এই একতরফা সম্প্রীতির বিজ্ঞাপন দিয়ে শেষতক সেক্যুলারিজমকে বাঁচানো যাবে?

নিউজিল্যান্ডে মসজিদে হামলার পিছনে কি তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের হাত আছে? তুরস্কে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ৩০ মার্চ। নিউজিল্যান্ডে মসজিদে খুনি বেন্টনের করা ভিডিওটি এরদোয়ান তার নির্বাচনী জনসভায় বড় পর্দায় সম্প্রচার করে ভোটটারদের মধ্যে ইসলামিক জোশ জাগানোর কৌশল নিয়েছে। তার প্রতিপক্ষ সেক্যুলারপন্থিকে খ্রিস্টান-ইহুদীদের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন হিসেবে আখ্যা দিয়ে এই খুনিদের সমর্থক হিসেব দাবী করছে।… না, আমি মনে করি না এরদোয়ান নিউজিল্যান্ডে মসজিদে হামলা চালিয়ে ফয়দা লুটছে। আমি আসলে একটা থিউরী প্রয়োগ করে দেখালাম যে থিউরী প্রয়োগ করে কাস্মিরে জইশ-ই মুহাম্মদের হামলার পর সবাই বলাবলি করছিলো এই ঘটনা এমন সময় ঘটল যখন ভারতে নির্বাচন সামনে এবং নরেন্দ মোদির অবস্থা বেশ নাজুক। কাস্মিরে জঙ্গি হামলা হলে মোদী একটা শোরগোল তুলতে পারবে যে সেক্যুলাররা কখনই এইসব জঙ্গিদের রুখতে পারবে না। তার জন্য দরকার একজন প্রকৃত হিন্দুত্ববাদীর…। এই থিউরী জইশ-ই মুহাম্মদের হামলাকে লঘু করে তোলে। খুনি কাস্মিরী যুবককে হালকা করে তোলে। যদিও এই থিউরী সরাসরি বলে না মোদীই এই ঘটনা ঘটিয়েছে –কিন্তু সকলের কাছে ঘটনার জন্য দোদীই ভিলেন হয়ে উঠে। নির্বাচনের জন্য মোদীই এই ঘটনা ঘটিয়েছে- সাধারণ জনগণ, বিশেষত মুসলিমরা তেমনটাই বিশ্বাস করতে শুরু করে। যেসব সেক্যুলার ও বামপন্থিরা কাস্মির ঘটনার পর এই থিউরীর ফিল্টার দিয়ে ঘটনাকে বিশ্লেষণ করেছিলেন তাদের কাউকেই এখন খুঁজে পাচ্ছি না! বিবিসি জানাচ্ছেন ফেইসবুক এ পর্যন্ত ১৫ লাখ ভিডিও ডিলিট করেছে নিউজিল্যান্ড হত্যাকান্ডের। তারা হিমশিম খাচ্ছে এই ভিডিও নিয়ে। সবাইকে অনুরোধ করছে এই ভিডিও শেয়ার না দিতে। অথচ তুরস্কের প্রেসিডেন্ট সমানে এই নৃশংস ভিডিও শেয়ার করছেন তার নির্বাচনী প্রচারণায়! আপনাদের থিউরী এখন কি বলে? খুনি বেন্টন কি ভিডিওটি এ জন্যই করেছিলো যে সেটি এরদোয়ান তার নির্বাচনী জনসভায় যাতে ব্যবহার করতে পারে?

না, এরকম পার্ভাট থিউরী আর যাই হোক রাজনৈতিক ধান্দা আছে এমন কেউ ছাড়া বিশ্বাস করবে না। বামপন্থিদের রাজনৈতিক লক্ষ্য থাকে, ইসলামিকদের রাজনৈতিক লক্ষ্য থাকে, লিবারালদের লক্ষ্য থাকে। তারা প্রতিটি ঘটনাকে তাদের রাজনৈতিক ধান্দায় ব্যবহার করে। আসানসোলের রামবমনিতে ইমাম রাশিদী তার ছেলেকে ও ক্রাইস্টচার্চে ফরিদ আহমেদ তার স্ত্রীকে হারিয়েছেন- উভয় তাদের খুনিদের ক্ষমা করে দিয়েছেন। এই দুটি ঘটনায় ব্যক্তির উদারতা ও অসাধারণ মানবিকতার উদাহরণ ঘটেছে। সেটাকে ধান্দাবাজরা ‘মুসলমানের উদারতা’ ‘ইসলামের উদার’ এরকম ধর্মীয় জিকিরে ব্যবহার করেছে। রাজীব গান্ধির খুনিকেও তার ছেলেমেয়ে ক্ষমা করে দিয়েছে। আরব দেশে রক্তঋণের টাকা পেয়েও পরিবার খুনিকে ক্ষমা করে দেয়। আসানশোলের রাশিদী ও ক্রাইস্টচার্চের ফরিদ আহমেদের ক্ষমা যদি ইসলাম ও মুসলমানের ক্ষমা হয়ে থাকে তাহলে সুইডেনে লরি চাপিয়ে হত্যাকারীও ইসলাম-মুসলমানের প্রতিনিধি? তখন কেন সন্ত্রাসীর কোন ধর্মীয় পরিচয় থাকে না? সেখানে তো ‘আল্লাহ আকবর’ বলেই হামলাটা চালানো হয়েছিলো!

কানাডার প্রেসিডেন্ট জাস্টিন ট্রুডো কানাডার মসজিদে মুসলিম ডানন্থিদের (যারা মসজিদে নিয়মিত নামাজ পরে ও ইসলামের সমস্ত নির্দেশ সুদূর ইউরোপ আমেরিকার মত দেশে বসেও পালন করে তারা ডানপন্থি নয় তো কি?) সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে জানিয়েছেন, পৃথিবীতে ইসলাম বিদ্বেষ ও ঘৃণার কোন স্থান নেই। এই হচ্ছে আমাদের বর্তমান সেক্যুলারিজমের অবস্থা! নিউজিল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট হিজাব পরে মুসলিম কমিউনিটির সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। ফরিদ আহমেদের উদারতাকে সেক্যুলারই ইসলামের উদারতা বলে প্রচার করছে! কুরআনে সরাসরি ইহুদী খ্রিস্টানদের নাম ধরে আয়াত আছে। হে মুমিণগণ! তোমরা ইহুদী ও খ্রীষ্টানদেরকে বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করো না। তারা একে অপরের বন্ধু। তোমাদের মধ্যে যে তাদের সাথে বন্ধুত্ব করবে, সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ জালেমদেরকে পথ প্রদর্শন করেন না (আল মায়িদা: ৫১)। এরকম অসংখ্য আয়াত রয়েছে কুরআনে। সবগুলো এখানে দিয়ে লেখা বড় করার কোন অর্থ নেই। জাস্টিন ট্রুডো ইসলাম বিদ্বেষকে পৃথিবীতে স্থান দিবেন না কিন্তু তার দেশেই ইহুদী-খ্রিস্টান ঘৃণা চর্চা হয়। মুসলমানরা এসব সুরা রমজান মাসে উচ্চস্বরে আবৃতি করে নামাজ পড়ে। যতগুলো ইসলামিক সেন্টার ইউরোপ-আমেরিকায় আছে সবখানেই কুরআনে এইসব বিদ্বেষপূর্ণ সুরার উপর চর্চা হয়। ভোটের রাজনীতিতে ট্রুডো মুসলিমদের খুশি রাখতে গিয়ে কানাডিয়ানদের মধ্যে যখন ডানন্থিদের সংখ্যা বেড়ে যাবে তখন তাদের মত সেক্যুলারদের ভোট ব্যাংক শেষ হওয়াটাই বড় কথা নয়, কানাডা ডানপন্থাদের উত্থান ঘটবে। ঘটবে এই সেক্যুলারদের একপেশে অবস্থানের জন্যই।

শেষ করি ভারতের আনন্দ বাজারের একটি নিউজ দিয়ে। আনন্দবাজার শিরোনাম হয়েছে, ‘বন্ধুত্বের টানে মসজিদে নমাজ পড়ছেন হিন্দু যুবক’! ঘটনা হচ্ছে তিন মুসলিমের সঙ্গে হিন্দুর বন্ধুত্ব হয়েছে। সন্ধ্যায় যখন মুসলিম বন্ধুরা মসজিদে নামাজ পড়তে যায় তখন সেই হিন্দু যুবকও তাদের সঙ্গে নামাজ পড়ে। আনন্দ বাজারের মন্তব্য হচ্ছে, ‘বন্ধুত্ব ও ভালবাসার পথে ধর্ম যে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। সেই কথাকেই ফের প্রতিষ্ঠা করল ভাইরাল হওয়া একটি ফেসবুক পোস্ট’। শেষে লিখেছে, ‘যদি গোটা বিশ্ব এটা বুঝত তাহলে কী পৃথিবীর বুকেই স্বর্গ গড়ে উঠত না?’ এতখানি মুর্খতা নিজের মধ্যে রেখে নিজেদের ধর্মনিরপেক্ষ সেক্যুলার বলাটা হাস্যকর। ধর্মকে রেখে পৃথিবীতে ধর্মীয় মৌলবাদ দূর করার কথা বলাটা ভন্ডামী। ধর্ম যতদিন থাকতে ধর্মীয় গোড়ামী, সাম্প্রদায়িকতাও থাকবে। এক হিন্দু যুবকের নামাজ পড়ায় যদি মুসলিমদের সম্প্রীতি বা কাছে টানার গল্প তৈরি হয় তাহলে তো মুসলিম যুবককেও হিন্দুদের দেবদেবীর সামনে মাথা নত করে পুজা দিতে হবে। সেটি কি আমরা দেখতে পাই? কেরেলার মন্দিরে ঈদের নামাজ পড়ার সুযোগ করে দেয়া, শিখ মন্দিরে ইফতার ও তারাবী নামাজের ব্যবস্থা করা, বৌদ্ধ মন্দিরে ইফতার বিতরণ- এরকম সম্প্রীতির বিপরীতে মসজিদে পুজার আয়োজন হতে দেখি না কেন? পুজা না হোক, অষ্টমী স্নানের সময় যদি একটাও মসজিদ হিন্দু তীর্থযাত্রীদের বিশ্রামের জন্য খুলে দিতো তবু তো একটা নজির হতে পারত? এই একতরফা সম্প্রীতির বিজ্ঞাপন দিয়ে শেষতক সেক্যুলারিজমকে বাঁচানো যাবে? ধর্মকে বাদ না দিয়ে কেমন করে মানুষের মধ্যেই বা সেক্যুলারিজমকে দেখতে চান?
Susupto Pathok