ইরাকের ইয়েজিদিরা কি প্রাচীন বৈদিক হিন্দু? ভারত থেকে অনেক দূরে, মধ্যপ্রাচ্যের মরুভূমি অঞ্চলে, ভোর ও সন্ধ্যা

ইরাকের ইয়েজিদিরা কি প্রাচীন বৈদিক হিন্দু?
ভারত থেকে অনেক দূরে,  মধ্যপ্রাচ্যের মরুভূমি অঞ্চলে, ভোর ও সন্ধ্যায় পাথর দিয়ে তৈরি করা দেবালয়গুলি থেকে ভেসে আসে  শঙ্খধ্বনি বা উলুধ্বনির মতো মাঙ্গলিক কিছু শব্দ। ঊষর মরুভূমির মতো রুক্ষ পরিবেশে, সকাল ও সন্ধের মিঠে হাওয়া ধরে অনেক দূরে পৌঁছে যায় শব্দগুলি। ছোটো ছোটো পাথুরে ঘর থেকে নতুন করে উলুধ্বনি ওঠে। মধ্যপ্রাচ্যের প্রধান ধর্ম ইসলাম ! কিন্তু, এগুলিতো ইসলাম ধর্মের ঈশ্বর আরাধনার রীতি নয়! তা হলে এঁরা কারা?

এঁরা হলেন ইয়েজিদি। অনেক ঐতিহাসিকের মতে, এঁরা সুপ্রাচীন সুমেরীয় সভ্যতার উত্তরপুরুষ। এঁদের ক্যালেন্ডার ৬৫০০ বছর পুরোনো। প্রায় ৫০০০ বছর ধরে, তাঁরা মধ্য প্রাচ্যে বাস করে আসছেন। প্রায় ৭৩ বার তাঁদের গণহত্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে। অটোমান মিলিশিয়া দিয়ে শুরু,  ইসলামিক স্টেট দিয়ে শেষ।
এর মাঝে গণহত্যা চালিয়ে গিয়েছে  কুর্দ ও তুর্কিরা। ইয়েজিদিদের একটাই অপরাধ। তাঁরা কাফের। তাঁদের নিজস্ব ধর্ম আছে। তাঁরা পৌত্তলিক। তাঁরা মালেক টাউস নামে এক দৈব ময়ূরকে নিজেদের ঈশ্বর বলে মানেন।  ঈশ্বর মানেন সূর্য, প্রকৃতি, বাতাস ও জলকেও।
ইয়েজিদিদের মেরে শেষ করতে চেয়ে ছিল আইসিস
আবু-বকর-আল-বাগদাদির ইসলামিক স্টেট এর উগ্রপন্থীরা, ২০১৪ সালে ইরাক আক্রমণ করে। আক্রমণ করে ইয়েজিদিদেরও। কুর্দিস্তান রিজিওনাল গভর্মেন্ট আগেই ইয়েজিদিদের অস্ত্র কেড়ে রেখেছিলো। ফলে নিরস্ত্র ইয়েজিদিরা অকাতরে মারা পড়তে থাকেন। অনেকে পালিয়ে যান ওই অঞ্চলের দুর্গম, রুক্ষ পাহাড় মাউন্ট সিনজারে। আগস্টের গরমে,  অনাহারে, পানীয় জলের অভাবে মাত্র দশ দিনে মারা যান প্রচুর বৃদ্ধ-বৃদ্ধা। মারা যায় কয়েকশো  ইয়েজিদি শিশুও।
আইসিসদের হাত থেকে  ইয়েজিদিদের বাঁচাতে এগিয়ে আসে, সিরিয়ার স্বশস্ত্র কমিউনিস্ট  গেরিলা বাহিনী ওয়াইপিজি। অবলুপ্ত হওয়ার হাত থেকে বেঁচে যায় ইরাকি ইয়েজিদিরা।
ইয়েজিদি জনগোষ্ঠীর মূল নিবাস ইরাকের নিনেভ  রাজ্যে। জনসংখ্যা কমতে কমতে এসে দাঁড়িয়েছে  সাত লক্ষে। হাজার হাজার বছর ধরে চলা  অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে জন্মভূমি ছেড়ে আরও কয়েক লক্ষ ইয়েজিদি ছড়িয়ে পড়েছেন সিরিয়া, আর্মেনিয়া, জর্জিয়া, আলবেনিয়া, রাশিয়া এমনকি সুইডেনেও।
ইসলামিক স্টেটের আক্রমণে দিশেহারা ইয়েজিদি জনগণ
ইয়েজিদি জনগোষ্ঠীর সঙ্গে তাদের চারপাশে থাকা অন্যান্য জনগোষ্ঠীর কোনও ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিক মিলই নেই। ইয়াজিদিদের জীবন যাত্রা,সংস্কৃতি ও ধর্মীয় রীতিনীতির সঙ্গে হিন্দুদের জীবন যাত্রা, সংস্কৃতি ও ধর্মীয় রীতিনীতির অবিশ্বাস্য মিল। দূরত্ব হাজার হাজার কিলোমিটার হওয়া সত্বেও। চারদিকে সৌদি আরব, জর্ডান, তুরস্ক, ইরান, সিরিয়ার মতো ইসলামি রাষ্ট্র থাকা সত্বেও কী ভাবে এত  মিল হয়, সেটাই  চরম আশ্চর্যজনক ব্যাপার।
কেন মনে হয়,  ইয়েজিদিরা প্রাচীন হিন্দু ধর্মেরই  কোনও এক শাখা !
● ইয়েজিদিদের মন্দিরগুলি দেখতে ভারতীয় মন্দিরগুলির মতো।  মধ্যপ্রাচ্যের অনান্য ধর্মস্থানের সঙ্গে মন্দিরগুলির স্থাপত্যের দিক থেকে কোনও মিল নেই। বরং ভারতবর্ষের মন্দিরগুলির গোপূরমের সঙ্গে এই মন্দিরের স্থাপত্যের হুবহু মিল দেখতে পাওয়া যায়।
ইয়েজিদিদের পবিত্রতম লালিশ মন্দির
● ইয়েজিদিদের পবিত্রতম মন্দির,  লালিশ মন্দিরের প্রবেশ পথে সর্প-প্রতীক দেখতে পাওয়া যায়। ইয়েজিদিদের কাছে সাপ পবিত্র এক প্রাণী ।  দক্ষিণ ও পূর্ব ভারতের বহু মন্দিরেও,  প্রবেশ পথের ওপরে ও পাশে সর্প-প্রতীক দেখা যায় ।
দক্ষিণ ভারতের দেবতা  মূরূগন নাগদের অবতার স্বরূপ। এছাড়াও বাংলার মনসাপুজা, সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে নাগপঞ্চমী,  হিন্দুধর্মের পূজাঅর্চনার সঙ্গে সর্পশ্রেণির যোগসূত্র প্রমাণ করে।
ইয়েজিদি মন্দিরে সর্প-প্রতীক
● ইয়েজিদিদের প্রধান আরাধ্য হলেন,  দুই পাখনা মেলা ময়ূর-দেবতা মেলেক টাউস (Melek Taus)। উত্তর ভারতের কার্তিক, যিনি দক্ষিণ ভারতের দেবতা মুরুগন। একই রকম ময়ূরের পিঠে বসে থাকেন। হিন্দুদের শ্রীকৃষ্ণও কার্তিক ঠাকুরের সঙ্গে ময়ূরের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক আমরা সবাই জানি।  ইয়েজিদিদের বাসস্থানের হাজার মাইলের মধ্যে ময়ূর পাওয়াই যায় না। অথচ, ময়ূর ইয়েজিদিদের প্রধান দেবতা। অন্যদিকে ভারতের জাতীয় পাখি ময়ূর।
ইয়েজিদিদের প্রধান দেবতা মেলেক টাউস
● ইয়েজিদিরা ময়ূর আকৃতির প্রদীপ জ্বালিয়ে, ময়ূর মূর্তিতে চুম্বন করে পূজার্চনা করেন। ভারতের প্রায়  জায়গায়,  হিন্দুদের ময়ূর আকৃতির প্রদীপ জ্বালাতে  দেখা যায়।
● ইয়েজিদিদের পবিত্রতম লালিশ মন্দিরের দেয়ালে আঁকা এক নারীর ছবি , ইয়েজিদিদের হিন্দু হওয়ার সপক্ষে একটি অকাট্য প্রমাণ। ছবিটি  ময়ূরদেবতার সামনে বসে থাকা এক রমণীর। রমণীর পরনে আঁচল দেওয়া শাড়ি, শাড়িতে পাড়ও আছে। গায়ে আছে ব্লাউজ।খোঁপায় ফুলের মালা।
ছবিটি দেখলেই মনে হবে কোনও ভারতীয় মহিলার ছবি।  এই পোশাক, ইয়েজিদি জনগোষ্ঠীর হাজার মাইল চৌহদ্দির মধ্যে থাকা, অন্য কোনও জনগোষ্ঠীর মধ্যে দেখা যায় না। অন্যদিকে শাড়ি হল, ভারতে মহিলাদের জাতীয় পোশাক ।
ইয়েজিদি মন্দিরের দেওয়ালে আঁকা, শাড়ি ব্লাউজ পরা রমনীর ছবি।খোঁপায় ফুলের মালা
● ইয়েজিদিদের আরেকটি প্রতীক হলো হলুদ সূর্য ,যার একুশটি রশ্মি , ভারতীয় ধর্মে একুশ সংখ্যাটি পবিত্র, ইয়েজিদিরা একুশবার দেবতাকে নৈবেদ্য উৎসর্গ করেন। হিন্দুরাও গণেশপূজায় একুশবার লাড্ডু উৎসর্গ করেন।
● হিন্দুরা যে রকম ভাবে, পূজার থালায় প্রদীপ বসিয়ে থালা সমেত হাত ঘুরিয়ে আরতি করেন। ইয়েজিদিরাও সে ভাবে আরতি করেন।
মন্দিরে আরতি করছেন ইয়েজিদি রমনীরা
● হিন্দুরা  দেবালয়ে হাতজোড় করে প্রার্থনা করেন ।  ইয়েজিদিরাও এ ভাবেই তাঁদের মন্দিরে  প্রার্থনা করে থাকেন।
● হিন্দুদের মতোই ইয়েজিদিরা সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তর সময়ে পূজাপ্রার্থনা করেন।
● হিন্দুরা সুন্নত করেন না ।  মধ্যপ্রাচ্যে থেকেও ইয়েজিদিরা মধ্যপ্রাচ্যের  সংখ্যা গরিষ্ঠ ধর্মাবলম্বীদের মতো সুন্নত করেন না।
● হিন্দুদের মতোই ইয়েজিদিরা পুজোর পর কপালে টিকা বা তিলক লাগান ।
পুজার শেষে পবিত্র তিলক পরিয়ে দিচ্ছেন ইয়েজিদি পুরোহিত
● বড় বড় উৎসবে, মন্দিরের আঙিনায়  অসংখ্য প্রদীপ জ্বালান ইয়েজিদিরা। ঠিক হিন্দুদের দীপাবলীর মতো।
● ইয়েজিদি পুরোহিত হিন্দুদের মতোই আগুন জ্বালিয়ে যজ্ঞ করেন। হিন্দুদের মতই যজ্ঞের আগুন অত্যন্ত পবিত্র বলে মনে করেন ইয়েজিদিরা ।
● ইয়েজিদি মন্দিরের মধ্যে ত্রিশূল আকৃতির ধাতব শলাকা ,ঘট আকৃতির জলের পাত্র দেখতে পাওয়া যায় ।
● পূজার সময় শঙ্খধ্বনির মতো আওয়াজ করা হয় যন্ত্রতে ফুঁ দিয়ে ,ঢোল জাতীয় বাদ্যযন্ত্র বাজানো হয় ,উলুধ্বনি দেওয়া হয় ।
● হিন্দুরাও পুনর্জন্মে বিশ্বাস করেন।  ইয়েজিদিরাও পুনর্জন্মে বিশ্বাস করেন।
ইয়েজিদিদের হোম
এ ছাড়াও  বৈদিক হিন্দুধর্মের আরও কিছু রীতিনীতির সঙ্গে, ইয়েজিদিদের ধর্মীয়, সাংসারিক ও সাংস্কৃতিক রীতিনীতির অস্বাভাবিক মিল দেখতে পাওয়া যায়। এর ফলেই হয়তো  আমেরিকায় গড়ে উঠেছে ‘ইয়েজিদি সনাতন ধর্ম সোসাইটি‘। এই  সোসাইটি আমেরিকা প্রবাসী ইয়েজিদি ও হিন্দুরা তৈরী করেছেন। দুটি গোষ্ঠীর মধ্যে ফিকে হয়ে  যাওয়া আত্মিক বন্ধনকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে।
এঁদের মতে, আজ থেকে  প্রায় ৫০০০ বছর আগে, ইয়েজিদিরা  ভারত থেকে আফগানিস্তান, ইরান হয়ে ইরাকে পৌঁছেছিলেন। ইয়েজিদিদের  দেবতা ‘মেলেক টাউস’,আসলে দক্ষিণ ভারতীয় দেবতা মুরুগন (কার্তিক)। এমন কি  ইয়েজিদিদের পবিত্র গ্রন্থগুলিও  সংস্কৃত বংশদ্ভূত আবেস্তা ভাষায় লেখা।