বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায় আওয়ামী লীগকে কেন ভোট দেয়?
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানে থেকে যাওয়া বাকী হিন্দুদের চাওয়া কি ছিল? বসবাসের গ্যারান্টি। সেটি কি তারা দেশ স্বাধীনের পর পেয়েছিল? আওয়ামী লীগের জন্ম মুসলিম লীগের পেটের ভেতর থেকে। মুসলিম লীগকে হিন্দুরা ভাল করে চিনত। সেই মুসলিম লীগই ‘মুসলিম’ শব্দটি কেটে বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগ হয়েছিল। সম্ভবত বঙ্গবন্ধুর ৬ দফার পরই এদেশের হিন্দুরা তাদের সমস্ত সমর্থন দিয়ে আওয়ামী লীগকে বিশ্বাস করেছিলো। তারা ভেবেছিল, আওয়ামী লীগ সেক্যুলার ধর্মনিরপেক্ষভাবে দেশ চালাবে। পরবর্তী ইতিহাস হচ্ছে ৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের সময় পশ্চিম পাকিস্তানীরা ‘এনিমি পোপার্টি অর্ডিন্যান্স’ করে এদেশের হিন্দুদের সম্পত্তি ‘গণিমত’ করতে মুসলিম লীগারদের লেলিয়ে দেয়। আর যে আওয়ামী লীগকে ৭০ সালের নির্বাচনে সমস্ত সমর্থন দিয়ে, বঙ্গবন্ধুকে দেবতার আসনে বসিয়েছিল, দেশ স্বাধীনতার পর এনিমি পোপার্টি অর্ডিন্যান্সকে সেই আওয়ামী লীগই নতুন নামে ‘অর্পিত সম্পত্তি’ হিসেবে আইন পাশ করে! ৭২ থেকে ৭৪ সাল পর্যন্ত এক লাখ একর হিন্দু সম্পত্তি সরকারী প্রতিষ্ঠানের জন্য, ব্যক্তিগত ভোগ দখলের জন্য যে মচ্ছব শুরু হয়েছিল সেটা একটা ‘অসাম্প্রদায়িক দলের’ সঙ্গে কিভাবে যায়?
এদেশে হিন্দুরাই সবচেয়ে বেশি ত্যাগ শিকার করেছে। ৪৭ সালের দেশভাগে, ৬৫ দাঙ্গায় সর্বস্ব হারিয়েছে তারাই। ৭১-এর মুক্তিযু্দ্ধে এক কোটি শরণার্থীর ষাট ভাগই ছিল হিন্দু সম্প্রদায়। পাকিস্তান ভাঙ্গার জন্য কাফের হিন্দুদেরই দায়ী করেছিল পাকিস্তানীরা। মুক্তিযুদ্ধে হিন্দুরা পাকিস্তানী এবং তাদের দোসরদের বিকৃত আক্রোশের শিকার হয়েছিল। দেশ স্বাধীন হবার পর নতুন স্বপ্ন নিয়ে হিন্দুরা শরণার্থী শিবির থেকে ফিরে এসেছিল। হাজার হাজার হিন্দু দেশে ফিরে নিজেদের সম্পত্তি ‘এনিমি পোপার্টি’ হয়ে যেতে দেখেছে। বিগত ৪৬ বছর আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পর্টি, জামাত ইসলামী সব মিলেমিশে হিন্দু সম্পত্তি দখল করেছে রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যে। আওয়ামী লীগের ভোটব্যাংক হওয়ায় বিএনপি-জামাতের পিটুনি যেমন হিন্দুদের ভাগ্য লিখন তেমনি আওয়ামী লীগ হেরে গেলে লীগের পিটুনি প্লাস বিএনপি-জামাতের বিজয়ের পিটুনি দুটোই তাদের খেতে হবে এটা ধ্রুব সত্য। ২০০১ সালের নির্বাচনে ইতিহাসের ভয়াবহ নির্বাচন পরবর্তী সাম্প্রদায়িক হামলাটি করেছিল বিএনপি-জামাত। আওয়ামী লীগ স্রেফ এই হামলাটি থেকে ফয়দা লুটেছে। কিশোরী পূর্ণিমা ছবি দিয়ে পোস্টার ছাপিয়ে নির্বাচন করে ক্ষমতায় এসে সেই হামলা নির্যাতনের কোন বিচারই করেনি আওয়ামী লীগ। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনায় ২০১০ সালে তখনকার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহার খাতুনের কাছে দায়ী ব্যক্তিদের চিহিৃত করে যে রিপোর্ট দেয়া হয়েছিল তা অন্ধকারে হারিয়ে গিয়েছে চিরতরে। কেন দায়ীদের বিচার করা হলো না?
‘আগামীতে আ.লীগ ক্ষমতায় না আসলে বাংলাদেশে কোনো হিন্দু থাকতে পারবে না’- এটা হিন্দুদের জন্য আওয়ামী লীগের থ্রেট নাকি নতুন মুলো ঝুলানো হয়েছে? লীগ ক্ষমতায় আসতে না পারলে দেশ পাকিস্তান হয়ে যাবে, মৌলবাদীরা সব দখল করে নিবে- এসব এক সময় সাধারণ হিন্দুরা, নাস্তিকরা, সেক্যুলাররা, বিশ্বাস করত খুব। হিন্দু নেতারা এসব মুলো বেচার অন্যতম হকার হিসেবে আওয়ামী লীগের উচ্ছিষ্ট খেয়ে নিজেদের ঘাড়ে-গর্দানে বাড়াতে সক্ষম হলেও হিন্দু সম্প্রদায় এদেশে প্রতিদিন তাদের অস্তিত্ব একটু একটু করে হারিয়েছে। এইসব নেতাদের সকলেই ধনী। এদের পরিবারের প্রায় সকল সদস্যই ভারতের সেটেলড। অবস্থান সম্পন্ন হিন্দুদের কেউ আর এখন ব্যবসা বাড়াতে রাজি নয়। বরং গুটিয়ে ফেলছে। তাদের সবাই নিরবে দেশ ছাড়ছে। এইসব ধনী হিন্দুরা পশ্চিমঙ্গে অর্থের জোরে রাজার হালে থাকলেও মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত ও দরিদ্র হিন্দুদের জীবন এক কঠিন পরিস্থিতে এনে ফেলছে। তারা পশ্চিমঙ্গে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে যাবে। লেখাপড়া জানা ছেলেমেয়েরা কেউ সার্টিফিকের কারণে চাকরি পাবে না। অর্থ-পুঁজির অভাবে এরা পশ্চিমঙ্গেও অচ্ছুৎ হয়ে পড়বে।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাডজাঙ্কট ফ্যাকাল্টি ড. মোহাম্মদ রাফি এক সাক্ষাৎকার বলেছিলেন, ‘ঢাকা শহরের দেড় কোটি অধিবাসীর মধ্যে যদি কমপক্ষে ১০ লাখও হিন্দু ধর্মাবলম্বী থাকে, তাদের মধ্যে দুই লাখ মানুষও যদি সারা দেশের সাম্প্রদায়িক হামলা-নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে নামত, তাহলে পুরো ঘটনাই অন্য রকম হয়ে যেত’।
আমার মনে হয়, এদেশের সাধারণ হিন্দুদের কি করতে হবে এরচেয়ে ভাল সমাধান আপাতত আর নেই…।