কে আটকাবে ইব্রাহিমদের? আজ শ্রীলংকা কাল অন্য কোথাও…।

সুধি, আমি জানি আপনারা শিক্ষিত, জ্ঞানী, পন্ডিত মানুষ। সমাজবিজ্ঞান মনোবিজ্ঞান মানুষের সভ্যতার ইতিহাস, ইউরোপিয়ান উপনিবেশযুগ, ফরাসী বিপ্লব থেকে আফ্রিকার হোয়াইট সুপ্রিমিটি, ভারতের সিপাহী বিপ্লব, মিশেল ফুকো  থেকে ফ্রয়েড, মার্কস দিয়ে লেলিনগ্রাদ হয়ে নোয়াম চমেস্কি দেরিদার এডওয়ার্ড সাঈদের সমাধির থেকে রবার্ট ফস্ট- এইরকম বিশাল বিপুল বিদ্যার ঝলকানি ও গরিমায় আপনারা শ্রীলংকার ঘটনার প্রকৃত প্রস্তাব রাখবেন জানি। আমি অভাজন নিতান্তই জ্ঞানহীন সাধারণ একজন মানুষ। আপনাদের কাছে একটু সময় মিনতি করছি তাই…।

ইলহাম ইব্রাহিম, তার স্ত্রী ফাতিমা এবং তার ভাই ইনশাফ- যারা শ্রীলংকায় অভিজাত ধনী বিলাসী এক জীবনযাপন করতেন। ইলহামের বাবা মশলার ব্যবসা করে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছিলেন। শ্রীলংকার রাজনৈতিক নেতাদের অনেকর কাছের মানুষ ছিলেন এই পরিবার। অভাব ছিলো না। বড় ভাই ইনশাফ বার স্ত্রী ও চার সন্তানকে নিয়ে প্রায় সাড়ে ১৬ কোটি টকা মূল্যের ম্যানশনে বাস করতেন। তার মেয়েটির বয়স ৮ বছর। তিন ছেলের বয়স ৬, ৪ এবং ২ বছর। পারিবারিক অশান্তিও ছিলো না। কারণ ব্যবসায়ীক কাজে জাম্বিয়া যাবার কথা বলে বিমানবন্দরে তার স্ত্রী ও চার সন্তান তাকে বিদায় জানাতে যায়। স্ত্রীকে ইনশাফ বলেন, ‘শক্ত থেকো’। বিদায় মুহূর্তে স্ত্রীকে তার এই শেষ বক্তব্যটুকু দুটি জিনিস আমাদের বিশ্বাস করায়। স্ত্রীর সঙ্গে তার ভালো সম্পর্ক এবং স্ত্রী জানতেন ইনশাফ ঠিক কি করতে যাচ্ছেন…। ছোটভাই ইব্রাহিম একইভাবে অঢেল সম্পদ আর বিলাসের মাঝ বড় হয়েছেন। ইব্রাহিমের ছবিই আমরা ভিডিও ফুটেজে দেখতে পাই যে পিঠে ভারী ব্যাগ নিয়ে গির্জায় প্রবেশ করছে। গির্জায় প্রবেশ করতে ইব্রাহিম একটি ছোট্ট শিশুর গাল টিপে আদরও করেছিলেন। যে কিনা একটু পরেই তার পিঠের বোমা বিস্ফরণ ঘটাবে আর তাতে ৪৫টি ছোট্ট ছোট্ট শিশুদের দেহ ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে ধাতব স্প্লিন্টারে…। ইব্রাহিমের স্ত্রী বোরখা পরে এই সিরিজ বোমা হামলায় অংশগ্রহণ করেছিলো পুলিশ জানতে পেরে তাকে যখন গ্রেফতার করতে যায় তখন আগে থেকে আত্মঘাতি ভেস্ট পরা থাকা ইব্রাহিমের অন্ত:সত্ত্বা স্ত্রী ফাতিমা তার তিন সন্তানসহ নিজেকে বোমায় উড়িয়ে দেয়…।

এ সবই আপনারা এখন জানেন। এসব বলার জন্য আমি আপনাদের কাছে একটু সময় প্রার্থনা করেনি। আমি শুধু বলতে চাই ইব্রাহিমের শিশুর গালে আদর করে নির্ভিক দ্বিধাহীন মানুষ হত্যার শক্তি কোথায় পায়? তার স্ত্রীর সন্তানসহ আত্মঘাতিনী হওয়ার রহস্য কোথায়? এগুলো তো কোন সাধারণ মানুষের কাজ নয়। কেমন করে তারা সাধারণ থেকে পিশাচে পরিণত হয়েছিলো। ভদ্রমহদয়গণ, ষোল বছরের এক কিশোর উমাইর বিন আল-হুমামের কথা বলি আপনাদের কাছে। এই কিশোর ইসলামের নবী মুহাম্মদের এক যুদ্ধের সঙ্গী ছিলেন। এক অসম যুদ্ধে বিপক্ষের বিশাল বাহিনীর বিরুদ্ধে মুহাম্মদ তার সঙ্গীদের সামনে ছোট্ট এক ভাষণ শুরু করলেন। আনাস ইবনে মালিক আমাদের জানাচ্ছেন, মুহাম্মদ তাদেরকে বলেছিলেন, ‘উঠ এবং জান্নাতে প্রবেশ কর, যার প্রস্থ আসমান ও জমিনের সমান’। সাহাবী ইবনে সা’দ আমাদের বলেন, মুহাম্মদ যখন তাদের জিহাদের কথা বলতেন, যখন ধর্মোপদেশের কথা বলতেন তখন তিনি গলা চড়িয়ে কথা বলতেন এব্ং তার চক্ষু লাল হয়ে উঠত। একজন সেনানায়কের মত তিনি তখন রাগান্বিতভাবে তর্জনী ও মধ্যমা আঙ্গুল দেখিয়ে বলতেন, ‘পূনরুত্থান এবং আমি এই দুটো আঙুলের মতন…’ মুহাম্মদের হাতে থাকত একটি লাঠি বা ছড়ি। এখনকার ওহাবী মাওলানাদের দেখবেন সেই অনুকরণে জুম্মার খুতবার সময় হাতে লাঠি রাখে। মুহাম্মদ নি:সন্দেহে এমন একজন ছিলেন যিনি মানুষকে কথা বলে এতখানি উদ্দেলিত করতে পারতেন যা কোন সাধারণ মানুষ পারত না। কারণ মুহাম্মদ কোন সাধারণ মানুষ ছিলেন না। সাইকোপ্যাথরা কেউ সাধারণ মানুষ থাকে না। আমাদের যুগের এরকম একজন সাইকোপ্যাথি ছিলেন হিটলার। মুহাম্মদ তার যুগে জান্নাত আর দোযগের লোভ আর ভয় দেখিয়ে তার সঙ্গীদের মরতে উৎসাহিত করত। কাজটি কিন্তু সরল আবার কঠিন। প্রথমত কাজটি সরল কারণ মানুষ পরকাল ঈশ্বর ভূতপ্রেতে আগেই বিশ্বাস করে থাকে। কাজটি কঠিন কারণ আপনি আমি কাউকে বললে সেটি সেরকম শুনাবে না যেরকমটি লেলিন, হিটলারের মত রাজনৈতিক নেতারা বললে শোনাবে। মোল্লার ওমর তার মাদ্রাসার ছাত্রদের সামনে যে ভাষণ দিয়েছিলেন সেই এক ভাষণেই তালেবানের উত্থান কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি। মোল্লার ওমর কোন সাধারণ মানুষ ছিলেন না। গোটা একটা দেশ তিনি দখল করিয়েছিলেন এমন সব মাদ্রাসার ছাত্রদের দিয়ে যারা মরতে ভয় পেতো না কারণ মরলেই তারা জান্নাত লাভ করবে। জান্নাত ছিলো তাদের চোখের সামনে। এই জান্নাত দেখানোর কাজটি একজন সাইকো অগণিত মানুষকে খুব সহজে দেখাতে পারে যা কোন সাধারণ মানুষ পারে না। কোন কিছু বিশ্বাস করে মৃত্যুর পর যদি দেখেন কিছুই নেই তখন আফসোস করার চাইতে যদি অবিশ্বাস করে দেখেন আপনার জন্য কঠিন শাস্তি অপেক্ষা করে আছে অবিশ্বাস করার জন্য- সেটাই তো বড় আফসোসের কথা। এটাই সমস্ত ধার্মীকদের বিশ্বাসের মূল নিউক্লিয়াস। কুরআনের দোযগের আগুনের পোড়ানোর বর্ণনা একজন প্রচন্ড রকমের ভালো বক্তা যখন বর্ণনা করবেন তখন সাধারণ বিশ্বাসী মানুষ তাতে ভয় পাবে। তখন আপনি ভাববেন যিনি এই দোযগের সংবাদ নিয়ে এসেছেন তাকে অবিশ্বাস করলে সেই দোযগে যাবার বদলে বিশ্বাস করলে ক্ষতি কি? উল্টো লাভ জান্নাতের নানান পুরস্কার আর প্রশান্তি…। মুহাম্মদের ভাষণে ভীষণভাবে প্রভাবিত কিশোর উমাইর বিন আল-হুমাম আবেগপূর্ণভাবে জানতে চাইলেন, ‘হে রসূলুল্লাহ (সঃ)! জান্নাত কি আসমান ও জমিনের সমান?’ মুহাম্মদ দ্বিধাহীন সংশয়হীন জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ’। কিশোর উমাইর বলতে লাগল, ‘হে রসূলুল্লাহ (সঃ)! অন্য কিছু নয় বরং এই ইচ্ছা যে, আমি যেন তার (জান্নাতের) অধিবাসীদের একজন হতে পারি’। উমাইর তার থলে থেকে জীবনের শেষ খেজুর খেয়ে নিচ্ছিল। হঠাৎ খেজুরগুলো সব ফেলে দিয়ে উঠে দাঁড়াল। বলতে লাগল, এই খেজুরগুলি আমার জান্নাত যাবার পথে বিলম্ব করে দিচ্ছে…। সঙ্গীদের সঙ্গে বিদায় নিয়ে এক অসম যুদ্ধে শত্রুর মাঝে ঝাপিয়ে পড়ে নিজেকে শেষ করে দেয়… (বুখারীঃ ৪০৪৬, মুসলিমঃ ১৮৯৯)।

ইলহাম ইব্রাহিম, তার স্ত্রী ফাতিমা এবং তার ভাই ইনশাফ সেই জান্নাতের পাগল হয়ে উঠেছিলো। এমন কোন সাইকোপ্যাথি তাদের মধ্যে ধর্মোপদেশ জাগিয়েছিলো যার অসীম ক্ষমতা আছে মানুষকে পঙ্গপালের মত আগুনে ঝাপিয়ে পড়াতে পারে। মুফতি জসিম উদ্দীন রাহমানির ভাষণে অভিজাত পরিবারের ছেলেরা গুলশানে নৃসংশ জিহাদ চালিয়ে হত্যা করেছিলো। ইব্রাহিম গির্জার দরজার সামনের শিশুটির গাল টিপে আদর করেছিলো কারণ সে জানত সে কোন অন্যায় করছে না! সে এইসব কাফেরদের পরকালের পরণতি সম্পর্কে এতটাই নিশ্চিত ছিলো যেমন সে নিজের হাতের তালু সম্পর্কে নিশ্চিত থাকে। যখন আহমদ শফী বলেন কাফেরদের সৃষ্টি করা হয়েছে মুসলমানদের খেদমত করার জন্য সেটা তিনি পরম নিশ্চিত করেই বলেন কারণ তিনি পরকালের মতই এগুলো বিশ্বাস করেছেন। কুরআনে আয়াত বলছে, ‘আমি কাফেরদের মনে ভীতির সঞ্চার করে দেব। কাজেই গর্দানের উপর আঘাত হান এবং তাদেরকে কাট জোড়ায় জোড়ায়’ (সুরা আনফাল ৮:১২)। সেই ভীতিটাই ছড়ানো হচ্ছে। কে আটকাবে ইব্রাহিমদের? আজ শ্রীলংকা কাল অন্য কোথাও…। আপনাদের কাছে একটাই অনুরোধ, ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদ, ধর্মীয় সন্ত্রাসীদের মনস্তাত্বিক বিবেচনা করতে ধর্মকে বাদ দিয়ে আপনাদের বিপুল বিশাল জ্ঞান নির্থক হয়ে উঠবে…। একজন কিশোর উমাইরের জন্নাতের জন্য পাগল হয়ে উঠা, দ্রুত জান্নাতে যাবার জন্য আত্মঘাতি হয়ে উঠা- এগুলোকে বাদ দিয়ে ইসলামের জিহাদ জঙ্গিবাদের থিসিস ব্যর্থ অসম্পূর্ণ…। শত শত আলী রিয়াজের জিহাদের গবেষণা মুখ থবড়ে পড়বে ভবিষ্যতের ধনী স্বচ্ছল সুখি মানুষ যারা প্রচন্ডভাবে ধার্মীক- তারা কেন অকালে জীবন বিলিয়ে দিয়ে অন্যকে আঘাত হানতে চায়- সেই জবাব না পেলে। সুইসাইড বোম্বিং অপারেশন কুরআনে ২:২০৭ আয়াতকে দলিল মানা হয়। ইবনে কাথির বলেছেন এটি নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও প্রতিটি মুজাহিদদের সম্পর্কে বলা হয়েছে যারা জান্নাত লাভ করবে। এগুলো বাদ দিয়ে খালি নোয়াম চমেস্ক এডওয়ার্ড সাঈদ দিয়ে তো জিহাদের কূল-কিনারা পাবেন না…।