ব্যারিস্টার সুমনের মত স্বঘোষিত হিন্দু প্রেটেকশনধারীদের পক্ষে কখনই এসব বুঝা সম্ভব হবে না।

মনে করেন আনা ফাঙ্ক একজন হিন্দু কিশোরী। সে ডাইরি লিখেছে ধরুন, ৯০-এর বাবরী মসজিদ ভাঙ্গাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে পাইকারী হারে মন্দির ভাংচুর আর হিন্দুদের বাড়ি-ঘরে হামলার যে ঘটনা ঘটেছিলো, রাত জেগে পাহাড়া বসত হিন্দু বাড়িতে, বাড়ির মেয়েদের নিয়ে সর্বদা ভীত থাকত বাড়ির কর্তারা, পরিস্থিরি ভয়াবহতায় অনেক মুসলমান পর্যন্ত হিন্দু বাড়ি পাহাড়া দিতে এসেছিলো- মনে করুন সেই ঘটনাপুঞ্জগুলো আনা ফ্রাঙ্কের মত বাংলাদেশী কোন হিন্দু কিশোরী ডাইরিতে লিখে তা প্রকাশ করল- কি ঘটত বলুন তো?

কি ঘটত তার ইতিহাস আমাদের কাছে আছে। ৯০-এর হিন্দুদের উপর বাংলাদেশী মুসলিমদের সাম্প্রদায়িক আক্রমনের উপর লেখা তসলিমা নাসরিনের উপন্যাস ‘লজ্জ্বা’ লেখার কারণেই লেখিকা দেশছাড়া হন এবং বাংলাদেশের মেয়ে হয়েও এদেশে প্রবেশ তার জন্য আজ পর্যন্ত নিষিদ্ধ। লজ্জা লেখার পর সবাই ক্ষুব্ধ হয়ে গিয়েছিলো। হিন্দু বাড়ি পাহাড়া দেয়া লোকটিও ক্ষ্যাপে গিয়েছিলো। এরকম লোকগুলো বলছিলো, আমরা এদেশে যেভাবে হিন্দুদের প্রেটেকশন দিয়ে রাখি ভারতে মুসলিমদের হিন্দুরা তো কচুকাটা করে ফেলে…। প্রিয়া সাহার বক্তব্যের পর ব্যারিস্টার সুমনও একই রকম করে লাইভে এসে বললেন, আমরা (মুসলমানরা) বাংলাদেশে হিন্দুদের প্রটেকশন দিয়ে রাখি, তাদের বাড়িতে দাওয়াত দিলে খেতে যাই- আর আমরা নাকি তাদের নির্যাতন করি, এটা দেশদ্রোহিতা…।

বাংলাদেশের গতকালের সমস্ত টকশোতে এটাই প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে- এদেশে সে অর্থে কখনই সংখ্যালঘু সমস্যা নেই, টুকটাক যা হয় তেমনটা পৃথিবীর সবখানেই ঘটে, বরং বাংলাদেশে এসব একদমই কম। খুশি কবীর, আবুল মকসুদ দু:খ করে বললেন, সম্পূর্ণ বানোয়াট দাবী করেছে প্রিয়া সাহা…।

১৯৪৭ সালে এদেশে হিন্দু জনগোষ্ঠি ছিলো ৩০ শতাংশ। এতগুলি বছরে ৩৭ মিলিয়ন হিন্দু এদেশ ছেড়ে চলে গেছে। কিভাবে গেছে? আনা ফ্রাঙ্কের ডাইরিকে বিশ্ব বিবেক শ্রদ্ধাভরে গ্রহণ করে এই বিশ্বকে মানবিক হতে বলেছিলো। আর এখানে সেরকম কোন কাহিনী লিখলে তাকে ‘সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্টের জন্য দায়ী করা হয়। বদরুদ্দিন উমার দাবী করেছিলেন, ৯০-এ বাংলাদেশে বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ছাড়া হিন্দুদের উপর কোন ফুলের টোকাও পড়েনি! বাংলাদেশের কোন সাহিত্যিক ৯০-এ রাত জেড়ে হিন্দু বাড়ি পাহাড়া দেয়া, হিন্দু যুবতী মেয়েদের তড়িঘড়ি করে ভারতে আত্মীয়ের বাড়িতে রেখে আসা, দিনদুপুরে হিন্দু জমিজমা দখল, বাড়িতে আগুন, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলার মত ঘটনা ঘটলেও সেসব তাদের গল্পের প্লট হিসেবে কোনদিন উঠে আসেনি…।

বাংলাদেশে ‘ভালো মুসলমানরা’ আক্ষেপ করে বলে, আমরা এদেশে হিন্দুদের যে নিরাপত্তাটা দেই সেটা আর কোথাও দেখা যাবে না…’। অসভ্য সংস্কৃতির মানুষ জানে না একজন মানুষ তার নিজ দেশে ‘প্রেটেকশনে’ থেকে আর যাই হোক, নিজেকে স্বাধীন মনে করতে পারে না। অন্যের দয়ায়, অন্যের দেশে থাকার মত ফিলিংস নিয়ে আত্মমর্যাদার জীবন কাটানো যায় না। ব্যারিস্টার সুমনের মত স্বঘোষিত হিন্দু প্রেটেকশনধারীদের পক্ষে কখনই এসব বুঝা সম্ভব হবে না। বাংলাদেশে এতদিন সংখ্যালঘু নির্যাতনের সময় যাদের কথা বলতে দেখতাম, সেসব মুখগুলো গতকাল থেকে বলা শুরু করেছে, প্রিয়া সাহা কারোর এজেন্ট হয়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে নিয়োজিত কিনা সেটা ভাবার বিষয়…। এর আগে তসলিমা নাসরিনের বিরুদ্ধে ভারতের হিন্দুত্ববাদীদের কাছ থেকে অর্থ নিয়ে ‘লজ্জ্বা’ উপন্যাস লেখার দাবী করেছিলো ঢাকার সংস্কৃতি-সাহিত্য সর্দাররা।

শাহরিয়ার কবীর বিএনপি জামাত ক্ষমতায় থাকার সময় “শ্বেতপত্র বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের ১৫০০ দিন” নামে একটি গবেষণাপত্র বের করেন যেখানে ভয়াবহ হিন্দু নিপীড়ন, ধর্ষণ, হত্যা, দেশত্যাগে বাধ্য করার মত অসংখ্যক ঘটনার প্রামাণ্য তুলে ধরা হয়। ইন্টারনেটে এখনো এই গবেষণাটি পাওয়া যায়। সেই শাহরিয়ার কবীর প্রিয়া সাহার সেদিনের বক্তেব্যের পর বলছেন, এটি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক চক্রান্ত কিনা বের করা দরকার…। প্রিয়া সাহা ৩ কোটি গুম হয়ে গেছে বলাটাই যদি প্রধান হয়ে থাকে তাহলে সেটা নিয়ে এত হৈ চৈ করার কি আছে? ইংরেজিতে ভুল সবারই হতে পারে। আর যদি আপনি মনে করেন এদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন বলতে কিছু ঘটে না তাহলে প্রিয়া সাহাকে এনে ফাঁসি দেন কিংবা তসলিমার মত আজীবনের মত দেশছাড়া করে রাখুন…। সবাই জানুক, এদেশে চরমোনাই, আহমদ শফীর দেশ।

Scroll to Top