ওবায়দুল কাদেরের কলকাতা সফর এবং দাদাদের কিছু প্রশ্ন।

ওবায়দুল কাদেরের কলকাতা সফর এবং দাদাদের কিছু প্রশ্ন
http://www.bhorerkagoj.net/2017/12/25/23382/
ওবায়দুল কাদের-কে চিনতাম। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু’র হত্যাকাণ্ডের পর কলকাতায় কিছুটা সময় এবং প্রায় পুরো আশির দশক দৈনিক বাংলারবাণীতে একসাথে কাজ করার সুবাদে এই জানাশোনা। ধারণা করি, তিনি আমায় চিনবেন? একথা বলার কারণ হলো, আওয়ামী লীগের নেতারা অনেকেই ওপর তলায় উঠে যাবার পর নীচতলার বন্ধুদের ভুলে যান! যাহোক, এই চেনার সুবাদে তার ক্রমাগত উন্নতিতে আমি খুশি। তিনি এখন বিশাল মন্ত্রী, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি অ-সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক ও ভারত বন্ধু হিসাবে পরিচিত। বাংলারবানীতে তিনি ‘ও, কাদের’ নামে কলাম লিখতেন এবং কলকাতায় থাকাকালে বঙ্গবন্ধু’র ওপর একটি ইংরেজি বই প্রকাশ করেছিলেন, নামটি মনে নেই। ইদানিং তিনি ভারত সফর করেছেন এবং নানান কথাবার্তা বলেছেন। তথায় বাংলাদেশের হিন্দু ও সংখ্যালঘুদের নিয়ে তার কথাবার্তা বোধকরি কিছু প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে, তাই কেউ কেউ এ বিষয়ে জানতে চেয়েছেন।

ওবায়দুল কাদের অধুনা বাংলাদেশ বসেও বিভিন্ন সময় হিন্দুদের নিয়ে কথাবার্তা বলছেন, যা ভালো। তবে দেশে বসে বলা আর বিদেশে বসে বক্তব্য দেয়ার মধ্যে কিছুটা তফাৎ আছে। দেশে হয়তো এর অর্থ, হিন্দুদের বা সংখ্যালঘুদের কাছে টানা, তাদের ভোটটি পাওয়ার চেষ্টা? কিন্তু ভারতে বসে হিন্দুদের নিয়ে মন্তব্যের তাৎপর্য বহুবিধ। এর মূল লক্ষ্য, ভারত সরকার ও জনগণকে জানানো যে, আমরা হিন্দুদের পক্ষে , আমাদের সমর্থন দিন, আমরা আপনাদের সমর্থন চাই। গত নয় বছরে আওয়ামী লীগ শাসনামলে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর যে ভয়াবহ নির্যাতন হয়েছে, এবং এরফলে ভারতে, বিশেষত: পশ্চিমবঙ্গে যে মহাজোট বিরোধী মনোভাব তৈরী হয়েছে, ওবায়দুল কাদের হয়তো এর ওপর প্রলেপ দিতে ঐসব কথাবার্তা বলেছেন। এরপর কি বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব ফখরুল ইসলাম ভারত যাবেন এবং বলবেন, ‘আমরাই হিন্দুদের প্রকৃত বন্ধু?’ নির্বাচন আসছে, সবই সম্ভব। বড় দুই দল জানে নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে গেলে ভারতের সহযোগিতার প্রয়োজন আছে!

২১শে ডিসেম্বর ২০১৭ রংপুর পৌরসভা নির্বাচন হয়ে গেলো। বিজয়ী হয়েছেন জাতীয় পার্টির প্রার্থী। আওয়ামী লীগ প্রার্থী পেয়েছেন কমবেশি ষাট হাজার ভোট, ওখানে হিন্দু ভোট আছে প্রায় সমসংখ্যক। এরঅর্থ, আওয়ামী প্রার্থী সব হিন্দু ভোট পাননি, অথবা একটি বড় অংশ জাতীয় পার্টির পক্ষে গেছে। সম্প্রতি রংপুরের ঠাকুরপাড়ায় যে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস ঘটেছে, এর প্রভাব ভোটের ওপর পড়েছে।  ওবায়দুল কাদের ঘটনার পর রংপুর গিয়েছিলেন। তাতে কাজ হয়নি। রংপুরে হিন্দুরা প্রমান করেছে তারা আওয়ামী লীগের ‘ভোটব্যাঙ্ক’ নন? কিছুদিন আগে কুমিল্লার নির্বাচনেও তারা একই বার্তা দিয়েছেন। সদ্য প্রয়াত: মহিউদ্দীন চৌধুরীকে চট্টগ্রাম মেয়র নির্বাচনে হারিয়েও তারা প্রমান করেছিলো, হিন্দুরা আর আওয়ামী লীগের ভোটব্যাঙ্ক থাকতে চায়না? এর অন্যতম প্রধান কারণ, হিন্দুরা আওয়ামী লীগকে সবই দিয়েছিলো, কিন্তু প্রাপ্তির ঘরটি শূন্যই রয়ে গেছে। এমনকি গ্রামেগঞ্জে শান্তিতে বসবাস করার অধিকারও তারা হারিয়েছে। বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন একটি চলমান ঘটনা, প্রতিদিন কোথাও না কোথাও কিছু না কিছু ঘটছেই। ২০০৯-২০১৭ আওয়ামী লীগ শাসনামল বড়ই মসীলিপ্ত! প্রতিটি ঘটনায় আওয়ামী লীগ নেতারা জড়িত। কোন বিচার নাই?

সংখ্যালঘু নির্যাতন এ লেখার বিষয় নয়? সবাইকে ‘বড়দিনের’ শুভেচ্ছা। নুতন বছরের শুভকামনায় খুশির কিছু লিখতে চাই। বাংলাদেশের মেয়েরা ফুটবলে জিতেছে, ওদের অভিনন্দন। সমস্যা হলো, সদ্য মাদ্রাসার ছাত্ররা একটি ‘মহিলা বাথরুম’ ভেঙ্গে দিয়েছে। স্বাধীনতার ভাস্কর্যে নারীমুর্ক্তি পাল্টে পুরুষমুর্ক্তি করে দেয়া হয়েছে। ভয় হয়, যারা নারীর বাইরে চলাচল অপছন্দ করেন, তারা না আবার ফতোয়া দেন যে, ‘মেয়েরা ফুটবল খেলতে পারবে না’? বাংলাদেশে সবই সম্ভব। এর প্রেক্ষিতে কলকাতায় ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্য কতটা প্রণিধানযোগ্য তা ভাববার বিষয়। কলকাতা থেকে ‘বিতর্ক ডট কম’ সম্পাদক, সিদ্ধার্থ সেনগুপ্ত জানতে চেয়েছেন, ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্যের সত্যতা কতটুকু? তিনি ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্যের সুনির্দিষ্ট কিছুটা অংশও পাঠিয়েছেন। আর শুধু তিনি নন, দৈনিক যুগশঙ্খের চিফ রিপোর্টার রক্তিম দাস বা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডঃ মোহিত রায় জানতে চেয়েছেন, ঘটনা কি? সুখের বিষয়, পশ্চিমবঙ্গের বুদ্ধিজীবীরা যদি বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের নিয়ে কথা বলতেন, তাহলে অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যেতো?

কলকাতায় ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের উপর কোনও রকম আক্রমণ হাসিনা সরকার বরদাস্ত করবে না। এ ব্যাপারে আমাদের প্রধানমন্ত্রী জিরো টলারেন্সের কথা বলেছেন।” তিনি আরও বলেন, “আমি সংখ্যালঘু ভাই বোনদের বলছি, আপনারা এ দেশের নাগরিক, মুক্তি যুদ্ধে প্রাণ দিয়েছেন আপনাদের পরিজনেরা। নিজেদের অধিকারের কথা জোর গলায় বলুন।” তিনি বলেন, ”সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষকে আমি তো এমন কথা বলেছি, কেউ আক্রমণ করলে পাল্টা আক্রমণ করুন। মেরুদন্ড খাড়া করুন’। ”আমার মনে হয় সর্বত্র সংখ্যালঘুরা হীনমন্যতায় ভোগেন’।  সিদ্ধার্থ সেনগুপ্ত  জানতে চেয়েছেনা, ওবায়েদুল কাদেরের বক্তব্য কতটা সত্যি এবং বাস্তব? সিদ্ধার্থ সেনগুপ্তের প্রশ্নের জবাবে প্রথমেই আমার বলতে ইচ্ছে করছে, ‘ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্য পলিটিক্যালি কারেক্ট’। দেশে বসেও তিনি এসব কথা বলছেন। কিন্তু পলিটিক্যালি কারেক্ট কথাবার্তা সবসময় সত্য এবং বাস্তব নাও হতে পারে? মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নির্বাচনে জিতে সেটি প্রমান করছেন।

যেমন সবাই বলতে পছন্দ করেন যে, ;বাংলাদেশে চমৎকার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিরাজমান’। কথাটা বলার জন্যে বলা, বা পলিটিক্যালি কারেক্ট এঙ্গেল থেকে বলা হয়, কিন্তু যারা তা বলেন, তারাও জানেন, কথাটা মিথ্যা এবং অবাস্তব। আবার যেমন ওবায়দুল কাদের বলেছেন, সংখ্যালঘু নির্যাতনের ব্যাপারে সরকারের জিরো টলারেন্স। বাংলাদেশের সংখ্যালঘুরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মুখ থেকে একথা এখনো শুনেনি। তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একবার একথা বলেছেন! যদিও তার আমলে তার নাকের ডগায় নাসিরনগর, রংপুর থেকে অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে,তিনি নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছেন। ওবায়দুল কাদের পরামর্শ দিয়েছেন অধিকারের কথা বলতে। গত নয় বছরের হাজার বার ‘চিল্লাইয়া চিল্লাইয়া’ অধিকারের কথা বললেও আজ পর্যন্ত একটি দাবীও সরকার মেনে নেয়নি। উপরন্তু সরকার মৌলবাদী-জ্বিহাদী হেফাজতীদের সকল দাবিনামা মেনে নিয়েছেন। সামনের বছর নির্বাচন। সরকারের কানে জল ঢুকেছে। ওনারা তাই সেই পুরানো গীত গাইছেন। জননেত্রী শেখ হাসিনা চট্টগ্রামে ক্ষতিগ্রস্থ হিন্দু পরিবারের সাথে দেখা করেছেন, টাকা দিয়েছেন। তিনি কিন্তু নাসিরনগর বা রংপুরে যাননি, এমনকি একটি কথাও বলেননি?

ওবায়দুল কাদের ঝানু রাজনৈতিক। তিনি জানেন কিভাবে নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে হয়? তার সুন্দর সুন্দর কথাবার্তার কারণ নির্বাচন। নয় বছর ক্ষমতায় থাকার পরও তারা ২০০১-র সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিচার করেননি। বাংলাদেশে প্রতিদিন হাজার হাজার মুর্ক্তি ও মন্দির ভাঙা হলেও আজ পর্যন্ত একজন এজন্যে সাঁজা পেয়েছেন, এমন নজির নেই? হয়তো ওবায়দুল কাদেরের সদিচ্ছা আছে, কিন্তু ক্ষমতা নেই! কারণ বাংলাদেশের অবস্থাটা হচ্ছে, “এক নেতা এক দেশ শেখ হাসিনা বাংলাদেশ”। তাই যতক্ষণ না প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলছেন, ততক্ষন এর খুব একটা মূল্য নেই? ওবায়দুল কাদের বা মন্ত্রীরা এখন হয়তো সংখ্যালঘুর পক্ষে সজোরে ড্রাম পেটাবেন, তাতে হয়তো কিছুটা ‘মলম’ দেয়া হবে, কাজের কাজ কিচ্ছু হবেনা। সবেমাত্র রংপুর ঘটনার মূল হোতাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। পরের প্রশ্নটি হচ্ছে, উনি ছাড়া পাচ্ছেন কবে? নাসিরনগর ঘটনার মূল হোতা আওয়ামী লীগ নেতার নাম পুলিশের চার্জশীটে পর্যন্ত নেই? নির্দোষ শিক্ষক শ্যামল ভক্তকে কানধরে ওঠবস করানোর দায়ে অভিযুক্ত সেলিম ওসমানের সাথে ওবায়দুল কাদেরের কোলাকুলির ছবি মিডিয়ায় এসেছে। 

কলকাতার একটি দৈনিক ওবায়দুল কাদের-কে প্রশ্ন করেছিলো, বাংলাদেশের হিন্দু-বৌদ্ধরা কি সরকারের ওপর ক্ষুব্ধ? উত্তরে তিনি বলেছেন, সংখ্যালঘুরা হাসিনা সরকারকে নিজেদের সরকার মনে করেন। তার কথায়, সরকারকে হেয় প্রতিপন্ন করতে বিভিন্ন শক্তি সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার কিছু ঘটনা ঘটায়, সরকার বারবার সংখ্যালঘুদের পাশে দাঁড়িয়েছে, দুস্কৃতিকারীদের বিচার করেছে। তিনি আরো বলেছেন, বাংলাদেশে এবার ২৩০টি বেশি পূজা হয়েছে, মোট ৩০০৭৭টি। বাংলাদেশে যেকেউ স্বীকার করবেন, মন্ত্রীরা জানেন ও বলেন বেশি! তাই হয়তো ওবায়দুল কাদের জানেন কোন ঘটনার বিচার হয়েছে, জনগণ জানেনা? আর পাশে দাঁড়ানোর সংজ্ঞাটার রকমভেদ আছে, প্রতিটি নির্যাতনের ঘটনায় হিন্দুরা ‘সরকার’-কে পাশে দাঁড়িয়ে ‘নীরব দর্শকের’ ভূমিকা পালন করতে দেখেছে! মন্ত্রী পূজার সংখ্যা বাড়ার দৃষ্টান্ত দিয়েছেন, কিন্তু তিনি বলেননি যে, পুলিশ প্রহরা ব্যাতিত বাংলাদেশে এখন আর দুর্গাপূজা করা সম্ভব নয়? এইতো, বাংলাদেশ। মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের হয়তো টের পাচ্ছেন না, বাংলাদেশের সংখ্যালঘুরা এখন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি’কে একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ ভাবছেন?

শিতাংশু গুহ, কলাম লেখক।
২৫শে ডিসেম্বর ২০১৭। নিউইয়র্ক।