আজও বোমা বন্দুকের শব্দের মাঝেও সন্ধ্যা নামলে ইরাকের বুকে শোনা যায় শঙ্খের মত শব্দ, ঘন্টাধ্বনী। (ইয়াজিদি)

তাইগ্রিস ও ইউফ্রেতিস নদী বিধৌত প্রাচীন মেসোপটেমিয়া অর্থাৎ অধুনা ইরাক অতি প্রাচীন সভ্যতার লীলাভূমি। উপত্যকার উত্তর ভাগে নিনেভ ও নিমরুদে ছিল অ্যাসিরিয় সভ্যতা ও দক্ষিণ ভাগে উরে সুমেরু সভ্যতা।

ইরাকে ইসলামের প্রবেশের পর প্রাচীন ধর্মীয় ও সামাজিক বৈচিত্র প্রায় সম্পূর্ণ লুপ্ত হয়। তবু যে কয়েকটি প্রাচীন জনগোষ্ঠী ইসলামের প্রভাব থেকে নিজেদের মুক্ত রেখে আজও সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে তাদের মধ্যে অন্যতম হল ইয়েজিদি সম্প্রদায়। উত্তর পশ্চিম ইরাকের সিরিয়া সংলগ্ন পার্বত্য নিনেভ প্রদেশে প্রধানত ইয়েজিদিদের বসবাস। ইয়েজিদি শব্দটি এসেছে ফার্সি ‘ইজদ’ থেকে, যার অর্থ হচ্ছে দেবদূত বা দেবতা। তা থেকে ইয়েজিদি শব্দের সাধারণ অর্থ হচ্ছে, ‘ঈশ্বরের উপাসক’। এরা জাতিতে কুর্দিশ।

ধর্মীয় বিদ্বেষের কারনে ইয়েজিদিরা স্বদেশ ছেড়ে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছে। ইসলামিক স্টেট জঙ্গীদের হাতে সাম্প্রতিক কালে ইয়েজিদিরাই সবথেকে বেশী নৃশংসতার শিকার হয়। ইরাকে ৬ লাখ ৫০ হাজার, জার্মানিতে ৬০ হাজার, সিরিয়ার ৫০ হাজার, রাশিয়ায় ৪০ হাজার ৫৮৬, আর্মেনিয়ায় ৩৫ হাজার ২৭২, জর্জিয়ায় ২০ হাজার ৮৪৩, সুইডেনে ৪ হাজার, তুরস্কে ৩৭৭, ডেনমার্কে ৫০০ মিলে ইয়েজিদি সম্প্রদায়ের মানুষ সাকুল্যে ৭ লাখের বেশি নয় এ পৃথিবীতে।

ইসলামি দুনিয়ায় ইয়েজিদিরা রহস্যময় জাতি হিসাবে পরিচিত। তাদের শয়তানের উপাসক বলা হয়ে থাকে। প্রকৃতপক্ষে ইয়েজিদিদের ধর্মীয় আচার ইসলামপূর্ব সনাতন ধর্ম ও পারস্য অর্থাৎ ইরানের অগ্নি উপাসক ধর্মের সাথে বহুলাংশে সামঞ্জস্যপূর্ণ। ইসলামের সাথেও এর কিছু সাদৃশ্য আছে। তবে প্রকৃতপক্ষে মুসলিমরা তার পূর্ববর্তী যে সকল নিয়ম নিজেদের মধ্যে গ্রহণ করেছে, সেগুলিই ইয়েজিদিদের মধ্যে চলে আসছে।

ইয়েজিদিদের সাথে সনাতন হিন্দু ধর্মের মিল অনেক।

● ইয়েজিদিরা ময়ূর আকৃতির প্রদীপ জ্বালিয়ে ময়ূরমূর্তিতে চুম্বন করে অর্চনা করেন। ইয়জিদিদের প্রধান আরাধ্য দুই পাখনা মেলা ময়ূর দেবতা তাউস মেলেক। কিন্তু ইরাকের ত্রিসীমানায় ময়ূর পাওয়া যায় না। নিকটতম ময়ূরের বসতি পাকিস্তানে। ভারতেই ময়ূর আকৃতির প্রদীপ জ্বালানোর প্রথা প্রচলিত। ময়ূরের সাথে কার্তিকেয় ও শ্রীকৃষ্ণের যোগসূত্র আছে। ময়ূর ইয়াজিদিদের ও প্রধান দেবতার প্রতীক!

● ইয়াজিদিদের মন্দিরের সাথে মিশরের প্রাচীন মূর্তিপূজকদের স্থাপত্যের মিল আছে, আবার ভারতীয় মন্দির স্থাপত্যের গোপুরমের সাথেও আশ্চর্য মিল।

● ইয়াজিদিদের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় কর্তব্য হল ইরাকের উত্তর মসুলের লালিশ মন্দিরে জীবনে এক বার অন্তত যাওয়া। এই মন্দিরে একটি চিত্র আছে, যেখানে দেখা যায় ময়ূর দেবতার সামনে শাড়ি পরিহিতা এক রমনী। ঐরূপ শাড়ি পরিহিতা নারী ইরাক থেকে কয়েক হাজার মাইল দূরে ভারতেই দেখা যায়।

● লালিশ মন্দিরের প্রবেশ পথে সর্পের প্রতীক আছে। এটি হিন্দুদের মধ্যেই সহজলভ্য। অবশ্য লাতিন আমেরিকার প্রাচীন সভ্যতাতেও এর সন্ধান মেলে।

● ইয়াজিদিরা হিন্দুদের মত সূর্যের উপাসনা করে।

● থালায় প্রদীপ সাজিয়ে ইয়াজিদিরা হিন্দুদের মত আরতি করে।

● নিভেজা বেরিস্পেদে অর্থাৎ ভোরের প্রার্থনা ও নিভেজা রোজাভাবুনে অর্থাৎ সূর্যাস্তের প্রার্থনায় তাদের দেবালয় থেকে হিন্দু মন্দিরের মত শঙ্খ-ঘন্টা-উলুধ্বনী পাওয়া যায়। শঙ্খ তারা বাজায় না, তবে নিজস্ব বাদ্যযন্ত্রে ফুঁ দিয়ে শঙ্খের মত আওয়াজ করে। মন্দিরে প্রদীপ জ্বালায়। যজ্ঞের মত আগুন জ্বালায়।

● তারা হিন্দুদের নমস্কারের মত দেবতার সামনে হাত জোড় করে।

● তারা হিন্দু দর্শনের জন্মান্তর বিশ্বাস করে।

● তারা বৈষ্ণবদের মত কপালে তিলক কাটে।

এই রকম অজস্র মিল।

ইয়েজিদিদের সাথে হিন্দুদের কোনো প্রাচীন যোগসূত্র আছে কিনা তা জানা নেই। ইরাক আরব ভূখন্ডের পূর্বতম অংশ। প্রকৃতপক্ষে ভারত ও ইরাকের মধ্যে একটি মাত্র দেশ আছে : পারস্য বা ইরান। পাকিস্তান ও আফগানিস্তান ভারতেরই বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া অংশ। ইরাকের ইয়াজিদিদের ধর্মমত পারস্যের অগ্নি উপাসক জরাথ্রুষ্ট্র অনুসারিদের ও ভারতীয় হিন্দু ধর্মের প্রভাবে পুষ্ট। আজ থেকে প্রায় দুই থেকে আড়াই হাজার বছর আগে হিন্দু ও বৌদ্ধ মতবাদ পারস্য ও আরবভূমি অতিক্রম করে সিনাই সহ উত্তর মিশর অবধি পৌঁছে গেছিল। মিশরের আলেকজেন্দ্রিয়া ছিল হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের অন্যতম চর্চা কেন্দ্র। এর স্বপক্ষে প্রচুর প্রমানও আছে। কে বলতে পারে, হয়ত সেই সময়কার হিন্দু ধর্মের প্রভাব আজও ইয়াজিদিদের রক্তে।
সম্পর্ক আরো প্রাচীন হতে পারে।

সেই হরপ্পা মহেঞ্জোদারোর যুগের। হরপ্পার সাথে যে ইরাক তথা প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার সংযোগ ছিল, তা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। মেসোপটেমিয়ার অক্কাদীয় রাজা সারগনের সময় ভারতের নিম্ন সিন্ধু উপত্যকার মেলুহের সাথে বাণিজ্য চলত এবং বিভিন্ন মূল্যবান দ্রব্যাদির পাশাপাশি ময়ূর আমদানি করা হত। আন্তর্জাতিক বাজারে ভারতীয় ময়ূরের যে বিপুল কদর ছিল,তাঁর প্রমান পরবর্তীতেও পাওয়া যায়। ভারতে আগমনের পর গ্রিক রাজা আলেকজান্ডার ময়ূরের সৌন্দর্যে মোহিত হয়েছিলেন এবং তিনি ভারতীয় ময়ূর ম্যাসিডোনিয়ায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন।

গ্রিক দেবী হেরার সাথে ময়ূরের যে সম্পৃক্তকরন লক্ষ্য করা যায়,তা আসলে ভারত থেকে গ্রিসে ময়ূর আমদানীর প্রমান বহন করে। বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্ট অধ্যায় থেকেও ভারতীয় ময়ূরের চাহিদার কথা জানা যায় এবং রাজা সলোমন ভারতীয় ময়ূরের বিশেষ ভক্ত ছিলেন- এই তথ্যও পাওয়া যায়। সুতরাং প্রাচীন ভারতের সাথে ইয়েজিদি সম্প্রদায়ের যোগাযোগের বিষয়টি বেশ স্পষ্ট। হরপ্পার বেশ কিছু মৃৎপাত্রে ময়ূরের চিত্র পাওয়া গেছে। এর মধ্যে একটিতে দেখা যায় যে, একটি ময়ূর এক ক্ষুদ্র মনুষ্য দেহকে সাথে নিয়ে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে উড়ে যাচ্ছে।আপাত সাধারণ এই ছবিটির ধর্মীয় প্রেক্ষিতে ব্যাপক ব্যঞ্জনা আছে। ময়ূরকে এখানে স্বর্গে উত্তরণের মাধ্যম হিসেবে দেখানো হয়েছে বলাই যেতে পারে।

যদি ‘আলোকময় জগৎ’কে স্বর্গ রূপে অভিহিত করার বিষয়টি নিয়ে দ্বিমত থাকে,তাহলে একে জ্ঞানের প্রতীক রূপে অভিহিত করাই যেতে পারে। অন্যদিকে ইয়েজিদিরা তো বিশ্বাস করে যে ময়ূররুপী তাউসি মেলেক মানুষের মন থেকে অজ্ঞানতা দূরীভূত করে তাকে জ্ঞানের আলোকে উদ্ভাসিত করে। ভারত-ইয়েজিদি সম্পর্কের প্রাচীনতা এর থেকে স্পষ্ট হচ্ছে বলেই মনে হয়।

ইরাকে ইসলামের বিজয়রথ প্রবেশের পর
থেকেই সুপ্রাচীন এই মূর্তিপূজক গোষ্ঠী অসংখ্য গণহত্যার শিকার হয়েছে। আসলে পশ্চিম এশিয়ার অন্যান্য মূর্তিপূজক ধর্মগুলিকে ইসলাম সমূলে উৎপাটিত করতে সক্ষম হলেও, ইয়েজিদিরা সম্পূর্ণভাবে কোনদিন তাদের বশ্যতা স্বীকার করেনি আর এটাই ইসলামিক ইরাকের কাছে অত্যন্ত শ্লাঘার বিষয়। তাই বারবার ইয়েজিদিদের ওপর আঘাত নেমে এসেছে; কখনও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে আবার কখনও ধর্মগুরুদের মাধ্যমে।

অটোমান সাম্রাজ্যের কাল থেকে হালফিলের সাদ্দাম হুসেনের আমল কখনই ইয়েজিদি নির্যাতনে ছেদ পড়েনি। সাদ্দাম হুসেনের সময়কালে ইয়েজিদিরা বাস্তুচ্যুত হয়েছিল। সাদ্দামের সময় কুর্দ জনজাতি স্বাধীন ‘কুর্দিস্তান’এর দাবীতে আন্দোলন শুরু করেছিল এবং বহু সংখ্যক ইয়েজিদির বাস ছিল এই কুর্দিস্তানে। তাই স্বাধীনতাকামী আন্দোলনকে প্রতিহত করার যুক্তিতে সাদ্দামের সরকার বিপুল সংখ্যক ইয়েজিদিদের উৎখাত করেছিল ও পরবর্তীতে তাদের সরকার নিয়ন্ত্রিত ‘খাতানিয়া’ নামক হাউসিং কমপ্লেক্সে পুনর্বাসন দেওয়া হয়। ফলে এই সম্প্রদায় সম্পূর্ণ ভাবে সরকারের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়তে বাধ্য হয়। সবচেয়ে বিস্ময়কর দিকটি হল যে ইয়েজিদিরা কখনই নিজেদের কুর্দ রূপে পরিচয় দেয় না এবং প্রতিবেশী ইসলাম ধর্মালম্বী কুর্দদের থেকে তারা যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রাখে। সর্বোপরি এই বিচ্ছিন্নতাকামী আন্দোলনে ইয়েজিদিরা ছিল নিরপেক্ষ। আসলে ইয়েজিদিদের জীবন-যাপন সরকারী নিয়ন্ত্রনে আনার মাধ্যমে তাদেরকে ইসলামে দীক্ষিত করার প্রয়াস নেওয়া হয়েছিল, যা একদমই ফলপ্রসূ হয়নি।

ইয়েজিদি মতাদর্শকে ইসলামের বিপথগামী শাখা রূপে উল্লেখ করতে থাকেন ইসলামি পন্ডিতরা। অস্বীকার করার উপায় নেই যে ইয়েজিদি মতাদর্শে সুফি মতের কিছুটা প্রভাব রয়েছে।

তবে কখনই ইয়েজিদিদের ইসলামের শাখা হিসেবে গণ্য করা যায় না এবং ইসলামের চেয়েও এই মতাদর্শ অনেক প্রাচীন। নিছক সাদৃশ্যের প্রেক্ষিতে যারা ইসলাম ও ইয়েজিদি দর্শনকে সমজাতীয় রূপে গণ্য করেন,তাদের আদতে পশ্চিম এশিয়ার প্রাচীন ধর্মমতগুলি সম্পর্কে তেমন ধারনা নেই। কারন খ্রিস্টীয় মতাদর্শের ন্যায় ইসলামও তাঁর প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক কালে, আরব অঞ্চলের প্রাচীন বহু দেব-দেবী কেন্দ্রিক ধর্মগুলিকে যেমন বলপূর্বক উৎখাত করেছিল তেমনই সেগুলি থেকে বেশ কিছু উপাদান সংগ্রহ করেছিল।

বর্তমানে ইসলামে রোজা পালনের যে রীতি রয়েছে, ঠিক প্রায় একই প্রকার উপবাস পদ্ধতি ইসলামের আবির্ভাবের বহুকাল আগে থেকেই মূর্তিপূজারী প্রাচীন আরবীয়দের মধ্যে প্রচলিত ছিল। তাই ইয়েজিদি মতের বেশ কিছু যে ইসলাম অনুকরণ করেছে এমনটাই বাস্তব।

অতীত যাই হোক, ঘটনা হল আজও বোমা বন্দুকের শব্দের মাঝেও সন্ধ্যা নামলে ইরাকের বুকে শোনা যায় শঙ্খের মত শব্দ, ঘন্টাধ্বনী। দেবতার সামনে আরতি হয়। নীলনয়না মেয়েরা উলুধ্বনি দেয়। মন্দিরে প্রদীপ জ্বলে। আপনি কি রোমাঞ্চিত হচ্ছেন না?

(বিঃদ্রঃ কিছু অংশ সংকলিত)