আশার কথা, এবার কেন্দ্র ভারতবর্ষ।

আশার কথা, এবার কেন্দ্র ভারতবর্ষ
কথায় বলে, অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা। কথাটা কিন্তু এখন আর সর্বাংশে সত্য নয়। এখন দেখা যাচ্ছে, প্রতিভাবান এবং সক্রিয় মস্তিষ্কও শয়তানের কারখানা। কথাটা প্রমাণ করার মতো তথ্য যথেষ্টই আছে। সেটা প্রমাণ করে দিয়েছে উহানের ভাইরোলজি কারখানাটি। অনেকদিন ধরেই কথাটা কানাঘুষোর মতো ছড়াচ্ছিল। আর চীন বারবার তা অস্বীকার করেই যাচ্ছিল। ফেব্রুয়ারি মাসের গোড়ার দিকে উহানের এক মানবাধিকার কর্মী চেন কুইসি হঠাৎই নিরুদ্দেশ হয়ে গেলেন। ট্যুইটারে তাঁর ফলোয়ারের সংখ্যা ২ লক্ষ এবং ইউটিউবে তাঁর ৪ লক্ষ সাবস্ক্রাইবার্স। তিনি হাসপাতালে ঘুরে ঘুরে আক্রান্ত রোগী এবং ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বলে পরিস্থিতির আপডেট দিচ্ছিলেন। সেখানে তিনি বলেছিলেন, ‘উহানের মানুষ এক অজানা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে বিপন্ন। সরকার কিন্তু এ ব্যাপারে উদাসীন। আগামীদিনে আমরা ভয়ঙ্কর এক বিপদের দিকে এগচ্ছি।’ এত সব খবর বাইরে বেরিয়ে আসুক, তা চীন সরকার চায়নি। পৃথিবীর কোনও কমিউনিস্ট সরকারই গণতন্ত্রের ধার ধারে না। তাদের ভিতরে গণতন্ত্রের মোড়কে একটা একনায়কতন্ত্রের ঔদ্ধত্য থাকে। চীনে তো সব থেকে বেশি। রাতারাতি তারা মানুষটাকে হাপিশ করে দিল। কেউ তার খবর জানেন না।
আর একজন মানুষ। তাঁর নাম লি ওয়েনলিয়াং। উহানের একজন চোখের ডাক্তার। তাঁর নজর এড়িয়ে যায়নি এই রোগের ক্রম বাড়বাড়ন্ত। তিনি তো গত ডিসেম্বরেই বলে দিয়েছিলেন, ‘একটা ভয়ঙ্কর রোগ কিন্তু মহামারীর মতো ছড়িয়ে পড়তে পারে। আমাদের আরও সতর্কতা প্রয়োজন। কিন্তু তেমন কিছুই দেখা যাচ্ছে না। সুতরাং সাবধান।’ এরপর পুলিস তাঁকে ডেকে বলে, ‘আপনি ভুল খবর ছড়িয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করছেন। আপনি আপনার কাজটুকু করুন। এর বাইরে আপনাকে কিছু দেখতে হবে না।’ চীনের পুলিস সেদিন লাল চোখ দেখিয়ে লি’কে চেতাবনি দিলেও বিষয়টিকে প্রশাসন মোটেই পাত্তা দেয়নি। ডাঃ লি মানুষের চিকিৎসা করতে করতেই গত ফেব্রুয়ারি মাসে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। এর পর উহানের মানুষের মধ্যে একটা গণক্ষোভ তৈরি হয়। সেটা চাপা দিতে শেষ পর্যন্ত উহানের প্রশাসন লি-এর বাড়ি গিয়ে তাঁর পরিবারের কাছে ক্ষমা চায় এবং তড়িঘড়ি নানা পদক্ষেপ নেয়। ততদিনে যা সর্বনাশ হওয়ার হয়ে গিয়েছে। উহানের সীমানা ছাড়িয়ে, বেজিংয়ের সীমানা ছাড়িয়ে, চীনের সীমানা ছাড়িয়ে সেই ভাইরাস সুনামির গতিতে ছড়িয়ে পড়েছে সারা বিশ্বে। এখনও সেই ডাইনির লোল জিহ্বা প্রসারিত। একের পর এক মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়ে সে হা হা করে হাসছে। এ এক উন্মত্ত দানব, যাকে আটকাতে অক্ষম মানব প্রজাতি।
সারা বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়া এই ঘাতক করোনার পিছনে যে চীনেরই হাত রয়েছে, তা জিন পিংরা অস্বীকার করলেও সত্যটা কিন্তু প্রকাশ্যে এসে গিয়েছে। কথায় বলে পাপকে কখনও চাপা দেওয়া যায় না। বিশ্বজনীন এই করোনা-ত্রসনের পিছনে চীনের যে পাপকর্ম ছড়িয়ে রয়েছে, তা বিশ্বের মানুষের ইতিহাসে এক কলঙ্কিত অধ্যায়। এর মূল্য কিন্তু চীনকে চোকাতেই হবে। উহানের ইনস্টিটিউট অব ভাইরোলজি হল সেই ভাইরাসের সূতিকাগার। সেখানেই তৈরি করা হয়েছে এই মারণ ভাইরাসটি। জানা গিয়েছে, এক ইন্টার্নের দোষেই সেই ভাইরাস বাইরে ছড়িয়ে গিয়েছে। যে কথা আমেরিকা এতদিন বলে আসছিল, সেই কথা অনেকটাই সঠিক বলে জানিয়েছেন প্যারিসের নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী লুক মন্তাজিনিয়ের। তিনি বলেছেন, এই ভাইরাসটির মধ্যে যেসব বৈশিষ্ট্য দেখা গিয়েছে, তা কখনওই প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন নয়। তা যে মনুষ্যসৃষ্ট, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
গত জানুয়ারি মাসে ড্যানি শোহ্যাম স্পষ্টভাষায় জানিয়ে দিয়েছিলেন, এই ভাইরাসটি চীনের ল্যাবরেটরি থেকেই ছড়িয়েছে। ড্যানি হলেন ইজরায়েলের সেনা-গোয়েন্দা বিভাগের একজন অফিসার। চীনের জৈবাস্ত্র গবেষণা সংক্রান্ত বিষয়গুলি তাঁর নখদর্পণে। তখন তাঁর কথা বিশেষ গুরুত্ব পায়নি। চীনও তখন সব অভিযোগ উড়িয়ে দিচ্ছিল। নানাভাবে সে তার পাপ কাজ চাপা দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। এখনও অবশ্য তারা সেই চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।
উহানের সেই ভাইরোলজির কারখানাটি শহর থেকে অনেক দূরে প্রত্যন্ত এলাকায়। চারিদিকটা সেখানে পাহাড়ঘেরা। এটি হল এশিয়ার মধ্যে সব থেকে বড় ভাইরাস ব্যাঙ্ক। দেড় হাজারেরও বেশি ভাইরাসের স্যাম্পেল এখানে আছে। প্রতি বছর এখানে গবেষণার জন্য আমেরিকা থেকে প্রচুর পরিমাণ অর্থ আসে। ২০১৮ সালে মার্কিন বিশেষজ্ঞরা এই ল্যাবরেটরি পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। তাঁরা ফিরে গিয়ে তখন একটি রিপোর্ট দিয়েছিলেন। সেখানে সতর্ক করে বলা হয়েছিল, এই ধরনের ল্যাবরেরিতে যতটা সুরক্ষার প্রয়োজন, তা নেই। ফলে যে কোনওভাবে যদি সেই গবেষণা থেকে ভাইরাস বাইরে বেরিয়ে আসে, তবে তা মহামারীর আকার নিতে পারে।
চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনী। চীনও শোনেনি। কেননা, তার উদ্দেশ্যই ছিল অসাধু। কিন্তু পরবর্তীকালে সে সেটাকে আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। ‘ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন’ উপন্যাসের মতোই যেন পুরো কাহিনীটি। ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের তৈরি সেই দানব তার রোষ উজাড় করে দিয়ে একদিন হারিয়ে গিয়েছিল। অনন্ত অন্ধকারের মধ্য থেকে সে আবার যেন ফিরে এসেছে, নতুন রূপে। ফিরে এসেছে তার সেই পুরনো মারণ-শক্তি নিয়েই। উহানের ভাইরোলজি গবেষণাগারের সৌজন্যেই তার এই প্রত্যাবর্তন। আজ বিশ্বের প্রত্যেকে এ কথা জানে। চীনের পক্ষে এ কথা স্বীকার করা সম্ভব নয়। করেওনি। কিন্তু চীনের মানুষ জানেন, তাঁদের দেশই এই ভাইরাস ছড়িয়েছে। মুখে কিন্তু সে কথা বলা যাবে না। তাহলেই জিন পিংদের ভাড়া করা গুপ্ত ঘাতক এসে তাদের সরিয়ে নিয়ে যাবে। বিশ্বের অগোচরে অবিরত সেখানে ঘটে চলেছে গুমখুনের ঘটনা।
বাংলায় একটা প্রবাদ আছে, পাপ কিন্তু বাপকেও ছাড়ে না। চীনকেও ছাড়বে না। এই পাপের দায়ভার তাকে নিতেই হবে। সেটা যে অনেক মূল্য দিয়েই নিতে হবে, তা আমরা জানি। তার একটি একটি করে লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। চীনের শিল্প-বাণিজ্য-অর্থনীতির দিকে তাকালে বিষয়টি সহজেই বোঝা যাবে। শুরু হয়েছে তার ঔদ্ধত্যের হিসেব-নিকেশ।
প্রাথমিকভাবে দুই শতাধিক কোম্পানি সেই দেশ থেকে পাততাড়ি গোটাতে শুরু করেছে। এর মধ্যে বেশিরভাগই মার্কিন কোম্পানি। প্রথমত নিরাপত্তার কারণে এবং দ্বিতীয়ত চীনকে একটা বড় অর্থনৈতিক ধাক্কা দিতে কোম্পানিগুলি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এগুলি মূলত ম্যানুফাকচারিং শিল্প। দুটি শিল্পক্ষেত্র এর মধ্যে সবথেকে বড়। একটি প্রযুক্তি শিল্প এবং অন্যটি অটোমোবাইল শিল্প। বিভিন্ন আই ফোন প্রস্তুতকারী সংস্থাও সরে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর মধ্যে আছে উইসট্রন কর্প, ইনভেন্টেক কর্প, পেগাট্রন কর্প ইত্যাদি। আরও অনেক কোম্পানি সরে যেতে পারে বলে খবর ছড়িয়েছে। এতে চীনের কপালে বড় ভাঁজ। সারা বিশ্বে কম পয়সায় সস্তার শিল্প বেচে সে প্রচুর টাকা কামিয়েছে। এবার সেই শিল্পেও ধাক্কা লাগতে চলেছে। দ্রুত ঘটে যাওয়া এইসব ঘটনায় চীনের শিল্পে কালো ছায়া পড়তে শুরু করেছে।
চীনের মাটি ত্যাগ করে যেসব কোম্পানি বেরিয়ে আসছে, তাদের অধিকাংশের গন্তব্যই হতে চলেছে ভারত।
মূলত ভারত, তাইওয়ান, ভিয়েতনামের দিকেই ছড়িয়ে পড়তে পারে শিল্পগুলি। কম পয়সায় শ্রমের ক্ষেত্রে এই দেশগুলি সমানে সমানে। কিন্তু কর্মীদক্ষতার বিচারে ভারত অনেকটাই এগিয়ে রয়েছে। করোনা লড়াইয়ের পাশাপাশি চলছে এক বিরাট বাণিজ্য-যুদ্ধ। সে লড়াইয়ের উপর নির্ভর করছে বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক পরিবর্তন। করোনা-বিধ্বস্ত আমাদের এই দেশও অর্থনৈতিক দিক থেকে ভরাডুবির পথে চলে যেতে পারে। সারা বিশ্বই এক গভীর মন্দার পথে হাঁটছে। ভারতও তার ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু এর মধ্যেও আশার কথা শোনা যাচ্ছে। বিশ্বের বৃহৎ ও মাঝারি শিল্পগোষ্ঠীগুলির একটা বড় অংশ যদি ভারত অভিমুখী হয়ে ওঠে তবে,ভারত বিপর্যয় অনেকটাই সামলে নিতে পারব বলে মনে হয়। গভীর অন্ধকারের মধ্যে এই সোনালি আলোকরেখা আমাদের আশার এক উজ্জ্বল অভিজ্ঞান। আমাদেরও তাই প্রার্থনা, এবার কেন্দ্র হয়ে উঠুক ভারতবর্ষ!
লিখেছেন : সন্দীপন বিশ্বাস