“ মানুষের প্রকৃতি ভেদে মনের অবস্থান ও ধর্ম”

“ মানুষের প্রকৃতি ভেদে মনের অবস্থান ও ধর্ম”
ডাঃ মৃনাল কান্তি দেবনাথ

সনাতনি শাস্ত্র বলে, মানুষের মন তার নিজস্ব প্রকৃতি ভেদে শরীরের পাঁচ রকম কোষে অবস্থান করে এবং সেই মতো মানুষকে পরিচালিত করে। এরা হলো — (১)লিঙ্গ ময় কোষ (২) অন্ন ময় কোষ (৩) প্রান ময় কোষ (৪) জ্ঞান ময় কোষ (৫) আনন্দ ময় কোষ ।

লিঙ্গ ময় কোষ- —-নাভি দেশের নীচে লিঙ্গ ময় কোষের অবস্থান। যে ব্যাক্তির মন সর্বদাই এই লিঙ্গ ময় কোষে অবস্থান করে, তার মনে শুধুই “আহার-নিদ্রা-মৈথুন” এই তিন প্রকার চিন্তা ভাবনা আসে আর সে সেই মতো কাজ করে। অন্য কোনো ভাবনা চিন্তা তার মনে আসতেই পারে না,  তাই সে অন্য কোনো কাজ করতে উৎসাহও পায় না,করেও না। কিন্তু এই তিন কাজ করে সে মনে সাময়িক একটু সুখ ছাড়া কোনো নিরন্তর আনন্দানুভুতি পায় না। কারন এই তিন ক্ষুধা বা আদিম জৈবিক ক্রিয়ার সাধনের দ্বারা মনে পরিত্তৃপ্তি আসে না। প্রতিদিন যেমন খাবার জন্য পেটে ক্ষুধা হয়, ঘুম পায় ,ঠিক তেমনি প্রতিদিন নতুন যৌন ক্ষুধা আসে। এই তিন ক্ষুধা মেটাতেই সব শক্তি এবং সামর্থ্য ব্যয় হয়ে যায়। কিন্তু মনে থাকে অতৃপ্তি। সাধারনত, তামসিক মানুষের মনই এই লিঙ্গময় কোষে বিচরন করে।

অন্নময় কোষ— বুকের নিম্নাংশ থেকে নাভি অবধি অন্ন ময় কোষের অবস্থান। এই কোষে অবস্থান কারীর মনে সব সময় ভোগ তৃষ্ণা প্রবল থাকে। শুধু মাত্র যৌন তৃষ্ণাই নয়, সমস্ত রকম বিষয় বাসনা, ধন, মান,সম্পত্তি, অন্যের ওপরে আধিপত্য,প্রছুর ক্ষমতা লাভ ইত্যাদি এই অন্নময় কোষে বিচরন কারী মানুষের ভাবনা চিন্তা এবং কর্ম। মানুষের এই চাহিদাও কখনো পুরন হয় না,তাই শান্তিও হয় না। এরা লিঙ্গ ময় কোষে বিচরন কারীদের চেয়েও বেশী অসুখি, তার কারন,  লিঙ্গময় কোষে অবস্তান কারীর চিত্তে বাসনা শুধু ওই তিনটি, আর কিছুই নয়। কিন্তু অন্নময় কোষে অবস্থান কারীর মনে “লক্ষ বাসনা”, আর তার অপুরনে মানসিক অবসাদ এবং তজ্জনিত হতাশা—আর ফল স্বরুপ নানা শারীরিক ব্যাধি—ডায়াবেটিস, রক্তের উচ্চচাপ, বেশী কোলেষ্টারল, থাইরয়েডের সমস্যা, হৃৎপিন্ডের রক্ত বাহী নালীর ক্ষতি, বাইপাস অপারেশন, এঞ্জিওপ্লাস্টি, স্ট্রোক, বিছানায় শয্যাশায়ী জীবন যন্ত্রনা ইত্যাদি। এরাই তাদের  সব বাসনা পুরন করতে অন্যের ক্ষতি করে, সমাজে বিশৃংখলার সৃষ্টি করে। নিজে মরে অন্যকেও মারে। সাধারনত, তামসিক লোকেদের বেশী রজোগুন জমা হলে এই অবস্থা হয়। তমোগুনাশ্রিত ব্যাক্তি রাজনৈতিক ক্ষমতা পেলে (রাজা হলে) সেই রাজ্যবাসীর কপালে অনেক দুর্ভোগ হয়।

প্রান ময় কোষ—– বুকের মধ্য খানে প্রান ময় কোষের বিচরন ক্ষেত্র। স্বত্ত্ব গুনের প্রভাব প্রাথমিক স্তরে শুরু হলে মানুষের মনে পরিবর্তন হতে শুরু হয় এবং ধীরে ধীরে মন উপরে ঊঠতে থাকে। এই মন আহার-নিদ্রা-মৈথুন” পরিমিত (সংযত) ভাবে সম্পন্ন করার পক্ষপাতি। এই মনে কিছু কিছু অন্যের জন্য ভাবনা চিন্তা, সমাজের নানা মানুষের জন্য সামান্য হলেও কিছু করার কথা আসে। কিছু ভালো কথা শোনা, ভালো মানুষের সঙ্গ করা,কিছু আধ্যাত্ম/ধর্ম কথা শোনা এবং ধর্মীয় জীবন যাপন করার প্রয়োজনীয়তা মানা এবং সে মতো চলার চেষ্টা থাকে। তাদের চিন্তা এই ভাবে পরিবর্তিত হয়ে নিজের থেকে অন্যের জন্য যেতে থাকে। এই মন চেষ্টা করে নিজের মনের ময়লা দূর করে মনকে ঈশ্বরাভিমুখি করতে। এই মনের মানুষের প্রাথমিক ভাবে মনে হতাশা, দুঃখ কষ্ট হলেও ধীরে ধীরে ভালো সঙ্গ, ভালো কর্ম, ভালো চিন্তার প্রভাবে মনের দুঃখ কষ্ট লাঘব হতে থাকে।

জ্ঞানময় কোষ—-  মনের স্থিতি যখন আরো উপরে এসে কন্ঠে স্থির হয় তখন বলে জ্ঞানময় কোষে অবস্থিতি। এই সময় মানুষের জৈবিক চাহিদা কমে যায়, ভোগ তৃষ্ণা কমে যায়।জীবন ধারনের জন্য ন্যুনতম যে প্রয়োজন সেটুকু ছাড়া তার আর কিছু চাহিদা থাকে না। সৎসঙ্গ, সৎচিন্তা, সৎকর্ম ছাড়া আর কোনো কিছুতে সময়, ভাবনা ব্যায়িত হয় না। মনে সর্বদা আসে ঈশ্বর চিন্তা,তার স্বরুপ কি জানার চেষ্টা, শুনে, পড়ে বা নিজে ভাবনা চিন্তা করে শুধুই ঈশ্বর তত্ত্ব (সৃষ্টি এবং স্রষ্টা) জানার এক আগ্রহ মনের সমস্ত জায়গা জুড়ে থাকে। এই মন ঐশ্বরীয় কথা বলতে,তার গুন গান করতেই ভালোবাসে এবং সেই মানুষ তাইই করে। এই মনে বিষয় চিন্তা, কামনা ,লালষা, ,হিংসা ,দ্বেষ প্রায় শেষ হয়ে যায়, তাই তার হতাশা বা দুঃখ প্রায় শেষ হয়ে যায়। জাগতিক চাহিদা মুক্ত এই মন বিশ্বশক্তির সন্ধান পায় আর তার সঙ্গ যুক্ত থাকতেই চায় (যোগ যুক্ত)। তার চিত্ত হয় অমলিন, বুদ্ধি হয় নির্মল। সে সুখ এবং আনন্দের সন্ধান পায়। এই অবস্থায় স্বত্ত্ব গুন প্রবল হয় এবং অন্য গুন কমে যায়,প্রায় শেষ হয়ে যায়।

আনন্দ ময় কোষ —   আনন্দময় কোষ মনের সর্বোচ্চ অবস্থা। এই মন স্থির হয় ভ্রু মধ্যে। এই মনে জাগতিক চাহিদা প্রায় সম্পুর্ন ভাবে অবলুপ্ত হয়ে যায়। ক্ষুধা ,তৃষ্ণা থাকে নাম মাত্র। বিষয় চিন্তা, লোভ,লালষা,কিছুই থাকে না। ঈশ্বরীয় কথা, ঈশ্বরের গুন গান ছাড়া অন্য কোনো প্রসঙ্গ তার মনে আসে না, সেই রকম কোনো সঙ্গ তিনি করেন না, সামনে এলে সযত্নে এড়িয়ে যান। ঈশ্বরের স্বরুপ সম্বন্ধে পুর্ন জ্ঞান লাভ হয় তাই তিনি সব মানুষে, প্রানীতে সমত্ব জ্ঞান করতে শেখেন, এই সৃষ্টিতে কোথাও কোনো ভেদা ভেদ তিনি আর খুজে পান না। “সৎ, চিৎ, আনন্দ= সচ্চিদানন্দ” লাভ করে তিনি সর্বদা আনন্দ স্বরুপে থাকেন। সচ্চিদানন্দ কে বুকে ধরে তিনি হন সদানন্দময়। তিনি ঈশ্বরের সঙ্গ লাভ করে এই জন্মেই জন্ম মৃত্যুর বন্ধন থাকে মুক্তি পান,তার মোক্ষ লাভ হয়।

মনের এই উর্ধোগতি তাই এক সাধনা, জীবন ধারনের সাধনা। অধগতি জীবনে ঈশ্বর থেকে দূরে চলে আসা, উর্ধীগতি ঈশ্বরের সাযুয্য লাভ। সনাতনি শাস্ত্র এই শিক্ষা দেয়। মানুষ কোনটাকে ধরবে সেটা তার প্রকৃতি গত ইচ্ছা।