মহানায়ক উত্তম কুমার।

মহানায়ক উত্তম কুমার
———————————
      ।প্রথম পর্ব।
বাংলা চলচ্চিত্রের সর্বকালের সেরা নায়ক কে? এই প্রশ্নে কেউ বিব্রত হন না, হবেনও না। সংশয়হীনভাবে, একবাক্যে সমস্বরে সবাই বলবেন, একটিই নাম – ‘উত্তম কুমার’। বাংলা চলচ্চিত্রের ‘মহানায়ক’ বললেই যার ছবি চোখের সামনে ভেসে ওঠে, তিনিই উত্তম কুমার। প্রকৃত নাম অরুণ কুমার চট্টোপাধ্যায়। ১৯২৬ সালের ৩ সেপ্টেম্বর কলকাতার ভবানীপুরে জন্মগ্রহণ করেন। 

উত্তম কুমারের সেই ভুবনমোহন হাসি, অকৃত্রিম রোমান্টিক চোখের দৃষ্টি, আর অতুলনীয় অভিনয়ের গুণে প্রজন্মের পর প্রজন্ম পেরিয়েও বাঙালি দর্শকদের হৃদয়ের মণিকোঠায় আজও তিনি-ই মহানায়ক। ১৯৪৮ সালে ‘দৃষ্টিদান’ দিয়ে তার অভিনয় জীবন শুরু; আর ১৯৮০ সালের ২৪ জুলাই  ‘ওগো বধূ সুন্দরী’ ছবিতে অভিনয় করার সময় আকস্মিক জীবনাবসান। মাত্র ৫৪ বছরের ক্ষণজন্মা মহাপ্রতিভাধর অভিনেতা উত্তম কুমার চলচ্চিত্র শিল্পকে সেবা দিয়েছেন ৩২ বছর। তবুও অতৃপ্তি মেটে না। মিটবে কী করে? উত্তম কুমারের মতো বিরল শিল্পীর জন্ম তো আর বারবার হয় না, শতাব্দীতে হয়তো একজন হয়। তাঁর আকস্মিক চলে যাওয়া ছিল বাংলা চলচ্চিত্র শিল্পের এক আলোকবর্তিকার মৃত্যু। তিন তিনবার ভারতের জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত এই অভিনেতা সম্পর্কে যতই বলা হোক না কেন, তারপরও অতৃপ্তি যেন থেকেই যায়। মৃত্যুর এতো বছর পরও অসাধারণ জনপ্রিয় এই তারকার মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে তাঁর অভিনয় প্রতিভার আলোয় আজো আমরা শিহরিত হই, আলোড়িত হই। হঠাৎ-হঠাৎ ক্যামেরার দিকে ঘুরে এক ভুবনমোহিনী হাসি বা চিত্তহরা চাহনির উত্তম কুমারকে ভুলে থাকা যে কোন চলচ্চিত্র-প্রেমী নারী-পুরুষের পক্ষেই প্রায় অসম্ভব।
কিংবদন্তী চলচ্চিত্র অভিনেতা, চিত্রপ্রযোজক এবং পরিচালক উত্তম কুমার চলচ্চিত্রে অভিনয় ছাড়াও মঞ্চ অভিনয়েও যথেষ্ট সাফল্য লাভ করেছিলেন।  সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে এসে চলচ্চিত্র জগতে প্রতিষ্ঠা পেতে অমানুষিক পরিশ্রম করতে হয়েছে তাঁকে। নানা পুরস্কার আর সম্মাননার পরও ব্যক্তি উত্তম ছিলেন একবারেই সহজ-সরল সাধারণ মানুষ। দুস্থ শিল্পীদের কল্যাণে নিজে তৈরি করেছিলেন আর্থিক ফান্ড। দু’হাতে দান করেছেন মানুষকে। বাংলাদেশের প্রতি খুবই সহানুভূতিশীল ছিলেন উত্তম কুমার। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে গোপনে অর্থ সাহায্য করেছিলেন। সেজন্য অবশ্য তাকে কম ঝক্কি পোহাতে হয়নি। পাকিস্তান সমর্থক পশ্চিম বঙ্গের চীনপন্থী কমিউনিস্ট কমরেডরা গিয়ে তাঁকে ভীষণ হুমকি-ধামকি দিয়েছিল। চীন ও পাকিস্তানের দালাল কমিউনিস্টদের আচরণে খুব কষ্ট পেয়েছিলেন তিনি। প্রাণ বাঁচাতে মাস কয়েকের জন্য মুম্বাই চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। পাকিস্তানের পরাজয়ের পর পুনরায় ফিরে আসেন কলকাতায়।
উত্তম কুমারের পৈত্রিক নিবাস কলকাতা ভবানীপুরের ৫১নং আজিরীটোলা স্ট্রিট।  তাঁর দাদু আদর করে ডাকতেন উত্তম। উত্তম কুমারের বাবার নাম সাতকড়ি চট্টোপাধ্যায়, মা চপলা দেবী। অভাব-অনটনের মধ্য দিয়ে কাটে উত্তমের ছেলেবেলা। কিন্তু যার জন্মই হয়েছে আকাশ ছোঁয়ার জন্য; দারিদ্র্য পারেনি তাঁকে দমিয়ে রাখতে। অভিনয় জগতে আসার পেছনে তার পরিবারের প্রভাব ছিল গুরুত্বপূর্ণ। সংস্কৃতিমনা উত্তমের বাবা ও কাকারা পাড়া-প্রতিবেশীর সহায়তায় গড়ে তুলেছিলেন ‘সুহৃদ সমাজ’। বিভিন্ন উৎসবে সুহৃদ সমাজ থেকে যাত্রাপালার আয়োজন করা হতো। বাপ-কাকাদের যাত্রাপালায় অভিনয় দেখে উত্তমের অভিনয়ের ইচ্ছা জাগে, আর তার জের ধরেই স্কুলে থাকতেই উত্তম কুমার তার মহল্লার নাট্যসংগঠন লুনার ক্লাবে জড়িয়ে পড়েন; আর কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘মুকুট’ নাটিকায় অভিনয়ের মধ্য দিয়ে শুরু হয় মহানায়কের অভিনয় জীবন। হঠাৎ তাঁর মাথায় চেপে বসল সিনেমার ভূত। যে করেই হোক সিনেমায় অ্যাক্টিং করতে হবে। তখনকার দিনে চলচ্চিত্রে অভিনয়ের সঙ্গে গান জানা অপরিহার্য ছিল। তাই তৎকালীন অনেক নামীদামী শিল্পী যেমন মহিয়সী কানন দেবী, অমিতবরণ, রবীন মজুমদার, পাহাড়ী স্যান্নাল, কুন্দন লাল সায়গল প্রমুখ সবাই গান জানতেন। উত্তম কুমার তাই গান শিখতে কণ্ঠশিল্পী ও সংগীত শিক্ষক নিদান ব্যানার্জির শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন।
সংসারে অভাব থাকায় ১৯৪২ সালে দ্বিতীয় শ্রেণীতে ম্যাট্রিক পাস করার পর তিনি দিনে পোর্ট কমিশনার্স অফিসের ক্যাশ ডিপার্টমেন্টে কেরানির চাকরি নেন, আর রাতে ভর্তি হন ডালহৌসির গভর্নমেন্ট কমার্শিয়াল কলেজে। নানা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তিনি ১৯৪৫ সালে বি.কম. পাস করেন। একদিন তিনি গেলেন ভারত লক্ষ্মী স্টুডিওতে। সেখানে ভোলানাথ আর্য্য ‘মায়াডোর’ নামে একটি হিন্দি ছবি প্রযোজনা করছেন। প্রথমে দারোয়ান ঢুকতে না দিলেও অনেক অনুনয় বিনয়ের পর পূর্ব পরিচিত নাট্যজন গণেশ বাবুর পরিচয় দিয়ে প্রযোজকের সামনে হাজির হলেন। প্রযোজক অনেক দেখে-শুনে তাকে ছোট্ট একটি চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ দিলেন। নতুন বরের মার খাবার দৃশ্যে উত্তমের অভিনয় ছিল খুবই সাবলীল। এভাবে সহশিল্পীর মর্যাদা নিয়ে মহানায়ক উত্তম কুমার চলচ্চিত্রাঙ্গনে পা রাখেন। পার্শ্বচরিত্রে অভিনয়ের জন্য তিনি দৈনিক একটাকা চার আনা করে সম্মানী পান। কিন্তু তার প্রথম অভিনীত ছবি পরবর্তীতে আর মুক্তি পায়নি। ১৯৪৮ সালে মাত্র সাতাশ টাকা পারিশ্রমিকে নীতিন বসুর ‘দৃষ্টিদান’ ছবিতে উত্তম কুমার নায়কের অপরিনত বয়সের চরিত্রে অভিনয় করেন। এটিই তার অভিনীত মুক্তিপ্রাপ্ত প্রথম ছবি। কিন্তু তার অভিনীত প্রথম দিকের ছবিগুলো চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছিল।
সম্পাদনা
কৃত্তিবাস ওঝা ও অবন্তিকা
(ক্রমশ)