গজল

গজল এবং গানের মধ্য পার্থক্য কি? গজল শব্দের অর্থ কি? 

গজল এবং গানের মধ্য পার্থক্য কি? প্রতিটি গজল গান, কিন্তু প্রতিটি গান, গজল না। এই কারণেই প্রতিটি গজলকে গান বলা যায়। কিন্তু প্রতিটি গানকে গজল বলা যায় না।  বাঙ্গালী মুসলমারা গান আর গজলকে আলাদা মনে করে। আসলে সেটা কতটা সত্য সেটা আজ আমরা জানব। 

সঙ্গীত বা গান কি?

সংগীত দ্বারা গীত, বাদ্য, নৃত্য এই তিনটি বিষয়ের সমাবেশকে উল্লেখ করা হয়। গীত এক ধরনের শ্রবণযোগ্য কলা যা সুসংবদ্ধ শব্দ ও নৈশব্দের সমন্বয়ে মানব চিত্তে বিনোদন সৃষ্টি করতে সক্ষম। স্বর ও ধ্বনির সমন্বয়ে গীতের সৃষ্টি। এই ধ্বনি হতে পারে মানুষের কণ্ঠ নিঃসৃত ধ্বনি, হতে পারে যন্ত্রোৎপাদিত শব্দ অথবা উভয়ের সংমিশ্রণ। কিন্তু সকল ক্ষেত্রে সুর ধ্বনির প্রধান বাহন। সুর ছাড়াও অন্য যে অনুষঙ্গ সঙ্গীতের নিয়ামক তা হলো তাল।

অর্থযুক্ত কথা, সুর ও তালের সমন্বয়ে গীত প্রকাশিত হয়। সুর ও তালের মিলিত ভাব এ বাদ্য প্রকাশিত হয়।ছন্দের সাথে দেহ ভঙ্গিমার সাহায্যে নৃত্য গঠিত । সঙ্গীতের অনেক ধারা হতে পারে, সঙ্গীতের এক একটি ধারায় এক ধরণের গান।

গজল কি? 

গজল  এক প্রকার লঘু রাগসঙ্গীত। এর উদ্ভব পারস্য দেশে। ভারতীয় সঙ্গীতে পারস্য সঙ্গীতের প্রভাব সংক্রমিত হলে গজল গানের ধারা ভারতে অনুপ্রবেশ করে। ভারতীয় সঙ্গীতের যে দুটি ধারা হিন্দুস্তানি (উত্তর ভারতীয়) ও কর্ণাটকি (দক্ষিণ ভারতীয়), গজল তার প্রথম ধারার অন্তর্গত। দিল্লি ও লক্ষ্ণৌ গজল চর্চার দুটি প্রধান কেন্দ্র।

গজল শব্দের অর্থ কি? 

‘গজল’ শব্দের আক্ষরিক অর্থ প্রেমিক-প্রেমিকার কথোপকথন। তাই গজল গানকে প্রণয়সঙ্গীতও বলা হয়। গজল মূলত এক প্রকার ক্ষুদ্রগীত। এ গানে নর-নারীর বিচিত্র মনোভাব (যেমন, পূর্বরাগ, অনুরাগ, মনস্তাপ, বিরাগ, বিচ্ছেদ, আকাঙ্ক্ষা, আসক্তি, বিরহ, মিলন ইত্যাদি) প্রকাশ পায়। এর পাশাপাশি সষ্ট্রার প্রতি প্রেম, ভক্তি ও ভালোবাসাও প্রকাশ পায়।

পারস্যের শ্রেষ্ঠ সাধক কবিরা যে গজল রচনা করেন তাতে গভীর দার্শনিক তত্ত্ব প্রকাশ পেয়েছে। ভারতে গজল গানের প্রবর্তন হলে ফারসি, উর্দু ও অন্যান্য ভাষায় প্রচুর গজল রচিত হয় এবং তাতে রাগসঙ্গীতের মাধুর্য যুক্ত হওয়ায় গজল গান নতুন মাত্রা পায়।

গজল গানে মনকে আপ্লুত করার একটা বিশেষ গুণ আছে। তাই গজল বেশ জনপ্রিয় গান। গজল রচনার ক্ষেত্রে মীর্জা গালিব, জওক, মীল, আরজু, সম্রাট জাহাঙ্গীর, সম্রাজ্ঞী নূরজাহান, নবাব ওয়াজেদ আলী খান, চলচ্চিত্রাভিনেত্রী মীনা কুমারীর অজস্র সুন্দর সুন্দর গজল রচনার সন্ধান পাওয়া যায়।

গজল গানে সুরের চেয়ে কথার প্রাধান্য বেশি। এ গান শৃঙ্গাররসাত্মক এবং এর প্রধান উপজীব্য মানবপ্রেম হলেও যে কোনো ধরনের রচনাই এর বিষয়বস্ত্ত হতে পারে। উচ্চ ভাবপূর্ণ ও গাম্ভীর্যপূর্ণ রচনাও কোনো কোনো গজলে দেখা যায়। গজলে অনেকগুলি চরণ বা কলি থাকে।

Indian Ghazal singers
Indian Ghazal singers

 

‘স্থায়ী’ ছাড়া অন্য সমস্ত কলিকেই বলা হয় ‘অন্তরা’ এবং সেগুলি একই সুরে গাওয়া হয়। মাঝে মাঝে কোনো কোনো স্তবক  ছন্দ ভেঙ্গে ধীর লয়ে আবৃত্তি করা হয়।

গজল গানের প্রকৃতি বা স্বভাব কোমল।  টপ্পা এবং ঠুমরির মতো গজল গানে মধুর ও মৃদু স্বভাবের  রাগ ব্যবহূত হয়। সাধারণত কাফি, ঝিঝিঁট, খাম্বাজ, ভৈরবী, পিলু, বারোয়া প্রভৃতি রাগ এবং পশ্তু ও দীপচন্দী তালে গজল গাওয়া হয়।

বাংলা ভাষায় গজল রচনার পথিকৃৎ  অতুলপ্রসাদ সেন। উত্তর ভারতের লক্ষ্ণৌ শহরে থাকার কারণে তিনি এ ধারার সঙ্গে পরিচিত হন এবং বাংলা গজলের বুনিয়াদ রচনা করেন। তাঁর পরে নজরুল ইসলামের হাতে বাংলা গজল বিশিষ্ট রূপ লাভ করে এবং তাঁর রচনার মধ্য দিয়েই গজল গান জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

নজরুলের পরে মনিরউদ্দিন ইউসুফ বেশ কিছু বাংলা গজল রচনা করলেও এ নিয়ে আর উল্লেখযোগ্য চর্চা হয়নি। সুত্র বাংলাপিডিয়া বা বাংলাদেশ জ্ঞান কোষ

গান ও গজলের পার্থক্য?

প্রতিটি গজলকে গান হিসেবে গাওয়া যায় কিন্তু প্রতিটি গানকে গজল করা যায় না। গানটি ছন্দোবদ্ধ বা ছন্দ মুক্ত হতে পারে, তবে একটি ছন্দ থাকা আবশ্যক । গানে রাগ থাকাও বাঞ্চনীয়। গান বহু ধরণে হয়, গজল গানের একধরনে গান মাত্র। যেমন ভারতী সঙ্গীতে বহুধারা আছে সেখানে গজল একটি ধারা মাত্র।

কিন্তু হাজার হাজার শ্লোকের মধ্যে গজলকে শুধু নির্দিষ্ট ধরনের পদ বলা হয়। গজলের শ্লোকগুলিকে উর্দুতে বাহর বলা হয়, যা মাতলা (প্রথম শের), রাদিফ (শব্দ গ্রুপ যা প্রথম, দ্বিতীয় তারপর চতুর্থ, ষষ্ঠ লাইনে পুনরাবৃত্তি হয়), কাফিয়া (ছন্দ) এবং একটি বিশেষ সংক্ষিপ্ত গুরু ক্রম নিয়ে গঠিত ।

উদাহরণ স্বরূপ দেখুন এই গজলটিও একটি হিন্দি গান। গেয়েছেন জগজিৎ সিং জি এবং চিত্রা জি 

সাকী টক করা হবে না করা স্থগিত

তাওবার বিরতি ঢালাই হবে,

আসবে দলে দলে আসতে মনে সেই
হয় বে-নামেমাত্র ইচ্ছা

তোমার গলায় রাগ আসে না কেন?

ঈদে কি আবকেও স্বাধীন ইচ্ছা

ফাসলে গুল আয়া আবেগ ঝাঁপিয়ে পড়ল ‘জলিল’

এখন কিছু অনুমান করা হয়েছে

 

এখানে মোটা অক্ষরে বারবার বলা যাচ্ছে, সেটা হল রাদিফ।

তির্যক ভাষায় যে ছড়াটি আসছে : তালি, ডালি, বেখালি, খালি, হাতল সেই কাফিয়া।

(তেগে নাজ: চোখের তলোয়ার/কাব্য, ‘জলিল’ কবির নাম)

এর ছন্দ বা সংক্ষিপ্ত মাস্টার ক্রম হল: 2122/2122/212

যেমন:

সাকী টক করা হবে না করা এড়ানো =

কথা বলবে না করা স্থগিত

2 1 22 / 2 1 22 / 2 1 2

এই শ্লোকটিকে উর্দুতে ” রমাল মুসাদ্দাস মাহজুফ ” বলা হয়।

উর্দুতে 19টি মৌলিক শ্লোক রয়েছে যা গজলের 100 টিরও বেশি পদ তৈরি করতে পারে তবে মাত্র 20 -25টি বেশি জনপ্রিয়।

 

বিপরীতে, গানটি একেবারে শ্লোকমুক্ত হতে পারে । দেখুন মেরা নাম জোকার গানটি যা বিখ্যাত কবি পন্ডিত গোপাল দাস নীরজের লেখা কিন্তু কোন পদে নেই

আরে ভাই একবার দেখে নিন

শুধু সামনে নয় পিছনেও

শুধু ডানে নয় বামেও

শুধু উপরে নয় নীচেও

আপনি যেখানে এসেছেন তা আপনার

বাড়ি নেই, রাস্তা নেই, গ্রাম নেই

ভ্রমণ নেই, বসতি নেই, পথ নেই

পৃথিবী হয়

এবং প্রিয় বিশ্ব এটা সার্কাস

এবং সার্কাসে

বড়দের কাছে, ছোটদের কাছে, সত্যের কাছেও

এমনকি গরীব, চর্বিহীন, মোটাও

উপরে থেকে নীচে, উপরে থেকে নীচে

ভ্রমণ করতে হবে

ভাই

পুরানো গীতিকাররা সাধারণত গানে ছন্দ আনতে গজলের মিটারে লিখতেন এবং সুরকাররা এটিকে কিছু রাগের সাথে বেঁধে রাখতেন। আর বিস্তাতি জানতে চাইলে এখানে যেতে পারেন।

আর পড়ুন…..