এক দেশ, এক কর এবং এক বাজার।

এক দেশ, এক কর এবং এক বাজার। শুক্রবার মধ্যরাতে সংসদের ঐতিহাসিক সেন্ট্রাল হলে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বোতাম টিপে চালু করে দিলেন বহুল চর্চিত জিএসটি। ভারতের মতো বৈচিত্রপূণ্য দেশে শুরু হয়ে গেল অভিন্ন কর নীতি। ভিন্ন ভিন্ন করের জাল থেকে মুক্তি ঘটল দেশবাসীর। দীর্ঘ আলাপ আলোচনা, যুক্তি, পাল্টা যুক্তি, রাজনীতির মারপ্যাচ অতিক্রম করে অবশেষে চালু হল জিএসটি। অটলবিহারী বাজপেয়ি, অসীম দাশগুপ্তরা যে চিন্তাভাবনা শুরু করে ছিলেন পরবর্তী সময়ে মনমোহন সিং, প্রণব মুখোপাধ্যায়, পি চিদম্বরম, অমিত মিত্র-রা চেষ্টা চালিয়েছিলেন, আজ তা বাস্তবায়িত করলেন নরেন্দ্র মোদী, অরুণ জেটলিরা।

জিএসটি কি, এটা নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে, এখনও চলছে। ফলে এ’বিষয়ে আমি এই মুহূর্তে নতুন করে আলোচনা করছি না। বরং আমি আলোচনা করব জিএসটি নিয়ে যে প্রশ্নগুলো উঠছে বিভিন্নমহল থেকে, সে বিষয়ে।

জিএসটি’র কার্যকারিতা নিয়ে কোনও অর্থনীতিবিদের মনেই প্রশ্ন নেই। পৃথিবীর প্রায় সব উন্নত দেশেই জিএসটি চালু রয়েছে। তাহলে এত বিরোধিতা কেন? কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেস, বামপন্থী দলগুলি সংসদের সেন্ট্রাল হলের অনুষ্ঠান বয়কট করল কেন? তাদের দাবি, জিএসটি নিয়ে মোদী সরকার অযথা তাড়াহুড়ো করেছে, দেশের ৮০শতাংশের উপর ব্যবসায়ী অসংগঠিত ক্ষেত্রের, প্রায় ৬০ লক্ষ ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক ব্যবসায়ী প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন জানিয়েছিলেন যে তারা জিএসটি’র জন্য এখনও প্রস্তুত নন, তাদের আরও সময়ের প্রয়োজন। জিএসটি সম্পূর্ণভাবে তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর, এর পরিকাঠামো সঠিকভাবে তৈরি কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। জিএসটির করের মাত্রা বিশ্বে সব থেকে বেশি এমন অভিযোগও করছেন অনেকে। জিএসটির ফলে রাজ্যগুলির কর ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্থ হবে যা দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোর পরিপন্থী, জিএসটি এতটা জটিল যে ছোট এবং মাঝারি ব্যবসায়ীদের দক্ষ হিসাবরক্ষক নিয়োগ করতে হবে, যা তাদের কাছে চাপের, নোট বাতিলের মতো জিএসটি নিয়েও দেশের মানুষকে নাজেহাল হতে হবে। দেশে মুদ্রাস্ফিতির মতো পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। এমন কি বিরোধীরা সংসদের সেন্ট্রাল হলে জিএসটির সূচনা অনুষ্ঠান নিয়েও কটাক্ষ করতে ছাড়ছেন না। তাদের বক্তব্য, সেন্ট্রাল হলের মতো ঐতিহাসিক স্থানে এরকম ‘জলসা’র আয়োজন করে দেশের মানুষকে অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলা হয়েছে, তাই তারা এই অনুষ্ঠান বয়কট করছেন।

প্রথমত, যারা বলছে আর কিছুদিন দেরি করা যেত, আমার মনে হয় তারা নিজেদের রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতার থেকে এ’কথা বলছে। আমি একটু অবাক হয়েছি, যারা জিএসটি তৈরির সময় থেকে সব বিষয়ে থাকলেন, সংসদে জিএসটি’কে পাস করিয়ে আনলেন তারাও এখন এর বিরোধিতা করছেন! আমার প্রশ্ন, আপনারা এত দিন জানতেন না? তা হলে প্রস্তুতি নেননি কেন, উপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেননি কেন? এটা তো এপ্রিলে কার্যকর হওয়ার কথা ছিল। আসলে আমাদের দেশে যেকোনও উন্নয়নমূলক কাজ, সে অর্থনৈতিক হোক বা সামাজিক, সব কিছুতেই রাজনীতি। একটা উদাহরণ দিই, কলকাতার মেট্রো রেল সম্প্রসারণ, তা নিয়ে কত রকম রাজনীতি, আর তার ফলে মেট্রোর কাজ ঠিক কবে সম্পূর্ণ হবে তা সঠিকভাবে কেউ বলতে পারেন না। এর ফলে কোটি কোটি টাকা বাড়তি খরচ হচ্ছে। যা আসছে আমার, আপনার ঘর থেকেই। আসলে রাজনৈতিক দলগুলোর উদ্দেশ্য ছিল, কোনও মতে যদি একবার জিএসটি’কে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আটকে রাখা যায়, তা হলে এবারের মতো জিসটি বাতিল হয়ে যাবে, ফের তা সংসদে পাশ করাতে হবে। আর তার পরই তো লোকসভা নির্বাচনের বাদ্যি বেজে যাবে।

এবার আসি জিএসটি’র করের হার প্রসঙ্গে। অনেকে বলছেন জিএসটির সর্বোচ্চ করের হার বিশ্বের সব থেকে বেশি, ২৮%। হ্যাঁ এটা সত্যি, তবে পুরোটা সত্যি নয়। কারণ, জিএসটি’র আওতাভুক্ত পণ্য সামগ্রীর মাত্র ১০-১৫%-এর উপর এই কর লাগু হবে। তার মধ্যে বেশিরভাগটাই প্রমোদ কর। যা আগে ছিল ৩০%। জিএসটি’র ফলে কিন্তু ২% কমল। সাধারণ মানুষের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের উপর কর কিন্তু জিএসটি’র ফলে কমেছে। অনেক খাদ্যদ্রব্য, কৃষিকাজে ব্যবহৃত পণ্যসামগ্রী, সরঞ্জামের ক্ষেত্রে ০% কর ধার্য করা হয়েছে। আর আমার মনে হয় সর্বোচ্চ কর ২৮%  করার সিদ্ধান্ত ঋণগ্রস্থ রাজ্যগুলিকে টানার দায় থেকে। আমাদের রাজ্য সরকার বলছে, রাজ্যগুলির নিজস্ব আয়ের রাস্তা বন্ধ হয়ে যাবে। অর্থাৎ রাজ্যগুলি যে নানা ধরনের কর আদায় করে, জিএসটি’র ফলে তা বন্ধ হয়ে যাবে। হ্যাঁ, জিএসটির ফলে রাজ্যগুলি বিভিন্ন রকম কর আদায় আর করতে পারবে না। কিন্তু রাজ্যগুলি এতদিন যেসব কর আদায় করত তার সবগুলোই কিন্তু বন্ধ হয়ে যাচ্ছে না, রাজ্য বেশ কিছু কর জিএসটি’র পরও আদায় করতে পারবে। আর জিএসটি চালু হওয়ার পর পাঁচ বছর পর্যন্ত রাজ্যগুলির ঘাটতি কেন্দ্র পূরণ করবে। আমাদের দেশের অধিকাংশ রাজ্য দেনার দায়ে এতটাই জর্জরিত যে তাদের এই ঘাটতি পূরণ করতে করতে কেন্দ্রের নাভিশ্বাস উঠবে। ফলে কেন্দ্র সেই কথা ভেবেই জিএসটি’তে কিছু ক্ষেত্রে করের হার ২৮%  করেছে, যাতে কেন্দ্রের ঘরে থাকে ১৪%  আর রাজ্যের ঘরে যাবে ১৪%, এতে কেন্দ্রের চাপ কিছুটা কমবে, রাজ্যগুলির ঘাটতিও পূরণ করা যাবে। আসলে আমাদের রাজ্য সরকারের চিন্তা হওয়া উচিত পাঁচ বছর পর কি হবে? কেন্দ্র তো তখন আর ঘাটতি পূরণ করবে না। আগের বামফ্রন্ট সরকারে সময় থেকে এখনও পর্যন্ত আমাদের রাজ্যের ঋণের বোঝা বেড়েই চলেছে। তাই রাজ্য সরকার যদি আয় অনুযায়ী ব্যয় না করে, তাহলে ঋণের পরিমাণ বাড়তেই থাকবে। হয় আয় বাড়াতে হবে, না হয় খরচ কমাতে হবে। তা না হলে পাঁচ বছর পর সত্যিই চিন্তার কারণ আছে। আপনারা নিশ্চই লক্ষ্য করেছেন পেট্রোল-ডিজেলকে কিন্তু জিএসটি’র আওতার বাইরে রাখা হয়েছে। তার কারণ পেট্রোল-ডিজেলের থেকে রাজ্য এবং কেন্দ্র উভয়েই বড় অঙ্কের কর আদায় করে। তাই এই সুযোগ কেউই হাত ছাড়া করতে চায়নি। ফলে পেট্রোল-ডিজেলের ক্ষেত্রে কিন্তু ‘এক দেশ, এক কর’-এর নীতি খাটল না!

ব্যাঙ্কের সার্ভিস চার্জ বাড়ানো নিয়ে অনেকেই সরব হচ্ছেন। এর পিছনের কারণটা জানা দরকার। নোট বাতিল পর্ব এবং কালো টাকা উদ্ধার টাকা পর্বে ব্যাঙ্কে অতিরিক্ত বড় অঙ্কের টাকা ঢুকেছে। এর উপর ব্যাঙ্কগুলিকে সুদ দিতে হবে। এই সুদের টাকা কে দেবে? নিশ্চই ব্যাঙ্ক কর্মীরা দেবেন না। তা হলে এই টাকা ব্যাঙ্কগুলি ঋণ হিসেবে বাজারে খাটিয়ে আয় বাড়াবে। কিন্তু আমাদের দেশে এই মুহূর্তে ব্যাঙ্কগুলির বড় ঋণ দিতে সমস্যা আছে। আমাদের দেশের ব্যাঙ্কের ঋণ দান পদ্ধতি ইউরোপীয় দেশগুলিকে অনুকরণ করে। সেখানে ব্যাঙ্কগুলি ‘Liquidity’ দেখে ঋণ দেয়। কে কত তাড়াতাড়ি ঋণ শোধ করবে সেটাই বিবেচ্চ। সেখানে চার-পাঁচ বছরের জন্য স্বল্প মেয়াদে ঋণ দেওয়া হয়। কারণ সেখানকার বাজার অনেকটাই শেয়ার বাজারের উপর নীর্ভরশীল। আমাদের দেশে ব্যাঙ্কগুলোর এত ঋণ বকেয়া পড়ে আছে যে নতুন করে তাদের ঋণ দেওয়া সম্ভব নয়। আমি মনে করি আমাদের দেশে ব্যাঙ্কগুলির ঋণ দেওয়া উচিত ‘variability’কে গুরুত্ব দিয়ে। অর্থাৎ এমন ক্ষেত্রে ব্যাঙ্কগুলিকে লোন দেওয়া হোক, যেখানে ফল পেতে একটু সময় লাগে। যেখানে বিনিয়োগের সাথেসাথেই রিটার্ন আসে না। যেমন কয়লা, বিদ্যুৎ, স্টিল, বস্ত্র শিল্পে বিনিয়োগের পর রিটার্ন আসতে একটু সময় লাগে। ফলে ব্যাঙ্কগুলো যদি এই ক্ষেত্রগুলোকে NPA (Non Performing Assets) হিসাবে না দেখে, তাহলে এখানে বড় অঙ্কের টাকা ঋণ দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। পাশাপাশি আমাদের দেশে যদি বাংলাদেশের মতো ক্ষুদ্র ঋণের উপর জোর দেওয়া হয়, তাহলে দেশের চেহারাটাই অনেকটা পাল্টে যাবে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগপতিরা এতে লাভবান হবে এবং উৎসাহিত হবে, কৃষকরা উপকৃত হবে। ব্যাঙ্কগুলোরও আয় বাড়বে। কিন্তু আরবিআই’র কর্তারা এবিষয়ে সেভাবে মাথাই গলান না, তারা ইউরোপীয় দেশগুলিকেই অনুকরণ করে চলেছেন। ফলে ব্যাঙ্কগুলো বাঁচতে এখন নানা ধরনের সার্ভিস ট্যাক্স চালু করছে।

হ্যাঁ, এর পরও বলি জিএসটি নিয়ে প্রথম দিকে একটু সমস্যা হতে পারে, কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সেই সমস্যা দূর হয়ে যাবে। এরজন্য রাজ্য এবং কেন্দ্র উভয়েই দায়ী। কেন তারা সঠিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা আগে থেকে করল না। তবে এটা কেউ বলছেন না এই জিএসটির ফলে এক ধাক্কায় কত বড় সংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হল। আমাদের রাজ্যে যখন শিক্ষিত বেকারদের সংখ্যা বেড়েই চলেছে, কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হচ্ছে না, তখন জিএসটি’র ফলে কত হাজার ছেলে-মেয়ের কাজের সুযোগ তৈরি হচ্ছে, সেটা একবার ভেবে দেখেছেন কি? কেবলমাত্র চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্টদেরই কাজের সুযোগ বাড়ছে না, সাধারণ কমার্স গ্র্যাজুয়েট ছেলে-মেয়ে’দেরও কাজের সুযোগ বাড়ল। চাকরি না করেও স্বাধীনভাবে কাজ করে সম্মানজনক অর্থ রোজগার করতে সক্ষম হবে। তারজন্য বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এখন স্বল্প মেয়াদী প্রশিক্ষণেরও আয়োজন করা হয়েছে।

সবশেষে বলি, জিএসটি’র মাধ্যমে নিঃসন্দেহে দেশে খুব বড় ধরনের আর্থিক সংস্কার করা হল। কিন্তু যে ‘এক দেশ, এক অর্থনীতি’র কথা বলা হচ্ছে তারজন্য দেশের মানুষের অর্থিক বৈষম্য দূর করতে হবে। তা না হলে এটা কেবল কথার কথাই থেকে যাবে। খুব সাধারণভাবেই দেখুন না, কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারী এবং আমাদের রাজ্য সরকারের কর্মীদের বেতনের বৈষম্য কতখানি। ফলে দেশের মানুষের আয়ের মধ্যে একটা সামঞ্জস্য না আনতে পারলে কখনওই ‘এক দেশ, এক অর্থনীতি’র স্বপ্ন পূরণ হবে না।


সুমন মুখার্জি

লেখক- অর্থনীতিবিদ ।