গুরুতত্ত্ব : বর্তমানে গুরুগিরিকে এখন প্রায় সবাই ব্যবসা বলেই অভিহিত করে থাকেন, এবং সত্য বলতে কি এটা এখন এক বেশ লাভজনক ব্যবসা। আলোচনার শুরুতেই শিক্ষক এবং গুরুর মধ্যে পার্থক্যটা বলে নিই- শিক্ষক তিনিই, যিনি শিক্ষা নিয়ে ব্যবসা করেন;
অর্থাৎ, শিক্ষা দানের বিনিময়ে যিনি কিছু কামনা বা আশা করেন। অনেক সময় শিক্ষকের সংজ্ঞা না জানার কারণে, অনেক ক্ষেত্রেই আমরা শিক্ষা নিয়ে ব্যবসা করার জন্য শিক্ষকদের দোষ বা গালি দিই, আসলে এটা ঠিক নয়; কারণ, শিক্ষা নিয়ে ব্যবসা করেন বলেই তিনি শিক্ষক।
অন্যদিকে গুরু হচ্ছেন তিনি, যিনি শিক্ষা দেওয়ার বিনিময়ে কারো কাছে কিছু আশা করেন না, তার অনুগত বা শিষ্যরা, তার শিক্ষাদানে সন্তুষ্ট হয়ে তাকে যা গুরুদক্ষিণা দেন, তিনি তাই গ্রহণ করেন। অর্থাৎ, শিক্ষকের সাথে চুক্তি জড়িত, আমি তোমাকে এতটা দিবো, তার বিনিময়ে তুমি আমাকে এতটা দিবে। কিন্তু গুরুর বেলায় এমন কোনো চুক্তি নেই, এখানে আদান প্রদানের বিষয়টা সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাধীন।
মহাভারতের এক চরিত্র দ্রোণকে, সাধারণভাবে গুরুদ্রোণ হিসেবে বলা হলেও আসলে তিনি গুরুর পর্যায়ে পড়েন না; কারণ, তিনি এক সুদূর প্রসারী উদ্দেশ্য নিয়ে কুরু ও পাণ্ডবদের ১০৫ ভাইকে শিক্ষা দিয়েছিলেন, এর বিনিময়ে তিনি প্রতিমাসে হস্তিনাপুর থেকে শুধু অর্থসামগ্রীই পেতেন না, সকলের শিক্ষা সমাপ্ত হলে তাদের মাধ্যমে তিনি পাঞ্চাল রাজ্যকে দখল করে তার অতীতের এক অপমানের প্রতিশোধ নেন,
যেখানে পাঞ্চালের রাজা দ্রুপদ, তার ছাত্রজীবনের বন্ধু দ্রোণের বন্ধুত্বকে অস্বীকার ক’রে, ভরা রাজসভায় তাকে ভিখারীর মতো অপমান করেছিলো। দ্রোণের এই আচরণ ছিলো সম্পূর্ণভাবে শিক্ষকের আচরণ, যা কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের মধ্যে শ্রীকৃষ্ণ, তাকে হাড়ে হাড়ে বুঝিয়ে দিয়ে তাকে স্বেচ্ছায় প্রাণ ত্যাগ করতে বাধ্য করেন।
পৌরাণিক কাহিনীগুলোর মধ্যে শুধু পরশুরামকেই যথার্থ গুরু হিসেবে বিবেচনা যায়; কারণ, তার শিক্ষাদানের পেছনে, প্রাপ্তির কোনো উদ্দেশ্য ছিলো না। পরশুরামের উল্লেখযোগ্য তিনজন শিষ্য হলো- ভীষ্ম, দ্রোণ ও কর্ণ।
গুরু ও শিক্ষকের এই সব তত্ত্ব কথাকে পেছনে ফেলে, বর্তমানে গুরু বলতে তাদেরকেই বোঝানো হয়, যারা ধর্মীয় বিষয় সম্পর্কে শিক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্যে হিন্দুদেরকে শিষ্য বানান, কিন্তু নিজের অজ্ঞতা বা হিন্দু সমাজকে রক্ষা করার ব্যাপারে উদাসীনতার কারণে, কোনো হিন্দুকেই স্বপ্রণোদিত হয়ে বা স্বেচ্ছায় কোনো কিছু শেখান না,
শুধু বছরে দু এক বার শিষ্যদের বাড়ীতে সাঙ্গপাঙ্গো নিয়ে যান, শিষ্যদের গোলা খালি করে নিজেদের গতর বাড়ান, আর শিষ্যদের পকেট ফাঁকা করে নিজেদের পকেট ভরান। শুধু যে এই গুরুরা, নিজেদের থেকেই শিষ্যদেরকে কিছু বলেন না বা শেখান না, তাই নয়।
কেউ কেউ মুখ এমন ভাবে বন্ধ করে রাখেন, যেন মনে হয় পেটে বোমা মারলেও তাদের মুখ থেকে কিছু বেরুবে না। আর বেরুবেই বা কোথা থেকে, ভেতরে কিছু থাকলে তো বেরুবে ? কথায় বলে- মূর্খের শক্তি বা সম্মান ততক্ষণ, যতক্ষণ তার মুখ বন্ধ থাকে; আমাদের এই হিন্দুধর্মীয় গুরুরাই তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
এসব কথা আমি বানিয়ে বলছি না, বলছি নিজের অভিজ্ঞতা থেকে; কারণ, ছোটোবেলা থেকেই দেখে আসছি আমাদের বাড়িতে প্রায় প্রতিবছরই আমার বাবা মায়ের গুরু আসতো, সাথে আসতো আরও ৫/৭ জন। আসার পর যে কয়দিন থাকতো, চলতো ধুমসে খাওয়া।
কিন্তু এই জীবনে একবারও দেখি নি যে, সেই গুরু আমার বাবা বা মাকে বলছে, পাড়ার মধ্যে সবাইকে বলে দাও, আজ সন্ধ্যার পর সবাই মিলে বসে ধর্মকথা আলোচনা করা হবে, যার মনে যা প্রশ্ন আছে তার উত্তর দেওয়া হবে। মূলত গুরুদের এই প্রবৃত্তি না থাকার কারণেই হিন্দুরা ধর্মজ্ঞানে পিছিয়ে পড়েছে এবং বিভিন্নভাবে হিন্দু সমাজ ক্ষয়ে যাচ্ছে।
অবশ্য ধর্মজ্ঞানে হিন্দু সমাজ পিছিয়ে পড়ার জন্য দায়ী শুধু এই গুরুরা নয়, আরো বেশি দায়ী আমাদের প্রভাবশালী ও প্রতিষ্ঠিত আশ্রমগুলোও। কেননা, এদের লোকবল, অর্থবল আছে; এরা চাইলেই প্রতি সপ্তাহে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ধর্মসভা করে হিন্দুদেরকে ধর্মজ্ঞান প্রদান করত পারে।
কিন্তু এরা শুধু আশ্রমেই বসে থাকে আর এই প্রত্যাশায় থাকে যে, কখন কোন হিন্দু তাদের আশ্রমে আসবে আর তাদেরকে প্রণাম করে তাদের পেট ভরানোর জন্য প্রনামী দিয়ে যাবে। এই সব আশ্রমে আমাদের হিন্দুরা যত না যায়, ততই মঙ্গল; কারণ, আশ্রমের সাধু-সন্ন্যাসী-মহারাজ নামধারীরা, নিরামিষ খেয়ে খেয়ে যেমন নিজেরা হীনদুর্বল ও নপুংসক হয়ে গেছে, তেমনি এদের সংস্পর্শে যত লোক যাবে, তারা সবাই হবে হীনদুর্বল ও নপুংসক।
এদের আবার সবার মহান আদর্শ হলো বিয়ে না করা! আমি এদেরকে জিজ্ঞেস করছি, হিন্দু শাস্ত্রের কোথায় লিখা আছে যে, নিরামিষ খেতে হবে এবং ধর্ম কর্ম করার জন্য বিয়ে না করে সংসার ত্যাগ করতে হবে ?
যা হোক, এই ধরা ধামে চৈতন্যদেব (১৪৮৬-১৫৩৩) এর আবির্ভাবের পূর্বে গুরুর কাজ করতো শুধু ব্রাহ্মণরাই। তারা লোকজনকে শুধু শাস্ত্র শিক্ষাই দিতো না, হিন্দুদের রক্ষার জন্য দিতো অস্ত্র শিক্ষাও। এমন দুজন বিখ্যাত ব্রাহ্মণ গুরু হলো পরশুরাম ও গুরুদ্রোণ। কিন্তু চৈতন্যদেব আসার পর গুরুগিরিতে প্রায় একচ্ছত্র আধিপত্য ঘটে বৈষ্ণবদের; এখন গুরু বলতেই বৈষ্ণবগুরু, ব্রাহ্মণগুরুরা এখন প্রায় বিলুপ্তপ্রায় প্রাণী।
বর্তমানে গুরুগিরিকে এখন প্রায় সবাই ব্যবসা বলেই অভিহিত করে থাকেন, এবং সত্য বলতে কি এটা এখন এক বেশ লাভজনক ব্যবসা। এই ব্যবসার চোটে গুরুর অবস্থান এখন মর্যাদার দিক থেকে শিক্ষকেরও নিচে। কারণ, শিক্ষক যা নেয়, তাকে তার রিটার্ন দিতে হয় বা তার রিটার্ন দেওয়ার চেষ্টা থাকে।
কিন্তু গুরুগিরির ব্যবসায় রিটার্ন দেওয়ার কোনো ব্যাপারই নেই, এখানে মুখ বুজে শুধুই নেওয়া, কাউকে কোনো জবাবদিহি করতে হয় না; কত নিলাম, তারও কোনো হিসেব দিতে হয় না। কিন্তু বৈষ্ণব সমাজে এই গুরুগিরির ব্যবসা জেঁকে বসার কারণটা কী ?
হিন্দুরা যোগ্য এবং পূজনীয়কে ছেড়ে, বেশির ভাগ সময়ই অযোগ্য এবং অপদার্থকে- শ্রদ্ধা, ভক্তি, পূজা বা মূল্যায়ন করে এসেছে, শাস্ত্র বহির্ভূত এরকম অবতারের অভাব হিন্দু সমাজে নেই, কিন্তু আজকের টপিক যেহেতু ‘গুরু’ এবং আধুনিক গুরুবাদের জনক যেহেতু চৈতন্যদেব, সেহেতু এই পোস্টে শুধু তাকে নিয়েই কথা বলবো।
একটু আগে যা বললাম, তা শুনেই চৈতন্য ভক্তদের মাথার চুল অবশ্যই খাড়া হয়ে গেছে এবং কারো কারো মাথা দিয়ে সম্ভবত ধোঁয়া বের হচ্ছে। তাদের উদ্দেশ্যে বলছি, এখনই মাথা গরম না করে ঠাণ্ডা মাথায় এই পোস্টের বাকি অংশটুকু পড়ে শেষ করুন, তারপর আমার সম্পর্কে মনে যা আসে তা কমেন্ট করবেন।
বৈষ্ণবরা বলে, চৈতন্যদেব হলেন অবতার; শুধু অবতার নন, তিনি হলেন কলিযুগের জন্য রাধা-কৃষ্ণের যুগল অবতার। চৈতন্যদেবের ভক্তরা জানে না যে, তাদের এই দাবীটিই একটি বোগাস দাবী; এর কারণ একটু পরেই বুঝতে পারবেন-
শাস্ত্রমতে পৃথিবীতে অবতার আছে শুধু বিষ্ণুর এবং এই অবতারের সংখ্যা মাত্র ১০টি। এই ১০ টির মধ্যে চৈতন্যদেব বা নিমাই সন্ন্যাস বলে কেউ আছে ? না, নেই। তাহলে তাকে অবতার বলছেন কেনো ?
আবার এই দাবী করা হয় যে, চৈতন্যদেব হলেন রাধা-কৃষ্ণের যুগল অবতার। যারা আমার পুরোনো পাঠক, তারা জানেন যে, কৃষ্ণের জীবনে রাধা বলে কোনো প্রেমিকা ছিলো না; রাধা শুধুই কৃষ্ণের বাল্যকালের খেলার সাথী, কৃষ্ণ ১০ বছর ২ মাস বয়সে বৃন্দাবন ছেড়ে গেলে, যার সাথে কৃষ্ণের দেখা সাক্ষাত শেষ হয়ে যায় এবং এই রাধা, কৃষ্ণের জীবন উল্লেখযোগ্য কিছু ছিলো না ব’লে, হিন্দু ধর্মের প্রাচীন কোনো গ্রন্থে যার কোনো উল্লেখই নেই।
তার মানে, রাধাকে গুরুত্ব দিয়ে, চৈতন্যদেবকে রাধা-কৃষ্ণের যুগল অবতার বলা হলেও, কৃষ্ণের জীবনে রাধা বলে যেহেতু কেউ নেই, সেহেতু চৈতন্যদেবের অবতার দাবীর অর্ধেক এখানেই শেষ হয়ে যায়, আর বাকি অর্ধেক শেষ হয়ে যায় এই যুক্তিতে যে- কৃষ্ণ, পৃথিবীতে নিজেই অবতার, তার আবার অবতার আসবে কোথা থেকে ?
যদিও গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন যে, সংকটকালে তিনি পৃথিবীতে নেমে আসেন বা আসবেন, কিন্তু সেটা তিনি বলেছেন, বিষ্ণুর প্রতিনিধি হিসেবে, কৃষ্ণ হিসেবে নয়। কারণ, অবতার হিসেবে শুধু বিষ্ণুই পৃথিবীতে নেমে আসেন, শাস্ত্রে সে কথা ই বলা আছে।
এ তো গেলো থিয়োরির ব্যাখ্যা। এখন কাজের দিক থেকেও দেখা যাক, চৈতন্যদেব কোনো অবতার হতে পারেন কিনা ? পৃথিবীতে যারাই অবতার বলে স্বীকৃত, তারাই দুষ্টদের দমন করে পাপীদের বিনাশ করে পৃথিবীতে ধর্ম প্রতিষ্ঠা করেছেন বা করতে সাহায্য করেছেন।
এক কথায় তারা প্রত্যেকে ছিলো পাওয়ারফুল বা শক্তিমান, কিন্তু চৈতন্যদেবের মধ্যে কি এরকম কিছু ছিলো ? চৈতন্যদেবের সময়, বাংলা ছাড়াও সারা ভারতে হিন্দু হত্যাকারী পাপী মুসলমান শাসকদের অভাব ছিলো না, যারা তরবারি জোরে হিন্দুদেরকে মুসলমান বানিয়েছে বা হত্যা করেছে বা জিজিয়া কর দিতে বাধ্য করেছে, চৈতন্যদেব কয়জনকে বিনাশ করেছেন ?
এরপর চৈতন্যদেবের জ্ঞান বুদ্ধির অবস্থা দেখুন- ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ, জয়দেবের গীত গোবিন্দ, বড়ু চন্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য এবং কিছু পদাবলী কীর্তনের বর্ণনাকে ভিত্তি করে চৈতন্যদেব বিশ্বাস করে নিয়েছিলেন যে, রাধা বলে কেউ আছে এবং রাধাকেই তার জীবনের ধ্যান জ্ঞান করে নিয়েছিলেন।
কারণ, চৈতন্যদেবের বিশ্বাস ছিলো, রাধা যেমন কৃষ্ণের জন্য ব্যাকুল ছিলো, তেমন ব্যাকুল হলে নিশ্চয় কৃষ্ণকে পাওয়া যাবে। কিন্তু রাধার কথা যে, হিন্দু শাস্ত্রের প্রাচীন কোনো গ্রন্থ, যেমন- মহাভারত, উপনিষদ, বেদ এ উল্লেখ নেই, তা তিনি জানতেন না, তার মানে হিন্দু শাস্ত্রের প্রাচীন কোনো গ্রন্থ সম্পর্কে চৈতন্যদেবের কোনো ধারণা ছিলো না। শুধু তাই নয়, তার দূরদর্শিতার কী অবস্থা ছিলো, সেটাও দেখুন নিচে-
চৈতন্যদেব ছিলেন অসম্ভব মেধার অধিকারী। একবার পড়েই তিনি যেকোনো কিছু মুখস্থ রাখতে পারতেন। তো একবার তিনি কোনো এক গ্রন্থ লেখার কাজে হাত দিয়েছিলেন, কিছুটা লিখেও ছিলেন। এই খবর গ্রামের অনেকে জেনেও গিয়েছিলো। সেই দিন তিনি, নৌকায় বসে সেই লেখার কাজটি এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন, এমন সময় সেখানে তার এক বন্ধুসম ভক্ত কান্নাজড়িত কন্ঠে এসে হাজির।
কারণ জিজ্ঞেস করতেই সে বলে, আমি একটা বই লিখছিলাম, পরে শুনলাম সেই একই বিষয় নিয়ে তুমিও লিখছো, তোমার বই থাকতে আমার বই কেউ পড়বে ? এই দুঃখেই কাঁদছি। শুনে চৈতন্যদেব বলেন, ও এই কথা ? ব’লেই পাণ্ডুলিপিটি জলে ফেলে দিয়ে বললেন, যা আর লিখবো না, তুই ই লেখ, লোকজন তোর বই ই পড়বে।
এটা কি কোনো বুদ্ধিমানের কাজ হয়েছে ? আমি যা এবং যেভাবে লিখবো, তা কি কারো পক্ষে লিখা সম্ভব ? কেউ কি কারো মতো লিখতে পারে ? হতে পারতো, চৈতন্যদেব যা লিখতো, তা হিন্দু শাস্ত্রের একটি অমূল্য বা অনন্য সম্পদ হতো, যেমন হয়েছে মহাভারত বা রামায়ন। কেউ কারো মতো লিখে তার অবস্থান কেড়ে নিতে পারে না, এই জ্ঞান চৈতন্যদেবের ছিলো না।
পরবর্তীতে চৈতন্যদেবকে নিয়ে বহু গ্রন্থ রচিত হয়েছে, কিন্তু একটি লাইনও চৈতন্যদেবের নিজের লিখা নয়, এই তথ্য সম্ভবত খুব কম চৈতন্য ভক্তই জানে বা কেউ ই জানে না। উপরের ঐ গল্প নিয়ে কারো যদি কোনো সন্দেহ থাকে, তাকে একটি প্রশ্ন করছি, এত মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও কেনো কোথাও চৈতন্যদেবের একটি লাইনও লিখা নেই ?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজবেন, তাহলেই আমার কথার সত্যতা পেয়ে যাবেন। এখানে আরেকটা তথ্য জেনে রাখেন, বাংলা সাহিত্যে প্রথম যে জীবনী গ্রন্থ লিখা হয়, সেটা চৈতন্যদেবের, তার আগে কারো জীবনী লেখা হয় নি।
এবার চৈতন্যদেবের পারিবারিক জীবনের দিকে নজর দেওয়া যাক। চৈতন্যদেব, তার সদ্য বিবাহিত স্ত্রীকে ফেলে চলে গিয়েছিলো; এটা কি তার উচিত হয়েছে ? তার উদ্দেশ্যই যদি ছিলো সংসার ত্যাগ করা, তাহলে তার বিয়ে করার দরকার কী ছিলো ?
আর বিয়ে করার পর এভাবে স্ত্রীকে ত্যাগ করে একটি মেয়ের জীবন নষ্ট করার মানে কী ? প্রত্যেকেই চায়, সবাই তাকেই অনুসরণ করুক, এই সূত্রে চৈতন্যদেবের সব ভক্তরা যদি তাদের গুরুর অনুসরণে তাদের স্ত্রীকে ত্যাগ করে চলে যাওয়া শুরু করে, সমাজ সংসার কয় দিন টিকবে ?
শুধু তাই নয়, চৈতন্যদেবের বড় ভাই, আগেই সংসার ত্যাগ করে চলে গিয়েছিলো, চৈতন্যদেবের পিতাও মারা গিয়েছিলো, মাকে দেখার চৈতন্যদেব ছাড়া কেউ ছিলো না, এই অবস্থায় মায়ের দেখা শোনা করা চৈতন্যদেবের কি উচিত ছিলো না ?
মা ও স্ত্রীর প্রতি দায়িত্ব পালন না ক’রে সংসার ত্যাগ করে চৈতন্যদেব কি ঠিক কাজ করেছে ? গৌতম বুদ্ধের বাপের মতো, চৈতন্যদেবের বাপের কি জমিদারী ছিলো ? চৈতন্যদেব এর পরিত্যক্ত স্ত্রী ও মায়ের ভরণ পোষন চলতো কিভাবে ? আর সেই সময় বাংলায় ছিলো মুসলমান শাসন, মুসলমানরা যদি চৈতন্যদেবের মাকে হত্যা করে তার স্ত্রীকে তুলে নিয়ে যেতো, তাহলে কী অবস্থা হতো ?
চৈতন্যদেব মানসিকভাবেও সুস্থ ছিলো না, কালো কোনো কিছু দেখলেই তাকে কৃষ্ণ মনে করে জড়িয়ে ধরতো। একবার নদী পার হওয়ার সময়, কালো জল দেখে, কৃষ্ণ ব’লে নদীতে ঝাঁপ দিয়েছিলো, অন্যরা তাকে টেনে তুলে বাঁচায়। এই লোককে বৈষ্ণবরা, ভগবান বানিয়ে- “ভজ গৌরাঙ্গ, লহ গৌরাঙ্গ” ব’লে দিন রাত চিৎকার করছে, আর তাদের দেখাদেখি এখন অন্য হিন্দুরাও বৈষ্ণবদের সাথে সুর মিলিয়ে জন্ম, মৃত্যু বা অন্নপ্রাশনে মহাপ্রভুর ভোগ দিচ্ছে, যে ভোগের গানে কৃষ্ণের কোনো আরাধনা নেই, শুধুই আরাধনা চৈতন্যদেবের, হিন্দুদের ভবিষ্যৎ কী ?
বৈষ্ণব সমাজের আরেকটি সর্বনাশা এবং ভয়ংকর আত্মমর্যাদা বিনাশকারী থিয়োরি হলো বাধ্যতামূলক ভিক্ষা করা। কেউ যখন ভেক দেওয়ার মাধ্যমে বৈষ্ণবত্বে দীক্ষা নেয়, তখনও যেমন তাকে ভিক্ষা করতে হয়, তেমনি কেউ যখন মারা যায়, তখনও তার ছেলেকে কয়েক বাড়ি ভিক্ষা করে তার বাপের শেষকৃত্য সম্পন্ন করতে হয়। এছাড়াও প্রতিটি বৈষ্ণবের জন্য বাধ্যতামূলক হলো- প্রতিদিন ভিক্ষা করা, এখন পৃথিবীর সবাই যদি বৈষ্ণব হয় এবং সবাই ভিক্ষা করা শুরু করে, তাহলে কে কাকে ভিক্ষা দেবে ?
পশ্চিমবঙ্গের রানাঘাট স্টেশনে আমি এক বৈষ্ণব গোঁসাইকে বলেছিলাম, ব্যারাকপুরের এক মন্দিরে স্থায়ীভাবে থাকবেন, যেখানে আপনার থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করা হবে এবং হাত খরচের জন্য কিছু টাকাও দেয়া হবে, সেই গোঁসাই রাজী হয় নি; কারণ, তাকে প্রতিদিন মাধুকরী (বাড়ি বাড়ি ভিক্ষা) করতে হবে। এরপর আমি বললাম, এই ভিক্ষা কি করতেই হবে ?
সে বললো, প্রভু যে করে গিয়েছে! তার মানে গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু নিজে ভিক্ষা করে গেছেন, এখন তার শিষ্যদের না করলে চলবে কিভাবে ? এই ভিক্ষার সাথে বৈষ্ণবদের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো কান্নাকাটি করা। এসব দিয়ে কি একটি আত্মমর্যাদাশীল জাতি গঠন করা সম্ভব ?
যিনি অবতার তিনিই ভগবান, আর ভগবান মানেই- যশ, বীর্য, ঐশ্বর্য, জ্ঞান, শ্রী, বৈরাগ্য- এই ছয়টি গুনের আধার; চৈতন্যদেবের মধ্যে কয়টি ছিলো ? যারা চৈতন্যদেবকে ভগবান বানিয়ে পূজা করছে, তাদের পূজা প্রার্থনার ফল কী ?
যা হোক, চৈতন্যদেবের শাস্ত্র বিরোধী দুটি প্রধান থিয়োরি হলো- দাহ করার পরিবর্তে সমাধিস্থ করা এবং অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় শ্রাদ্ধ করার পরিবর্তে মহাপ্রভুর ভোগ; এগুলোকে শাস্ত্র বিরোধী বললাম এ কারণ যে, বেদ-গীতায় এই দুটির পক্ষেই কোনো কথা বলা নেই। এই চৈতন্যদেবের অনুসারীদের আরেকটি থিয়োরি হলো- মোক্ষলাভ করতে হলে গুরু ধরতেই হবে এবং সেই গুরুকে হতে হবে অবশ্যই বৈষ্ণব গুরু এবং কোনো অবস্থাতেই কূলগুরুকে ত্যাগ করা যাবে না বা গুরু বদলানো যাবে না।
এটা যে নিজেদের গুরুগিরি ব্যবসাকে টিকিয়ে রাখার জন্য বলা, সেটা বোঝার জন্য খুব বেশি বুদ্ধিমান হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না, একটু ভাবলেই তা বোঝা যায় এবং একটু পর সেটা আরো ভালো করে বুঝতে পারবেন।
গুরু অবশ্যই ধরতে হবে; কারণ, গুরু হলো পথপ্রদর্শক। গুরু ধরলে, সে আপনাকে এমন পথ দেখাবে, যার মাধ্যমে আপনি সঠিক পথে এগিয়ে খুব দ্রত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারবেন। কিন্তু গুরুর জ্ঞান বুদ্ধি যদি সেই স্তরের না হয়, তাহলে আপনি কি আপনার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারবেন ? পারবেন না।
যাদের কাছে আমরা প্রাইমারি স্কুলে পড়েছি, তারাও আমাদের গুরু; যারা আমাদেরকে হাইস্কুলে পড়িয়েছে, তারাও গুরু; যারা কলেজে পড়িয়েছে, তারাও; যারা ইউনিভার্সিটিতে পড়িয়েছে তারাও। এখন আপনার গুরুর জ্ঞান যদি প্রাইমারি লেভেলের হয়, তার কাছে কি হাইস্কুল লেভেলের জ্ঞান আশা করতে পারবেন ?
পারবেন না। আবার হাইস্কুল লেভেলের গুরুর কাছ থেকে কলেজ বা ইউনিভার্সিটির জ্ঞান অর্জন করত পারবেন ? পারবেন না। তার মানে একবার কাউকে গুরু ধরলে, তাকে ছাড়া যে অন্য গুরুর কাছে যাওয়া যাবে না বা অন্য কাউকে গুরু হিসেবে স্বীকার করা যাবে না, এটা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক কথা। যারা আমাদেরকে প্রাইমারি স্কুলে পড়িয়েছে তারাই শুধু আমাদের স্যার, না সমগ্র শিক্ষাজীবন ধরে যারা আমাদেরকে পড়িয়েছে, তারা সবাই আমাদের স্যার ?
নিশ্চয় সবাই আমাদের স্যার। তাহলে বৈষ্ণব গুরুরা আমাদেরকে একটি ক্ষুদ্র গণ্ডীর মধ্যে আটকে রাখতে চাচ্ছে কেনো ? বৈষ্ণব গুরুরা কি প্রত্যেকেই ঈশ্বর যে তারা সব জানে ? তাই একজনকে গুরু হিসেবে ধরলে, তাদের মতে, তাকে আর ছাড়া যাবে না বা আর অন্য কারো কাছে যাওয়া যাবে না বা যাওয়ার প্রয়োজন নেই ?
এখানে আর একটা বিষয় গুরুত্বপূর্ণ যে, ‘গুরু ছাড়া’ বলে কিছু হয় না; আপনি প্রাইমারী স্কুলে যার কাছে পড়েছেন, পরে হাইস্কুলে বা কলেজে পড়ার পর কি প্রাইমারী স্কুলের স্যারদের, স্যার না ব’লে অস্বীকার করতে পারবেন ?
পারবেন না। গুরু হলেন তিনি, যিনি জ্ঞান প্রদান করেন। একবার বা একদিনের জন্য যাকে আপনি শিক্ষক হিসেবে মেনেছেন বা যার কাছ থেকে কিছু শিখেছেন, সে যেমন আপনার সারা জীবনের শিক্ষক, তেমনি গুরুও; যাকে আপনি একবার গুরু হিসেবে মনে করেছেন, সে আপনার সারাজীবনের গুরু। তাহলে এখানে প্রশ্ন হচ্ছে, কখন এবং কেনো আপনি নতুন গুরু সন্ধান করবেন বা তার কাছে যাবেন ?
যতক্ষণ কোনো গুরু, আপনার মনে উদিত হওয়া সকল প্রশ্নের জবাব, শাস্ত্রসম্মত ও যুক্তিসঙ্গতভাবে দিতে সক্ষম, ততক্ষণ আপনার নতুন কোনো গুরুর অনুসন্ধান করার প্রয়োজন নেই এবং কেউ তা করেও না। কিন্তু যদি আপনার গুরু আপনার সকল প্রশ্নের সন্তোষজনক জবাব দিতে না পারে, তাহলে উচ্চতর জ্ঞানের জন্য আপনাকে নতুন গুরুর কাছে যেতেই হবে বা নতুন গুরু ধরতেই হবে, যেমন বাচ্চার পড়াশোনার উন্নতি না হলে, আপনি আপনার বাসায় প্রাইভেট টিউটরকে বদলিয়ে থাকেন।
কোনো গুরু, তার শিষ্যদের প্রশ্নের সন্তোষজনক জবাব দিতে না পারলে বা শিষ্যের জ্ঞান ও দক্ষতা অনুযায়ী শিক্ষা দিতে না পারলে সেই গুরুর উচিত, নিজেই তার শিষ্যদেরকে নতুন কোনো গুরুর সন্ধান দেওয়া, যেমন- মহাভারতে, কর্ণের প্রথম গুরু, নিজেই কর্ণকে বলেছিলো গুরু দ্রোণের কাছে যেতে, কিন্তু গুরু দ্রোণ তাকে শিক্ষা দিতে রাজী না হলে কর্ণ পরশুরামের কাছে যায় এবং তার কাছে শিক্ষা লাভ করে।
ব্যাপারটা এই রকম যে, উচ্চতর জ্ঞানের জন্য প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক যেমন তার ছাত্রদেরকে হাইস্কুলে পাঠায়, আবার হাইস্কুলের শিক্ষক পাঠায় কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে; তেমনি অল্পজ্ঞানী গুরুরও উচিত তার শিষ্যদেরকে যোগ্য গুরুর কাছে পাঠানো।
এমন হলে পুরানো এবং নতুন উভয়গুরুই শিষ্যর কাছে সম্মানিত হন বা হবেন। কিন্তু কোনো গুরু যদি তার শিষ্যের জ্ঞান স্পৃহাকে আটকে রাখার চেষ্টা করে এবং এ নিয়ে সেই শিষ্যের মধ্যে বিন্দুমাত্র কোনো প্রশ্নের উদয় হয়, তাহলে সেই গুরুর গুরুত্ব বা গুরুগিরি, সেই শিষ্যের কাছে এমনি ই খারিজ হয়ে যাবে, তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে সেই গুরুকে বাদ দেবার কোনো প্রয়োজন হবে না।
শুধু জ্ঞানের ঘাটতি এবং তা মেটানোর জন্য, নতুন কোনো গুরুর কাছে শিষ্যকে না পাঠানোর জন্যই নয়, গুরুর কোনো আচরণ নিয়ে যদি কোনো শিষ্যের মধ্যে বিন্দু মাত্র প্রশ্নের উদ্রেক হয় বা তার প্রতি কোনো কারণে শ্রদ্ধাবোধ নষ্ট হয়, তা হলেও সেই গুরু, আর সেই শিষ্যের জন্য গুরু হিসেবে থাকবে না।
গুরু-শিষ্যের ব্যাপারটা যেহেতু ছাত্র-শিক্ষকের মতোন চুক্তির বিষয় নয়, তাই গুরু হিসেবে কাউকে মনে স্থান দেওয়া শিষ্যের সম্পূর্ণ নিজস্ব ব্যাপার, কেউ যদি কারো জ্ঞান ও আচরণে মুগ্ধ হয়ে, কাউকে গুরু হিসেবে মনে করে,
তাহলেই সে তার গুরু এবং যদি কোনো কারণে তার কোনো বিষয় নিয়ে তার মনে সংশয়ের সৃষ্টি হয়, তাহলেই সেই শিষ্যের কাছে তার গুরুগিরি শেষ। জোর করে যেমন জনপ্রিয় হওয়া যায় না, তেমনি এসব ক্ষেত্রে গুরুরও কিছু করার নেই, যা করবে সব পাবলিক অর্থাৎ জনগন অর্থাৎ শিষ্য।
বৈষ্ণব গুরুবাদের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো-
“গুরু ত্যাগী গোবিন্দ ভজে, সেই পাপী নরকে মজে।”
এটা হিন্দু শাস্ত্রের নয়, বৈষ্ণব শাস্ত্রের কথা। কারণ, এমন কথা গীতার কোথাও বলা নেই, যে গীতা হিন্দুধর্মের প্রধান শাস্ত্র গ্রন্থ; বরং গীতার ৯/২৯ নং শ্লোকে বলা আছে,
“সমোহহং সর্বভূতেষু ন মে দ্বেষ্যোহন্তি ন প্রিয়ঃ।
যে ভজন্তি তু মাং ভক্ত্যা ময়ি ত তেষু চাপ্যহম।।
এর অর্থ- আমি সকলের প্রতি সমভাবাপন্ন। কেউ আমার প্রিয় বা কেউ অপ্রিয় নয়। যারা ভক্তিপূর্বক আমাকে ভজনা করেন, তারা আমাতে অবস্থান করেন এবং আমি তাদের মধ্যে বাস করি।
এখানে কি বলা আছে যে, আমাকে ভজনা করার পূর্বে তোমাদেরকে গুরু ধরতে হবে ? না নেই। তাহলে বৈষ্ণবগুরুরা কিসের ভিত্তিতে এই কথা বলে থাকেন যে, গুরু না ধরলে কৃষ্ণকে ভজনা করা যাবে না ?
শাস্ত্রীয় কোনো ভিত্তি না থাকলেও এটা যে তাদের ব্যবসার ভিত্তি, সেটা তো আর ব্যাখ্যা করে বলবার প্রয়োজন নেই। কারণ, এই বাইন্ডিংস না দিলে কেউ তো আর গুরু ধরবে না, আর তাদের ব্যবসাও বাড়বে না বা টিকে থাকবে না।
কোনো কোনো গুরু এই মতে বিশ্বাসী এবং এটা প্রচার করে যে, যে দীক্ষা নেবে না, তার হাতে জলও খাওয়া যাবে না। এটা কিন্তু তারা এমনি এমনি বলে না, বৈষ্ণব শাস্ত্রে এর ভিত্তি আছে এবং স্বয়ং চৈতন্যদেব, যারা দীক্ষিত নয়, তাদের হাতে কখনো খান নি এবং এ সম্পর্কে, বৈষ্ণব শাস্ত্রে যে নির্দেশ দেওয়া আছে,
তা খুবই ভয়ংকর, বলা আছে, যারা দীক্ষা নেয় নি, তাদের হাতের জলকে মূত্র তুল্য এবং অন্যান্য খাদ্যদ্রব্যকে মলের তু্ল্য বিবেচনা করবে। এই দিক থেকে বৈষ্ণবদের থিয়োরি, মুসলমানদের থিয়োরি থেকে কম কিছু নয়, ইসলাম গ্রহণ না করলে, মুসলমানদের প্রতি ইসলামের নির্দেশ যেমন অমুসলমানদেরকে ঘৃণা করা, তেমনি দীক্ষা না নিলেও বৈষ্ণব থিয়োরি বলে, অন্যদেরকে ঘৃণা করতে।
গুরুবাদে দীক্ষা ও শিক্ষা ব’লে দুটো শব্দ আছে এবং এর সম্প্রসারিত রূপ হিসেবে দীক্ষামন্ত্র এবং শিক্ষামন্ত্র বলেও দুটো কথা আছে এবং এই দুটি বিষয় অনেকের কাছেই তেমন পরিষ্কার নয় যে, আসলেই দীক্ষা মন্ত্র এবং শিক্ষামন্ত্র বলতে কী বোঝায় ?
যখন আপনি কোনো গুরুর কাছে দীক্ষিত হচ্ছেন, সেটাই হলো দীক্ষা, আর শিক্ষা হলো, সেই গুরু আপনাকে যা শেখাবে তা। এখানে দীক্ষামন্ত্র বা শিক্ষামন্ত্র বলে কিছু নেই। যদি কিছু থাকে তা হলো- দীক্ষামন্ত্র ও শিক্ষামন্ত্রের নামে একাধিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে বাধ্য করে তথাকথিত গুরু কর্তৃক শিষ্যকে শোষণ করার প্রক্রিয়া।
আর একটা কথা এখানে না বললেই নয় যে, তথাকথিত দীক্ষা বা শিক্ষা, শুধু মাত্র কানে কানে কোনো একটি বীজমন্ত্র বলে দেওয়া এবং তা শিষ্যকে জপ করতে ব’লে খেয়ে দেয়ে বিদায় হয়ে বছরের পর বছর ধরে শিষ্যের কাছ থেকে উধাও হয়ে থাকা নয় বা বছরে একবার করে সেই শিষ্যের বাড়িতে গিয়ে পদধুলি দিয়ে তাদেরকে ধন্য(!) করা নয়;
কাউকে দীক্ষা দেওয়ার মানে হলো তার ভালো মন্দ সকল কিছুর দায়িত্ব নেওয়া, তার বিপদে আপদে তাকে পথ দেখানো। সুতরাং যে গুরু আপনার কানে কানে কোনো বীজমন্ত্র বলে দিয়ে তার পাওনা প্রণামী নিয়ে উধাও হয়ে গেছে, তারপর আপনার আর কোনো খোঁজখবর রাখে না, ধরে নেবেন সে আপনার গুরু নয়।
আদর্শ গুরু কেমন হবে, সেটা সম্ভবত উপরে সবাইকে বোঝাতে পেরেছি, এখন আদর্শ শিষ্য কেমন হবে, সে সম্পর্কে হরিভক্তবিলাসে (১/৬১ )বলা হয়েছে –
“আচার্যস্য প্রিয়ং কুর্যাত্ প্রাণৈরপি ধনৈরপি ৷
কর্মনা মনসা বাচা স যাতি পরমাং গতিম্৷৷”
এর অর্থ- যে ব্যক্তি কায়, মন, প্রাণ, বাক্যও ধন দ্বারা গুরুদেবের সন্তোষ বিধান করেন তিনিই উপযুক্ত শিষ্য এবং তিনিই পরমা গতি লাভ করেন ৷
শেষে চৈতন্যদেবকে নিয়ে আরেকটা কথা না বলে পারছি না; সমাজ টিকে থাকে জনসংখ্যার উপর, নিমাইকে তার পিতা মাতা জন্ম দিয়েছিলো বলেই, নিমাই পরে চৈতন্যদেব হয়ে জগতে বিখ্যাত হয়ে আছেন। যদি তার পিতা মাতা তাকে জন্ম না দিতো, তাহলে এর কিছুই হতো না। এর মানে হলো যার জন্ম হবে তার মধ্যে কোনো না কোনো সম্ভাবনাও থাকবে, যেমন নরেন্দ্র মোদীর জন্ম হয়েছে বলেই সে আজ ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়ে হিন্দুদের জন্য কিছু ভূমিকা রাখতে পারছে;
আবার আমার জন্ম হয়েছে বলেই সমাজের জন্য কিছু করার চেষ্টা করছি, কিন্তু আমার বাবা মা যদি আমার জন্মই না দিতো, আমি কি কিছু করতে পারতাম ? পারতাম না। তার মানে সন্তান জন্ম দেওয়া সমাজকে টিকিয়ে রাখার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। চৈতন্যদেব কি এই ভূমিকাটি পালন করেছেন ? করেন নি। এখন সব হিন্দু যদি চৈতন্যদেবের আদর্শকে অনুসরণ ক’রে সন্তান জন্ম না দিয়ে স্ত্রীকে ফেলে রেখে পালিয়ে যায়, হিন্দু সমাজ কয় দিন টিকে থাকবে ?
এখন দিব্যজ্ঞানীদের উদ্দেশ্যে আরো কিছু প্রশ্ন করছি, চৈতন্যদেব কার আদর্শ অনুসরণ করে সংসার ত্যাগ করেছিলেন ? আমাদের প্রাচীন মুনি-ঋষিরাও বিয়ে করেছেন, সংসার করেছেন, সন্তানের জন্ম দিয়েছেন।
শুধু তাই নয়, হিন্দুদের জন্য সবচেয়ে বড় আদর্শ হলো ভগবান শ্রী কৃষ্ণ, তিনি কি প্রেম করেন নি ? বিয়ে করেন নি ? সংসার করেন নি ? রাষ্ট্র পরিচালনা করেন নি ? যুদ্ধ করেন নি ? পাপীদের শাস্তি দেন নি ? তিনি কি সংসার থেকে পালিয়ে বেড়িয়েছেন ?
চৈতন্যদেব কৃষ্ণকে পাবার জন্য ব্যাকুল ছিলেন, কিন্তু তিনি কৃষ্ণের কোন আদর্শকে ফলো করেছেন, আর কার আদর্শ অনুসরণ করে স্ত্রী ও সংসার ত্যাগ করেছিলেন ? এছাড়াও বর্তমানের আশ্রম নিবাসী সাধু-সন্ন্যাসী-মহারাজরা, কার আদর্শ ফলো করে সংসার ত্যাগ করে এবং সন্তানের জন্ম দেয় না ?
কার আদর্শ ? কার ? মহাভারতে বলা আছে, “যে নিঃসন্তান, তার দান, যজ্ঞ, উপবাস সবই বৃথা” এবং সন্তানহীনদের পিতৃঋণ শোধ হয় না, সেজন্য তারা কখনো স্বর্গেই যেতে পারবে না, মুক্তি বা মোক্ষ লাভ তো দূরের কথা। তাহলে সংসার ধর্ম পালন না করে, মোক্ষ লাভের চিন্তা কি সঠিক পথ ?
শুরুর দিকে আমি বলেছি,
হিন্দুরা যোগ্য এবং পূজনীয়কে ছেড়ে, বেশির ভাগ সময়ই অযোগ্য এবং অপদার্থ ব্যক্তিদেরকে- শ্রদ্ধা, ভক্তি, পূজা বা মূল্যায়ন করে এসেছে, শাস্ত্র বহির্ভূত এরকম অবতারের অভাব হিন্দু সমাজে নেই।
আমি এটা বলেছি, সেইসব হিন্দু ধর্মগুরুদের উদ্দেশ্যে- যারা নিরামিষ খাওয়ার এবং বিয়ে ও সংসার না করে এবং সন্তানের জন্ম না দিয়ে নপুংসকের মতো ভীক্ষা করে জীবন চালিয়ে সাধু-সন্ন্যাসী হওয়ার পক্ষপাতী। কারণ, এটা বেদ ও গীতার শিক্ষার বিরোধী; বেদ এ- ব্রহ্মচর্য, গার্হস্থ্য, বাণপ্রস্থ ও সন্ন্যাস আশ্রমের কথা বলা আছে,
যেটা মানুষের জন্য আদর্শ জীবন পদ্ধতি, আর গীতায় কাম ক্রোধকে ত্যাগ করে কাউকে নপুংসক হতে বলা হয় নি, বলা হয়েছে- কাম, ক্রোধকে নিয়ন্ত্রণ করতে, যাতে তা সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য অনর্থের কারণ না হয়। গীতা তো ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বাণী, গীতায় তিনি যদি কাম ক্রোধকে নিয়ন্ত্রণ করতে বলতেন, তাহলে কি তিনি বিয়ে ও সংসার করতেন ? এবং ক্রোধের বশে শিশুপালসহ অন্যদেরকে হত্যা করতেন ?
যদি কোনো ব্রহ্মজ্ঞানী থাকেন, আমার এই সব প্রশ্নের জবাব দেবেন, আপনার জবাবে আমাকে যদি মুগ্ধ করতে পারে, তাহল অবশ্যই আমি আপনার শিষ্যত্ব গ্রহন করবো।
শেষ কথা শুনে রাখেন, যেটা উপরেও বলেছি, “যেসব লোক সন্তানের জন্ম না দিয়ে মারা যাবে, তারা কখনো স্বর্গে যেতে পারবেনা, মোক্ষ লাভ তো দূরের কথা।” সংসার ত্যাগী, নপুংসক সাধু-সন্ন্যাসী-মহারাজদের নিজেদেরই তো মুক্তি লাভ হবে না, তাদেরকে যদি গুরু হিসেবে নেন, তারা আপনাকে মুক্তি দেবে বা মুক্তির পথ দেখাবে কিভাবে ?
পরিশিষ্ট : প্রথম বার এই পোস্ট করার পর একজন কমেন্ট করে বলেছিলো, তাহলে কি নরেন্দ্র মোদীও মোক্ষ লাভ করতে পারবে না ? কারণ, তিনিও তো সংসার করেন নি বা সন্তানের জন্ম দেন নি।
হিন্দু শাস্ত্র এটাই বলে যে, নরেন্দ্র মোদীও এই জন্মে সংসারের এই জন্ম মৃত্যুর শৃঙ্খল থেকে মুক্তি পাবেন না। নরেন্দ্র মোদী এই জন্মেই মুক্তি পাক, মনে হয় ঈশ্বরের ইচ্ছা তেমন নয়; তাই তাকে এভাবে জীবন চালাতে হচ্ছে। কারণ, নরেন্দ্র মোদীর মতো লোককে প্রকৃতি নামের ঈশ্বর এক জনমে তৈরি করতে পারে না,
নরেন্দ্র মোদীর এই জীবন পেতে তাকে বহু বার জন্ম নিতে হয়েছে এবং তার কাজ এই জনমে শেষ হবে না বলে তাকে আবার জন্ম নিতে হবে। তাই আমার ধারণা, আবারও তিনি জন্ম নেবেন এবং তার উপর অর্পিত দায়িত্ব সমাপ্ত করে তিনি পরবর্তী বা কোনো এক জন্মে মোক্ষ লাভ করবেন।
তাই সংসার ও সন্তানের জন্ম না দেওয়ায়, নরেন্দ্র মোদীর মতো লোক মুক্তি পাবে না বলে যারা আফশোস করছেন, তাদেরকে বলছি, এই ধরণের লোক যত মুক্তি না পায়, সমাজের জন্য ততই মঙ্গল; কারণ, তিনি আছেন বলেই হিন্দুরা আবার স্বপ্ন দেখতে পারছে এবং তার মতো লোক থাকলেই হিন্দুরা স্বপ্ন দেখতে থাকবে, মান সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকতে পারবে। তাই আমি চাই না নরেন্দ্র মোদীর মতো কোনো লোক জীবন মৃত্যুর চক্র থেকে মুক্তি পাক।
এমনকি আমিও আমার মোক্ষলাভ চাই না। আমি বার বার হিন্দু হিসেবে জন্ম নিতে চাই এবং হিন্দুসমাজ ও ধর্মের জন্য কাজ করতে চাই। এজন্যই আমি মনে করি, হিন্দুদেরকে এত দুর্দশার মধ্যে রেখে যেসব সাধু সন্ন্যাসী হিন্দুদের টাকাতেই খেয়ে পড়ে চোখ বন্ধ করে সাধনা করে মোক্ষ লাভ করতে চায়,
তারা একেকজন চরম স্বার্থপর এবং আমি যে সাধু সন্ন্যাসীদেরকে দেখতে পারি না বা সহ্য করতে পারি না, এটাও নয়, কিন্তু হিন্দু সমাজের মেরুদণ্ড ভেঙ্গে যে সাধু সন্ন্যসী নিজের মুক্তির পথ খোজে সে কখনই হিন্দু সমাজের জন্য মঙ্গল জনক নয়। সুতরাং চোখ কান খোলা রাকুন আপনি ভূল করছেন না তো!
( Requested Post : Request by- Tanmoy Kundu )
আর পড়ুন..
‘সোমনাথ মন্দির’ ১৭ বার ভাঙ্গার পরও বার বার উঠে দাঁড়িয়েছে।-দুর্মর
কন্যাদান : হিন্দুমিসিক হিজাবি বলিউড-কর্পোরেটদের দ্বারা কন্যাদানের বিরুদ্ধে অপপ্রচার প্রচার।
গাজওয়া-ই-হিন্দ-এর নতুন ষড়যন্ত্র, গাজওয়াতুল হিন্দ কড়া নাড়ছে আপনার দুয়ারে।