বৈদিক সভ্যতা মানব সভ্যতার অহংকার।

বৈদিক সভ্যতা! মানব সভ্যতার অহংকার।

বৈদিক সভ্যতা! মানব সভ্যতার অহংকার। আজকের দিনে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া হিন্দু তরুন তরুনীরা তাদের নিজ ধর্ম, কৃষ্টি ও সংস্কৃতির বিষয়ে আলোচনা করার ক্ষেত্রে চরম উদাসীন থাকেন।

এবিষয়ে মোটেও আলাপ আলোচনা আগ্রহ দেখায় না। অত্যন্ত দুঃখ ভরা মন নিয়ে বলতে হয়, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত আধুনিক এসব হিন্দু ছাত্র তরুন বন্ধুদের সাথে সনাতন তথা প্রাচীন বৈদিক সভ্যতা ও হিন্দুধর্ম বিষয়ে কথা বলতে গেলে কোন এক অজানা কারণে এরা এড়িয়ে যায়।

হতে পারে তাদের নিজধর্ম বিষয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞানের অভাব, আবার হতে পারে আমাদের চারপাশের প্রচলিত ধর্মমত গুলির দৃশ্যমান উন্মাদনায় ভীতশ্রদ্ধবোধ ও হতাশা থেকে, কিংবা হতে পারে অন্য কোন অজানা কারণ।

শুধুমাত্র ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষগুলোর প্রতি এ অঞ্চলে সেই ১৯৪২-৪৭ সাল থেকে আজ অবধি অত্যন্ত সচেতন ও একতরফাভাবে ধমিয়ে রাখার উদ্দেশ্যে কখনো পরোক্ষ, আবার কখনোও বা প্রত্যেক্ষভাবে নির্যাতন কার্যক্রম ধারাবাহিকভাবে চলে এসেছে।

মজার ব্যাপার হলো ১৯৪২ থেকে এসময়ের মধ্যে বাংলাদেশ নামক এ অঞ্চলে হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্য থেকে আজ অবধি কোন সিংহ পুরুষ জেগে উঠতে পারেনি। বরং অসাম্প্রদায়িককতার আড়ালে সবাই যেন মারা গেছেন কিংবা ঘুমোচ্ছেন।

ঘুমের ঘোর আছে বলেই কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত হিন্দু তরুনরা হিন্দুধর্ম ও হিন্দুত্বের কথা উচ্চারণ করতে কিংবা আলোচনা করতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। কেহ যদিও কদাচিৎ আলোচনা করার আগ্রহ দেখায়, অমনি অন্যসব তরুন বন্ধুরা বাঁধা দিতে তৎপর হন এবং চিৎকার করে বলতে শুনি তিনি সাম্প্রদায়িক নন, সাম্প্রদায়িক হতে চান না।

সুতরাং ধর্ম নিয়ে আলোচনা করা যাবে না। এসব তরুন বন্ধুদের কাছে ধর্ম মানেই হলো সা¤প্রদায়িতকতা। ঠিক বিপরীতটা দেখা যায় আমাদের প্রতিবেশী অন্য অন্যান্য ধর্মাবলম্বী তরুন-তরুনীদের মধ্যে। ওরা ওদের ধর্ম জানুক কিংবা না জানুক, বঝুক কিংবা না বঝুক, শুধু বিশ্বাসের উপর ভর করে এরা সর্বক্ষেত্রে আগ্রহ দেয়ায়, যদি আলোচনাটি শুধু ওদের নিজ ধর্মের নামে সৃকৃত্বির উপর দৃষ্টিপাত পূর্বক আলোচনা সুনিদ্দিরষ্ঠ ভাবে সীমাবদ্ধ থাকে।

আমাদের সনাতনী তরুনরা কেন এমন ধারণা পোষন করেন?

হিন্দু-তরুনদের বদ্ধমূল ধারণা হিন্দুত্ববাদ হলো আমাদের চারপাশে দৃশ্যমান প্রতিবেশী ধর্মাবলম্বীদের মতো সাম্প্রদায়িক উন্মাদনা। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো এসব আধুনিক হিন্দু তরুন যুবকরা না জেনে, না বুঝে হিন্দুত্ববোধকে অন্য সাম্প্রদায়ের মৌলবাদিত্ব ও সাম্প্রদায়িতকতার সাথে একসাথে গুলিয়ে ফেলেন।

এতে শুধুমাত্র এরা নিজেরা ছোট হচ্ছেন না, ছোট করছেন তাদের পিতৃধর্ম, নিজ সংস্কৃতি ও পারিবারিক ঐতিহ্যকে। পৃথিবীর ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, পৃথিবীতে দুই দুইটা বিশ্বযুদ্ধে যতগুলো মানুষ মারা গেছেন, এর চাইতে কয়েক গুন বেশী মানুষকে হত্যা করা হয়েছে ধর্মের নামে যুদ্ধ সংঘঠিত করে।

তবে ইতিহাস বলে ধর্মযুদ্ধ গুলিতে কখনোই সনাতনী স¤প্রদায় তথা হিন্দুরা করেিিন। কারণ এ ধর্মমতে আছে পরমত সহিষ্ণুতা, নিন্দা না করা, ক্ষমা, দয় ইত্যাদি মানবীয় গুন। যা বংশ পরম্পরা এ ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে প্রোথিত থাকে।

অন্যদিকে, ধর্মযুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে কিংবা করেছে ঐসব ধর্মান্ধরা, যাদের পূর্বপুরুষরা আদি অকৃত্রিম সনাতনী অংশ হতে বিচ্যুত হয়ে নিজেদের মনগড়া মতবাদের উপর ভর করে ঈশ্বরের নামে ধর্ম প্রচার করেছেন এবং ঐমতবাদ গুলিই ধর্মের নামে দ্বিমতপোষনকারী অন্য সকল নিরীহ মানুষের উপর জোর জবরধস্তিমূলক চাপিয়ে দেয়ার নামেই যুদ্ধ করা হয়েছে।

ইতিহাসের পাতা থেকে সাধারণতঃ অনুমান করা যায়, খৃষ্টজন্মের পূর্ববর্তী সময় থেকে এবং খৃষ্ট মতবাদ প্রচার শুরু করার পর থেকেই জোর জবরদস্তিÍ মূলক ধর্ম নামের মতবাদ চাপিয়ে দেবার ধ্যান ধারণা ও পদ্ধতি চালু করা হয়েছে এবং এখনো অবধি সেধারা অব্যাহত রাখা হয়েছে।

সুতরাং জোর করে বলা যায় যীশু আবির্ভাবের পূর্বে ইহুদীদের ধর্মগুরু ও পরবর্তী প্রভু যীশুর মতবাদ প্রচারকরা জোর জবরদস্তি মূলক ধর্ম প্রচারের পদ্ধতি প্রথম চালু করেছেন এবং ওরাই তাদের জবরদস্তি মূলক কাজগুলিকে পবিত্র ধর্মযুদ্ধ নামে অবহিত করেছেন।

মজার ব্যাপার হলো যীশু তথা খৃষ্টধর্মের পরবর্তী প্রবর্তিত ধর্মগুলিও প্রায় একই পন্থা বেচে নিয়েছিল। এরা তাদের ধর্মমত প্রচার করবার উদ্দেশ্যে কোন কোন ক্ষেত্রে তাদের পূর্ববর্তী ধর্মমত গুলি তথা খৃষ্ট্রানদের চাইতেও ভয়াবহ পন্থা অবলম্বন করেছিল।

এদের ধর্মযুদ্ধকে এরা “জেহাদ” নামে অবিহিত করেছে। জেহাদে অংশ গ্রহন এদের ধর্মানুশীলনের অংশ হিসাবে দেখানো হয়েছে, আর ঐ জেহাদে জয় লাভের জন্য এরা কখনো ব্যবহার করেছে তরবারী, কখনো সাম্যবাদ, কখনো বা সর্বধর্ম সমান এমন ধরনের মতবাদ তথা সুফীবাদ, কখনো বা ছেলে ও মেয়েদেরকে লাগিয়ে প্রেম ভালবাসার অভিনয় ধর্মে ধর্মান্তকরণ হালে যেটি হালে লাভ জিহাদ নামে অবিহিত ইত্যাদি কুটকৌশল।

সর্বকালে সর্বক্ষেত্রে সকল ধরনের জেহাদের ভয়ংকর বলি হয়েছেন সনাতনী স¤প্রদায়ের মানুষগুলো। এর কারন সনাতনী পরিবারিক শিক্ষা ভিত্তিমূলে রয়েছে অধিকতর সহিষ্ণুতা, ক্ষমা, দয়া, চুরি না করা, সুচিতা, ইন্দ্রিয় সংযম, জ্ঞান, সত্য ও ক্রোধহীনতা এদশটি গুন। ফলে এসব তরুনদের উদারতা ও সাম্যতা বহুলাংশে বৃদ্ধি পায় বিধায় তরুন-তরুনীরা সর্বভুতে ঈশ্বর দেখতে গিয়ে ভূল করেন বলেই ভুল জায়গায় ঈশ্বর দর্শন করার চেষ্টা করেন।

কারণ এরা এদের ধর্মচর্চার অভাবে জানে না সর্বত্র মানব সত্বার মূলভাব সহিষ্ণুতা, ক্ষমা, দয়া, চুরি না করা, সুচিতা, ইন্দ্রিয় সংযম, জ্ঞান, সত্য ও ক্রোধহীনতা এদশটি গুন থাকতে পারে না এবং প্রযোজ্য হয় না। যদি তা প্রযোজ্য হত, তাহলে দ্বাপর যুগে একই বংশের কূরু-পান্ডব মধ্যে যুদ্ধের প্রয়োজন হন তা এবং মহাভারতের মত পূরান রচিত হবার প্রয়োজন হত না।

কিংবা ত্রেতাযুগে রাবন কর্তৃক সীতাদেবীকের হরণ করা হতো না এবং শ্রীরাম চন্দ্র রাক্ষস রাজ রাবনের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হত না এবং এনিয়ে রামায়নও রচিত হত না। ধর্মযুদ্ধের জেহাদীরা ভারত বর্ষে এসেছে সেই সাতশ বার সালে। তখন থেকেই এরা উপমহাদেশের সনাতনী সমাজের উপর নানাভাবে নিপীড়নের মাধ্যমে মানুষকে ধর্মচ্যুত করে তাদের দল ভার করার চেষ্টা করেছে এবং সেধারা এখনো অব্যাহত আছে।

১২ শতক থেকে ১৭ শতক অবধি শুধু ভারতবর্ষেই প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ সনাতনধর্মবলম্বীকে ধর্মের নামে জেহাদের অংশ হিসাবে হত্যা করা হয়েছে কিংবা বন্দী পূর্বক ভারতবর্ষের বাইরে নিয়ে দাস হিসাবে বিক্রি করে দেয়া হয়েছে। মানবতা বিরোধী এজঘন্য কাজ গুলোকে কখনো এরা কিংবা এদের বিশ্বাসে পাপ বলে গণ্য করা হয়নি বরং এগুলোকে পরকালের সুখ লাভের উপায় হিসাবে বিবেচনা করা হয়েছে।

একবিংশ শতকের আজকের দিনে বিশ্বজুড়ে যে সকল অস্থিরতা এখনো অবধি বিরাজমান, এর বেদী মুলে রয়েছে সেই আদিম অকৃত্রিম জোর জবরধস্তি মূলক ধ্যান ধারণা বা মতবাদ চাপিয়ে দেয়ার প্রানান্ত চেষ্টা। এর মানে হলো এখনো চলছে কথিত সেই ধর্মযুদ্ধ। তবে ধর্মযুদ্ধের ধরনটা কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে মাত্র।

এখানেও আক্রান্ত হচেছ আমাদের সনাতনী সমাজ। অথচ সনাতনী সমাজ তাদের ধ্যান ধারণা কখনোই কারো উপর জোর জবরদস্তি মূলক চাপিয়ে দেবার চেষ্টা করেনি। অন্ততঃ ইতিহাস সেসাক্ষ্যই দেয়। বরং প্রচন্ড অশান্তির বাতাবরনের উপর দাঁড়িয়ে মানুষকে শুনিয়েছে মনুষ্যত্বের জয়গান। শুধুমাত্র বৈদিক ইতিহাস ও ভারতবর্ষের শুদ্ধ ইতিহাস না জানার কারণে আমাদের আজকের যুব সমাজ হিন্দুত্ববাদ ও হিন্দুধর্মীয় চেতনাবোধকে অন্য ধর্মীয় মৌলবাদ ও স¤প্রদায়িকতা সাথে এক কাতারে গুলিয়ে ফেলেন বলেই এদের নিজ পিতৃধর্ম ও কৃষ্টির প্রতি এত অনীহা।

মানব সভ্যতা সৃষ্টির পেছনের ইতিহাস যদি ভাল করে তাকিয়ে দেখা যায়, তাহলে দেখা যাবে পৃথিবীর আদি ও অকৃত্রিম সভ্যতা হলো বৈদিক সভ্যতা। একে বলা যায় আধুনিক সভ্যতার ভিত্তি। এবং বৈদিক সভ্যতার ধারণ বা পন্থা হলো সনাতনধর্ম যা মানব সৃষ্টি শুরুর পর একটু একটু করে পরিপুষ্টতা লাভ করে সামান্য প্রাণী হতে মনূষ্যত্ব প্রদানের মাধ্যমে আমাদেরকে মানুষ হতে সাহায্য করেছে।

ইংরেজীতে বলা হয় সিভিলাইজেশন, অর্থাৎ মানুষ অসভ্য থেকে সভ্য হয়ে সাহায্য করেছে। সনাতনী পদ্ধতিই মানুষই ভগবানকে আবিস্কার করেছে, ভগবান মানুষকে নয়। তাইতো ভগবান তথা ঈশ্বরের অসংখ্য বিভুতি বা শক্তিকে এক একটি দেবতা কিংবা দেবী রুপে চিন্তন পুজা ও প্রার্থনা পদ্ধতি চালু হয়ে এসেছে। সনাতনী স¤প্রদায়ের এক মানুষের সাথে অন্য মানুষের প্রার্থনা পদ্ধতি কিংবা যার যার ইষ্ট দেবতা আলাদা আলাদা হলেও কেহ কাউকে এনিয়ে কখনো আক্রমন করেছেন এমন পাশবিক নজীর আধুনিক সভ্যতা কেন, পৃথিবীর আদিম ইতিহাসেও নেই।

কেননা সনাতনী স¤প্রদায় লোকজন জানুক বা না জানুক, সনাতনী স¤প্রদায়ের আর্য ঋষিরা “এক ঈশ্বরকে বহুরুপে খোঁজার ধারণা” এধর্মানুসারী মানুষের রক্তের মধ্যে প্রথিত করে দিয়েছেন বলেই এ ধর্মানুসারী মানুষরা তাদের নিজের অজান্তেই ধারন ও লালন করে থাকে।

একই কারণেই অন্তকাল হতে চলে আসছে সনাতনী সমাজের মানুষগুলো ঘর হতে বের হয়ে পর্যায়ক্রমে ভিন্ন ভিন্ন মঠ, মন্দির, মিশন, আশ্রম এভাবে সর্বত্রই যাতায়াত করেন, তাদের ভক্তি-শ্রদ্ধা-অর্ঘ্য সমার্পন করেন এবং শেষে ঘরে ফেরেন। অধুনা হিন্দু স¤প্রদায়ের মধ্যেও দৃশ্যমান এধারা এখনো দু¯প্রাপ্য নয় এবং কখনো ছিলো না । যা আমাদের প্রতিবেশী ধর্ম গুলোর মধ্যে অতীতে এর শুরু থেকে যেমন দেখা যায়নি, এখনো দেখা যাচ্ছে না এবং ভবিষ্যতেও কখনো যাবে মনে করার কোন অবকাশ নেই।

আজকের দিনে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত ভাইবোনদের উদ্দেশ্যে বলতে ইচ্ছে করে, আমাদের চারপাশের মানুষগুলো যে দর্শন কিংবা ধর্মাবরনে নিজেদের পরিচয় দিচ্ছেন, তাদের সবার নিশ্চয় অভিজ্ঞতা আছে যে, সুযোগ ফেলেই অন্য ধর্মযোদ্ধা তথা জিহাদীরা কথায় কথায় ওদের ধর্মের মহানতার বিজ্ঞাপন দিয়ে বেড়ায়।

কিন্তু কখনো এরা বলে না মানবতা ও মনুষ্যত্বের কথা, এরা কখনো বলে সর্বমঙ্গলের কথা। সুযোগ ফেলেই সনাতনধর্মের বিরুদ্ধে একরাশ মিথ্যা অপবাদ দিতে এরা কখনো পিছনা হয় না, এরা জেনেও বলে না, এদের পূর্ব পূরুষরাও হিন্দুধর্মের অনুসারী ছিলো এবং নানান জঠিল অবস্থায় পড়ে এদের পূর্ব-পূরুষকে ধর্মান্তর হতে হয়েছে কিংবা এদেরকে বাধ্য করা হয়েছিলো।

ওরা জেনেও না জানার ভান করেন। এর ফলে এদের পূর্বপূরষরগন নরকগামী হয়েছেন এবং আমরাই তাদের অনেক অত্যাচার সহ্য করেও তাদের আদি পূর্ব-পূরুষের ধর্মাচারণ ধারণ ও লালন করে এদেরকে পিতৃ- পূরুষদের পারলৌকিক মুক্তির ব্যবস্থা আমরাই প্রতিনিয়তই করে চলেছি।

নিজধর্ম বিষয়ে যখন কটুক্তি করা হয়, তখন আমাদের ডিজিটাল যুগের সনাতনী পরিবারে জন্ম নেয়া সর্বাধুনিক ভাইবোনেরা এর বিরুদ্ধে পাল্টা জবাব দিতে পারে না। এর কারণ এরা তাদের নিজেদের গৌরবান্বিত ইতিহাস জানে না। এছাড়াও আমাদের ভাই বোনরা যে সনাতনী পরিবার থেকে উঠে এসেছেন, তাদের রক্তে প্রোথিত করা হয় মানুষের মনে আঘাত না করা, কারো বিশ্বাসের ব্যাঘাত না ঘটানো, এভাবেই এদের মনোবৃত্তির বিকাশ ঘটে।

অপরদিকে প্রতিবেশী অন্য ধর্মালম্বীর সম-বয়েসী যুবককে জম্নের পর থেকে শেখানো হয়েছে তার ধর্মের মহানত্বের কথা, শেখানো হয় তার নিজ ধর্ম মতবাদ ব্যতীত পৃথিবীতে অন্য কোন মতবাদ সত্য নয় । শেখানো হয়, অন্যধর্মাবলম্বী তথা সনাতনী হিন্দু ভাই-বোন কোন একজনকে নিজধর্মে আত্মীয়করন তথা দীক্ষিত করতে পারলে বেহেস্হে যাবার পথ সুগম হবে ইত্যাদি ইত্যাদি।

একটু খেয়াল করলে বুঝতে অসুবিধে হবে না যে, এসব মহানধর্মের মানুষ গুলো যখন প্রার্থনার ছলে চিৎকার দিয়ে অন্য ধর্মানুভুতিতে আঘাত সুলভ বক্তব্য রাখেন এবং শুধু ঐধর্মের বা গোষ্ঠির মানুষের কল্যাণের কথা বলেন তখন তাদের সুংকীর্ণতা ছাড়া আর কিছুই প্রকাশ পায় না।

এরা অনুভব করতে পারে না যে পৃথিবীর তাবৎ মানুষের মধ্যে এটা একটি খন্ডিত ক্ষুদ্রাংশ মাত্র। অধিকাংশ মানুষের অমঙ্গল আর অনিষ্ঠ কামনা করে অন্ততঃ “শান্তি” প্রতিষ্ঠা করা যায় না। এরা এসব জানতে কিংবা বুঝার অনুভব করে না, কেননা তাদের বিশ্বাসের বেদীমূলে শুধুমাত্র গোষ্ঠি ভিত্তিক ঠিকে থাকার ভ্রান্ত ধারণা ছাড়া সমগ্র মানবজাতির কল্যানের বিষয়ে ভাবনা কিছু নেই। এভাবেই এদের বেড়ে উঠা ও বিশ্বাসে ভিত্তি পোক্ত হয়।
একজন সনাতনী হিন্দু স¤প্রদায়ের ধার্মিক মানুষ কী করেন?

বৈদিক সভ্যতা

একটু লক্ষ্য করে দেখা যাবে, একজন হিন্দু ধর্মান্ধ ব্যক্তি, যিনি তার স্নানাদি তর্পন শেষে নিজ পুজোর ঘরে প্রবেশ করার পূর্বে তাবৎ পৃথিবীটাকে অশুচি মনে করে হাতে রক্ষিত ঘটির জল ছিটিয়ে সামনের পথ এগিয়ে চলেন এবং স্নানাদি করেনি – এমন মানুষকে অশুচি ভেবে পাশ কাটিয়ে চলেন, যাকে ধর্মান্ধ গোঁড়া হিন্দু বলা হয়

-এমন হিন্দুটিও তাঁর পূজোর ঘরে ইষ্ট দেবতার পূজো শেষে হাত জোড় করে সবার জন্যই প্রার্থনা করে বলেনঃ-
সর্বে ভবন্তু সুখিন,
সর্বে সন্তু নিরাময়া,
সর্বে ভদ্রানি পশ্যন্তু,
মা কশ্চিদ দুঃখ মাপ্নুয়াত,
ওম শান্তি শান্তি শান্তি।

(বৃহদারন্যক উপনিষদ ১/৪/১৪)
অর্থাৎ সবাই যেন সুখী হয়, সকলে যেন নিরাময় হয়, সকল মানুষ পরম শান্তি লাভ করুক, কশ্মিনকালেও যেন কেহ দুঃখ বোধ না করেন। সকলের শান্তি লাভ করুন। কট্টর যে হিন্দু মানুষটি কিছুক্ষন আগে সবাইকে পাশ কাটিয়ে গেল, অসূচি মনে করল, তিনি তাঁর পূজাচ্চনার শেষ প্রান্তে এসে জগতের সকলের জন্যই সুখ ও শান্তি কামনা করছেন। তিনি কারো বিনাশ কামনা করছেন না। তাহলে গোড়া হিন্দু মানুষটাকে নিয়ে কী বলা যাবে? সাম্প্রদায়িক? না কি সর্ব মঙ্গলকামী প্রকৃত ধার্মিক মানুষ?

সাম্প্রদায়িকতা কী ? সাম্প্রদায়িক অপরাধ গুলি কী?

সা¤প্রদায়িকতা হলো ধর্ম, গাত্রবর্ণ কিংবা অন্য কোন বিশেষ পরিচয়ে পরিচিত কোন বিশেষ জাতি গোষ্ঠিকে আলাদা ভাবে চিহিৃত করে কারনে/অকারণে ঐজাতি গোষ্ঠির বিরুদ্ধাচারণ করা। আর ঐ বিশেষ জাতি গোষ্ঠিকে সমূলে নিমূল করবার জন্য সংঘঠিত যে অপরাধ তা হলো জেনোসাইড বা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। এটি আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃত ব্যাখা।

আমরা যদি পেছনের দিকে দেখি, তাহলে দেখব নিকট অতীত ১৯৪৩-৪৭ সাল অবধি দ্বি-জাতিতত্তে¡র বীজ তথা হিন্দু-মুসুলমান আলাদা আবাস এধারনাটি অখন্ড ভারতবর্ষের ঐসময়কার সংখ্যা গরিষ্ট হিন্দু স¤প্রদায়ের নেতাদের ছিল না। গোষ্ঠি ভিত্তিক ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত নোংরা দাবীটি উত্থাপিত হয়েছিলো ঐসময়কার অখন্ড ভারতবর্ষের সংখ্যালঘু তথা মুসলিম স¤প্রদায়ের নেতাদের কর্তৃক।

দ্বিজাতিতত্তে¡ ধারণাটি মুসলিম গোষ্ঠির নেতারা মনগড়া ভাবে উত্থাপন করেননি, বরং এধরনের সা¤প্রদায়িক ধারণাটি প্রোথিত আছে তাদের ধর্ম বিশ্বাসের বেদী মুলে। আমাদের সনাতনী তরুন বন্ধুদের জানা উচিত এধরনের ভাবনা গুলিই হলো সা¤প্রদায়িকতা। আর গোষ্ঠি ভিক্তিক নিমূল ধারনার প্রয়োগ হলো জেনোসাইড, যা সেই ৭১২ সাল থেকে ভারতবর্ষে সনাতনী স¤প্রদায়ের বিরুদ্ধে ধারাবাহিকভাবে সংঘঠিত হয়ে আসছে।

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের দিকে তাকিয়ে দেখি, তাহলে দেখতে পাব, সেই সময়কার পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠি ও তাদের এদেশীয় দালালরা বাছাই করে এদেশের হিন্দু স¤প্রদায়ের মানুষ গুলোকে হত্যার করার প্রাধান্য দিয়েছে এবং হিন্দু বাড়ীঘর ও স্থাপনাগুলি পুড়িয়েছে। কাজটি একটি বিশেষ উদ্দেশ্যে করা হয়েছিলো, আর বিশেষ উদ্দেশ্যটি ছিলো এঅঞ্চল থেকে সম্পূর্ণ রুপে হিন্দু নিমূল করা। এটা শুধু সা¤প্রদায়িকতা নয়, এটি ছিলো কোন হিন্দু জাতি গোষ্ঠিকে নিমূল করবার জঘন্য প্রচেষ্টা, যাকে এদেশে আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ সংক্রান্ত প্রচলিত আইনের ভাষায় বলা হয় মানবতার বিরুদ্ধে জঘন্যতম অপরাধ তথা “জেনোসাইড”।

আমরা যদি স্বাধীনতা উত্তর ১৯৯০ সাল হতে অদ্যাবধি দেখি, তাহলে দেখব হিন্দু মেয়েদের রেপ করা, ফুসলিয়ে নিকাহ করা, ধর্মান্তর করা, হিন্দু বাড়ী, ঘর স্থাপনাতে অগ্নি সংযোগ করা এগুলো মোটেও সাদামাটা বিছিন্ন অপরাধ ছিল না, বরং এগুলো হলো এদেশ হতে হিন্দু স¤প্রদায়কে সমূলে নিমূল করবার মত ধারাবাহিকভাবে মানবতার বিরুদ্ধে জঘন্য অপরাধ তথা ক্রনিক জেনোসাইড। এছাড়াও যদি স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলির শাসনামলের সরকার ব্যবস্থা একটু লক্ষ্য করা হয়, তাহলে দেখতে পাওয়া যাবে, কিছু কিছু আইন কানুন এদেশে অতি সচেতন ভাবে রচনা করা হয়েছে, যা সম্পূর্ণ এদেশের হিন্দু স্বার্থ বিরোধী ধারণার প্রকাশ ব্যতিত অন্য কিছু নয় ।

এছাড়াও পড়াশুনার ক্ষেত্রে প্রথম শ্রেণী থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ পাঠ্য ব্যবস্থায় যা রাখা হয়েছে তা হলো হিন্দুস¤প্রদায়ের ছেলে মেয়েদের ধর্মীয় বিশ্বাসকে মন¯Íাত্বিকভাবে বিনষ্ট করার জঘন্য পাঁয়তারা। এধরনের প্রচেষ্টাও একধরনের জেনোসাইট। কেননা জেনোসাইডের সংজ্ঞায় কোন জাতি গোষ্ঠিকে সমূলে নিমূল করার জন্য শুধুমাত্র অস্র দিয়ে হত্যা করাকে বুঝায় না।

বরং নিদ্দিষ্ট জাতি গোষ্ঠির বিশ্বাসের ভিতকে নড়বড়ে করে দিয়ে ধর্ম বিচ্যুতির মাধ্যমে মূল জাতি ধারা থেকে বিচ্যূত করাটাও জাতিগত নিমূলের সংঙ্ঘার মধ্যে পড়ে, যেটি জেনোসাইড বলা খুব বেশী অন্যায় হবে না। সুতরাং দেখা যাচ্ছে স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের হিন্দুদের উপর শুধু শারীরিক আক্রমন হয়নি কিংবা হচ্ছে না, মনস্ত¡াত্বিকভাবে এদেশের হিন্দুদের বিচ্যূতির করণ ধারা বহাল ছিলো, এখনো আছে এবং ভবিষ্যতে থাকবে।

তরুন বন্ধুদের উদ্দেশ্যে বলা যায়, সনাতনধর্মের অভ্যন্তরে আছে সার্বজনীনতা। এটি কোন বিশেষ গোষ্টির জন্য নয়, এটি সমস্ত মানুষের জন্য। উদাহরন হিসাবে বলা যায়, সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সকল পূজো পার্বনের অনুষ্ঠান গুলো সার্বজনীন অয়োজন হয়। যেখানে স¤প্রদায়ের যাবার এবং অংশ গ্রহণ করবার অধিকার আছে, যা আমাদের প্রতিবেশী ধর্মগুলো কিংবা বর্তমানে প্রচলিত পৃথিবীর অন্য ধর্মে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত।

আরও একটা কথা না বললেই নয়, আমাদের এ অঞ্চলে আমরা যারা বসবাস করছি, আমরা সংখ্যায় কম বলে আমাদের তরুনরা হীনমন্যতায় ভোগে থাকেন। হীনমন্যতার ভোগার কোন কারণ আছে বলে মনে হয় না। এর কারণ হিসাবে বলা যায়, ভারত-পাকি¯Íান-বাংলাদেশ উপমহাদেশের সকল হিন্দু জনগোষ্ঠী যদি আমরা গননার মধ্যে আনয়ন করি, তাহলে দেখা যাবে প্রায় দুই হাজার বছর ধর্মীয় নির্যাতন ভোগ করারর পরও ভারতবর্ষে এখনো অবধি একক ভাবে হিন্দুরাই সংখ্যা গরিষ্ঠ।

এর সাথে যদি শিখ, জৈন, বৌদ্ধদের সংখ্যা যোগ করা হয়, তাহলে শুধু ভারতীয় উপমহাদেশ কেন পুরো পৃথিবীতে সনাতনী স¤প্রদায়ের মানুষের সংখ্যা এখনো প্রায় তিন-চুর্তথাংশই হবে। শিখ, জৈন ও বৌদ্ধরা আধুনিক বিশ্বে এক একটি ধর্ম পরিচয়ে পরিচিত হলেও আদতে এগুলো সনাতন ধর্মাবলম্বীদের উপঅংশ মাত্র।

এসব ধর্ম জম্মান্তর কর্মফলবাদ বিশ্বাস করেন এবং এসব ধর্মের প্রবর্তক গুরুনানক শাহী, মহাবীর জৈন, গৌতম বুদ্ধ কখনো বেদ-বেদান্তের বাহিরে এসে নিজেরা মনগড়া মতবাদ প্রচার করেনি। এমতাবস্থায়, সনাতনী তরুন ভাইবোনদের উদ্দেশ্যে বলছি, আপনার নিজেরা নিজেদের অসাম্প্রদায়িক ধর্মীয় চেতনাবোধে উদ্দীপ্ত হউন।

আপনার ছোটভাই কিংবা বোনটিকে সচেতনতায় উদ্দীপ্ত করুন। দেখবেন আপনি পৃথিবীর ইতিহাসে কলঙ্কিত হবে না, বরং আপনার নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখিত হবার সম্ভবাবনা থাকবে। কেননা, বৈদিক সভ্যতা, সনাতন ধর্ম, হিন্দুত্ববোধ আপনাকে আগ্রাসী করে তুলবে না, বরং আপনাকে করবে পরিশালিত ও মার্জিত। হিন্দুত্ববোধ ও এর চর্চা মানুষকে মানুষ হতে দেবত্বে পৌছাতে পারে। বাবা লোকনাথ, বামাক্ষেপ, শ্রীরামকৃষ্ঞ পরমহংসদেব, স্বামীবিবেকানন্দ, মাহাত্মা গান্ধী, শ্রীশ্রীল প্রভুপাদ – এরা সবাই হিন্দু পরিবারের সাধারণ মানুষই ছিলেন।

শুধু ধর্মচর্চার মাধ্যমে এসকল মনিষী দেবত্বে অবস্থান করছেন। পৃথিবীতে এমন কোন স¤প্রদায় কিংবা ধর্মালম্বী লোক পাওয়া যাবে না, যারা শুদ্ধ হিন্দুত্ব চর্চাকারী এসকল মনিষীদের ঘৃণা করেন। কেননা এসকল মনিষী হিন্দুত্ব চর্চার মাধ্যমে সকল মানুষের কথা এবং জগতের কল্যানের ভাবনার কারণেই এরা সাধারণ মানুষ হতে দেবত্বে পৌঁছেছেন। সুতরাং বৈদিক সভ্যতা, সাংস্কৃতি, সনাতনী ভাবনা তথা হিন্দুত্ব মানব সভ্যতার জন্য ক্ষতিকর নয়, বরং অহংকার।

লেখক- অরুন চন্দ্র মজুমদার
[email protected]

আর পড়ুন…….