বেদে অনিত্য ইতিহাস খোজার কার্য সায়নাচার্য্য দ্বারাই শুরু হয়েছে। এবং বিদেশীরা তাহার দ্বারাই অনুপ্রাণিত।

সায়নাচার্য্য সমন্ধ্যে থেকে নিজে থেকে অতিরিক্ত কিছু বলার নেই। যোগী অরবিন্দ তাহার বেদ রহস্যে  সায়নাচার্য্যের বেদ ভাষ্য সমন্ধ্যে যাহা বলেছেন তাহারই কয়েকটা লাইন উপস্থিত করলাম –
.
” বেদের মহান ভাষ্যকার সায়ন ঋক মন্ত্রগুলির কর্মকান্ডীয় ব্যাখ্যা উপস্থাপিত করেছেন,  প্রয়োজন বোধে কোথাও পৌরাণিকী আখ্যায়িকাত্মক বা ঐতিহাসিক অর্থের আভাস দিয়েছেন যেন পরীক্ষাচ্ছলে।  কোনরূপ উদাত্ত বা ভাবগম্ভীর অর্থের নিরূপন সায়নের টীকাই সূদূর্লভ।  বহু আয়াসেও যে মন্ত্রগুলির যাজ্ঞিকী বা পৌরাণিকী ব্যাখ্যা সম্ভব হয় নাই সেখানে বিকল্প হিসেবে উচ্চাঙ্গ অর্থের ক্ষীণ আভাস দিতে বাধ্য হয়েছেন হতাশ হয়েই যেন।  তথাপি আধ্যাত্মিক অর্থে বেদের প্রমাণ সায়ন নিরাকরণ করেন নি,  ঋকমমন্ত্রগুলিতে কোন পরমার্থ সত্য নিহিত এ কথা তিনি  তা স্বীকার করেন নি। সেই অন্তিম কার্যটির সেই অস্বীকৃতির ভার এই যুগের উপর ন্যস্ত হলো,  পাশ্চাত্য পন্ডিতদের প্রভাবে তাহা লোকপ্রিয়ও হয়ে উঠলো।
ইউরোপীয় পন্ডিতেরা সায়নের কর্মকান্ডীয় সিদ্ধান্তটিই নিলেন,  অন্য বিষয়ে তাকে দূরেই রাখলেন।  শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থে স্বকীয় মতের অর্থের অনুমানিক ভাবার্থের আরোপ করে তারা বেদমন্ত্রের এমন একটি রূপ দিলেন যা বহুস্থলে স্বৈরাচারী ও কল্পনা প্রসুত। এই পন্ডিতেরা বেদের মধ্যে প্রাচীন ইতিহাস,  সমাজ গঠন,  সংস্থা, প্রথা,  রীতিনীতি ও তৎকালীন সভ্যতার চিত্র ও নিদর্শন খুজলেন। “
.
অর্থাৎ নিত্য বেদে অনিত্য ইতিহাস খোজার কার্য সায়নাচার্য্য দ্বারাই শুরু হয়েছে।  এবং বিদেশীরা তাহার দ্বারাই অনুপ্রাণিত। 
নমুনাস্বরূপ ঋগবেদ ১।১৮।১ মন্ত্রে সায়ন আদি বিদ্বান কক্ষীবানের ইতিহাস তুলে ধরেছেন।  মহাভারত,  মৎসপুরাণ ও বায়ুপুরাণে এ গল্প উপস্থিত । ঘটনাটি এরকম যে, কলিঙ্গরাজ সন্তান আকাঙ্খায় তাহার রাজ্ঞীকে দীর্ঘতমা মুনির সহিত সহবাসের আদেশ দিয়াছিলেন। রাজ্ঞী স্বয়ং না যাইয়া দাসী উশিজকে পাঠাইয়া দিলেন। মুনি ইহা বুঝিতে পারিলেন,  এবং উষিজের দ্বারা কক্ষীবান নামক সন্তান উৎপাদন করিলেন।
.
অথঃ মন্ত্রার্থ প্রকাশঃ
.
সোমান স্বরণং কৃণুহি ব্রহ্মণস্পতে।
কক্ষীবন্তং য ঔশিজঃ।।
(ঋগবেদ ১।১৮।১)
.
পদার্থঃ (ব্রহ্মণস্পতে) বেদের স্বামী ঈশ্বর! (যঃ) যে আমি (ঔশিজঃ) বিদ্যার প্রকাশে সংসার কে বিদিত হওয়া এবং বিদ্বানের পুত্রের সমান হই,  যেই আমাকে (সোমানম্) ঐশ্বর্য্য সিদ্ধকারী যজ্ঞের কর্তা (স্বরণম্) শব্দ অর্থের সমন্ধ্যের উপদেশক এবং (কক্ষীবন্তম্) কক্ষা হস্ত বা অঙ্গুলির ক্রিয়ায় হওয়া প্রসংশনীয় শিল্পবিদ্যার কৃপায় সম্পাদন কারী (কৃণুহি) করো। (মহর্ষি দয়াননন্দ কৃত ভাষ্য)
.
এই মন্ত্রের অনুবাদে নিরুক্তার যাস্ক লিখেছেন – সোমান সোতারং প্রকাশনবন্তং কুরু ব্রহ্মণস্পতে কক্ষীবন্তমিব য ঔশিজঃ। কক্ষীবান্ কক্ষাবান্। ঔশিজ উশিজঃ পুত্রঃ। উশিগ্বষ্টেঃ কান্তিকর্মণঃ। অপি ত্বয়ং মনুষ্যকক্ষ এবাভিপ্রেতঃ স্যাত্। তং সোমানং সোতারং মাং প্রকামনবন্তং কুরু ব্রহ্মণস্পতে ।। (নিরুক্ত ৬।১০)
.
মন্ত্রে,
সোমানম =যঃ সবত্যৈশ্বর্য্য করোতীতি তং যজ্ঞানুষ্ঠাতারম্।
স্বরণম্ = যঃ স্বরতি শব্দার্থসমন্ধানুপদিশতি তম্
কৃণুহি = সম্পাদয়।  উতশ্চ পত্যায়চ্ছন্দো বা বচনম্। (অষ্টা ৬।৪।১০৬)
ব্রহ্মণঃ পতে = বেদস্য স্বামীন্নীশ্বর। ষষ্টয়াঃ পতিপুত্রপৃষ্টপরপদপয়স্পোষেষু।  (অষ্টা০৮।৩।৫৩) ইতি সূত্রেণ ষষ্টয়া বিসর্জনীয়স্য সকারাদেশঃ।
কক্ষীবন্তম্ = যাঃ কক্ষাসু করাঙ্গুলিক্রিয়াসু ভবাঃ শিল্পবিদ্যাস্তাঃ প্রশস্তা বিদ্যন্তে যস্য তম্। কক্ষা ইত্যঙ্গুলিনামসু পঠিতম্।  (নিঘন্টু ২।৫) অত্র কক্ষাশব্দাদ্ ভবে ছন্দসি ইতি যত্ ততঃ প্রসংসায়াং মতুপ্। কক্ষায়া সংজ্ঞায়াং মতৌ সম্প্রসারণং কর্ত্তব্যম্। (অষ্টা০ ৬।১।৩৭) অনেন বার্ত্তিকেন সম্প্রসারণম্। আসংদীবদ (অষ্টা ৮।২।১২) ইতি নিপাতনামকারস্য বকারাদেশঃ।
ঔশিজঃ য উশিজি প্রকাশে জাতঃ স উশিক্ তস্য বিদ্যাবৃত্তঃ পুত্র ইব।
.
সায়নাচার্য্য এবং তাহার অনুসরনকারী Prof. Wilson এবং Griffith বেদের এই মন্ত্রে ঐতিহাসিক অনুবাদ করেছেন।  এখানে তারা কক্ষিবান নামে এক বিশেষ ঋষির কথা উল্লেখ করেছেন যিনি কি না উশিজের পুত্র ছিলো ।  সায়নাচার্য্য নিম্নোক্তরূপে মন্ত্রের ব্যাখ্যা করেছেন –
.
” হে ব্রহ্মণস্পতে এতন্নামক দেব (সোমানম্) অভিপবস্য কর্তারম্ (স্বরণম্) দেবেষু প্রকাশবন্তম্ (কৃণুহি) কুরু তত্র দৃষ্টান্তঃ (কক্ষীবন্তম্) এতন্নামকম্ ঋষিভ।  ইব শব্দোহন্নাধ্যাইর্তব্যঃ। কক্ষীবান্ যথা দেবেষু  প্রসিদ্ধস্তদ্ধদিত্যর্থঃ। যঃ কক্ষীবান্ ঋষিঃ (ঔশিজঃ) পুত্রঃ তম্ ইষেতি পূর্বত্ন যোজনা।।”
.
pro. willson সায়নাচার্য্য কে অনুসরন করে মন্ত্রের অর্থ করেছেন –
” Bramhanaspati,  make the offee of the libation illustrious  among the Gods, like Kakshivat,  the son of Usnik ”
তাহার নোটে তিনি কক্ষিবানের ইতিহাস মৎস এবং বায়ু পুরাণ থেকে উদ্ধৃত করেছেন।  চমৎকারের বিষয় এই যে, স্কন্ধ স্বামী পরিষ্কারভাবে নিরুক্তের ভাষ্যে বলেছেন –
ঔপচারিকো মন্ত্রেব্যাখ্যানসময়ঃ।
পরমার্থেষু নিত্যপক্ষ ইতি সিদ্ধম্।।
(নিরুক্ত ভাষ্যে ২. ৭৮)
.
বেদে ঐতিহাসিক শব্দগাথা যা অনেক বেদে সময় পাওয়া যায় সেগুলো প্রতীক অথবা রূপকধর্মী। আর মূল কারণ এটা যে বেদ নিত্য শাশ্বত এখানে সেই পরমার্থের জ্ঞানই রয়েছে। কোন ঐতিহাসিক ঘটনা প্রবাহ নিত্য বেদে থাকতে পারে না।
.
কপিল শাস্ত্রি একজন মহান যোগী তিনি যাস্কাচার্যের নিরুক্তের উক্ত ভাষ্যের ব্যাখ্যায় বলেছেন –
.
কক্ষীবান ঔশিজঃ কক্ষাবান, ঔশিজঃ  উশিজঃ পুত্রঃ  উশিজ বষ্টেঃ কান্তিকর্মণঃ নর্হি উশিক্ কান্তিমত্ তেজো বা ভবতি তস্য অপত্যং তৈজস কক্ষীবান্ রহস্যবান্ পরমদৈবতরসহস্যসম্পন্ন ইতি বাচ্যং কক্ষশব্দস্য গমনার্থে গোপ্যার্থে বা প্রসিদ্ধেঃ। যোহম্ ঔশিজঃ কান্তিজন্মাতৈজসঃ তে সোমানং সোতারং কক্ষীবন্তং পরম রহস্যবিজ্ঞং মাং স্বরণং প্রকাশনবন্তং দেবেষু প্রখ্যাতং কুরু ব্রহ্মণস্পতে – ইত্যুপপন্নতরম্।।
(কপালিশাস্ত্রিকৃতেসিদ্ধাঞ্জনভাষ্যে প্রথম খন্ড পৃ০ ২১৩)
.
এখানে ঐতিহাসিক ঘটনাকে খারিজ করা হয়েছে। যোগী পন্ডিত কপিল শাস্ত্রি ব্যাখ্যা করেছেন,  কক্ষীবান = বেদ রহস্যের মহান জ্ঞাতা। এখানে কক্ষ শব্দ গমনার্থে গোপন অর্থে প্রসিদ্ধ।  এবং ঔশিজ = আলোর কান্তি জন্মা। এই আধ্যাত্মিক ভাষ্যের অনুই মহর্ষি দয়ানন্দের ভাষ্যে উপস্থিত।