বাড়তি উপাদান আটকে রাখে। তবে সুস্পষ্টভাবে সেখানে কীভাবে কার্যপ্রণালী নিয়ন্ত্রিত হয় তা বিজ্ঞানীদের তখন জানা ছিল না। তিনি এবং আরো অনেক গবেষক দেখতে পান কোষ নিজের ভেতরে একটি আবরণ তৈরি করে তার মধ্যে অনেক অপ্রয়োজনীয় উপাদান আটকে রাখে এবং ক্রিস্টিয়ান ডে ঝিল্লি-আবৃত এ অংশটির নাম দেন লাইসোসম।

ধর্মীয় প্রথাকে ধর্মীয় দৃষ্টিকোন বা বিশ্বাস নির্ভর আচার-অনুষ্ঠান হিসেবেই দেখতে হবে। ধর্মের সাথে বিজ্ঞান জড়িয়ে ধর্মের গুরুত্ব বাড়াতে যাওয়া যেমন অযৌক্তিক, আবার বিজ্ঞান দিয়ে ধর্মকে খারিজ করে দেয়াও অপ্রয়োজনীয়। ধর্ম ধর্মের মত থাক, তাতে কোনো সমস্যা নেই, কিন্তু শিক্ষিত ‘ধার্মিকের’ সমস্যা হচ্ছে সে উঁকি দিতে চায় সবার ঘরে এবং সেটি করে সে সাম্প্রদায়িকভাবে, এবং এভাবে সে একটি ডায়াস্পোরা নিজের পেছনে দাঁড় করাতে সমর্থ হয়। অতএব, বলতে হবে শিক্ষিত ধার্মিক এটি উদ্দেশ্যমূলকভাবেই করে।

লেখক- মাসুদ হাসান-ঢাকা বাংলাদেশ

আর পড়ুন….