বাঙ্গালি মুসলমানদে আত্মপরিচয়ের সংকট।

মুসলমানের রবীন্দ্র বর্জনে কোন দোষ নাই। আরবী নামের মুসলমানদের আত্মপরিচয় সংকট তার নামকরণেই শুরু। বাঙালী মুসলমান ধর্মান্তরিত না আরবী-তূর্কী-আফগার বংশজাত তা নিয়ে ঘোর মতবিরোধ থাকলেও বরাবরই বাঙালী মুসলমান তার দোঁআশ মানসিক সংকট প্রমাণ করেছে। রবীন্দ্র বর্জনকারীদের জন্ম আজকের নয়। বলা যেতে পারে আফগান দস্যু আর বণিকরা এসে স্থানীয় রমনীদের গর্ভে তাদের জেনিটিক চিহৃ রাখার পর থেকেই। রবীবন্দ্রনাথ স্বয়ং এদের সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন। ‘কথা ও কাহিনী’ কাব্যগ্রন্থের মানি কবিতায় ‘আরঙজেব ভারত যবে/ করিতেছিল খান খান’ লাইনটি মুসলিমরা তাদের “পূর্বপুরুষদের” অপমানিত করা হয়েছে বলে দাবী করে রবীন্দ্রনাথকে ক্ষমা চাইতে বলেছিল। বলেছিল, ঐ লাইন তুলে নিতে হবে…।

আরঙজেবের মানস বংশধররা রবীন্দ্রনাথের উপর এর শোধ তুলেছিলো ৪৭ সালে নিজেদের জন্য সাম্প্রদায়িক দেশ পাকিস্তান করার পর। পূর্ব পাকিস্তানের বাংলা ভাষী মুসলমানরা নতুন সাহিত্য সৃষ্টি করবে। সম্পূর্ণই মুসলিম ভাবধারায়। রবীন্দ্রনাথকে বাদ দেয়া হলো। পাকিস্তানে রবীন্দ্রনাথ নিষিদ্ধ। করাচি লাহোরের সঙ্গে একই মুসলিম ভ্রাতৃত্ববন্ধন নিশ্চিত করতে পশ্চিমবঙ্গ এবং রবীন্দ্রনাথকে বড় বাধা মনে করা হলো। বাঙালী মুসলমান এই প্রচেষ্টায় নিজে বিলিন হবার মুখে ফের রবীন্দ্রনাকে আকড়ে ধরে। বাংলাদেশ হবার পর আহমদ ছফা ‘বাংলাদেশী সাহিত্যের নিজস্ব’ ভাষা নির্মাণ করার কথা বলে পশ্চিমকে ফের নিষিদ্ধ করার ডাক দেন। এসব ক্ষেত্রে আমরা সব সময় গোলাম মুস্তফা ফরুখ আহমদের নাম বললেও আহমদ ছফার নাম এড়িয়ে যাই। বস্তুত পূর্ব পাকিস্তানী মুসলমান তথা বাংলাদেশী মুসলমানদের আজো নিজস্ব সাহিত্য ভাষা তৈরি হয়নি! কয়েকটা শাহবাগের আঁতেল আলাদা ভাষার নামে উদ্ভট ডিজুস ভাষায় (বিক্রমপুরের আঞ্চলিক ভাষার সঙ্গে প্যাকেজ নাটকের ন্যাকা মেয়েদের ভাষার মিশেল) ইনারা সাহিত্য প্লাস নিজেরা কথাবার্তা বলেন…!

এই যে, হঠাৎ করে রবীন্দ্রনাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চাননি বিতর্ক যারা তুলে দিলো, মুসলমানের রবীন্দ্রনাথ বর্জন করা উচিত বলে নছিয়ত করল, এদের জীবনে পড়া বাংলা বইয়ের ৯০ ভাগই পশ্চিমবঙ্গের লেখকদের! এদের সাহিত্যে নিজেদের ‘বাঙালী মুসলমান সাহিত্যিক’ বিভাজন কোনভাবেই দুই বাংলার ঐতিহাসিক আর্থ-সামাজিক ধর্মীয় বাস্তবতার নিরিখে নয়, এর পুরোটাই সাম্প্রদায়িক বিভেদ ঘৃণা ঈর্ষাজনিত কারণ থেকে। কারো কারোর লজ্জ্বাশরম কম বলে নিজেকে সাম্প্রদায়িক মুসলমান হিসেবে ফুটিয়ে তুলতে লজ্জ্বাবোধ করে না, বাকীরা নিজেদের সাম্প্রদায়িক ভাবতে অস্বস্তিবোধ করে আবার ঐতিহাসিক দেশভাগের দ্বিজাতিতত্ত্বের সুফলকে মনে মনে অস্বীকার করতে পারে না। আর যাই হোক, ঢাকায় সিনেমা বানানো শুরু না হলে কি ওমর সানী নায়ক হতে পারত?

রবীন্দ্রনাথকে মুসলমানরা ত্যাগ করলে, বাংলা সাহিত্যের উত্তরাধিকার অস্বীকার করলে বখতিয়ার খিলজি ছাড়া বাঙালী মুসলমানের জন্য আর কিছু রইল না। আলাওল, আবদুল হাকিমদের মত মধ্যযুগের কবিদের এইরকম ঘৃণ্য সাম্প্রদায়িক ভেদরেখা ছিলো না। কাজেই তাদের দেখিয়ে বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন যুগের কথিত ‘মুসলমানদের অবদান’ জাতীয় হেফাজতী প্রপাগান্ডা চালিয়ে লাভ নেই। রবীন্দ্রনাথকে বর্জন করে পাকিস্তানকে রক্ষা করা যায়নি। মুসলিম জাতীয়তবাদ একটা বাতিল মাল। বার বার উপমহাদেশসহ পুরো পৃথিবী জুড়ে এটা প্রমাণিত হয়েছে।