চিকিৎসাবিজ্ঞান

প্রাচীন আর্যাবর্তের চিকিৎসাবিজ্ঞান।-দুর্মর

প্রাচীন আর্যাবর্তের চিকিৎসাবিজ্ঞান, ত্বক, মানবদেহের সবচেয়ে বড় প্রত্যঙ্গ, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক প্রত্যঙ্গও কিনা তা নিয়েও হতে পারে বিতর্ক।

কিন্তু তা আমাদের আজকের আলোচ্য নয়। চিকিৎসা বিজ্ঞানের চোখে এই ত্বকের কাজ অসংখ্য ও গুরুত্বপূর্ণ। শরীরকে সকল ক্ষয়ক্ষতি থেকে সুরক্ষা দেয়া, তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা, জল, ঔষধ শোষণ করা ইত্যাদি কতই না কাজ ত্বকের। চিকিৎসাবিজ্ঞান বলছে ত্বকের ৭ টি স্তর।

১) এপিডার্মিস যার ৫ টি ভাগ-
১) Stratum corneum.
২) Stratum lucidum.
৩) Stratum granulosum.
৪) Stratum spinosum.
৫) Stratum basale.

এরপরের স্তরের নাম ডার্মিস(৬নং স্তর)। জীব বিজ্ঞান প্রমাণ করেছে এই স্তরেই আমাদের ঘর্মগ্রন্থি, তৈল গ্রন্থিসমূহ থাকে অর্থাৎ এই স্তর থেকেই ত্বকে ঘাম,তেল এসব নিঃসরণ হয়।

প্রাচীন ভারতের চিকিৎসার ইতিহাস
প্রাচীন আর্যাবর্তের চিকিৎসাবিজ্ঞান
এবং সর্বশেষে থাকে হাইপোডার্মিস (৭নং) নামক স্তর যার কাজ হলো ত্বকের সাথে মাংসপেশীকে সংযুক্ত করা বা ধরে রাখা। অর্থাৎ মোট ৭ টি।
এবার দেখি আজ হতে প্রায় ২৬০০ বছর পূর্বের আর্য চিকিৎসাবিজ্ঞানী ঋষি সুশ্রুত যাকে প্লাস্টিক সার্জারির জনক বলা হয় তিনি তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ সুশ্রুত সংহিতায় কী বলেছেন ত্বকের স্তর নিয়ে।
সপ্ত ত্বচো ভবন্তি
ত্বকের ৭ টি স্তর
(সুশ্রুত সংহিতা, শরীরস্থান, অধ্যায় ৪, শ্লোক ২)
এরপর ৪ নং শ্লোকে সেই ৭ টি স্তরের বর্ণনা দেয়া হয়েছে-
তাসাং প্রথমাবভাসিনী
প্রথম স্তরের নাম আবভাসিনী
এরপর একে একে বাকী ৬ টি স্তরের নাম বলা হয়েছে- লোহিতা, শ্বেতা, তাম্রা, বেদিনী, রোহিণী, মাংসধর।
অর্থাৎ প্রথম ৫ টি স্তর হলো আবভাসিনী, লোহিতা, শ্বেতা, তাম্রা, বেদিনী অর্থাৎ এপিডার্মিস।
রোহিণী নামক ৬নং স্তরটি হলো ডার্মিস। একটু আগেই আমরা দেখেছি জীববিজ্ঞান বলছে এই ডার্মিস নামক স্তরেই ঘামগ্রন্থি, তৈল গ্রন্থিসমূহ থাকে। ঋষি সুশ্রুতও তাই বলে গেছেন ২৬০০ বছর আগে-
ষষ্ঠ রেহিণীনামব্রিহীপ্রমাণাঃ গ্রন্থ্যপচ্য
অর্থাৎ রোহিণী নামক ষষ্ঠ স্তর আক্রান্ত হলে গ্রন্থিসমূহের রোগ হয়! এর মানে হলো গ্রন্থিসমূহ যে এই স্তরেই তা তাঁর জানা ছিল! অথচ আমরা বর্তমান বিজ্ঞানে অণুবীক্ষণ যন্ত্রের মাধ্যমে তা নিশ্চিত হয়েছি কোষ পরীক্ষা করে!
বিজ্ঞান অনুযায়ী এরপরের স্তর হাইপোডার্মিসের কাজ হলো মাংসপেশীকে চামড়ার সাথে ধরে রাখা অর্থাৎ যুক্ত করে রাখা। আর এদিকে ঋষি সুশ্রুত এই স্তরের নাম ই দিয়েছেন মাংসধর!
 

সপ্তমীমাংসধরা নাম…

পাশ্চাত্য ডাক্তার ওয়াইজ এই শ্লোকের টীকাতেও সেই কথাটিই বলেছেন-
Mangshadhara Is The Cellular Tussue That Retains The Muscles In Their Places!

এত নিখুঁতভাবে এত সহস্র বছর আগেই ত্বকের স্তরের ন্যায় সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়ের বর্ণনা দিয়ে যাওয়া চমকপ্রদই বটে!

এমনই অসাধারণ সব নিদর্শন পাওয়া যায় পৃথিবীর প্রাচীনতম বিস্তারিত চিকিৎসাবিজ্ঞান গ্রন্থ এই সুশ্রুত সংহিতায় যা একজন ঋষি কর্তৃক রচিত।

পৃথিবীতে রোগতত্ত্বের এনসাক্লোপিডিয়া নামে খ্যাত Encyclopedia of Epidemiology এর Volume 1 এ
Sarah Boslaugh লেখেন –
“The Hindu text known as Sushruta Samhita is possibly the earliest effort to classify diseases and injuries”

অর্থাৎ সুশ্রুত সংহিতাই সম্ভবত রোগতত্ত্ব সম্পর্কিত প্রাচীনতম বই। গ্রন্থটি দুটি মূল অংশে বিভক্ত। প্রথম পাঁচটি অধ্যায় নিয়ে গঠিত হয়েছে ‘পূর্বতন্ত্র’ এবং পরের অংশটি ‘উত্তরতন্ত্র’। ছয়টি কাণ্ডে বিভক্ত ১৮৬টি অধ্যায়ে বিধৃত চিকিৎসাবিজ্ঞানের এই প্রাচীনতম গ্রন্থটি।

বইটিতে ঋষি সুশ্রুত দিয়ে গেছেন ১১২০ টি রোগের বর্ণনা, ৭০০ ভেষজ উদ্ভিদের কথা, ৬৪ টি রাসায়নিক মিশ্রনের বর্ণনা যা বিভিন্ন খনিজ থেকে তৈরি হয় এবং আরও ৫৭ টি মিশ্রন যা প্রাণিজ উপাদান থেকে প্রস্তুত করা হত । 

১২০ রকমের সার্জিকাল যন্ত্রের উল্লেখ রয়েছে এতে, ৫৬টির রয়েছে বিশদ বর্ণনাসহ। ব্যবহারের আগে যন্ত্রগুলি জলে ফুটিয়ে জীবাণুমুক্ত করা হত, রোগীকে অজ্ঞান করে নেওয়া হত (এনেস্থেসিয়া)।

 

১২০ রকমের সার্জিকাল যন্ত্রের উল্লেখ রয়েছে
১২০ রকমের সার্জিকাল যন্ত্রের উল্লেখ রয়েছে

 

তিনি তার গ্রন্থের বড় অংশই বরাদ্দ রেখেছেন শল্যচিকিৎসা বা সার্জারির জন্য। ১৪ রকম পদ্ধতিতে ১৫ রকম ফ্র্যাকচার বা হাড় ভাঙ্গা সারানোর কথা বলা হয়েছে বইটিতে। 

বইটি পড়লে দেখা যায় প্রাচীনকালে যুদ্ধবিগ্রহে অনেকের অঙ্গহানী  হতো যা মেরামতের পদ্ধতি ঋষি সুশ্রুত বলে গিয়েছিলেন। যেমন সুশ্রুত দেহের অন্য অংশ থেকে চামড়া এনে কেটে যাওয়া নাক মেরামতের বর্ণনা দিয়েছেন। এজন্যই ঋষি সুশ্রুতকে প্লাস্টিক সার্জারির জনক বলা হয়।

প্রায় ২৬০০ বছরের পুরনো বইটিতে আছে ডায়বেটিস (মধুমেহ), হৃদশূল (হার্ট এটাক),  হাইপারটেনশন (রক্তগত বাত) সহ অসংখ্য আধুনিক রোগের বর্ণনা ও চিকিৎসা।

বইটির খ্যাতি এতই প্রভাব বিস্তার করেছিল যে ৭৫০ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে খলিফা আব্বাসীর সময়ে বইটিকে আরবি ও ফারসি ভাষায় অনুবাদ করা হয় কিতাব-সুশ্রুদ-এ-হিন্দ এবং কিতাব-এ-সুশ্রুদ নামে। ৮ম শতকে ইরাকের বাগদাদের চিকিৎসাকেন্দ্রসমূহে ব্যবহারের জন্য বইটি তাদের ভাষায় অনুবাদ করা হয়।

৯ম শতকে বইটি ইউরোপে প্রথম ইতালিতে এরপর সারা ইউরোপে ছড়িয়ে পরে। প্রথম ইউরোপিয়ান হিসেবে বইটির ল্যাটিন অনুবাদ করেন হেসলার এবং জার্মান অনুবাদ করেন মুলার।

প্রাচীন এ গ্রন্থের ঐতিহাসিক মূল্য ও গুরুত্ব বিবেচনায় এনে ২০১৩ সালে ইউনেস্কো সুশ্রুত সংহিতার নেপালি পাণ্ডুলিপিকে বিশ্ব ঐতিহ্যের অন্তর্ভুক্ত করে।

সনাতন আর্য সভ্যতার প্রাচীন নিদর্শনসমূহ জানুন, সকলকে জানান, নিজেদের সমৃদ্ধ ইতিহাসকে ভুলে যাওয়া মহাপাপ।

আর পড়ুন…………….