দুটি ইতিহাস একই পরিনতি…।।।

দুটি ইতিহাস একই পরিনতি…

১). #রাজপুত_রানী #পদ্মাবতী ও
#মুসলমান_সুলতান #আলাউদ্দীন_খিলজী

অনন্য সুন্দরী পদ্মাবতী (পদ্মিনী নামেও পরিচিত) ছিলেন সিংহলের (শ্রীলঙ্কা) রাজকন্যা। আবার কারও মতে সিংহল না, উত্তর ভারতের হরিয়ানার ‘সিঙ্ঘাল’ নামক জায়গাটিই ছিল পদ্মাবতীর বাসস্থান। চিতোরের রাজা রাওয়াল রতন সিং এর দ্বিতীয় স্ত্রী ছিলেন তিনি। সিসোড়িয়া বংশীয় রতন সিং স্বয়ম্বরে জিতে বিয়ে করেন পদ্মাবতীকে।

রতন সিং এর সভায় রাঘব চেতন নামে এক সঙ্গীতকার ছিলেন, যে আবার গোপনে জাদুবিদ্যা চর্চা করতো। সেসময় রাজ্যে জাদুবিদ্যা চর্চা নিষিদ্ধ ছিল। একদিন জাদুচর্চার সময় হাতে নাতে ধরা পড়লে রাজা তাকে রাজ্য থেকে নির্বাসিত করেন। এই অপমানের জ্বালায় প্রতিশোধপ্রবণ হয়ে ওঠে রাঘব চেতন। সে সোজা দিল্লী চলে গিয়ে সুলতান আলাউদ্দিন খিলজীর দরবারে আশ্রয় নেয়। এই আলাউদ্দিন খিলজীকে নিয়ে কিছু কথা জেনে রাখা দরকার।

আলাউদ্দিন খিলজী ছিলেন খিলজী বংশের দ্বিতীয় এবং সবচেয়ে ক্ষমতাধর শাসক। তিনি বরাবরই একজন সম্পদ ও ক্ষমতালোভী ব্যক্তি ছিলেন বলে জানা যায়। উল্লেখ্য, ভারতীয় উপমহাদেশে শাসনের আসনে বসা সব মুসলিম শাসক কিন্তু একরকম ছিলেন না। খিলজী বংশের প্রতিষ্ঠাতা সুলতান জালালউদ্দিনের ছোট ভাই শিহাবউদ্দিনের পুত্র ছিলেন এই আলাউদ্দিন খিলজী। পিতার মৃত্যুর পর চাচা জালালউদ্দিনের কাছেই মানুষ হন তিনি। পরিণত বয়সে তিনি জালালউদ্দিনের এক কন্যাকে বিয়ে করেন এবং কারা রাজ্যের শাসক হিসেবে নিযুক্ত হন। কিন্তু তার বরাবরই লোভ ছিল সিংহাসনের প্রতি।

শ্বশুরের পরিবারের প্রতি তার বিশেষ বিতৃষ্ণা কাজ করতো। শুধু ক্ষমতা হাসিল করার জন্যেই যে তিনি জালালউদ্দিনের সাথে আত্মীয়তার বন্ধন দৃঢ় করেন, তা এমনিই বোঝা যায়। নিজের কূটপরিকল্পনা সফল করার লক্ষ্যে তিনি প্রথমে পার্শ্ববর্তী হিন্দু রাজ্যগুলোর উপর আক্রমণ করতে থাকেন এবং প্রচুর অর্থ ও ধন-সম্পদ হস্তগত করে নিজের সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করতে থাকেন। এদিকে জালালউদ্দিন ভাবতে থাকেন, এসব ধন-সম্পদ বোধহয় তারই পায়ে লুটাবার জন্যে। আলাউদ্দিনের সাফল্যের খবর শুনে জালাউদ্দিন গোয়ালিয়র আসেন তার সাথে দেখা করার জন্যে। কিন্তু তাকে অভ্যর্থনা জানাবার ছলে গিয়ে আলাউদ্দিন তাকে হত্যা করেন। সালটি ছিল ১২৯৬।

আলাউদ্দিন খিলজী নিজেকে দিল্লীর অধিকর্তা ঘোষণা করেন। ১২৯৬ থেকে ১৩০৮ সাল পর্যন্ত নিজ সীমান্তবর্তী এলাকায় বারংবার হওয়া মোঙ্গল আক্রমণ সফলভাবে প্রতিরোধ করেন তিনি। ১২৯৮ সালে দিল্লীর উপকন্ঠে মোঙ্গলদের একটি অংশ এসে বসতি গড়ে। এরা সকলেই কিছুদিন আগে ইসলামের ছায়াতলে এসেছিলেন। কিন্তু আলাউদ্দিন সন্দেহ করেন যে, এরা কোনো বড় ধরণের ষড়যন্ত্রকারী হতে পারে। ক্ষমতার বিষয়ে তিনি কখনোই কোনো আপোষ করতে চাননি। তাই তার নির্দেশে একদিনে এই প্রায় ৩০ হাজার নও মুসলিমের উপর গণহত্যা চালানো হয় এবং তাদের স্ত্রীদের দাসী বানানো হয়।

অমুসলিমদের উপর আলাউদ্দিন জিজিয়া, খরাজ, কারি ও চারি, চার ধরনের কর ব্যবস্থার প্রচলন করেছিলেন। মাত্র কয়েক দশক পুরোনো ইতিহাসেরও অনেক বিষয় অনেক সময় মেনে নিতে সংকোচ হয় মানুষের। সেখানে আমরা জানছি কয়েকশ বছর আগের ইতিহাস। মনে রাখতে হবে, সে সময়টা ছিল আলাদা, আর কোনো নির্দিষ্ট ধর্ম বা উচ্চ বংশ কখনোই পৃথিবীর বুকে একজন মানুষের চরিত্র নির্ধারণ করেনি।

এবার ফিরে আসা যাক মূল কাহিনীতে। রতন সিং কর্তৃক বিতাড়িত হয়ে রাঘব চেতন দিল্লীতে গিয়ে একটি জঙ্গলে আশ্রয় নেয়। সে জানতো সেই জঙ্গলে আলাউদ্দিন খিলজী নিয়মিত হরিণ শিকারে আসতেন। একদিন আলাউদ্দিন দলবল নিয়ে জঙ্গলে প্রবেশ করার পর রাঘব অতি সুমধুর সুরে বাঁশি বাজাতে থাকে। তার সুরে মুগ্ধ হয়ে আলাউদ্দিন নির্দেশ দেন তাকে ধরে আনার। সুলতানের সামনে উপস্থিত হয়ে কৌশলে রাঘব নিজের দুরভিসন্ধি কাজে লাগাতে শুরু করে। সে বলে, কেনো সুলতান মামুলি একজন বাঁশিওয়ালাকে নিয়ে পড়ে আছেন যখন পাবার মতো আরও অনেক সুন্দর জিনিস আছে। প্রতিশোধপরায়ণ রাঘব রানী পদ্মাবতীর রুপের গুণাগুণ বর্ণনা করতে থাকে সুলতানের কাছে। সেই রুপকথনের জালে জড়িয়ে আলাউদ্দিন খিলজী প্রাসাদে ফিরে তৎক্ষণাৎ চিতোরের দিকে সৈন্য পরিচালনার আদেশ দেন।

কিন্তু চিতোর পৌঁছে হতাশ হন খিলজী। রতন সিং এর দুর্গটি ছিল অনেক বেশি সুরক্ষিত। বাধ্য হয়ে তিনি রতন সিং এর কাছে খবর পাঠান যে তিনি রানী পদ্মাবতীকে শুধু এক ঝলক দেখতে ইচ্ছুক। তাকে দেখতে পেলেই তিনি সসৈন্যে দিল্লী ফিরে যাবেন। তিনি এটাও উল্লেখ করেন যে, পদ্মাবতীকে তিনি বোনের মতো দেখেন, অবশ্য খিলজীর অভিপ্রায় সম্পর্কে সকলেই অবগত ছিলেন। একজন রাজপুত নারীর জন্য এই প্রস্তাব ছিল অসম্মানজনক। তাদের প্রথা অনুযায়ী অচেনা ব্যক্তির সাথে দেখা করা নারীদের জন্য বারণ ছিল। কিন্তু নিশ্চিত যুদ্ধ এড়াতে রতন সিং পদ্মাবতীকে রাজি করান। শর্ত থাকে যে, আলাউদ্দিনকে আয়নায় রানীর প্রতিচ্ছবি দেখতে হবে। মহলের একটি কক্ষে এমনভাবে কিছু আয়না স্থাপন করা হয় যাতে সরাসরি সাক্ষাৎ না করে দূর থেকেই রানী নিজের প্রতিবিম্ব দেখাতে পারেন। কিন্তু এই উপায়ে রানীকে চাক্ষুস দেখার পর আলাউদ্দিনের বদ অভিপ্রায় আরও দৃঢ় হয়ে ওঠে। যে করেই হোক পদ্মাবতীকে তার পেতেই হবে!

শিবিরে ফেরার সময় কিছুদূর পর্যন্ত পথ রতন সিং আলাউদ্দিনকে এগিয়ে দিতে আসেন। এই সুযোগের ফায়দা নিয়ে আলাউদ্দিন রতন সিংকে তৎক্ষণাৎ অপহরণ করে ফেলেন। রাজার মুক্তিপণ হিসেবে তিনি দাবী করেন রানী পদ্মাবতীকে। গোরা আর বাদল নামে দুই বীর রাজপুত সেনাপতি তখন আলাউদ্দিন খিলজীকে তার নিজের খেলাতেই হারাবার ফন্দি আঁটেন। তারা খবর পাঠান, পরদিন সকালে রানী পদ্মাবতী তার দাসী-বাদিসহ পালকিতে খিলজীর শিবিরের দিকে রওনা দেবেন। পরদিন ১৫০, কোনো বর্ণনামতে ২০০ পালকি খিলজীর শিবিরের দিকে রওনা হয়। কিন্তু প্রত্যেকটি পালকি ছদ্মবেশে চারজন করে দুর্ধর্ষ রাজপুত যোদ্ধাদের দ্বারা বাহিত হচ্ছিল আর প্রত্যেক পালকিতে দাসীর বদলে লুকিয়ে ছিল আরও চারজন করে যোদ্ধা। এই প্রতিহিংসাপরায়ণ ভয়ানক সৈন্যদলটি খিলজীর শিবিরে পৌঁছেই অতর্কিত হামলাকরে বসে। আলাউদ্দিন খিলজীর শিবিরে ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ পরিচালিত করে এই সেনাদল রাজা রতন সিংকে মুক্ত করে নিয়ে যায়।

এই ঘটনায় পরবর্তীতে দ্বিগুণ আক্রোশে আরও বেশি সৈন্য চালনা করে আলাউদ্দিন চিতোরের দুর্গ অবরোধ করেন। অতি সুরক্ষিত সেই দুর্গে প্রবেশ করতে না পারায় অবরোধই ছিল একমাত্র পথ। দিনের পর দিন অবরুদ্ধ থাকার পর দুর্গের ভেতরে রসদ ফুরিয়ে এলে রাজা রতন সিং সিদ্ধান্ত নেন দুর্গের ফটক খুলে মুখোমুখি হবার। দীর্ঘদিনের অবরুদ্ধ থাকার পর রাজপুতদের জন্য এ যুদ্ধ ছিল অসম যুদ্ধ। পদ্মাবতী ও দুর্গের অন্যান্য নারীরা জানতেন এ যুদ্ধে তাদের পুরুষদের জয়ের সম্ভাবনা কতোটা ক্ষীণ। এরকম পরিস্থিতিতে সম্মান রক্ষায় রাজপুত নারীদের মধ্যে ‘জওহর’ নামক আগুনে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহননের এক রকম প্রথার প্রচলন ছিল। বিজয়ী সৈন্যদের হাতে লাঞ্চিত হবার চেয়ে মৃত্যুকেই তারা বেশি সুখকর মনে করলেন।

রাতে দুর্গের ভেতরে এক বিশালাকার অগ্নিকুন্ড জ্বালানো হলো। নিজেদের সবচেয়ে সুন্দর পোষাকে সজ্জিত হয়ে ধর্মীয় সঙ্গীত গেয়ে আত্মসম্মান রক্ষায় আগুনের আলিঙ্গনে অগ্রসর হলেন নারীরা। সবার আগে আগুনে ঝাঁপ দিলেন রানী পদ্মাবতী, অন্য নারীরা তাকে অনুসরণ করলেন। স্বজনহারা সৈনিকদের বেঁচে থাকার আর কোনো উপলক্ষ্য থাকলো না। পরদিন সকালে যুদ্ধের সাজে সেজে খিলজী বাহিনীর সাথে লড়তে বেরিয়ে গেলো রাজপুতদের দল। ফলাফল যা হবার তাই হলো। খিলজীর সেনাদল যখন দুর্গে প্রবেশ করল তখন শুধু নারীদের দেহাবশেষ আর ভস্মই পেলো। যার মোহে এতো জনবল ক্ষয় করলেন আলাউদ্দিন খিলজী, তাকে তার পাওয়া হলো না।

চিতোরের ইতিহাসে এটিই ছিল প্রথম জওহরের ঘটনা। চিতোরগড়ের দুর্গে এর পরেও দুইবার জওহরের ঘটনা ঘটে। দ্বিতীয়বার ১৫৩৫ সালে রানী কর্নাবতি গুজরাটের রাজা বাহাদুর শাহের কবল থেকে সম্মান বাঁচাতে দলবল সমেত এই পথ বেছে নেন। এরপর তৃতীয় জওহরের ঘটনা ঘটে ১৫৬৭ সালে, মহামতি আকবরের চিতোরগড় দখলকালে। স্বয়ং আলাউদ্দিন খিলজীই ১২৯৪ সালে রাজস্থানের জয়সালমীর দুর্গ দীর্ঘ ৭ মাস অবরুদ্ধ করে রাখলে ২৪ হাজার নারী জওহরের পথ নিতে বাধ্য হয়।

……………………………………………………………………
২). #বাংলার_রানী #সত্যবতী ও
#রাজপুত_রাজ #শোভা_সিং
সঙ্গম রায় কাপুরের উত্তরপুরুষ বর্ধমান রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা কৃষ্ণ রায়ের ছোট মেয়ে। ষোড়শী রাজকন্যা, অপূর্ব সুন্দরী।

সাল ১৬৯৬, শোভা সিং এবং রহিম খাঁ যৌথ ভাবে বর্ধমান রাজ্য আক্রমণ করে। রাজা কৃষ্ণ রায় পুত্র অম্বর রায়কে নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে যান এবং যাওয়ার আগে রানীকে বলে যান যে তাঁদের  পরাজয়ের খবর পেলে, বিধর্মীর কাছে ইজ্জত দেবার বদলে পরিবারের মেয়েরা যেন আত্মহত্যা করে।

কয়েকদিন পরে রাজার পরাজয়ের খবর এলে রানীমা সবাইকে ডেকে তাদের হাতে কালকূট তুলে দেন। পরিবারের বাকি মেয়েরা সেই বিষ হাসি মুখে গ্রহণ করলেও, সত্যবতী তা গ্রহণ করতে অস্বীকার করে। ফলে, আক্রমণকারীরা প্রাসাদে প্রবেশ করে সবাইকে মৃত দেখলেও সত্যবতীকে জীবিত অবস্থায় পায়।

সত্যবতীর রূপে মুগ্ধ হয়ে শোভা সিং রহিম খাঁকে প্রাসাদের সমস্ত সম্পদ নিয়ে বিনিময়ে তাকে সত্যবতীকে দিয়ে দিতে বলে। সত্যবতী বন্দিনী হল স্বেচ্ছায়, বিনা প্রতিবাদে। রাত্রিবেলায় প্রহরীর দল তাকে পৌঁছে দিল শোভা সিং-র ঘরে। তার পাশবসত্বা তখন পুরোমাত্রায় জেগে উঠেছে।

সে একটানে খুলে দিল সত্যবতীর ওড়না। ছিঁড়ে ফেলল তার ঘাগরা। ভিতরে অধোবাস। দেহের সঙ্গে লেপটে থাকা চুড়িদার-চুস্ত। কামাতুর শোভা সিং সত্যবতীর চুড়িদারের ফাঁস খোলার চেষ্টা করে। কিন্তু কি বজ্রআঁটুনি, কিছুতেই খুলতে পারেনা। এবার সে দুহাতে ফাঁস খোলার চেষ্টা করে। আর এই মুহূর্তটির জন্যেই এতক্ষণ এত নিগ্রহ সহ্য করেছে সত্যবতী।

সে সন্তর্পণে নিজের ডান হাত বুকের ভিতর ঢুকিয়ে দেয়। পরমুহূর্তেই একটি প্রচন্ড আর্তনাদে দরজার বাইরের প্রহরীরা চমকে ওঠে। আর্তনাদ প্রত্যাশিতই ছিল, ভাবে সেটা রমণ শীৎকার। কিন্তু পরমুহূর্তেই তাদের ভুল ভাঙে, এ যে পুরুষের আর্তনাদঃ,

দরজা ভেঙে তারা যখন ভিতরে প্রবেশ করল তখন সত্যবতীর দেহে প্রাণ নেই। আর বর্ধমান রাজপ্রাসাদজয়ী শোভা সিং পড়ে আছে মাটিতে। তার গলায় বিঁধানো আছে একটি একটি ছোট্ট কিন্তু মারাত্মক ছুরিকা যেটা তাঁর বাবা তাকে জন্মদিনে উপহার দিয়েছিলেন।