কাশ্মির ও বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম কি একই রকম ইস্যু?

কাশ্মির ও বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম কি একই রকম ইস্যু?

এই আলোচনা যাবার আগে একটা সংবাদ দেই, গতকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মিছিল করেছে ‘আজাদ কাশ্মিরের’ দাবীতে। তারা বলেছে কাশ্মিরীরা তাদের ভাই, এই ভাইদের উপর ভারত জুলুম করছে- তারা এর প্রতিবাদ করছে…। কাশ্মিরীদের ভাই বলছে কারণ তারা মুসলমান। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যখন এরকম মুসলিম জাতীয়তাবাদ ধারণ করে তখন একটা দেশের উপরের স্তরের বুদ্ধিভিত্তিক অবস্থাটা কি রকম সেটা বুঝা যায়। পাকিস্তান আমলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রগতিশীল সেক্যুলার অবস্থানই ৭২ সালের সংবিধান রচনা করার সাহস ও আস্থা তৈরি করেছিলো। ফিলিস্তিন বা কাশ্মির ইস্যুতে ঢাবিতে আগেও মিছিল হয়েছে। সবটাই ঘটেছে মুসলিম জাতীয়তাবাদী অবস্থান থেকে। এই মিছিলকারীরা কখনই বাংলাদেশের পাহাড়ে আদিবাসীদের উপর চলা বছরের পর বছর অন্যায়, ভূমি দখল আর আর্মি শাসনের বিরুদ্ধে টু শব্দটি পর্যন্ত করেনি। উল্টো আর্মি আর ৩৬৫ দিন ধরে চলা কারফিউ পক্ষে তাদের কথা হচ্ছে, আর্মি না থাকলে চাকমারা বান্দরবান খাগড়াছড়ি রাঙ্গামাটি বিচ্ছিন্ন করে ফেলবে…।

এবার লেখার মূল পয়েন্টে আসি। বাংলাদেশের পাহাড়ে বাংলাদেশের যে কোন নাগরিকের জমি কেনা বেচার অধিকার আছে। আইনত বাঙালী পাহাড়ী বা অন্য জাতি সম্প্রদায়ের মাঝে বিয়েও নিষিদ্ধ নয়। বাংলাদেশের প্রচলিত আইন আদিবাসী পাহাড়ীদের জন্য পর্যজ্য নয়- এরকম কোন ধারাও বাংলাদেশের সংবিধানে নেই। বাংলাদেশের আদিবাসী পাহাড়ীরা কখনই বলে না- এখানে কেবল পাহাড়ীরাই থাকবে। এখানকার জমি কেবল তাদের মালিকানাই বজায় থাকবে- এরকম কোন আইন সেখানে কোনদিন ছিলো না। বা এরকম আইন আজ বাতিল হয়ে যাওয়ায় তারা মাথা চাপড়ে বলছে না তাদের অস্তিত্ব ধ্বংস হয়ে যাবে। তারা বলছে না এজন্য তারা যদি বিচ্ছিন্নতাবাদ শুরু করে দেয় তাহলে তাদেরকে দোষ দেয়া যাবে না।

কাশ্মিরে ঠিক এ রকম নিয়ম আর আইন এতদিন ধরে চলেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে ‘শান্তি বাহিনী’ গড়ে উঠেছিলো ভূমির অধিকার ফিরে পেতে। বাংলাদেশের পাহাড়ীরা অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিলো যখন তাদের জমি সরকার দখল করে নিয়েছিলো। সেটেলার বাঙালীদের যখন পাহাড়ী পল্লিতে পুশ করে দেয়া হয়েছিলো সরকার থেকে, যখন পাহাড়ীদের গ্রামে জমি যা বহু শতাব্দী থেকে গ্রাম মোড়লের অধিনে থেকে তারা গোষ্ঠিবদ্ধভাবে আবাদ করে আসছিলো, সেখানে ইচ্ছে করে জোর খাটিয়ে বাঙালীদের প্রবেশ করিয়ে তাদের শান্তি ভঙ্গ করেছিলো বাংলাদেশ। অপপ্রচার চালিয়ে ছিলো পাহাড়ে বাংলাদেশীদের জমি কেনার কোন অধিকার চাকমা মারমারা মানতে চায় না। বাংলাদেশের ৯৫ ভাগ শিক্ষিত অশিক্ষিত মানুষ এখনো এমনটাই জানে এবং সেই দরূণ প্রচন্ডভাবে তারা পাহাড়ী বিদ্বেষী। আসল সত্য হচ্ছে পাহাড়ে যে কেউ জমি কিনতে পারে। কিন্তু পৃথিবীতে কোন দেশই কি অন্যের জমি দখলকে স্বীকৃতি দেয়? যদি ইজরাইল অবৈধ বসতি স্থাপন করে থাকে তাহলে পাহাড়ে সরকারীভাবে সেটেলার বাঙালী অনুপ্রবেশকে কি বলবেন?

বাংলাদেশের আদিবাসী পাহাড়ীরা নিজেদের জন্য আলাদা পতাকার দাবী করেনি। বাংলাদেশী হিসেবে নিজেদের মেনে নিতে তাদের কোন সমস্যা নেই। পাহাড়ে তাদের অধিকার, ঐতিহ্য অটুট থাকলে তাদের বাংলাদেশ নিয়ে কোন সমস্যা নেই। ‘শান্তি চুক্তি’ নামে বাংলাদেশের পাহাড়ে যেটা হয়েছিলো তার কোন ধারাই আজ পর্যন্ত মানা হয়নি। অনেক শতাব্দী ধরে চলা পাহাড়ীদের জমি অধিকারকে অস্বীকার করে বাঙালী সেটেলারদের দিয়ে জবরদখল দেখেও যারা নির্বিকার থাকে তারাই আজ এদেশে কাশ্মিরের স্বায়ত্বশাসনের দাবীতে মুখর! কাশ্মিরের অবস্থা কখনই বাংলাদেশের পাহাড়ের চেয়ে খারাপ ছিলো না। কাশ্মিরের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মুসলমান। কাজেই সেখানকার স্থানীয় শাসনতন্ত্র এই মুসলমানদের নিয়েই গঠিত হত। চাকরিতে তাদের সংখ্যাই বেশি হত। ভারত কোনদিন তাদের আলাদা দেশ হিসেবে ছেড়ে দিবে না। তারচেয়ে ভারতে থেকে, ভারতের একটি রাজ্য হয়ে ভারতের আইন সংবিধান মেনে নিজেদের বিকাশ করলে কাশ্মিরীদের কোন সমস্যা ছিলো না। ৪৭ সালে দেশভাগের সময় কি কথা হয়েছিলো- সেটা ধরে কোনদিন তাদের স্বাধীনতা আসবে না। পাকিস্তান কিংবা ভারত- কেউ কোনদিন কাশ্মিরকে ছেড়ে দিবে না। সে অর্থে কাশ্মিরের মঙ্গল তাদের হাতেই রয়েছে। কারণ তারা সেখানকার সংখ্যাগুরু। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রাম তথা বাংলাদেশের আলাদা ব্যাপার। বাংলাদেশ মূলত বাঙালী মুসলমানদের দেশ। এখানে পার্বত্য চট্টগ্রামে কখনই স্বায়ত্বশাসন পাবে না আদিবাসীরা। আমরা কেউ তা চাইও না। ছোট একটা দেশে সবাই মিলেমিশে থাকুক। তাদের ভূমির অধিকার আর নাগরিক সুবিধাটুকু পেলেই তারা নিজেদের খাবার নিজেরাই আবাদ করে নেয়। কাশ্মির দরদী বাংলাদেশীদের ফিলিস্তিন, কাশ্মির নিয়ে কান্নাকাটি করার আগে প্রথমে আয়নায় তাদের নিজেদের চেহারা দেখে নেয়া ভালো…।