যদি হায়নাধর্ম না লইতে চান, তবে হায়নাদিগের জন্য হায়নাদিগের আইন জারি করুন।

সাম্যদর্শীর সুসমাচারঃ

বহুদুরে কোন এক গাঁয়ে কিছু নির্বোধ বাস করিত। তাহারা গরু টরু চরাইত, বেলাশেষে গরু জড়াইয়া ধরিয়া ঘুমাইত। ওদিকে জঙ্গলে থাকিত একপাল হায়না। তাহারা সুযোগ সুবিধামত গরু কিম্বা গ্রামবাসী ধরিয়া খাইত। আহারান্তে বিপ্লব সফল করিয়া লেনিন (সকল বিপ্লব তাহাতে ধৰ্ষিত হউক) যেভাবে হাস্য করিতেন, সেইরূপে “হিঃ হিঃ” করিয়া হাসিত। সেই হাসি শুনিয়া গ্রামবাসীরা বড় ভীত হইত। এইরূপেই চলিতেছিল।

এমতাবস্থায় কোথা হইতে ক্ৰেম্লিনের মাকুওয়ালা আসিয়া তথায় উপস্থিত হইয়া কহিল, “ওহে গ্রামবাসীগণ, শোনো এই যে হায়নারা, ইহারা তোমাদের মারিয়া থাকে কেন জান? কারণ ইহাদের তোমরা দূরে ঠেলিয়া রাখিয়াছ। আপন করিয়া লও নাই, উহাদের সংস্কৃতি বুঝিতে চাহ নাই। উহাদের ভাই বানাও নাই।”

গ্রামবাসীগণ নির্বোধ ছিল। আর সমস্ত নির্বোধেরই সুশীল হইবার প্রবণতা থাকে। তাই উহারা ক্ৰেম্লিনের মাকুওয়ালার কথায় বড় খুশী হইল। তবে দুই একটা বেয়াদপ গ্রামবাসী কহিয়াছিল বটে, “উহারাও তো আমাদের সংস্কৃতি বুঝিতে চাহে নাই। আমরা গরু জড়াইয়া ঘুমাই, আর উহারা খাইয়া লয়।”

কিন্তু তখন আমাদের মাকুভাই উত্তেজিত স্বরে গলা কঁপাইয়া কহিলেন, “হে সর্বহারা গ্রামবাসী, বরফ যুগের পর যখন সুশীলযুগের পত্তন হইতে যাইতেছে তখন এইরূপ প্রতিক্রিয়াশীল কথা বলিয়া তোমাদের সদ্যোত্থিত সুশীলতাকে যুক্ত নিতম্বপ্রহার করিতে চাহে এই বেয়াদপেরা। বিপ্লবের এই সন্ধিক্ষণে তোমাদের সংস্কৃতি বড় হইল? এই ভোগবাদী, আত্মস্বার্থবাদী পশ্চিমা লুঠেরা সংস্কৃতির ক্রীড়নক মানসিকতা ত্যাগ করিয়া বিপ্লবী চেতনায় রাঙাইয়া লিও নিজেরে। নিজ সংস্কৃতি দূরে গিয়া মরুক, হায়নাদের সংস্কৃতিতেই নিহিত আছে বিপ্লবের কল্যাণ। গরু জড়ানো আবার একটা সংস্কৃতি হইল?
সংস্কৃতির কথা বলতে হইলে বানু কুরাইজার উদাহরণ আছে, গুলাগ আছে, বাট ইয়ে গরু গরু ক্যা হ্যায়, ইয়ে গরু গরু?”

বস্তুত গরুর বীরত্বের শেষ উদাহরণ বশিষ্ঠ মুনির আমলে হওয়ায় এই কলিকালে গরু শুধুই হাম্বার উপর উঠিতে পারে না। ফলতঃ জনতা চমকিত হইল। তাহার পর উত্তেজিত হইল। তাহার পর বেয়াদপোপরি যার পর নাই ক্রুদ্ধ হইল। মাকুর্বচনে

তাহারা সুশীলতার তুরীয় দশাপ্রাপ্ত হইল। এই গোলমালে আসল প্রশ্ন চাপা পড়িয়া গেল। তাহারা বেয়াদপদের উত্তমরূপে গালাগালি করিয়া ধোপা নাপিত বন্ধ করিয়া একঘরে করিয়া দিল। শুধু তাহাই নহে পিবিজিবিসিসিপিসি সব ডাকিয়া স্থির হইল, হায়নাগণের বিরুদ্ধে কোনরূপ অভিযোগ করিলেই তাহাকে বেয়াদপ বলে ঘোষণা করিয়া একঘরে করা হইবে। একঘরে হইবার ভয়ে হায়নানিরপেক্ষ দলে জনসংখ্যা বাড়িতে লাগিল। তাহারা হায়নাবদনে স্বীয় ভ্রাতৃমুখকৌমুদী দর্শনের দ্বান্দিক বস্তুবাদী প্রকল্প চালু করিলেন।

কিন্তু হায়নারা পরদিন দুইটা গ্রামবাসী একসাথে খাইল। লোকমুখে শোনা গেল। উক্ত প্রাতে গ্রামবাসীরা তখন হায়নার মধুর বদনে নাকি বড় পরিচিত কোন মুখসাদৃশ্য খুঁজিয়া পাইয়া বড় নিকটে চলিয়া গিয়াছিলেন, তাই এই বিপত্তি। আমাদের ক্ৰেম্লিনের মাকুওয়ালা সগর্জনে কহিলেন, “ইহা গুজব, কারণ এমন কিছু ঘটে নাই, এবং ইহা বেয়াদপদের কীর্তি, কারণ তাহারাই হায়নানিরপেক্ষ ভ্রাতাদিগকে মারিয়া শুভ্ৰচরিত্র হায়নাগণকে বদনাম করাইতেছে, এবং ইহা আমেরিকার ষড়যন্ত্র যাহাতে পুষ্পবৎ নিষ্পাপ হায়নাগণকে দিয়া এসব করানো হইয়াছে।”

একসাথে এত প্রকার বহুনির্দেশী তত্ত্ব পাইয়া হায়নানিরপেক্ষরা খুশীতে উন্মাদপ্রায় হইয়া দিকে দিকে পুচ্ছ তুলিয়া নৃত্য করিলেন এবং হায়নারা পুনরায় যথারীতি জনা তিনেককে খাইল। অনেককে বেয়াদপ ঘোষণা করিয়া এযাত্রা আমাদের হায়নানিরপেক্ষরা গ্রামের প্রগতি কোনক্রমে বাঁচাইলেন। তবু জনরোষ রহিল। অতঃপর পিবিজিবিসিসিপিসি ডাকিয়া ইহা সিদ্ধান্ত হইল যে, হায়নাগণকে এখনো পর্যন্ত যথেষ্টপ্রকার ভ্ৰাতায় পরিণত না করা যাওয়াতেই এই বিপত্তি। ক্ৰেম্লিনের মাকুভাই তখন বিপ্লব দীর্ঘজীবী করার স্বার্থে আমেরিকা বা ইটালি কোথাও একটা চামড়া টান করাইতে গিয়াছিলেন। তাই তাহার অবর্তমানে আশুপ্রক্রিয়া হিসাবে খিচুড়ি কর্মসূচী লওয়া হইল। পাঞ্চলাইন হইল “তোমরা উহাদের খিচুড়ি খাওয়াও, উহারা তোমাদিগকে আঁটি বাঁধিয়া দিবে”।

কিন্তু হায়নারা খিচুড়ির কথায় ভয়ঙ্কর ক্রুদ্ধ হইল। খ্যাক খ্যাক, ম্যাক ম্যাক করিয়া গ্রামের পথঘাট ফাটাইয়া ফেলিল। এসব শুনিয়া বেজিং বা হাভানার কোন দুৰ্গম স্থান হইতে ঠোঁটে চুরুট চাপিয়া মাকুভাই কহিলেন, “করিয়াছ কি? তোমরা সকলেই বেয়াদপ নাকি? হায়নানিরপেক্ষ গ্রামে হায়নার শান্তিপূর্ণভাবে নিজধৰ্ম পালনের অধিকার থাকিবে না। সে কি প্রকারে হয় ?”

গ্রামবাসীদের মনে মনে ক্ষোভ জন্মাইয়াছিল। হায়নার দাঁতের বহরে তারা ভীত হইলেও মনে মনে হায়নাপ্রেমে বিলক্ষণ ঘাটতি পড়িয়ছিল। তাহাদের মধ্যে একদল বলিয়াই বসিল, “তাহারা তো আমাদের খাইতেছে সুযোগ পাইলেই। গত সপ্তাহে নিমাই শীলের মেয়ে পূর্ণিমা শীলকে একসাথে পনেরোটি হায়না মিলিয়া চাটিয়া পুটিয়া খাইয়া ফেলিয়াছে। নিমাই শীল এক এক করিয়া খাইতে বলিয়াছিল, তাহার সেই সাংস্কৃতিক অনুরোধটুকুও রাখে নাই হায়নাগণ। গতকল্য শুনিয়ছি, রজকের কন্যাকে কামড়াইয়া মারিয়া ফেলিয়াছে খাইতে দিতে রাজি না হওয়ায়। জাতি কি এমন হায়না চাহিয়াছিল ?”

মাকুভাই ক্রুদ্ধ হইয়া ভেংচাইয়া কহিলেন, “শালা লুম্পেন, গরুর শাবক কোথাকার। হায়নার ধর্ম কি হবিষ্যিভোজন ? তাহার ধর্ম মানুষ খাওয়া। সকল বিজ্ঞানের যাহা উৎস সেই কিতাবে স্পষ্ট লিখিত আছে। ফলে শান্তিস্য পুত্রাঃ হায়নাগণ নিজধৰ্ম পালন করিলে তোমাদিগের এত সমস্যা কিসের বাপু ? উহাদের শ্বদন্ত বর্তমান, উহারা তাহা ব্যবহার করিতেছে। সম্পূর্ণ জীববিজ্ঞান তো! নিতান্ত অবৈজ্ঞানিক বেয়াদপি না হইলে তো এত গাত্ৰদাহ হইবার কথা নয়। শীল বা রজকেরা কাঁদিয়া সময় নষ্ট না করিয়া হানিমুন করিয়া আসুক। কিন্তু কোনভাবেই এই খিচুড়ি কর্মসূচী করিয়া হায়নাদিগের ভাবাবেগে আঘাত করা সমর্থন করিতে পারিব না। আমাদের আরও হায়নাবিক হইতে হইবে। হায়নারা তখনই তোমাদের আপনি করিবে যখন তোমরা এক একটি উপযুক্ত নওহায়না হইতে পরিবে। ইহাই তাহাদের ধর্ম। অতএব উহাদের আঘাত না করিয়া হায়না হইয়া যাইতে পার, বা হায়না ঐক্যে সামিল হইয়া উহাদের খাদ্য হইতে পার। তাহার পর সকলে মিলিয়া বিপ্লব করিব।”

মাকুভাইয়ের যুক্তি যে অকাট্য তাহা গ্রামবাসীরা বুঝিলেন। যতই নির্বোধ হন হায়নাদিগকে যে খিচুড়ি খাওয়ানো উহাদিগের জৈবিক ধর্ম অনুসারেই অসম্ভব তাহা তারা স্পষ্ট হৃদয়াঙ্গম করিলেন। মাকু ভাইয়ের হাস্যোজ্বল মুখের সহিত হায়নামুখসাদৃশ্য বড় প্রকট হইল অনেকের মানসপটেই। কিন্তু মুখে তাহা বলিলেই বেয়াদপ বলিয়া হায়নানিরপেক্ষীরা একঘর করিতেছে।

আপাতত একঘর একঘর করিতে করিতে বেয়াদপদের ঘর বাড়িতেছে। হায়না ও হায়নানিরপেক্ষীরা পরিত্ৰাহি চিৎকার করিতেছে। বিপ্লব আসন্ন।

米 米 米 米 米

আমি নিরীহ বেড়াল, আপনাকে গল্প শুনাইতে শুনাইতে চুপি চুপি একটা কথা বলি। চাপা পড়া আসল প্রশ্নটি হইতেছে, হায়নাদের পর করা হইয়াছে, নাকি হায়নারা সকলকে হায়নাধর্মের কারণে পর করিয়াছে? আমাকে মৎস খাওয়া হইতে বিরতকরণ যেমন অবৈড়ালিক, হায়নাগণকে খিচুড়িভোজী হইবার কথা বলাও তাই। অতএব যদি হায়নাধর্ম না লইতে চান, তবে হায়নাদিগের জন্য হায়নাদিগের আইন জারি করুন। হায়নার জন্য সম্পূর্ণ হায়নাবিক আইন, মনুষ্যের জন্য সম্পূর্ণ মানবিক আইন, বিড়ালের জন্য বৈড়ালিক আইন। না মানিলে ডাণ্ডা রেডি করুন। হায়নাবিক আইনে ডাণ্ডা প্রয়োগ অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। হায়নাদের আরও উৎসাহিত করুন। হায়নাবিকতা প্ৰদৰ্শন করিতে।

ভাবিতেছেন, বিড়াল হইয়া আপনাদিগের ন্যায় মনুষ্যকুলকে সুসমাচার দিতেছি কেন? কারণ মনুষ্যকুল নিতান্ত নির্বোধ। উহারা সুশীলসাগরে অত্যন্ত দ্রাব্য। ফলে উহাদের জাগাইয়া দেওয়া বুদ্ধিমানের অবশ্যকর্তব্য। তাছাড়া হায়নাদের জঙ্গল তো হায়নারা পাইয়াছেই। এখন গ্রামে ঢুকিয়া নিরীহ বেড়ালের ভাত মারিতেছে কেন?

লেখকঃ শ্রী দীপ্তরূপ সাম্যদর্শী
সৌজন্যেঃ স্বদেশ সংহতি সংবাদ। পূজা সংখ্যা ২০১৭; পৃষ্ঠা – ৪