গোপালগঞ্জ জেলা সদরের সাহাপুর ইউনিয়নে এক সময় একজন মানুষও অন্য ধর্মের ছিলো না । সাহাপুরের সকলেই হিন্দু ধর্মাবলম্বী । অথচ এই ইউনিয়ন বর্তমানে পুরো এলাকাই হয়ে গেছে ‘শত্রু সম্পত্তি’ । গোপালগঞ্জে বিএনপি-জামাত নেই বললেই চলে । এখানে দুই দল আছে । একটি আওয়ামীলীগ এবং আরেকটি হিন্দু লীগ । কাজেই এখানে কোন দলের ক্যাডাররা হিন্দু নির্যাতন করে তা স্পষ্ট করে বলার দলকার আছে কি? গোপালগঞ্জ জেলা সদর আসনে আওয়ামীলীগের প্রার্থী দেড় লাখ ভোট পেলে বিএনপির প্রার্থী ভোট পায় (সর্বোচ্চ) মাত্র চার থেকে পাঁচ হাজার । কিন্তু তারপরেও বিএনপি শাসনামলে গোপালগঞ্জে এত নির্যাতন হয়নি । গোপালগঞ্জে চুয়ান্ন শতাংশ হিন্দু ভোটার থাকলেও কোনো হিন্দুকে নির্বাচনে প্রার্থী হতে দেওয়া হয় না । কোনো হিন্দু যদি গোপালগঞ্জ থেকে প্রার্থী হওয়ার সাহস দেখায় তবে তাকে মারধর করা হয় । 2001 সালের নির্বাচনে হিন্দুলীগ গোপালগঞ্জের তিনটি আসনেই প্রার্থী দিয়ে ছিলেন ।
গোপালগঞ্জ – তিন আসনে হিন্দুলীগের প্রার্থী ছিলেন দলটির মহাসচিব বীরেন্দ্র নাথ মৈত্র । আর তার প্রতিদ্বন্ধী প্রার্থী হিসেবে ছিলেন আওয়ামীলীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা । তাহলে বুঝতেই পারছেন হিন্দুলীগের প্রার্থীকে সরাতে না পারলে যে শেখ হাসিনার জয় অনিশ্চিত হয়ে পড়তো । যে কারণে আওয়ামীলীগের কর্মীরা বীরেন্দ্র মৈত্রের নির্বাচনী ক্যাম্প ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেয় । নির্বাচনী জনসভাও করতে দেওয়া হয়নি । বাংলাদেশ হিন্দুলীগ কোটালীপাড়া উপজেলা শাখার সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা পরিমল চন্দ্র বিশ্বাসকে কোটালীপাড়া মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কার্যালয়ের সামনে মারধর করে । ওই দিন আওয়ামীলীগের কর্মীরা তার বাড়ি-ঘর ভাংচুর করে । মুক্তিযোদ্ধা পরিমলকে পুকুরের মধ্যে পানিতে ডুবানোর মত অমানবিক ঘটনাও ঘটে । হিন্দুলীগ প্রার্থী বীরেন মৈত্রের হয়ে কাজ করায় পরিমল চন্দ্রের ওপর আওয়ামীলীগের কর্মী মিলন ও রুহুল কবিরের নেতৃত্বে হামলা চালানো হয় । এরপর 2007 সালের 12 জানুয়ারী বাতিল হওয়া নির্বাচনে হিন্দুলীগের প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় আওয়ামীলীগের কর্মীরা পরিমল চন্দ্র বিশ্বাস ও সুনীল কুমার সরকারকে মারধর করে । এ সময় পরিমলের কাছ থেকে নগদ পাঁচ হাজার টাকা, মনোনয়নপত্র ও অন্যান্য কাগজপত্র ছিনিয়ে নেয় হামলাকারী । এই ঘটনাটি ঘটে সাংবাদিক মোল্লা মহিউদ্দিনের সম্মুখে । অনেকের প্রশ্ন হিন্দু অধ্যুষিত গোপালগঞ্জে হিন্দু সংসদ সদস্য নেই কেন? এই কেন এর জবাবটা যদি পারেন তবে শেখ হাসিনাকে জিজ্ঞাসা করবেন । হিন্দুলীগের পক্ষ থেকে দলীয় প্রার্থীরা এখানে প্রতি বছর নির্বাচন করতে পারলেও গত দুই নির্বাচনে আওয়ামীলীগ করতে দেয়নি ।
গত নির্বাচনে হিন্দুলীগকে নির্বাচন কমিশন নিবন্ধন করেনি । তাই হিন্দুলীগ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্ধিতা করতে পারেনি । শুধু হিন্দুলীগ প্রার্থীদের ই নয় স্বয়ং আওয়ামীলীগের হিন্দু নেতা মুকুল বসুকেও মনোনয়ন দেয়নি । এ বিষয়ে গোপালগঞ্জের ব্যবসায়ী লালমোহন বিশ্বাস বলেন, হিন্দুদের মধ্যে একতা নেই বলেই এমনটা হচ্ছে । হিন্দু অধ্যুষিত গোপালগঞ্জে হিন্দু নেতারা প্রার্থী হতে পারবে না কেন? আসলে আমাদের মধ্যে একতা নেই বলেই তো অধিকার থেকে বঞ্ছিত হতে হচ্ছে । তিনি আরো বলেন, শেখ সেলিম সাহেবকে এলাকার সব মানুষ ই ভোট দেয় তাই আমিও দেয় । তবে উনিতো এলাকাতে আসেন না । কাজেই তিনি এলাকায় কি জনসেবা দিচ্ছেন তাতো বোঝায় যাচ্ছে ।
গোপালগঞ্জে তিনটি সংসদীয় আসনের মধ্যে একটিতে শেখ হাসিনা, একটিতে শেখ সেলিম এবং অপরটিতে ফারুক খান । তারা কয়েক টার্ম ধরেই নির্বাচিত হয়ে আসছেন এবং আগামীতেও হবে । মোদ্দা কথা, নির্বাচনে গোপালগঞ্জে হিন্দু প্রার্থী দাঁড়ানো মানেই তো আওয়ামীলীগের জন্য গলায় মাছের কাঁটার মত অবস্হা হয়ে যাবে । দীর্ঘ সময়ের জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে গত নির্বাচনে ফারুক খানের প্রতিদ্বন্ধী হিসেবে দাঁড়িয়ে ছিলেন জাতীয় পার্টির হিন্দু নেত্রী দীপা মজুমদার । কিন্তু এই দীপা মজুমদারকেও কম হেনস্হা হতে হয়নি আওয়ামীলীগের কর্মীদের হাতে । হিন্দুরা সেদিন আওয়ামীলীগের কর্মীদের ভয়ে দীপা মজুমদারকে ভোট না দিয়ে ফারুক খানকে ভোট দিয়েছিল । সবশেষ কথা, শেখ হাসিনা যদি উনার নির্বাচনী আসন গোপালগঞ্জ – তিনে এতটাই জনপ্রিয় হন তবে সুষ্ঠ নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে হিন্দুলীগের কর্মীদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্ধিতা করে দেখাক । আসলে গোপালগঞ্জের হিন্দুরা আওয়ামীলীগের ভোট ব্যাংক কোনো দিনই ছিলো না । তারা মূলত হিন্দুলীগের ভোট ব্যাংক । সেই ভোট ব্যাংক জোরপূর্বক কারা ছিনিয়ে নিয়েছে স্পষ্ট করে আর বলতে চায় না ।