আমাদের প্রাচীন সংস্কৃতি…………………………………………পর্ব ২….।।

ব্রহ্মচর্য পালন ছিল প্রশিক্ষণ গ্রহণ আশ্রমে থেকে। তারপরে গার্হস্থ জীবন, যেখানে বংশধারা রক্ষা করে সৃষ্টিকে বাঁচিয়ে রাখা ও প্রাপ্ত শিক্ষাকে সন্তানদের মাধ্যমে বাঁচিয়ে রাখা যা পরম্পরাগত ভাবে বয়ে যাবে।      আশ্রমিক তার আশ্রমজীবনে ঋত, তাপস ও ব্রাহ্মণ (এর প্রাথমিক অর্থ যে বৈদিক প্রার্থনা করে)- জীবন অতিবাহিত করে সমাজের নেতা হয়ে উঠতে পারতেন ও সমাজকে স্থায়ী মূল্যবোধ, অন্তর্দৃষ্টি ও বিচারবোধের দ্বারা চালিত করতেন। সমাজে সামাজিক ও মানবিক (psycho-social) মূল্যবোধের ভিত সুদৃঢ় ও স্থায়ী হতো। 

রাজারা যুদ্ধের নেতা হতেন, অস্ত্র যারা চালাতেন তাঁরা ক্ষত্রিয় বলে গণ্য হতেন। আর্যদের একটি বড় অংশ চাষবাসের দিকে যায়। তাদের বৈশ্য বলা হতো। অনার্যরা যারা সংস্কৃতিবান হয়ে ওঠেনি, তাদের শূদ্র বলা হতো।       
এই চারটি ভাগ আর্যদের শ্রীবৃদ্ধির সময় বংশগতভাবে চিহ্নিত হতো না, কাজের মাধ্যমে ছিল তাদের ভাগ। কিন্তু একে অপরের প্রতি নির্ভরশীল ছিল বলে একটি একতাবদ্ধ সমাজ গড়ে উঠেছিল।
বৈদিক শিক্ষার মূল কথা ছিল — জীবনের সুখ ও আরামের দিকে ধাবিত না হওয়া —
‘Vedik rishis firm determination was above material comforts, beyond the lure of wealth and success.
‘Let the source of high knowledge, the intelligence and the resolute will and the deathless flame within the hearts of men without which no action can be done.
‘Let all these inspire my mind
‘To will the good of all.’
এই ব্রত (mission) আর্যদের প্রেরণা যোগাতো সম্মিলিত ভাবে সমাজের অগ্রগতির জন্য কার্যক্রমকে। 
আর্যরা চাইতেন আর্য সভ্যতা সংস্কৃতির পূর্ণ বিস্তার যেখানে আইনবিরোধী কারোর স্থান হবে না। কিন্তু একই সময়ে আর্যরা ভারতভূমিতে এসে যারা আর্য নয় তাদের সামাজিক রীতি-নীতি, প্রথা, ধর্মবিশ্বাস — সব কিছুর সঙ্গে সামঞ্জস্যবিধান করে নেয়, দ্রাবিড় ও অন্যান্য জাতির সঙ্গে বিবাহ সম্পর্ক স্থাপন করে এবং ঐক্য স্থাপন করে সমাজে যার ফল একটি মূল সংস্কৃতি স্থাপন, যার উল্লেখ এই প্রবন্ধে আগেও করা হয়েছে। 
তবে আর্য ঋষি বশিষ্ঠ, বিশ্বামিত্রেরও আগে অন্য এক আর্য ঋষির দল দক্ষিণ ও পশ্চিম ঘাটে আসেন ও বসতি স্থাপন করেন। তাঁরা ও তাঁদের শিষ্য ঋষিরা আর্য সংস্কৃতিকে অনেক এগিয়ে নিয়ে যান। লোপামুদ্রা ও অগস্ত্য মুনি বিন্ধ্যাচল পর্বত পার হয়ে দক্ষিণ ভারতে আর্য সংস্কৃতি নিয়ে আসেন এবং তা বিস্তৃত করেন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া পর্যন্ত। অগস্ত্য মুনিকে বলা হয় তামিল ব্যাকরণ ও কবিতার জনক।
একই সময়ে ভৃগুরাও পশ্চিম ঘাটে তাঁদের বসতি স্থাপন করেন। ক্যাম্বে থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত ব্রাহ্মণেরা নিজেদেরকে আজও ভৃগু বা পরশুরামের বংশধর বলে মনে করেন। কেরলের নাম্বুদিরি ব্রাহ্মণেরা যুগযুগান্তরের ব্যবধান সত্ত্বেও আজও Vedik lore-কে বাঁচিয়ে রেখেছেন।
যখন আদিবাসী সংস্কৃতির (tribal culture) সঙ্গে আর্য সংস্কৃতির সংমিশ্রণ ঘটে — ঋষিরা আর্যদের সর্বজনীন প্রথা ও প্রতিষ্ঠানগুলিকেই প্রাধান্য দিয়ে তাঁদের সংস্কৃতিকে অনার্যদের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলেন।  
পরশুরাম একুশটি যুদ্ধে সমস্ত আর্য রাজাদের পরাজিত করে তাদের মেরে ফেলেন। হয়ত সেই সঙ্গে বৈদিক যুগের শেষ হয়।
বৈদিক যুগের পরবর্তী সময় খুব সম্ভবত: শুরু হয় যীশুখ্রীষ্টের জন্মের সপ্তম শতাব্দীর আগে। আর্যরা তখন গঙ্গার তীরে নিজেদের বসতির পুনর্বাসন করে। আর্য-দ্রাবিড় গোষ্ঠীর রাজারা বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। ইতিহাস সাক্ষী সেই সময়ের গৌরবময় উজ্জ্বল বিকাশের সব রকম অর্থে। ভারতের ইতিহাসের একটি গৌরবময় অধ্যায় এটি।
আমাদের প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতির বিষয়ে জানতে গেলে একটি সত্য কখনই ভুললে চলবে না যে, ভারতীয় সংস্কৃতি আর্য-দ্রাবিড় সংস্কৃতির সমন্বয়, দুই-এর সামাজিক,  ধর্মীয়, জাতিচেতনা উদ্ভূত কৃষ্টি রয়েছে এর মূলে। এই সমন্বয় সাধিত হয় ভাষা, মূল্যবোধ, প্রথা, প্রতিষ্ঠানগুলির একীভূত করণের দ্বারা। এই দুই সংস্কৃতির প্রভাব পড়ে উত্তর ভারতে বিশেষ করে, যখন এই দুই জাতি বেদের যুগে ও পরে একে অন্যের সংস্পর্শে আসে। দ্রাবিড় ভাষার বেশ কিছু অংশ আর্য ভাষায় মিশে যায়। তবে আর্যরা বলিষ্ঠ ও সাহসী জাতি হলেও তাঁরা বস্তুবাদী সংস্কৃতির অঙ্গ ছিলেন না। কারণ, তাঁরা প্রধানত যাযাবর প্রথায় জীবন যাপন করতেন। দ্রাবিড় জাতীয়রা এ ব্যাপারে অনেক উন্নত ছিল। আর্যরা পরে ঐ সংস্কৃতিকে নিজেদের সংস্কৃতির অন্তর্গত করে।
দুই জাতির সংমিশ্রণের উদাহরণ — বেদব্যাস — আর্য ঋষি পরাশরের পুত্র, কিন্তু তাঁর মা উত্তরপ্রদেশের কল্পীর এক জেলের মেয়ে, যিনি পরে আর্য রাজা শান্তনুর রাণী হন ও কৌরব- পাণ্ডবদের প্রপিতামহী। শ্রীকৃষ্ণের পিতা বাসুদেব ও পাণ্ডবদের মাতা কুন্তী শুরের ঔরসজাত ও এক নাগা মায়ের গর্ভজাত।
বেদের পরবর্তী ও বেদের যুগেও মুখ্য আর্য জনগোষ্ঠীর উদ্দেশ্যই ছিল বৈদিক মূল্যবোধগুলিকে জারিত করে দেওয়া সকলের মধ্যে – “words of vedic sage- ‘Aryanising all’ “ তার অর্থ বিভিন্ন আদি জনগোষ্ঠীর মধ্যে একই আচার, ব্যবহার, সামাজিক, ধর্মীয় রীতি-নীতি, প্রথা ও প্রতিষ্ঠানগুলি একীভূত করে একটি ঐক্যের বোধ আনা, যাতে সমগ্র মানবগোষ্ঠী সংঘবদ্ধ হয়ে সমাজ ও সংস্কৃতির বৌদ্ধিক, সামাজিক সংস্কৃতির উন্নতিসাধন করে।
এই ভাবে গৌরবর্ণ আর্যরা রাজনৈতিক ও সামরিক ভাবেও দ্রাবিড়গোষ্ঠীর উপর আধিপত্য বিস্তার করে ও তাঁদের সংস্কৃতিই উচ্চস্থানে থেকে আর সকলকে তা গ্রহণ করাতে সক্ষম হয়। সামাজিক গোষ্ঠীর মধ্যে যারা বৈদিক সংস্কৃতি পুরোপুরি গ্রহণ করে তাঁরা দ্বিজ নমে অভিহিত হয়। দ্বিজ শব্দের অর্থ দ্বিতীয়বার জাত। আশ্রমে বাসকালীন উপনয়নের পর এই দ্বিতীয় জন্ম শুরু হতো। আর এখানে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, বিজেতা ও পরাজিত — এরকম কোন বিভেদ ছিল না।  
আর যারা এই সংস্কৃতি গ্রহণ করেনি, তারা শূদ্র বলে আখ্যা পায়। তবে এদের মধ্যে যারা উন্নত বৈদিক সংস্কৃতি গ্রহণ করতে ইচ্ছুক ছিলেন তাদেরকে সেই সুযোগ দেওয়া হতো। এই প্রথা বহুযুগ ধরে চলেছে এবং এখনও বর্তমান। অস্পৃশ্যতাবাদ (untouchability) তখন ছিলই না।
বেদ-পরবর্তী যুগে বশিষ্ঠের বংশধর কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন (যিনি পালিত হয়েছিলেন কুরুক্ষেত্রের আশ্রমে) বেদের মন্ত্রগুলিকে আর বেদে বর্ণিত সব কিছু (যা বৈদিক সংস্কৃতি সম্বন্ধে এত্ক্ষণ বলা হয়েছে) সংগ্রহ করেন সেগুলির পুনর্সংকলন করেন, তাদের উদ্দেশ্য ও সম্পর্ক অনুযায়ী চারটি ভাগে সংকলিত করেন। এই কারণে তাঁকে বেদব্যাস (ব্যাস অর্থ বিভাজন) নামেও অভিহিত করা হতো।
মহাভারতের কুরু-পাণ্ডবদের বিখ্যাত যুদ্ধশেষে যুধিষ্ঠির সমগ্র ভারতের রাজচক্রবর্তী হন। এই যুদ্ধের প্রতিফলন পড়ে সমগ্র ভারতবাসীর মানসিক পর্দায়। যত কাব্য, মহাকাব্য রচিত হয়েছে এই যুদ্ধ নিয়ে তাতে দুজন বিশিষ্ট মানবের কথা বিশেষ ভাবে বলা হয়েছে। একজন ঋষি-জ্ঞানী বেদব্যাস ও অন্যজন শ্রীকৃষ্ণ — যোদ্ধা, দূরদর্শী, বাস্তববাদী ও বিজ্ঞ রাজনৈতিক — অমিতশক্তিধর, চিরজয়ী অতিমানব। বেদব্যাস ধর্মের ব্যাখ্যাতা আর শ্রীকৃষ্ণ তার রক্ষক।
এবারে বলা যায় আর্য-দ্রাবিরিয়ান সভ্যতা  ও সংস্কৃতির রূপান্তরিত মূল্যবোধের কথা। শুরুর দিকে দ্রাবিড়জাতির পিতৃতন্ত্রকে গ্রহণ করে এবং তার ফলে অন্য প্রথা ও প্রতিষ্ঠানগুলিও গ্রহণ করে এবং পরিবার প্রতিষ্ঠানের উপর গুরুত্ব আরোপ করে তাকে উন্নত করে এই লক্ষ্যে যে, পরিবারে সকলের প্রতি সকলের গভীর সম্বন্ধ থাকবে।
বহুবিবাহ প্রথাটি সাধারণত: অনার্যদের মধ্যেই ছিল। সংমিশ্রিত নতুন সমাজে আর্যরাও এই প্রথা গ্রহণ করে। তাঁদের ধর্মীয় ধারণা ও কার্যাবলীও মিশে যায়। জীবন সম্পর্কে ধারণা বা বোধ, পরিবারের ধারণা, উৎসব অনুষ্ঠান ইত্যাদির দুটো ধারা একই সঙ্গে চলতে থাকে। বৈদিক আর্যদের ধারাকে বলা হতো ‘নিগম’ আর দ্রাবিড়গোষ্ঠী যারা যোগকে (yoga) প্রাধান্য দিয়েছিল — সেটিকে বলা হতো ‘আগম’। দ্রাবিড়দের পিতা-ভগবান হলেন ‘শিব’ এবং হরপ্পার সংস্কৃতিতে তার প্রমাণ রয়েছে। বৈদিক রুদ্রর সাথে তাঁকে মেলানো হয়।  
এশিয়ার অনেক স্থানেই সিংহবাহিনী মাতৃমুর্ত্তির আরাধনার প্রচলন ছিল। বৈদিক আর্যদের কাছে তা অপরিচিত ছিল। কিন্তু পরে শিবের স্ত্রী উমা ও পার্বতী নামে এই দেবী পূজার প্রচলনকে তাঁরাও নিজেদের ধর্মীয় আচারে সামিল করে নেন। পিতা ও মাতা ভগবানকে আনার পর দ্রাবিড় জাতীয়রা পুত্র ভগবানের সৃষ্টি করলো — কুমার স্কন্দ, কার্ত্তিক, মুরুগন ইত্যাদি নামে।
অন্যদিকে বৈদিক মতে বিষ্ণু (যা সূর্যের আর এক নাম) সর্বোচ্চ দেব ছিলেন দেবলোকে। ‘দ্রাবিড়িয়ান’ সংস্কৃতি যোগ হওয়ায় শিব ও বিষ্ণু একাসনের অধিকারী হলেন।   
যজ্ঞ ছিল রাজা ও ঋষিদের করণীয় কর্তব্য। নতুন মিশ্র সংস্কৃতিতে বৈদিক হোমের জায়গায় স্থান পেল পূজা অনুষ্ঠান। সহনশীলতা ও অহিংসা এই দুটি তাত্পর্যময় দিক যোগ হল মিশ্র সংস্কৃতিতে।   মিশ্র সংস্কৃতির এই নবজাগরণের প্রভাবে ধর্মের জন্ম হল, যার উপর ভিত গড়েছে ভারতীয় সংস্কৃতি। ধর্মের ব্যাখ্যা এ ভাবে দেওয়া যায় — এটি বিশেষ কেউ একজন সৃষ্টি করেন নি। বহু প্রজন্মের আশ্রমিক জ্ঞানী গুণীরা তাঁদের সৃজনশীল ক্ষমতা ও অভিজ্ঞতার মাধ্যমে ধর্মের একটি সংজ্ঞা দেন যা সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়ে। আশ্রমবাসী এই ঋষিরা বেদের মূল ধ্যান ধারণাগুলিকে অনুসরণ করে জীবন যাপন করতেন ও তাঁদের সংস্পর্শে আসা অন্যদেরকেও ঐ ভাবে জীবন যাপনে আগ্রহান্বিত করতেন।
ভারতবর্ষে তখন পাঁচমিশেলি বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ তাদের বিভিন্ন স্তরের বিভিন্ন সংস্কৃতি নিয়ে বাস করত। আর্য আশ্রমগুলি তখন দুটি সমস্যার সম্মুখীন হয়। প্রথম — এই বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোকেদের একতাবদ্ধ করে তাদের মধ্যে একটি সমান সমাজচেতনাবোধ আনা। দ্বিতীয় — এমন একটি সমাজ গঠন করা যেখানে জাতি, সংস্কৃতিগত কোন বিভেদ থাকবে না এবং ক্রমশ ওই একত্রিত সমাজ ধর্মের অর্থাৎ বেদের সত্য ইত্যাদি নিয়মগুলি অনুসরণ করবে।
কথায়, কাজে, চিন্তায় সত্যের প্রয়োগ, যজ্ঞানুষ্ঠানে ও তাপস (নিজের অহংবোধ তথা, সব রিপুর আহুতি দেওয়া) পালন করে ব্যক্তি নিজেকে সুনিয়ন্ত্রণ করার উপযোগী হয়। এটাই ধর্মাচরণ। একেই মানবধর্ম বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এর একটি সামাজিক উদ্দেশ্য ও ধর্মীয় লক্ষ্যও রয়েছে। শুধু তাই নয়, ব্যক্তির উপর এর প্রভাবে তার কিছু নৈতিক দায়বদ্ধতাও থাকে। মানবধর্মের মূল কথা সকলের ভালো হওয়া (for the good of man)।     
রুশোর সময় থেকে আধুনিক পৃথিবী শুনে আসছে মানুষের সাম্যের কথা। কিন্তু বাস্তবিক ভাবে তা হয়তো সম্ভব নয়। মানুষ বংশগতভাবে, জন্মগতভাবে, মানসিক গঠন ও ক্ষমতায় একে অন্যের থেকে পৃথক। সেই কারণে সমাজের বিভিন্ন বিভাগ তৈরি হয় যেখানে একই উৎপত্তিস্থল, একই পেশা ও একই আগ্রহ মানুষকে সংঘবদ্ধ করে এক একটি সামাজিক স্তর তৈরি হয়। প্রাচীন ভারতেও তাই ছিল। বর্ণ ধর্ম বৈদিক যুগের মতো পরবর্তী পর্যায়েও চলে যদিও তাতে বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী বিভাগকে অনুসরণ করা হতো বেদের সময়েরই মতো। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র এই চার বর্ণের প্রধান ব্রাহ্মণ যাদের দায়িত্ব নেতা হিসাবে সামাজিক ও মানসিক নিয়মাবলী সৃষ্টি করে সমাজকে ঠিক পথে চালিত করা; ক্ষত্রিয়দের প্রধান দায়িত্ব ছিল প্রয়োজনমত অস্ত্রের সাহায্যে যুদ্ধ করা ও সমাজকে ও ধর্মকে রক্ষা করা; ব্রাহ্মণদের অনুমতি ছাড়া ক্ষত্রিয়রা কিছু করতে পারত না। অন্য দিকে ব্রাহ্মণদেরও ক্ষত্রিয়দের ছাড়া সমাজ চালানো সম্ভব হতো না।  একে অপরের উপর নির্ভরশীলতাই ঐক্য আনে এই সত্যই প্রতিষ্ঠিত হয় তাতে। বৈশ্যরা ব্যবসা বাণিজ্য করে, মহাজনী কারবার করে, কৃষিকাজ করে অর্থের যোগান রাখতো। ব্রাহ্মণদের মতো কঠোর নিয়মাবলী পালন  করতে হতো না বা ক্ষত্রিয়দের মতো যুদ্ধও করতে হতো না বৈশ্যদের।    
শূদ্ররা তাদের স্ব-অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিল না। ব্রাহ্মণগৃহে ব্রাহ্মণ গৃহপতির অধীনে কাজ করলেও তারা এবং তাদের পরিবার ব্রাহ্মণ পরিবারের অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য করা হতো। তাদের জন্য পেশার বিভিন্ন রাস্তা খোলা থাকত, শিল্পকলা, বিভিন্ন প্রকার জিনিষের ব্যবসা করা, সৈন্যদলে যোগ দেওয়া এবং বিপর্যয়ের সময় বৈশ্যদের পেশা নেবার সুযোগ তাদের থাকত। খালি বেদগ্রন্থ পড়ার অধিকার তাদের ছিল না। ক্ষমতা থাকলে রাজাও হতে পারতো, কিংবা সমাজের উঁচু স্থান লাভ করতে পারতো। এইভাবে সমাজে সকলেরই স্থান ছিল।     
স্মৃতি গ্রন্থগুলি পড়লে সেই সমাজের সামাজিক আদর্শ বা দর্শন ভালো করে যানা যায়। মানবধর্ম সমাজে প্রতিযোগিতার আদর্শ না রাখার পক্ষপাতী কারণ — মানবসমাজের সাধারণভাবে আগ্রহ থাকে নিজের নিজের অহংবোধ বা আমিত্ববোধকে প্রাধান্য দিয়ে অসত্যের দিকে ধাবিত হওয়ার। তখনই সৃষ্টি হয় হিংসা, লোভ স্ব-ইচ্ছাপূরণের প্রবল স্পৃহা।
অন্যদিকে প্রতিযোগিতার মনোভাব থাকলে সেই সমাজের গতি অন্যরকম হয়, সমান অধিকার বা সমান স্থান পাবার জন্য ভবিষ্যতের রাস্তা খোলা থাকে সকলের জন্য যেখানে জাতি, ধর্ম, বর্ণ কোন কিছুর বিভেদ থাকে না। কিন্তু এই ব্যবস্থা খুব অনিশ্চিত। কাজ (employment) অনিশ্চিত।   
প্রতিযোগিতার পরিবেশ এক শ্বাসরুদ্ধকারী অবস্থার সৃষ্টি করে⤓কে কাকে ফেলে এগিয়ে যাবে। তার ফল — দুশ্চিন্তা, ক্ষোভ সারাজীবনের সঙ্গী হয়ে পড়ে। আর এই পরিস্থিতিতে নিরপত্তাহীনতা, মানসিক ও সামাজিক উদ্বেগ সৃষ্টি হবেই। সকলের ভালো (the highest good) যা মানবধর্মের পথ, তা গুটি কয় ব্যক্তিরই থাকে। প্রত্যেকেই নিজের উন্নতির চেষ্টায় নিজের সব শক্তি ব্যবহার করবে এটা সত্যি, কিন্তু আর যারা ততটা শক্তিধর নয় তাদের ক্রমশ: পিছনের সারিতে চলে যেতে হয় — তাদের মধ্যে জন্ম নেয় হতাশা — তার থেকে রাগ — রাগ থকে ঘৃণাবোধ যা সমাজের পক্ষে খুবই ক্ষতিকর।
মানবধর্মের সামাজিক দর্শন ব্যক্তির সব চেষ্টাকেই অগ্রাহ্য করে না — যে ব্যক্তি শুধু নিজেরই উন্নতির কথা ভাবে তকে গ্রহণ করে না। প্রত্যেকে সমাজের প্রতি কর্তব্য করবে প্রথমে  এটাই সার কথা। তা ছাড়া ব্যক্তি যে বংশে জন্মায় তার গুণাবলী সহজাতভাবে পাবে, বাবা-মায়ের বিশেষ দক্ষ শৈলীগুলি সন্তানের মধ্যে থাকবে এবং পরিবারের সকলে তকে উত্সাহ দেবে বংশগত ধারা বা কাজের দক্ষতাকে অর্জন করতে।             
প্রতিযোগিতাহীন সমাজে ব্যক্তি তাই তার পরিবারের পেশাকেই দক্ষতার সঙ্গে অর্জন করতে শিখবে। সমাজের অন্যরাও ব্যক্তিকে তার সাফল্যের চেষ্টায় সহযোগিতা করে সমাজের ‘সকলের ভালো’ এই মূল লক্ষ্যে পৌঁছবে। প্রত্যেকেই তার নিজ নিজ দায়িত্ব সম্পাদন করলে অহংবোধ/আমিত্ববোধ ও স্ব-ইচ্ছাপূরণ (self indulgence) এই সব ত্রুটিগুলি দূর হয়ে যাবে এবং বিভিন্ন সামাজিক সঙ্ঘগুলি তাদের স্বকীয়তা স্ব-স্ব সম্মান বজায় রেখে সমাজকে এগিয়ে নিতে পারবে।
এবারে এত কথা বলার পরে প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতির একটি সার সংক্ষেপ দেওয়া যায়।   
সৃষ্টি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের নিয়মের বা cosmic order-এর অধীন বা বলা ভালো সৃষ্টি cosmic order-এর ফল। ঋত ও ধর্ম সেই সৃষ্টিকে ও তার অন্তর্গত সব কিছুকে চালায় বা শাসন করে। এবং এটাই একমাত্র এবং বিভাজনহীন ব্যবস্থা যা কাজ করে বস্তুবাদ, নৈতিক, ধর্মীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক, দার্শনিক সব রকম পরিবেশের উপর।
যে কোন ব্যক্তিই সত্যকে আদর্শ করে জীবন যাপন করতে পারে। সেই জীবন যাপনই সব চাইতে উঁচু স্থান পায় কারণ কাজে, কথায় কর্মে সত্যের ব্যবহার সেই ব্যক্তিকে সমাজের সকলের কাছে গ্রহণীয় করে তোলে ও সকলে তার কথা মেনে চলে। এটাই ‘Highest Good’-এর জীবন।    
এই Cosmic order-এর আর একটি বিশেষ দিক ‘সামান্য ধর্ম’ (the law of moral causation) এই নীতি ব্যক্তিকে শেখায় অহিংসা, সত্যবদ্ধতা, চুরি না করা, স্বত্বাধিকার না থাকা। এসব প্রতিনিয়ত জীবনে অভ্যাস করলে ব্যক্তি জয়লাভ, ভালোবাসা, ধন-দৌলত, শক্তি ও সাহস সবই অর্জন করতে পারে যা বাস্তব জীবনের মুখ্য উদ্দেশ্য।          
Cosmic order-এর আর একটি বৈশিষ্ট্য কর্মবাদ, যেমন কর্ম ফলও তেমনি হবে। এই কর্মবাদের শৃঙ্খল থেকে অব্যাহতি পাওয়া যায় যদি ‘সকলের ভালো’ এই লক্ষ্যে পৌঁছানো যায়। মানবধর্মের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি তাই এমন থাকা উচিত যেখানে সামাজিক প্রথা, আচরণবিধি, সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলি ব্যক্তিকে সাহায্য করবে তার মূল আদর্শর দিকে পরিচালিত হতে।
সমাজে তাই প্রতিযোগিতামূলক ব্যবস্থা বা অবস্থা থাকবে না। প্রত্যেকেই তার ক্ষমতা ও যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ ও কর্তব্যসম্পাদন করবে ও সমাজকে দৃঢ় বন্ধনে রাখবে। সমাজের মাথায় এমন ব্যক্তিদের থাকতে হবে যারা সুশৃঙ্খল জীবন যাপন করবে, অর্থলালসা বা বৈষয়িক বোধ থাকবে না — মৌলিক মূল্যবোধগুলি শিক্ষা দেবে। তাঁরা যদি কঠোর দারিদ্রের মধ্যে থাকেন তবে সমাজ তাঁদের সাহায্য করবে যাতে বেঁচে থাকার জন্য (struggle for existence) যুদ্ধ না করতে হয়।
মানুষ তার ক্ষমতা মানসিক গঠন ও বংশগতভাবে চারটি ভাগে বিভক্ত: (১) নেতা শ্রেণী যারা জ্ঞানের আলোর সন্ধান দেবে, (২) কর্মক্ষম শক্তিশালী লোক, (৩) এমন ব্যক্তি যাদের শক্তি থাকলেও কাজে অনীহা ও (৪) এমন ব্যক্তি যারা নিষ্ক্রিয় বা অলস।  
এখন প্রতিযোগিতাহীন সমাজে এদের সকলকেই দায়িত্ব কর্তব্য পালন করতে হবে তাদের নিজ নিজ ক্ষমতা অনুযায়ী। তার অর্থ সমাজই বলে দেবে কার কি করণীয় যাতে কারোর ব্যক্তিগত সুখ সম্ভোগের দিকেই একমাত্র দৃষ্টি না থাকে। 
শুধু কোন ব্যক্তির উন্নয়নই লক্ষ্য নয় যাতে কম দক্ষ ব্যক্তিরাও নিজেদের উন্নতি করে সমাজে উঁচু স্থান পেতে পারে সেদিকেও সমাজপতিদের লক্ষ্য রাখতে হবে।         
এই প্রতিযোগিতাহীন সমাজে সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলি এমন ভাবে গঠিত হবে যেখানে জনমতের প্রাধান্য থাকবে এবং প্রতিটি শ্রেণীর কর্তব্য দায়িত্ব জনগণই ঠিক করে দেবে। এই জনমত গঠন করার পেছনে থাকবে সমাজপতিদের  সুনেতৃত্ব, উদাহরণ এবং আবেদন। এইরকম ব্যবস্থায় নেতৃস্থানীয়দের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা সাহায্য করবে সমাজে বিভিন্ন প্রথা ও প্রতিষ্ঠান নী ভাবে তৈরি হবে সঠিক মূল্যবোধের উপর ভিত্তি করে।
শাস্তিপ্রথার মাধ্যমে সংশোধনের চেষ্টা শুধুমাত্র ব্যক্তির আমিত্ব বা অহংবোধকে চেপে রাখতে বাধ্য করবে যা জনমতপ্রধান সমাজের পক্ষে বিরূপ ভাবেরই চেষ্টা করবে,  একতাবদ্ধ শৃঙ্খলাপরায়ণ, সত্যে প্রতিষ্ঠিত সমাজ ও সংস্কৃতি গড়ে উঠবে না। সুশিক্ষা-সুপারিবারিক সংগঠন, সুসামাজিক সংগঠন — সর্বোপরি আচার্যরা প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতিকে সৃষ্টি করে বহু যুগ ধরে এগিয়ে নিয়ে গেছে।         
C. Rajagopalachari কি বলেছিলেন ভারতীয় সংস্কৃতি সম্বন্ধে তা একটু বলা প্রয়োজন বোধ করে সংযোজন করছি। (He was a versatile man whose lectures on Indian culture were of great importance and his approach is quite different) তাঁর মতে সংস্কৃতি হচ্ছে একদল মানুষের একসঙ্গে দলবদ্ধ হয়ে জীবনযাত্রা অতিবাহিত করা এবং সেই জীবনযাত্রা প্রণালী এক প্রজন্ম থেকে পরবর্তী প্রজন্মে অনুসৃত হবে। এই মানুষের সমাজে প্রত্যেকেই তাদের দীর্ঘ জীবন ইতিহাস নিয়ে আলাদা সংস্কৃতির ধরণ গঠন করে, তবে সেই সমাজে সাধারণ সকলেরই গ্রাহ্য সাংস্কৃতিক গুণাবলী যেমন থাকে তেমনি প্রত্যেক জাতির নিজস্ব বৈশিষ্ট্যও থাকে।      
প্রথমেই দেখে নিতে হবে সব জাতির কাছেই সংস্কৃতির সাধারণ ধর্মটা কি? সংস্কৃতি কথাটিকে খুব সহজ ভাবে ব্যাখ্যা করলে হবে না। যখন কোন মানুষকে সংস্কৃতিবান বলা হয় তখন তার চরিত্রগত গুণ বা দোষের কথা বলা হয় না। ভালোমানুষ আর সংস্কৃতিবান মানুষ এই দুটির মধ্যে পার্থক্য আছে। অনেক ভালোমানুষ আছে যাদেরকে আমরা সংস্কৃতিবান বলতে পারি না। সংস্কৃতি সাহিত্য সৃষ্টি করা বা বীণা বাজানোর পারদর্শিতার নিরিখেও বিচার হয় না। সংস্কৃতি মানুষটির সাধারণ ব্যবহার, কথা বলার ভঙ্গী ও অন্যান্য আচরণ থেকে প্রতিভাত হয় — এর সঙ্গে চরিত্রের ভালো-মন্দের কোন সম্পর্ক নেই। 
সংস্কৃতি আবার শুধু নৈতিক চরিত্রের মাপকাঠিতেও বিচার হয় না। চরিত্র মানুষের ভিতরে৫র দিক আর সংস্কৃতি মানুষের বাইরের দিক। সংস্কৃতি মানুষের ব্যবহার, তার জীবনযাত্রাপ্রণালীর উপরই নির্ভর, চরিত্রের উপর নয়। তবে চরিত্রের সঙ্গে সম্পর্ক আছে সংস্কৃতির কিছুটা এই অর্থে যে বাইরের আচরণ, ব্যবহার সবই ভিতরের চরিত্রের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলে।    
মানুষকে প্রকৃতি সংবেদনশীল পাঁচটি ইন্দ্রিয় দিয়েছেন। এই ইন্দ্রিয়গুলির সাহায্যে সে ক্ষমতা অর্জন করে ও জীবনের আনন্দ উপভোগ করে। ক্ষমতা আবার মানুষকে অসৎ, দুর্নীতিপরায়ণ করে তোলে আর সে কথা মানুষকে মনে করানোও হয়। Lord Acton এই মন্তব্যটি করেছিলেন যদিও তা রাজনৈতিক বিষয়েই বলা।    
সংস্কৃতি বিষয়ক দুর্নীতি অন্য ধরণের। ইন্দ্রিয়গুলি মানুষকে আনন্দের অনুভূতি করায়। প্রতিটি ইন্দ্রিয়ের আবশ্যিক কাজও আছে যা জীবনধারণের জন্য অতি প্রয়োজন। তারা আবার শারীরিক আনন্দের যোগানদার। মানুষ তার এই ইন্দ্রিয়গুলির যখনই অতি ব্যবহার করবে তার মধ্যে অসৎ ভাব আসবে তখনই। সভ্যতার কাজ হচ্ছে মানুষের এই ইন্দ্রিয়প্রবণতার প্রবৃত্তিকে সংযত করা। সভ্যতার সত্যি অর্থই হল নিয়ন্ত্রণ।       
সমাজচেতনা, ও সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে বাস করা — মানুষকে নিয়ন্ত্রিত করে ইন্দ্রিয়বশ হওয়া থেকে। এই ইন্দ্রিয়গুলিকে সঠিক ভাবে চালনা করে সমাজে একত্রিত হয়ে বাস করার যোগ্যতা অর্জন করে, ব্যক্তিগত ভাবে ইন্দ্রিয় আসক্তিকে নিয়ন্ত্রণে আনলেই তা সভ্যতার পরিচায়ক। সভ্যতার আরো অন্য অর্থ আছে কিন্তু সত্যি এবং সব চাইতে প্রয়োজনীয় অর্থ এটাই। সভ্যতা শুধুমাত্র প্রযুক্তির উন্নতিই নয় বা জীবনের বস্তুগত সুখ-সুবিধার উপকরণের যোগানদার নয়।
আমাদের মনে রাখতে হবে সভ্যতা একটি বিমূর্ত বিশেষ্য (abstract noun) এবং একটি জীবনযাত্রাপ্রণালীকে (state of living) নির্দেশ করে, কোন বস্তুকে নয়। সভ্যতা জংলি-বর্বরোচিত আচরণ, অত্যধিক আবেগ, যেমন ক্রোধ, যৌনকামনা ইত্যাদির নিয়ন্ত্রণ আনবে। সভ্যতার দুটি অঙ্গ এই নিয়ন্ত্রণের। একটি সরকার যা সব সভ্যতারই বিশেষ প্রয়োজনীয়, আর একটি সংস্কৃতি যা পরিবারের শিক্ষা, প্রথা, ধর্মীয় ধারণা বা বিশ্বাস, সাহিত্য এবং সাধারণ শিক্ষার মাধ্যমে বিকশিত হয়। সংস্কৃতি অসংযম, উচ্ছৃঙ্খলতাকে দমন করে অন্দরের দিক থেকে আর সরকার শাস্তিমূলক আইন প্রয়োগ করে বাইরে থেকে। যদি এই দুটি সংস্থা পরাজিত হয় তখন নিন্দা, অপবাদের মাধ্যমে বা পুরোপুরি ভাবে সমাজ থেকে বহিষ্কার করে সমস্যার সমাধানের চেষ্টা হয়। সরকার জোর করে বাইরে থেকে নিয়ম প্রয়োগ করে আর সংস্কৃতি ভিতর থেকে নীরবে কাজ করে।    
সংস্কৃতির প্রভাবে মানুষ নিজের ইচ্ছাতেই নিয়ম পালন করে। এই স্ব-ইচ্ছায় কিছু পালন খুবই শক্তিশালী, আর জোর করে চাপানো নিয়মে মানুষ জেদি গোঁয়ার হয়ে যায়। সংস্কৃতি তাই স্ব-নিয়ন্ত্রণের সফলতা। চরিত্র ও সংস্কৃতি এক নয় আগে বলা হয়েছে যদিও, তবু চরিত্রকেও সমান দরজা দেওয়া যায় সংস্কৃতির সঙ্গে সাধারণ ভাবে। খোসার ভিতরে ফল থাকে। অনেক সময় খোসার সুগন্ধ ফলের থেকেও বেশী হয় — যেমন কমলালেবু বা কলার খোসা, তেমনি সংস্কৃতিসম্পন্ন ব্যবহার সদ্গুণের থেকে আকর্ষক বেশী। সংস্কৃতি একটি সামাজিক সদাচার তাই সমাজে সহজেই পরিলক্ষিত হয় এবং সমাদর পায় সদ্গুণের থেকেও। ফলের খোসা ও ফল একই সঙ্গে বর্ধিত হয় পেকে যাওয়া পর্যন্ত — ঠিক তেমনি সংস্কৃতি মনের ভিতরে ও চরিত্র বাইরের কাজকর্মের অর্থাৎ স্বভাব গঠনের মাধ্যমে একই সঙ্গে বেড়ে ওঠে।
সংস্কৃতি কপটতার ফাঁদে পড়বে যদি চরিত্রের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হয়। কোন কপটতাই (hypocrisy) সংস্কৃতি নয়। বিনয়নম্রতাও সংস্কৃতির একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিক। “বিদ্যা বিনয়সম্পন্নে ব্রাহ্মণে”। বিদ্যা, বিনয় ও জ্ঞান ব্রাহ্মণের সম্পদ। এই তিনটি সম্পদ ছাড়া সংস্কৃতি হয় না। একজন সংস্কৃতিবান বিনয়ী সত্যের যত কাছে  — একজন সংস্কৃতিবান কিন্তু আত্মগরিমায় গর্বিত ও আত্মপ্রচারকারী মানুষ সহজাত বা প্রকৃতিদত্ত ক্ষমতার অধিকারী হলেও সত্য থেকে দূরে ও সমাদর কমই পায়।         
শুধু খাওয়া-পরা, বাসস্থানের ব্যবস্থা সংস্কৃতি তৈরি করে না। সমাজবদ্ধ হয়ে বাস করার যে আনন্দ, জীবনকে পরিপূর্ণ করার আনন্দ সংস্কৃতির ভিত তৈরি করে। মানসিক নীচতা, অসত্ভাব ও নিষ্ঠুরতা — এই তিনটি কদাচার থেকে দূরে থাকাই সংস্কৃতির অঙ্গ।  কাউকে বা গরীবকে কিছু দেওয়ার সময় সহানুভূতিপূর্ণ আচরণ, সুন্দর স্নেহশীল কথা দেয় জিনিষটি থেকে অনেক বেশী মূল্যবান। এটাই সংস্কৃতি।  
ভারতীয় সংস্কৃতি মূলত আত্মসংযমের উপর প্রতিষ্ঠিত। নিজের যা কিছু আছে, তা অন্যের সঙ্গে বিশেষ করে গরীবের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া, চিত্তের নির্মলতা, অনাড়ম্বর জীবন যাপন, সন্ন্যাস এবং সর্ব ধর্ম সহিষ্ণুতা হচ্ছে তার মূল উপকরণ — ভারতীয় সঙ্গীত বা ভারতনাট্যম নৃত্য নয়।
কুলধর্ম ও দেশধর্মও সংস্কৃতির একটি বিশেষত্ব। ভারতবর্ষের জাতীয় ব্যবহার একটি মৌলিক সুসংগঠিত দেশ ধর্ম যা পরিবার, জাতি, একটি নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যযুক্ত এলাকায় সকলকে একত্রিত করে এবং একে অন্যের পেশার সম্পূরক হয় — তখনই একটি জাতি বা nation-এর উদ্ভব হয়। প্রাচীন ভারতের যুক্ত পরিবার (joint family) একটি এমন প্রতিষ্ঠান ছিল যেখানে পরিবার ধর্ম সকলকে একত্রে বেঁধে রাখত ও একে অন্যের সহযোগিতা, বিপদের সময় এক যোগে তার সম্মুখীন হওয়া সকলের উন্নতি সাধন — এই গুণগুলি বর্তমান ছিল। যুক্ত পরিবার নিজেই একটি সমাজতান্ত্রিক ধাঁচের সংগঠন, আবার সেখানে ব্যক্তির স্বাধীনতাও থাকে, তার ভিতরের উদ্যম বা শক্তিকে কাজে লাগিয়ে উন্নতি করার। 
ভারতীয় সমাজে বিবাহ প্রথাটি শুধু পাত্র-পাত্রীর বিবাহবন্ধনই সূচিত করতো না — দুটি পরিবারও সম্পর্কিত হতো, যদিও এখন সেই প্রথার অনেক ব্যতিক্রম ঘটেছে অর্থনৈতিক কারণ ও আন্তর্জাতিক মেলামেশার ফলস্বরূপ, কিন্তু তার মূল ধারাটি একই আছে। এটি একটি পারিবারিক প্রথা। বিবাহের মন্ত্রে যত কথা বলা হয়েছে তা আসলে একটি চুক্তিপত্র (যদি এই ভাষায় বর্ণনা করি) কিন্তু সেটি কিছুতেই লঙ্ঘন করা যেত না। 
সামাজিক সংগঠনের সিঁড়িটি  কিন্তু এক লাফে পরিবার থেকে সামাজিক সংগঠন ⤒ তার থেকে জাতীয়তাবোধ বা জাতির ধারণায় ওঠা যায় নি।    
যুক্ত পরিবার — তার থেকে সংগঠন (community) যা যুক্ত পরিবার থেকে বড় — তার থেকে জাতি — যেখানে পরস্পরের মধ্যে বোঝাপড়া, সহযোগিতার মনোভাব এবং পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধার ভাব বজায় রেখে সামাজিক মূল্যবোধগুলিকে বাঁচিয়ে রাখা ও পরবর্তী প্রজন্মকে একই শিক্ষা দেওয়া — এই ছিল মূলমন্ত্র। মূল কথা ছিল একজনের দায়িত্ব কেবল তার স্ত্রী-সন্তানের প্রতি কর্তব্যেই সীমাবদ্ধ থাকতো না — জাতির, যা বর্ধিত পরিবার বলে চিহ্নিত হতো — তার প্রতিও দায়িত্ব থাকতো। একজন প্রভাবশালী লোক তাঁর প্রভাব খাটিয়ে অন্যের, তা নিজের পরিবারের হোক বা অন্যের (বর্ধিত পরিবারের) হোক তাকে সাহায্য করতে হতো। বর্তমানের প্রেক্ষিতে এটা স্বজনপোষণ বলে দোষারোপ পাবে।       
সংস্কৃতি পুরোটা না হলেও আংশিক ভাবে নির্ভর করে আত্মসংযমের উপর (আগে উল্লেখিত) এবং রাষ্ট্রের নিয়ম ও শৃঙ্খলার উপর, এবং সব সমাজেই এই ধারাটি বজায় থেকেছে। ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বলতে পারা যায় ভারতবাসীরা জাতি প্রথার (caste system) প্রতি কতটা ঋণী।
ভারতবর্ষই সম্ভবত: একটি রাষ্ট্র যেখানে এক শাসনতন্ত্র (সরকার) থেকে আর এক শাসনতন্ত্র (সরকার) পরিবর্তনের মধ্যে সময়ের দীর্ঘ ব্যবধান ঘটেছে। এমনও অনেক সময় গেছে যখন জনগণ না রাজ্য সরকার, না কেন্দ্রীয় সরকার পেয়েছে। ঐ সব সময় এই পরিবার ও জাতি প্রথার শৃঙ্খলা ও নিয়মই জনগণকে সুসংবদ্ধ রেখেছে সংস্কৃতির আত্মসংযমের শিক্ষার সাহায্যে। তখন শুধু যে সমাজ নিয়ম-নীতি মেনে চলেছে তা নয় — ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প কলা, সঙ্গীত, নৃত্যকলার সঙ্গে সঙ্গে সাধারণ কারিগরদের কাজ সফলতার সঙ্গে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়েছে। সরকার না থাকাতে কোন পার্থক্য হয় নি। একজন নেতৃস্থানীয় লোকই রাজার মত সব দায়িত্ব সামলাতেন। জীবনদর্শনের কোন নিচু মান দেখা যায় নি। স্বাস্থ্য পরিষেবা, চুক্তিবদ্ধ ভাবে কাজ করা, সম্পত্তি রক্ষা, সকলের নিরাপত্তা সবই ভাল ভাবে হয়েছে এই জাতি প্রথার (caste system) মাধ্যমে যা পৃথিবীর অন্য কোন জায়গার ইতিহাসে পাওয়া যায় না যখন সেখানে অরাজকতা বা মাৎস্যন্যায় চলেছে। এই সব কিছুই পরিচালিত হয়েছে ভারতীয় সমাজের উন্নত সংস্কৃতির দ্বারা। জাতির মধ্যে ভাঙন ধরে নি কারণ সকলেই সম্পৃক্ত ছিল একই মূল্যবোধে। কুলধর্ম, জাতিধর্ম ও ভারতধর্ম এক সূত্রে গ্রথিত করে রেখেছিল পুরো ভারতীয় সমাজকে। সংস্কৃতি শুধুমাত্র জীবনকে পরিপূর্ণ করে নি — যখন ভারতেও অরাজকতা উপস্থিত হয়েছিল সংস্কৃতি রাজা বা অন্যান্য রাজকর্মচারীর জায়গায় নিজেকে প্রতিপন্ন করেছে দায়িত্ব পালনে, জাতি প্রথার সাহায্যে।     
এর কোন নথি বা প্রমাণপত্র নেই। কিন্তু যখনই প্রয়োজন হয়েছে এই কাজটি সম্পন্ন করেছে পরিবার ও জাতিধর্ম। এই দুটি সন্দেহাতীত ভাবে সম্পন্ন করেছে কোন ঢাক ঢোল না পিটিয়ে। তারা কোন রেজিস্টার রাখে নি বা নতুন আইনও প্রণয়ন করে নি। সংস্কৃতির সঠিক মূল্যায়ন এই প্রাচীন সমাজেরই অবদান। 

আমাদের প্রাচীন সংস্কৃতি…………………………পর্ব ১
তথ্য সূত্র –
Foundations of Indian Cuiture–K.M.Munshi
Our culture– C.Rajagopalachari
Cultural Heritage of India—compiled & edited by V.Sivaramakrishan
some other essays published in Bhavan’s Journal.
________________________________________