এমনিতে কানন দেবী ছিলে অভাবী ঘরের, অন্য দিকে ছিলেন রক্ষিতার কন্যা। এই কারণে, তাঁর সামাজিক মূল্য ছিল অতি নিম্ন। চলচ্চিত্রে আসার পর, তার এই অবস্থার আরও অবনতি ঘটে। পরিচালকরা তাঁকে দিয়ে প্রায় নগ্নদশায় পর্দায় উপস্থিত করার চেষ্টা করেন। তার পুরোমাত্রার অভিনয় জীবন শুরু হয় ১৯৩০ সালে। তার প্রথম সবাকচিত্র ‘জোর বরাত’ (১৯৩১)। রাধা ফিল্মসের সবাক ছবি ‘জোরবরাত’-এ নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করেন। এই ছবির পরিচালক জ্যোতিষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশে নায়ক জোর করে তাকে চুম্বন করেন। এই আচরণে তিনি ক্ষুব্ধ হলেও, মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। উল্লেখ্য, তাঁর বিপরীতে নায়কের ভূমিকায় ছিলেন জয়নারায়ণ মুখোপাধ্যায়। এরপর তিনি অভিনয় করেন ‘বিষ্ণুপ্রিয়া’, ‘শঙ্করাচার্য’, ‘শ্রীগৌরাঙ্গ’ ও ‘মা’ ছবিতে। ১৯৩৫ সালে সতীশ দাস গুপ্তের ‘বাসবদত্তা’ ছবিতে তিনি প্রায় নগ্ন হয়ে অভিনয় করতে বাধ্য হন। অথচ শোনা যায়, ছবি নির্মাতারা তাকে অভিনয়ের সম্মানীও ঠিকমতো দেন নি।
ভারতীয় চলচ্চিত্রের প্রথম সুপারস্টার(৪)।
(চতুর্থ কিস্তি) ভারতীয় চলচ্চিত্রের প্রথম সুপারস্টার(৪)
KANAN DEVI: THE FIRST SUPERSTAR OF INDIAN CINEMA
কানন দেবী অসাধারণ সুন্দরী ছিলেন। নিজের সৌন্দর্য সম্পর্কে তিনি সচেতন ছিলেন। কাননদেবী যখন চলচ্চিত্রে আসেন, তখন অভিজাত ঘরের মেয়েরা চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য আসতেন না।
১৯৩৫ সালে জ্যোতিষ বন্দ্যোপাধ্যায়-এর ‘মানময়ী গার্লস স্কুল’ ছবিতে অভিনয় করে কানন দেবী সুখ্যাতি লাভ করেন। এই ছবিতে তিনি নিজের কণ্ঠে গীত গানের সাথে ঠোঁট মেলান। এ সময়েই তিনি কাননবালা থেকে কানন দেবীতে পরিণত হন। অপরূপা কানন এতই জনপ্রিয়তা অর্জন করেন যে, রাস্তার ধারে তার আলোকচিত্র বিক্রি হতে শুরু করে এবং তার পোশাক, অলঙ্কার, চলাফেরা ইত্যাদি নারীদের জন্যে ফ্যাশনে পরিণত হয়। ১৯৩৬ সালে দেবকী বসুর ‘বিদ্যাপতি’ তাকে অসাধারণ জনপ্রিয়তা এনে দেয়। আর, প্রমথেশ বড়ুয়ার ‘মুক্তি’তো বাংলা ছবির ইতিহাসেই অবিস্মরণীয় সংযোজন। মুক্তি-র সংগীত পরিচালক ছিলেন পঙ্কজকুমার মল্লিক। এ ছবিতে কানন দেবীর অভিনয়ও যেমন, তার গলার রবীন্দ্রসংগীতও বিদগ্ধ দর্শক, শ্রোতাদের কানন-অনুরাগী করে তোলে। কাননদেবীর কণ্ঠে ‘আজ সবার রঙে রঙ মেলাতে হবে’ শুধু মুক্তি-র রবীন্দ্রসংগীত হয়ে থাকেনি, ছড়িয়ে পড়েছে প্রতিটি বাঙালির ঘরে। তবে, তার কণ্ঠে দ্বিভাষিক ‘শেষ উত্তর’ বা ‘জবাব’ ছবির ‘তুফান মেল’ গান মাতিয়েছিল সারা ভারতের মানুষকে। ‘শেষ উত্তর’-এর ‘আমি বনফুল গো’ গানটাও বাঙালি কোনওদিন ভুলবে না। ভোলা যাবে কানন দেবীর গাওয়া ‘যদি ভালো না লাগে তো দিয়ো না মন’? না, ভোলা তো যাবেই না, সেই চল্লিশের দশকে সুশীল মজুমদারের ‘যোগাযোগ’-এ তার কণ্ঠে এ গান শুনে আপামর বাঙালি মন দিয়েছিল তাকে।
আগেই জেনেছি, দেবকী বসু পরিচালিত ‘বিদ্যাপতি’ ছবিতে অভিনয় করে কাননবালা খ্যতির শীর্ষে উঠে আসেন। এই বছরেই মুক্তিপ্রাপ্ত ‘মুক্তি’ ছবির মাধ্যমে তিনি প্রথম সারির নায়িকা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেন। সেকালের প্রখ্যাত নায়ক প্রমথেশ বড়ুয়ার সঙ্গে ‘মুক্তি’ এবং আরও কয়েকটি ছবিতে নায়িকা চরিত্রে অভিনয় করে ভূয়সী প্রশংসা লাভ করেন। এই বছর থেকে দরিদ্র সস্তা অভিনেত্রী ‘কাননবালা’ থেকে তিনি সম্ভ্রান্ত ‘কাননদেবী’ হয়ে উঠেন। আর্থিক দুরবস্থার কারণে, এই সময়ে বাছবিচার ছাড়া তিনি বহু ছবিতে অভিনয় করেছেন। ১৯৩৬ সালে ‘কৃষ্ণ সুদামা’, ‘কণ্ঠহার’, ‘বিষবৃক্ষ’ খুনি কৌন (হিন্দি) প্রভৃতি ছবিতে অভিনয় করেন। এই বছরে তিনি নিউ থিয়েটার্স-এ যোগদান করেন। ১৯৪১ সালে কানদেবী নিউ থিয়েটার্স ছেড়ে নিজের পছন্দমতো বইয়ে অভিনয় শুরু করেন।১৯৪২ সালে প্রমথেশ বড়ুয়া পরিচালিত ‘শেষ উত্তর’ ও তার হিন্দি ‘জবাব’ ছবিতে তিনি বিশেষ সাফল্য পান। বিশেষ করে তার ‘তুফান মেল’ গানটি তাকে অভিনেত্রীর পাশাপাশি গায়িকা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। ১৯৪৩ সাল থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত হিন্দি বাংলা মিলিয়ে বেছে বেছে অনেকগুলো ছবিতে অভিনয় করেন। তার জনপ্রিয় ছবিগুলোর মধ্যে আছে বিদ্যাপতি, সাথী, পরিচয়, শেষ উত্তর, এবং মেজদিদি। ১৯৩৮ থেকে ১৯৪০ সালের ভিতরে তার অভিনীত উল্লেখযোগ্য ছবিগুলো ছিল ‘স্ট্রিট সিংগার সাথী (১৯৩৮), সাপুড়ে (১৯৩৯), জওয়ানি কি রাত (১৯৩৯), পরাজয় (১৯৪০) ইত্যাদি অন্যতম। ১৯৪৮ সালে তিনি চলচ্চিত্র প্রযোজনা শুরু করেন, প্রতিষ্ঠা করেন ‘শ্রীমতী পিকচার্স’ এবং এই প্রতিষ্ঠানের ব্যানারে চলচ্চিত্র প্রযোজনার দিকে মন দেন। এই সময় তিনি শরৎচন্দ্রের উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্র তৈরিতে মনোযোগী হন। ১৯৫৯ সালে তিনি শেষবারের মতো অভিনয় করেন ‘ইন্দ্রনাথ শ্রীকান্ত ও অন্নদা দিদি’। তিনি এ সময় পর্যন্ত বিশেষত মায়ের ভূমিকায় অভিনয় করেন।
(ক্রমশ)
Posted by Admin K C Chowdhury from Russia