বাচ্চাদের মাথার দখল নেওয়াটা বোধ হয় সব রাষ্ট্রের শিক্ষানীতির অংশ। এবং সবটাই শাসক শ্রেনীর স্বার্থ মেনে।
ভারতে যেহেতু অধিকাংশ সময় কংগ্রেস রাজত্ব করছে, ভারতীয় ইতিহাস বইগুলোও সেই ভাবেই তৈরী। যাতে দেখানো হচ্ছে, কংগ্রেসের স্বাধীনতা সংগ্রামের ফলে, আরো বললে নেহেরু, গান্ধী সহ কংগ্রেসী নেতাদের আত্মত্যাগই ভারতের স্বাধীনতা এনেছে।
ভারতের রাজনীতিতে বিজেপি বা হিন্দুত্ববাদিদের উত্থানের আগে,বামেরাই ছিল কংগ্রেসের প্রধান বিরোধি শত্রু। তারা ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে আরেকটা কাউন্টার ন্যারেটিভ আনার চেষ্টা করে – যে গান্ধীর অহিংস আন্দোলন না, সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনই ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল চালিকা শক্তি। এর একটা বড় কারন, অতীতের বিপ্লবীদের অধিকাংশই আন্দামানে জেল খেটেছেন। সেখানকার সেলুলার জেল থেকে মার্ক্সীয় মন্ত্রে দীক্ষা নিয়ে পরবর্তী কালে বামপন্থী রাজনীতি করেছেন।
এইদিক দিয়ে দেখলে, স্বাধীনতা সংগ্রামে বিজেপির কোন লেগাসি নেই। কারন আর এস এসের প্রতিষ্ঠাতা কেশব বালিরাম হেজোয়ার নিজে ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী- প্রাত্তন কোর অনুশীলন সমিতি ক্যাডার। কিন্ত আর এসে এসের উদ্দেশ্য নিয়ে খুব পরিস্কার ভাবে লিখেছেন- এই সংগঠনের কাজ স্বাধীনতা সংগ্রাম না- হিন্দুদের শারীরিক এবং মানসিক উন্নতিই তার লক্ষ্য। উনি আর এস এসকে এতটাই স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে দূরে রাখতে চেয়েছিলেন, ১৯৩০ সালে গান্ধী যখন সত্যাগ্রহের ডাক দিলেন, তখন উনি নিজে স্বাধীনতা আন্দোলনে আবার যোগ দিলেন। কিন্ত আর এস এসকে ওর মধ্যে টানলেন না। সংঘ প্রচারকরা বরাবরই স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে দূরে থাকতে চেয়েছেন । হিন্দুদের আত্মিক, দৈহিক উন্নতিই ছিল তাদের পলিটিক্যাল লাইন।
নেতাজিকে ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ঘোষনার মধ্যে দিয়ে, বিজেপি কংগ্রেসের একটা কাউন্টার ন্যারেটিভ তৈরী করার চেষ্টা করছে-কিন্ত তা বুমেরাং হবে। কারন এক – নেতাজি জাপান অধিকৃত ভারতের ( যেমন আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ ) প্রধানমন্ত্রী হিসাবে আসলেই জাপানের হাতের পুতুলমন্ত্রী ছিলেন। আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে জাপানী সেনারা ২০০০ স্বাধীনতা সংগ্রামীকে হত্যা করে ( ১৯৪২-৪৪)। আসল ক্ষমতা জাপানীদের হাতেই ছিল। দুই- নেতাজি হিন্দু মহাসভার বিরোধি ছিলেন। সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরোধিতা করেছেন চিরকাল। তার রাজনীতির সাথে বিজেপির রাজনীতির কোন সংযোগ নেই।
ইতিহাস খুব ভাল ভাবে পড়লে বিজেপির হাতে কাউন্টার ন্যারেটিভ ছিল। ভারতের স্বাধীনতা নেতাজির হিংসা বা গান্ধীর অহিংসা-কোন পথেই আসে নি। এসেছে আন্তর্জাতিক রাজনীতির আবহে। ১৯৪১ সালে বৃটেন যখন যুদ্ধ করতে দেউলিয়া, চার্চিল হাত পাতলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের কাছে। তখনো পল হার্বার হয় নি। আমেরিকানরা যুদ্ধে জড়াতে চাইছে না। কারন তারা মনে করে বৃটেনের জমিদারি টেকানোর ভার আমেরিকা কেন নেবে? সেটাই জানালেন রুজভেল্ট চার্চিলকে। আগে ভারত সহ ৪০ টা রাষ্ট্রের কলোনীর স্বাধীনতা ঘোষনা কর, কারন তা নাহলে জার্মানীর কলোনাইজেশনের বিরোধিতা করা অনৈতিক। চার্চিলের তখন দেওয়ালে পিঠ। ফলে নাই নাই করে বাধ্য হলেন আটলান্টিক সনদে সাইন করতে। যাতে বলা হল যুদ্ধের পরে বৃটেনের আন্ডারে থাকা চল্লিশটা দেশ স্বাধীন হবে!
কিন্ত বৃটেনে ফিরেই চার্চিল উলটো গাইলেন। এর মধ্যে জাপান পল হার্বার ঘটিয়েছে। আমেরিকা জাপানের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে গেছে। ফলে জাপানকে হারাতে ভারতকে পাশে দরকার আমেরিকার। আমেরিকার চাপ খেয়ে, চার্চিল পাঠালেন স্যার স্টাফোর্ড ক্রিপসকে, যা ক্রিপ্স মিশন নামে খ্যাত। ক্রিপস লোকটা ভাল ছিল-জেনুইনলি কাজ শুরু করতেই চার্চিল ব্যাগরা দিলেন। এদিকে চার্চিল ভারতের স্বাধীনতা বিরোধি জেনে, ক্রিপস মিশন যাতে ব্যর্থ না হয়, তার জন্য রুজভেল্ট ভারতে পাঠালেন আমেরিকার রাষ্ট্রদূত থমাস উইলসনকে। থমাস উইলসন , ক্রিপ্স , রুজভেল্ট -এরা চার্চিলকে ক্রমাগত চাপ দিয়েও ভারতের স্বাধীনতা আদায় করতে পারেন নি। এর মধ্যে আমেরিকা ব্যাটল অব মিডীওয়েতে জেতার পর পরিস্কার হয়, জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আমেরিকার দরকার নেই ভারতকে-তারা একেলাই যথেষ্ট। ফলে ১৯৪৩ সালের পরে রুজভেল্ট আর চার্চিলকে ভারতের স্বাধীনতা নিয়ে বিরক্ত করেন নি।
চার্চিল ভারতের স্বাধীনতা দেওয়ার বিরুদ্ধে ছিলেন ১৯৪৫ সালেও। কিন্ত ১৯৪৫ সালের নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়ী হলেন লিব্যারাল ক্লিমেন্ট এটলি। যার ম্যনিফেস্টোতেই ছিল, বৃটেন সমস্ত কলোনী ছেড়ে দেবে। এটলির হাতেই ভারত, জর্ডন , প্যালেস্টাইন-সমস্ত কিছু স্বাধীনতা পায়। চার্চিল জিতলে, ভারতকে স্বাধীনতা পেতে আরো অনেক দিন অপেক্ষা করতে হত। বাই দ্যা ওয়ে, জর্ডনের কোন স্বাধীনতা সংগ্রাম ছিল না- কিন্ত তারাও ভারতের সাথে স্বাধীন হয়েছে! সুতরাং ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে গান্ধী, নেহেরু, সুভাষ বোসের অবদান অতিরঞ্জিত। তার থেকে অনেক বেশী কৃতিত্ব দাবী করতে পারেন স্বয়ং হিটলার যিনি বৃটেনকে ব্যাঙ্করাপ্ট করে ছেরেছিলেন-যার ফলে বৃটেনের সাধারন জনগন ভারতের স্বাধীনতার সমর্থনে এটলীকে বিপুল ভোটে জয়ী করে।
কিন্ত ভারতের কোন ইতিহাস বইতে, এই ন্যারেটিভ পাওয়া মুশকিল। কারন তাহলে কংগ্রেসের ঝুলিতে ক্রেডিট কিছু কম হইবে।
ভারত কোন ব্যতিক্রম না। পাকিস্তানের স্কুল বইতে এত ভারত বিরোধি ন্যারেটিভ, যে পাকিস্তানে ভারত বিরোধি সন্ত্রাসবাদি তৈরী হওয়াটা একটা স্বাভাবিক ঘটনা।
আমেরিকাও ইম্যুউন না। এই বছর ক্লাস সেভেনে আমার ছেলে পড়ছে আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস। এখানে তাদের প্রথম পরিচয় হয় কমিউনিউজমের সাথে। তাদের শিক্ষক কমিউনিজম চেনার জন্য পড়তে দিয়েছে জর্জ ওরোয়েলের এনিম্যাল ফার্ম। ওদের বন্ধুরা কমিউনিজম এবং স্বৈরতন্ত্র নিয়ে কি হয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ান, উত্তর কোরিয়া, ভিয়েতনামে খুব ভাল করেই শিখছে। চীনের কালচারাল রিভোলিউসন নিয়েও টিচার প্রজেক্ট দিচ্ছে। এবং আমি মনে করি এটা খুব ভাল ইতিহাস শিক্ষা হচ্ছে, যেটা পশ্চিম বঙ্গে শেখালে রাজ্যটা ৩৪ বছরে বামপন্থীদের গাধার ঘারে যেত না। কিন্ত আমেরিকান স্কুলে যেটা সেখাচ্ছে না- সেটা হচ্ছে ঠান্ডা যুদ্ধের সময় আমেরিকা ডজনে ডজনে স্বৈরাচারী মিলিটারী জেনারেলদের সিংহাসনে বসিয়েছে গণতন্ত্রকে ধ্বংস করে।
এতেব দুঃখ করে লাভ নাই- ইতিহাস বিকৃত হবেই। কারন ইতিহাসের ন্যারেটিভ একটা জাতির, পার্টির পরিচয়। সেখানে বিকৃতিই বাস্তব।