ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা তাদের ধর্ম প্রতিষ্ঠা করতে ও পরবর্তী প্রজন্মকে তাদের থেকে বেশি না জানতে দেয়ার জন্য হাজার বছরের সংগৃহীত জ্ঞান ভান্ডার ধ্বংস করেছিলো। আর সেই জ্ঞানের আধার ছিলো আলেক্সান্দ্রিয়া লাইব্রেরী।
আমরা সবাই আফগানিস্তান এর মুসলিম জঙ্গী বা জিহাদী গোষ্ঠি তালেবান এর নাম জানি নিশ্চয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার সময় ৭০ এর দশকে এদের জন্ম হয়েছিলো আফগানিস্তানে। এই সময় পর্যন্ত সেদেশের সাধারন মানুষ ও বিশেষ করে নারীরা অনেক স্বাধীন ছিলেন। তারা কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করতে পেরেছেন তখন, চাকরি-বাকরিও করতেন অফিস আদালতে। এবার একটু চিন্তা করে দেখুন, এটা বর্তমান সময়ে আফগানিস্তানে কি অসম্ভব না সম্ভব। তাদের অবস্থা এমন হয়েছিলো, একটা সময় পঞ্চম শ্রেণির বেশি তাদের পড়াশোনা করা নিষিদ্ধ ছিলো। পোশাক বলতে তাদের বস্তা বন্দী করা হয়েছে যা এখন পর্যন্ত বিদ্যমান আছে। তালেবানরা ইসলামিক আইন ফলো করতো। যেমন করে গিয়েছিলেন তাদের প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সাঃ) এবং তার পরবর্তী উত্তরসূরীরা। যাদের একজনের হাতেই ধ্বংস হয়েছে বলে জানা যায় এই আলেক্সান্দ্রিয়া লাইব্রেরী।
তালেবান সহ সকল মুসলিম জাতির ধারনা এই যে, তাদের প্রধান ঐশ্বরিক কিতাব কোরান হচ্ছে একমাত্র জ্ঞানের বই যার সাথে পৃথিবীর অন্য কোন বই এর তুলনা করা চলে না। তাই কোরান বাদে অন্য কোন বই পড়া মানে কুপথে চলে যাওয়া এবং ইসলাম বহিঃভূত কাজ করা। এই ধারনা থেকে তারা তৎকালীন আফগানিস্তান এর গ্রামে গ্রামে গিয়ে কোরান বাদে যত বই পেয়েছিলেন তা আগুনে পুড়িয়ে ফেলেন। তাদের কথা ছিলো কোরান বাদে আর যত কিতাব আছে তা সবই শয়তানী কিতাব তাই এগুলো জ্বালিয়ে দাও। ঠিক একই কথা ৬৪২ খ্রিস্টাব্দে খলিফা ওমর বলেছিলেন আলেক্সান্দ্রিয়া লাইব্রেরী পোড়ানোর সময়।
এটি ছিলো একটু কাছাকাছি সময়ের ছোট্ট নমুনা। এবার আসুন আজ থেকে প্রায় ১৪০০ বছর আগের কিছু নমুনায় যাওয়া যাক। ইসলামের প্রধান নবী মুহাম্মদ (সাঃ) এর প্রাচারিত রাজনৈতিক দলের ইসলামী সংস্কৃতি আস্তে আস্তে ইসলাম ধর্মে বদল হতে থাকে এবং একটা সময় ৬৩০ খৃস্টাব্দে মক্কা বিজয়ের পর তার এই ইসলাম ধর্ম আরো শক্তিশালী হয়ে উঠে। যার একটিই কারন ছিলো মৃত্যু পরবর্তীতে জান্নাত বা বেহেশত প্রাপ্তির আশা।
যা তার অনুসারীদের করে তুলতো আরো সাহসী ও মৃত্যু ভয়হীন যোদ্ধা। মুহাম্মদ এর মৃত্যুর পরে ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে তার উত্তরাধীকারী হয় তার একজন সঙ্গী আবু বকর এবং পরবর্তীতে তার মৃত্যুর পরে আরেকজন সঙ্গী ওমর তার উত্তরাধিকারী পান। আর এই খলিফা ওমরের নেতৃতে ধ্বংস করা হয় সেই আলেক্সান্দ্রিয়া লাইব্রেরী, যার ক্ষতি পূরন করা আজো সম্ভব হয়নি। আমি “মিশরীয় সভ্যতা ও ইসলাম ধর্ম” নামের একটি লেখাতে কিছুটা উপস্থাপন করেছিলাম।
আলেক্সান্দ্রিয়া লাইব্রেরীর অবস্থান ছিলো বর্তমান মিশরের আলেক্সান্দ্রিয়া শহরে (আরবি: الإسكندرية আল ইস্কান্দারিয়া)। যা মিশরের ২য় বৃহত্তম শহর এবং এই শহরেই মিশরের বৃহত্তম সমুদ্র বন্দর অবস্থিত। প্রাচীনকালে এই শহরটি বাতিঘর বা লাইট টাওয়ার (প্রাচীন পৃথিবীর সপ্তাশ্চর্যের একটি) এবং গ্রন্থাগারের (প্রাচীন পৃথিবীর সর্ববৃহৎ গ্রন্থাগার আলেক্সান্দ্রিয়া লাইব্রেরীর) জন্য বিখ্যাত ছিল। সম্প্রতি আলেক্সান্দ্রিয়ার সমুদ্রতীরবর্তী এলাকায় সামুদ্রিক নৃবিজ্ঞান এর উপর ভিত্তি করে পরিচালিত গবেষণায় (যা ১৯৯৪ সালে শুরু হয়েছিল) আলেক্সান্ডারের আগমনের পূর্বে যখন এই শহরের নাম ছিল রাকোটিস, সেই সময় এবং টলেমীয় রাজত্বের সময়ের আলেক্সান্দ্রিয়া নিয়ে নতুন অনেক তথ্যই পাওয়া যাচ্ছে যা থেকে এই মুসলিম সম্প্রদায়ের অনেক অতীত ইতিহাস জানা যাচ্ছে।
প্রায় সব প্রাচীন গ্রন্থেই আলেক্সান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগারকে প্রাচীন বিশ্বের বৃহত্তম ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থাগারগুলির একটি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে এই গ্রন্থাগারের বিবরণ ইতিহাস ও কিংবদন্তির মিশ্রণই রয়ে গিয়েছে। এই গ্রন্থাগারের মূল উদ্দেশ্য ছিল প্রাচীন মিশরের ঐশ্বর্য প্রদর্শণ। গবেষণা ছিল গৌণ উদ্দেশ্য। তবে গ্রন্থাগারের সঞ্চিত গ্রন্থগুলি মিশরের শাসকদের কাজে লাগত। আলেক্সান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগারের দায়িত্ব ছিল সারা বিশ্বের জ্ঞান সংগ্রহ করা। গ্রন্থাগারের অধিকাংশ কর্মচারী প্যাপিরাসে বই অনুবাদের কাজে ব্যস্ত থাকতেন। রোডস ও এথেন্সের বইমেলায় ঘুরে রাজার অর্থে প্রচুর বই সংগ্রহ করে এই কাজ চলত। গালেনের মতে, বন্দরের কোনো জাহাজে কোনো বই পাওয়া গেলেই তা গ্রন্থাগারে নিয়ে আসা হত। এই বইগুলি “জাহাজের বই” নামে তালিকাভুক্ত করা হত। তারপর সরকারি লিপিকার সেই বইয়ের অনুলিপি করতেন। মূল বইটি গ্রন্থাগারে রেখে, অনুলিপিটি মালিককে ফেরত দেওয়া হত। অতীতকালের গ্রন্থ সংগ্রহের পাশাপাশি এই গ্রন্থাগারে একদল আন্তর্জাতিক গবেষক সপরিবারে বাস করতেন। তাঁরা রাজার কাছ থেকে বৃত্তি পেতেন।
আলেক্সান্দ্রিয়ার প্রাচীন গ্রন্থাগারের আকার কেমন ছিল, তা সঠিক না জানা গেলেও প্রাচীন গ্রন্থগুলির বর্ণনা অনুসারে, এই গ্রন্থাগারে স্ক্রোলের বিশাল সংগ্রহ, আঁকাবাঁকা পায়ে চলার পথ, একত্রে ভোজনের কক্ষ, পড়ার ঘর, সভাকক্ষ, বাগান ও বক্তৃতাকক্ষ ছিল। আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলির শিক্ষাপ্রাঙ্গণে এই ধরনের নকশা দেখা যায়। গ্রন্থাগারের একটি অধিগ্রহণ বিভাগ (সম্ভবত গ্রন্থভাণ্ডারের কাছে অবস্থিত ছিল বা বন্দরে জিনিসপত্র রাখার কাজে ব্যবহৃত হত) এবং একটি ক্যাটালগিং বিভাগ ছিল। একটি বড় ঘরে তাকে প্যাপিরাসের সংগ্রহ রাখা হত। এগুলিকে বলা হত “বিবলিওথেকাই”। জনশ্রুতি আছে, এই তাকগুলির উপর একটি ফলকে লেখা থাকত: “আত্মার চিকিৎসার স্থান”।
আলেক্সান্দ্রিয়া গ্রন্থাগার পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল মুসলিম খলিফা ওমর এর নেতৃত্বে। যার ফলে বহু স্ক্রোল ও বই চিরতরে নষ্ট হয়ে যায়। আলেক্সান্দ্রিয়ার প্রাচীন গ্রন্থাগারের অগ্নিকাণ্ড তাই সাংস্কৃতিক জ্ঞান ধ্বংসের প্রতীক। আজ পর্যন্ত বিশ্বের জ্ঞানী ব্যাক্তি ও গবেষকেরা এর অভাব অনুভব করেন। প্রাচীন গ্রন্থগুলিতে এই অগ্নিকাণ্ডের সময় নিয়ে বিতর্ক পাওয়া যায় মুসলিম সম্প্রদায়ের ভেতরে। তাদের ভাষ্য এটা মুসলমানেরা করেনি। কে এই অগ্নিসংযোগ ঘটিয়েছিলেন তা নিয়েও মতান্তর তৈরি করা হয়েছে। এই ধ্বংস নিয়ে একটি জনশ্রুতি হল, বহু বছর ধরে জ্বলতে থাকা আগুনে এই গ্রন্থাগার বিনষ্ট হয়। সম্ভবত ৪৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে জুলিয়াস সিজারের মিশর আক্রমণের সময় অথবা ২৭০ খ্রিস্টাব্দে আরেলিয়ান আক্রমণের সময়, ৩৯১ খ্রিস্টাব্দে কপটিক পোপ থেওফিলাসের নির্দেশে এবং ৬৪২ খ্রিস্টাব্দে সর্বোশেষ মিশরে মুসলমান আক্রমণের সময় সংঘটিত পৃথক পৃথক অগ্নিকাণ্ডে আলেক্সান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগার সম্পূর্ণ ভস্মীভূত হয়। এর মধ্যে ৩৯১ খ্রিস্টাব্দের সেই ঘটনায় কপটিক পোপ থেওলিফাস এর কথা কয়েক জায়গায় উল্লেখ আছে। কিন্তু তিনি সেই লাইব্রেরী পোড়াননি। তিনি লাইব্রেরীর পার্শ্ববর্তী একটি মন্দিরে হামলা চালিয়েছিলেন বলে উল্লেখ আছে। তখনও সেই লাইব্রেরী অক্ষত ছিলো। তবে ইতিহাস অনুযায়ী সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য যে তথ্য পাওয়া গেছে, ৬৪২ খ্রিস্টাব্দে মুসলমান খলিফা ওমর এর দ্বারাই এই আলেক্সান্দ্রিয়া লাইব্রেরী ভস্মীভূত হয়।
লেখক: ব্লগার মৃত কালপুরুষ
লেখাটি ইতিপূর্বে একটি বাংলা ব্লগেও প্রকাশিত হয়েছে ০৭/১০/২০১৭ইং তারিখে।
http://ebizctg.com/news/13296