সাত্ত্বিক মানে কি নিরামিষ খাবার…….. ?

সাত্ত্বিক মানে কি নিরামিষ খাবার ?

(Requested Post : Request by – maximum friend.

কিছু কিছু দিব্যজ্ঞানীর অত্যাচারে টেকা দায় হয়ে পড়েছে। এরা মনে করে, সাত্ত্বিক মানে নিরামিষ খাবার; এছাড়া এরা আরও মনে করে যে ধর্ম পালন করতে হলে নিরামিষ খাবারই খেতে হবে, আমিষ খাবার খাওয়া যাবে না; শুধু তাই নয়, এরপর এরা প্রশ্ন করে ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে কি মাছ মাংস নিবেদন করা সম্ভব ? তার মানে, এদের শেষ কথা হচ্ছে- ধর্মকর্ম করতে গেলে নিরামিষ খেতেই হবে আর এই নিরামিষ খেতে খেতে কাম-ক্রোধ ত্যাগ ক’রে হীন দুর্বল হয়ে মুসলমানদের হাতে মার খেয়ে হয় জন্মভূমি ত্যাগ করতে হবে, না হয় মরতে হবে। এদেরকে আমি জিজ্ঞেস করছি, এই যদি হয় শেষ পরিণতি, তাহলে সেই ধর্ম পালনের প্রয়োজনীয়তা কী, যে ধর্ম মানুষকে আত্মরক্ষা করার পথ দেখায় না বা আত্মরক্ষা করার শক্তি অর্জন করতে দেয় না ?

নিরামিষ খাবারের ভয়াবহ ক্ষতিকর দিক বিবেচনা করে আমি নিরামিষ খাবারের সম্পূ্র্ণ বিরুদ্ধে, 

দিব্যজ্ঞানী কমলাক্ষ গিরীধারী দাস  বলেছে, “সনাতন ধর্মের সকল স্তরে সকল মাছ মাংস খেতে নিষেধ করা হয়েছে।”

সবগুলো স্তর উল্লেখ না করলেও সে কিছু কিছু রেফারেন্স দিয়েছে, দেখা যাক সেখানে আসলে কী বলা হয়েছে, গিরিধারী আমাকে গীতার ৩য় অধ্যায় এর ১২,১৩, ৭তম, ৯ম অধ্যায়, মনুসংহিতার ৫ম অধ্যায়ের ১৫ নং শ্লোক গুলো পড়তে বলেছে। এখানে নাকি ভগবান মাছ মাংস ছেড়ে বিষ্ণু প্রসাদ খেতে বলেছেন!

গীতার ৩য় অধ্যায়ের ১২ নং শ্লোকে বলা হয়েছে,

ইস্টান ভোগান হি বো দেবা দাস্যন্তে যজ্ঞভাবিতাঃ।
তৈর্দত্তানপ্রদায়ৈভ্যো যো ভুঙক্তে স্তেন এব সঃ।।

এর অর্থ- যজ্ঞের ফলে সন্তুষ্ট হয়ে দেবতারা তোমাদের বাঞ্ছিত ভোগ্যবস্তু প্রদান করেন। কিন্তু দেবতাদের প্রদত্ত বস্তু তাদেরকে নিবেদন না করে যে ভোগ করে সে নিশ্চয় চোর।

এর সরল মানে হলো, দেবতারাই আমাদেরকে আমাদের ভোগ্যবস্তু প্রদান করে, তাই তাদের নিবেদন করে আমাদের খাদ্য গ্রহন করা উচিত। এখানে কি বলা আছে যে, কোন খা্দ্য তাদেরকে নিবেদন করতে হবে ? যেহেতু বলা নেই যে কোন খাদ্য তাদেরকে নিবেদন করতে হবে, সেহেতু আমরা যা খাবো, সেটাই আমাদেরকে নিবেদন করতে হবে। এখন আমরা কী খাবো সেটা বলা আছে বেদ এ- এভাবে,

“জীবস্য জীবস্মৃতম”

এর মানে হলো এক জীব খাদ্যরূপে অপরজীবকে গ্রহন করবে। এটাই তো প্রকৃতির নিয়ম, নাকি ? এই নিয়মকে অস্বীকার করে কেউ কি বাঁচতে পারে, না আপনি বাঁচতে পারবেন ?

এরপর গীতার ৩/১৩ নং শ্লোকে বলা আছে,

যজ্ঞশিষ্টাশিনঃ সন্তো মুচ্যন্তে সর্বকিল্বিষৈঃ।
ভুঞ্জতে তে ত্বঘং পাপা যে পচন্ত্যাত্মকারণাৎ।।

এর অর্থ- ভগবদ্ভক্তেরা সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত হন, কারণ তারা যজ্ঞাবিশিষ্ট অন্নাদি গ্রহণ করেন। যারা কেবল স্বার্থপর হয়ে নিজেদের ইন্দ্রিয়ের তৃপ্তির জন্য অন্নাদি পাক করে, তারা কেবল পাপই ভোজন করে।

এখানে প্রথম যে কথা বলা হয়েছে, তা হলো- ভগবদ্ভক্ত অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণের ভক্তরা সকল রকম পাপ থেকে মুক্ত হন। দ্বিতীয় কথা হলো- খাবার দাবারে প্রয়োজনের অতিরিক্ত বিলা্সিতাকে পাপ হিসেবে গন্য করা হয়েছে। এখানে কী বা আছে, কোনো খাবার আমাদেরকে খেতে হবে ?

এরপর গিরিধারী তার কমেন্ট বলেছে ৭ তম, এটা বলতে সে যদি বোঝায়, আগেরগুলোর মতোই ৩ অধ্যায়ের ৭ নং শ্লোক, তাহলে বলছি, সেখানে খাবার-দাবার নিয়ে কিছু বলা নেই। বিশ্বাস না হলে গীতা খুলে দেখে নিতে পারেন।

এরপর গিরিধারী বলেছে ৯ম অধ্যায়ের কথা, এই অধ্যায়ের নাম রাজগুহ্য যোগ, এই পুরো অধ্যায়েও খাবার-দাবারের ব্যাপারে কিছু বলা নেই, শুধু ২৬ নং শ্লোকে বলা আছে,

পত্রং পুষ্পং ফলং তোয়ং যো মে ভক্ত্যা প্রযচ্ছতি।
তদহং ভক্ত্যুপহৃতমশ্নামি প্রযতাত্মনঃ।।

এর অর্থ- যে বিশুদ্ধচিত্ত নিষ্কামভক্ত ভক্তি সহকারে আমাকে পত্র পুষ্প ফল ও জল অর্পন করে, আমি তার সেই ভক্তিপ্লুত উপহার প্রীতি সহকারে গ্রহণ করি।

গীতার এই শ্লোকটিকে কোনো কোনো নিরামিষভোজী, নিরামিষ যে খেতেই হবে তার অকাট্য প্রমান হিসেবে পেশ করে, কিন্তু তারা তলিয়ে দেখে না যে, যে শরবতের কথা তারা বলছে, সেই শরবতে লবন না চিনি মেশানো আছে ?

এই শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, পত্র পুষ্প ফল ও জল তাকে অর্পন করতে, কিন্তু তিনি কি তার ভক্তদেরকে এগুলোই বা শুধু এগুলোই খেতে বলেছেন ? যদি শ্রীকৃষ্ণ তার ভক্তদেরকে এগুলোই খেতে বলে থাকে, তাহলে তো আমাদেরকে শুধু পত্র পুষ্প ফল ও জল খেয়েই থাকতে হবে। ফল ও জল না হয় খাওয়া যায় বা যাবে, কিন্তু পত্র ও পুষ্প অর্থাৎ পাতা ও ফুল কিভাবে খাওয়া যাবে ? কিছু কিছু সবজিজাত পাতা ও ফুল অবশ্য মানুষ খায়, কিন্তু সেগুলো কি মানুষ কোনো দেবতাদের উদ্দেশ্যে নিবেদন করে ? করে না। তার মানে, যে পাতা ও ফুলের কথা বলা হয়েছে সেগুলো মানুষের খাদ্য নয়। এখন নিরামিষভোজীদের জন্য বাকি থাকলো ফল ও জল; এখন আপনারাই বলেন, আপনারা কি শুধু ফল ও জল খেয়ে থাকেন, অন্য কিছুও খান ?

গীতা শুধু পড়লেই হয় না, গীতার বাণীর মর্মকে উপলব্ধি করতে হয়। যেমন- এক জায়গায় বলা হয়েছে, কাম ক্রোধ নরকের দ্বার। তার মানে কি কাম ক্রোধকে ত্যাগ করতে বলা হয়েছে ? কাম ক্রোধকে কন্ট্রোল করতে বলা হয়েছে, যাতে তার দ্বারা কোনো অনর্থ না ঘটে। শ্রীকৃষ্ণ যদি কামকে ত্যাগ করতেন তাহলে কি তিনি বিয়ে করতেন ? ক্রোধকে ত্যাগ করলে কি তিনি শিশুপালকে হত্যা করতেন ? এভাবেই পত্র পুষ্প ফুল ও জল শ্রীকৃষ্ণকে নিবেদন করার বিষয়টি হলো প্রতীকী, এর মাধ্যমে শুধুমাত্র সেগুলোই আমাদেরকে খেতে বলা হয় নি, বলা হয়েছে, দিনে অন্তত একবার হলেও তার উদ্দেশ্যে সেগুলো নিবেদন করে যেন তাকে স্মরণ করি; পত্র পুষ্প ফুল ও জল হলো শ্রদ্ধা প্রর্দশনের একটি মাধ্যম মাত্র, যেমন- শহীদ মিনার, স্মৃতিসৌধে বা মৃত কোনো বিখ্যাত মানুষের মূর্তির বেদিতে পুষ্পস্তবক অর্পন করে শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা হয়।

আপনারা অনেকেই হয়তো করে থাকেন বা কাউকে করতে দেখেছেন যে, ভাত খাওয়ার পূর্বে কেউ কেউ গ্লাস থেকে হাতে জল নিয়ে থালার চারপাশে বৃত্তের মতো জল দিয়ে ভাতকে প্রণাম করে খাওয়া শুরু করে, এটাও এক প্রকারের নিবেদন এবং উপরের শ্লোকে জল নিবেদনের যে কথা বলা হয়েছে, এটাও তার এক প্রকারের রূপ।

এরপর গিরিধারী, মনুসংহিতার ৫ম অধ্যায়ের ১৫ নং শ্লোকের কথা বলেছে, অনেকের মতো হয়তো এই দিব্যজ্ঞানীও জানে না যে, মনুসংহিতা হিন্দু ধর্মের কোনো গ্রন্থ নয়, এটা সিন্ধু সভ্যতার এক রাজা স্বায়ম্ভূব, যে চালাকি করে নিজের নামের সাথে মনু লাগিয়ে নিজকে ব্রহ্মার মানসপুত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে এবং রাজ্য পরিচালনার জন্য একটি সংবিধান রচনা করে যার নাম মনুসংহিতা। হিন্দু ধর্মের কোনো গ্রন্থ না হলেও অনেক মূল্যবান গ্রন্থের মতো এটিও একটি গ্রন্থ, তাই এই গ্রন্থের যা ভালো তা যেমন অনায়াসে গ্রহন করা যায়, তেমনি যা ভালো নয়, তাকেও অনায়াসে ছুঁড়ে ফেলা যায়, এতে কোনো পাপ নেই বা পাপ হবে না।

প্রথম দিব্যজ্ঞানী গিরিধারীর রেফারেন্স এর ব্যাখ্যা এতক্ষণ দিলাম। কিন্তু দ্বিতীয় দিব্যজ্ঞানী Arjun Chandra Das আমার কথাকে চ্যালেঞ্জ করে বলেছে, “খাবারের মধ্যেও ধর্ম আছে, যেমন গীতায় আছে, শ্রেষ্ঠ আহার সাত্ত্বিক, মানে নিরামিষ।”

এই বিষয়টাই আজকের পোস্টের বিষয়বস্তু, তাই এটা নিয়ে আর আলাদা করে কিছু বলছি না। খাবার দাবার নিয়ে গীতায় কী বলা আছে, সেই আলোচনা করবো পোস্টের শেষে, তার আগে একটু দেখে নিন, নিরামিষ খাবার সম্পর্কে হিন্দু ত্রাতা ড. রাধেশ্যাম ব্রহ্মচারী তার “বিপথগামী হিন্দুধর্ম ও হিন্দুর ভবিষ্যৎ” পুস্তিকায় কী বলেছেন-

“গুপ্তযুগের আগে হিন্দুধর্ম ছিলো যজ্ঞ ও পশুবলির ধর্ম, হিন্দুরা ছিলো একটি মাংসাহারী জাতি। শ্রীরামচন্দ্র ছিলেন ক্ষত্রিয়। মনুসংহিতা অনুসারে এই ক্ষত্রিয়দের সমস্ত রকম পানাহার বৈধ। বাল্মীকি রামায়নে অন্তত ১৫ জায়গায় বলা আছে, বনবাসকালে রাম বন্য প্রাণী স্বীকার করে নিয়মিত তার মাংসা আহার করতেন। কোথাও আছে শ্রীরাম বন্যহরিণ বা বরাহ শিকার করে তা পুড়িয়ে স্ত্রী সীতা, বনের মুনি ঋষিগণ এবং ভাই লক্ষ্মণের সাথে আহার করছেন। আবার কোথাও কোথাও বড় একটা গোসাপ পুড়িয়ে তা আহার করছেন।

গোরক্ষপুরের গীতা প্রেস পরিচালনা করছে একটি শক্তিশালী নিরামিষভোজী গোষ্ঠী। এই গোষ্ঠী, তাদের প্রকাশিত বাল্মীকি রামায়নের যে যে শ্লোকে রাম, সীতার মাংস খাওয়া পরিষ্কার বর্ণনা আছে, সেখানে পাদটীকা ছাপিয়ে দিয়ে বলেছে, এই শ্লোকে মাংসের বদলে অমুক অমুক মূল বুঝতে হবে। কারণ, তাদের মতে রামের পক্ষে মাংস খাওয়া অসম্ভব এক ব্যাপার।

অহিংসার কথা বললে বৌদ্ধরা মাংস খাওয়ার বিরোধী নয়। এখনো তারা গরুসহ সকল প্রাণীর মাংস খায়। বৌদ্ধদের মতে প্রাণী হত্যা করা পাপ, কিন্তু অন্যের হত্যা করা প্রাণীর মাংস খাওয়া পাপ নয়। অহিংসা তত্ত্বের প্রবক্তা গৌতম বুদ্ধের মৃত্যু হয়েছিলো বাসি শুকরে মাংস খেয়ে।”

যা হোক, আবার নিজের কথা শুরু করছি, এতে গীতার উদাহরণ দেওয়ার আগে রামায়ণ নিয়ে একটু আলোচনা করি, একটু আগেই পড়লেন যে, বাল্মীকি রামায়নে অন্তত ১৫ জায়গায় বলা আছে, বনবাসকালে রাম বন্য প্রাণী স্বীকার করে নিয়মিত তার মাংসা আহার করতেন। কিন্তু নিরামিষভোজীরা সেই রামায়ন নতুন করে প্রিন্ট করতে গিয়ে রাম সীতার সেই মাংস খাওয়ার শ্লোকের অর্থ পাল্টে দেওয়ার জন্য বলেছে, এই শ্লোকে মাংসের বদলে অমুক অমুক মূল বুঝতে হবে, এখন আপনারাই বোঝার চেষ্টা করুন প্রকৃত ব্যাপারটা আসলে কী ?এছাড়াও সংস্কৃত মহাভারতে বলা আছে, ভীম ছিলেন মাংসলোভী পেটুক। তাহলে ভীম কি একাই মাংস খেতো, না অন্যরাও খেতো ?

এবার রামায়নের একটা ঘটনা বলি, কমনসেন্স দিয়ে বিষয়টি বিবেচনা করবেন। আপনারা অনেকেই জানেন যে, সীতার আবদার মেটাতে গিয়ে এক হরিণের পেছনে ছুটতে গিয়ে রাম সীতাকে একা ফেলে দূরে চলে যায়, অনেকক্ষণ রাম আর ফিরছে না বলে, সীতা লক্ষণকে আবার রামের খোঁজে পাঠায়, এই ফাঁকে সীতাকে একা পেয়ে রাবন তাকে অপহরণ করে নিয়ে যায়।

এখানে প্রশ্ন হচ্ছে, সীতা কেনো রামকে হরিণকে ধরতে বা শিকার করতে পাঠিয়েছিলো ? সীতার কি তখন হরিণ পোষার শখ হয়েছিলো ? কারো কারো এটাও মনে হতে পারে, কিন্তু তারা ভুলে যায় যে, সীতা তখন ছিলো জঙ্গলে, তখন তার হরিণ পোষার মতো কোনো বিলাসিতা ছিলো, শুধু তাই নয়, পোষা হরিণের মতো সীতা সেই জঙ্গলে যখন তখন হরিণ দেখতে পেতো। তাহলে সীতা কেনো হরিণটি চেয়েছিলো ? কেউ কেউ বলতে পারে, সেটা ছিলো সোনার হরিণ। কিন্তু আপনার কমনসেন্স কী বলে, সোনার হরিণ বলে কি কিছু হয় ? রাম সীতার হরিণের মাংস খাওয়াকে আড়াল করার জন্য আমাদের নিরামিষভোজী রামায়ণ অনুবাদকেরা বাস্তব হরিণকে সোনার হরিণ বানিয়ে দিয়ে আমাদের চোখে ধুলা দিয়েছে, আর সেই ধুলাকে এখন পর্যন্ত আমরা চোখ থেকে সরাতে পারি নি।

যা হোক, এটা পরিষ্কার যে, সীতা হরিণের মাংস খাওয়ার জন্যই রামকে হরিণ ধরে আনতে বলেছিলো এবং রাম সীতা লক্ষণ যে বনে পশুর মাংস খেতো, সেটা মূল রামায়ণের অন্তত ১৫ জায়গায় বলা আছে, যেটা একটু আগেই আপনারা জেনেছেন। তাছাড়া এটাও জেনেছেন যে, মনুসংহিতা অনুসারে ক্ষত্রিয়দের জন্য সমস্ত রকম পানাহার ছিলো বৈধ, তাই এটা ভুলে যাবেন না যে, রাম ছিলো ক্ষত্রিয় এমনকি কৃষ্ণও ছিলো ক্ষত্রিয়, তাই তাদের খাদ্যের মেনুটা কীরকম ছিলো, সেটা একটু কল্পনা করে নিন। শুধু তাই নয়, সংস্কৃত মহাভারতের অনেক জায়গায় পাণ্ডবদের মাংস খাওয়ার অনেক ঘটনা আছে এবং যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞে আমন্ত্রিত অতিথিদের জন্য মাংস খাওয়ার প্রভূত ব্যবস্থা ছিলো, সেখানে নিমন্ত্রিত ছিলো কৃষ্ণও। এছাড়াও এক জায়গায় কৃষ্ণ ও অর্জুন মিলে বনে গিয়ে শিকার করছেন, এমন বর্ণনাও আছে।

এখন দেখা যাক, গীতায় খাবার সম্পর্কে কী বলা আছে ?

গীতার ১৭/৮ শ্লোকে বলা আছে,

“আয়ুঃসত্ত্ববলারোগ্যসুখপ্রীতিবিবর্ধনাঃ।
রস্যাঃ স্নিগ্ধাঃ স্থিরা হৃদ্যা আহারাঃ সাত্ত্বিকপ্রিয়াঃ।।”

এর অর্থ – আয়ু, বল, রোগহীনতা, চিত্ত প্রসন্নতা ও রুচি বর্ধনকারী রসযুক্ত, স্নিগ্ধ, এবং প্রীতিকর খাদ্য সা্ত্ত্বিক ব্যক্তিগনের প্রিয়।

এখানে কি বলা আছে যে, সাত্ত্বিক মানে নিরামিষ খাবার ? এখানে শুধু সাত্ত্বিক খাবারের বৈশিষ্ট্যের কথা বলা হয়েছে এবং কোন ধরণের খাবার সাত্ত্বিক লোকজন পছন্দ করেন সেই বিষয়ে বলা আছে।

এরপর দেখুন রাজসিক আহার বলতে কী বোঝানো হয়েছে,

“কট্বম্ললবণাত্যুষ্ণতীক্ষ্ণরূক্ষবিদাহিনঃ।
আহারা রাজসসেষ্ট্যা দুঃখশোকাময়প্রদাঃ।।” (১৭/৯)

এর অর্থ – অতি কটু, অতি অম্ল, অতি লবনাক্ত, অতি উষ্ণ, তীক্ষ্ণ বিদাহী এবং দুঃখ, শোক ও রোগ উৎপাদনকারী।

এখন আপনারাই বলেন, এই ধরণের খাবার কি সাধারণত কেউ খায় ? আর এখানেও কি বলা আছে যে রাজসিক খাবার কী কী ? এরপর দেখুন তামসিক আহারের ব্যাপারটা আসলে কী ?

“যাতযামং গতরসং পূতি পর্যুষিতং চ ষৎ।
উচ্ছষ্টমপি চামেধ্যং ভোজনং তামসপ্রিয়ম্।।” (গীতা, ১৭/১০)

এর অর্থ – যে খাদ্য অনেক আগে রান্না করা হয়েছে, যার রস শুকিয়ে গেছে, যা দুর্গন্ধযুক্ত, বাসী, উচ্ছিষ্ট ও অপবিত্র, তা তামসিক ।

এখন আপনারাই বলেন, এই ধরণের খাবার কি সাধারণত কেউ কখনো খায় ? আর এখানেও কি বলা হয়েছে, তামসিক খাবার কোনগুলো ? এখানেও শুধু তামসিক খাবারের বৈশিষ্ট্যের কথা ই বলা হয়েছে।

আপনারা অনেকেই জানেন, স্বামী বিবেকানন্দ ১৮৯৩ সালে আমেরিকার শিকাগোতে যে বিশ্ব ধর্মসম্মেলন হয়েছিলো, তাতে যোগ দিতে আমেরিকায় গিয়েছিলেন। সেই সময় চার বছর তিনি আমেরিকায় ছিলেন, সেই সময় যাদের বাড়িতে তিনি আশ্রয় পেয়েছিলেন, তারা যা খেতো, স্বামীজীকেও তাই খেতে হতো। অনেকেই জানেন যে, হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে খাওয়া নিয়ে অনেক বাছ বিচার থাকলেও খ্রিষ্টানদের মধ্যে তা নেই, তারা গরু শুয়োর সহ যা খাওয়া যায়- সবই খায়, স্বামীজীকেও সেই চার বছর সেই সব খাবারই খেতে হয়েছিলো। আমেরিকায় এবং পরে ইউরোপ ভ্রমণের সময় স্বামীজী এসব খাবার খেলেও দেশে ফিরে তিনি কখনো হিন্দু শাস্ত্রে নিষিদ্ধ কোনো খাবার খান নি। কিন্তু তিনি কখনো নিরামিষভোজীও ছিলেন না, মাছ মাংস খেয়ে গেছেন জীবনের শেষ পর্যন্ত। শাস্ত্র না পড়েই যারা মনে করেন যে, হিন্দু ধর্মে নিরামিষ খাবারের কথা বলা আছে, তাদেরকে জিজ্ঞেস করছি, আপনার কি মনে হয়, হিন্দু শাস্ত্র সম্পর্কে স্বামীজীর কম জ্ঞান ছিলো ? স্বামীজী জানতেন যে, হিন্দু শাস্ত্রে কোথাও নিরামিষ খাবারের কথা বলা নেই, তাই তিনি নিরামিষ খেতেন না, শুধু তাই নয়, স্বামীজী আরো জানতেন যে, নিরামিষ খাবারের কুফল কতটা, তাই তিনি বলেছেন,

“অহিংসার নামে অস্ত্র ত্যাগ এবং নিরামিষ আহার হিন্দু জাতির পতন ও হাজার বছরের পরাধীনতার অন্যতম কারণ।”

নিরামিষ ভোজী বড় জোর একটা হাতি হতে পারে, যে হাতির অনেক শক্তি থাকা সত্ত্বেও তাকে কেউ বনের রাজা বলে না, যে হাতিকে মাহুত লোহার অঙ্কুশ দিয়ে খোঁচা মারতে পারে আর তাকে নিজের মতো করে চালনা করতে পারে। কিন্ত বনের রাজা হয় আমিষ ভোজী বাঘ বা সিংহই, যাকে নিজের মতো করে চালনা করার কথা কেউ ভাবে না।

লড়াইয়ের ময়দানে শত্রুর সাথে যুদ্ধ করতে গেলে যে ক্ষিপ্রতা, সাহস ও তাৎক্ষণিক তীক্ষ্ণ বুদ্ধির দরকার তার জন্য আমিষ বা এ্যানিমাল প্রোটিন একান্তভাবে দরকার। একারণে পৃথিবীর কোনো দেশের সামরিক বাহিনীতে নিরামিষের কোনো স্থান নেই।

তাই আমি মনে করি, নিরামিষ প্রথার স্থান কোনো বাড়িতে হওয়াও উচিত নয়, যদি আমরা নিজেরা লড়াই করে টিকে থাকতে চাই। আর যদি আপনি মার খেতে চান, দেশ থেকে বিতাড়িত হতে চান বা মরতে চান, তাহলে আপনার জন্য চৈতন্যদেবের আদর্শ এবং নিরামিষ খাবারই উত্তম। এখন সিদ্ধান্ত আপনার, আসলে আপনি কী চান ? টিকে থাকতে চান, বাঁচতে চান; না মার খেতে, বিতাড়িত হতে এবং মরতে চান ?

পরিশিষ্ট :
আমি জানি, এই পোস্ট পড়েও কিছু লোক আমার ঘোর সমালোচনা করবে; কারণ, তারা বিচার মানে, কিন্তু তাল গাছের অধিকার ছাড়ে না, তাই এইসব ব্যক্তিদের বিরোধিতায় আমার কিছুই যায় আসে না; কারণ, সত্যকে তুলে ধরার জন্যই আমার জন্ম এবং আমি তা করে যাবো। তবুও, যারা আমার বিরোধিতা করবে, তাদের উদ্দেশ্যে বলছি, প্রচলিত বিশ্বাসকে গড়পরতায় আঁকড়ে না ধরে, আমার কোন তথ্যটি মিথ্যা, পারলে সেই বিষয়টিকে নির্দেশ করুন। আর একটা কথা মনে রাখবেন, যারা হিন্দু সমাজ ও ধর্মের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখতে চায়, তারা আমার মতোই কথা বলতে বাধ্য।