মুসলিম হিসেবে এরা সবাই মনে করে মানুষসহ যে কোন জীবন্ত জীবজন্তুর ছবি দেখলে রহমতের ফেরেস্তা সামনে আসে না।

বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা বিদেশে যেখানেই যায় সেখানকার মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়ে। এমন কি সিরিজ কভার করতে যাওয়া সাংবাদিকরাও খেলোয়ারদের সঙ্গে মসজিদে গিয়ে নামাজটা পড়ে আসে। ক্রিকেট কর্তাদের যারা সফরে যান- তারাও মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়ে আসেন। এখন এমন বাস্তবতায় কে এসে মুশফিকের চরম ধৃষ্ঠতার বিচার করবে? মুসলিম হিসেবে এরা সবাই মনে করে মানুষসহ যে কোন জীবন্ত জীবজন্তুর ছবি দেখলে রহমতের ফেরেস্তা সামনে আসে না। মুসলিম মাত্রই এটি বিশ্বাস করে। টেলিভিশনে যে খেলার অনুষ্ঠানগুলো হয়, সেখানে ভারতীয় চ্যানেলে কোন সিরিজ উপলক্ষ্যে প্রমো তৈরি করলে সেখানেও বাংলাদেশ টিমের প্রতি হেয় করার অভিযোগ তুলে শোরগোল তুলে ফেলে। এমনকি শেহবাগকে দিয়ে অস্টেলিয়া সিরিজের প্রমো দেখেও তারা ব্যথিত হয়েছে কারণ ওখানে নাকি ইন্ডিয়ার অহংকার প্রকাশ পেয়েছে। এদিকে জাতীয় ক্রিকেট টিমের লোগোটির এক পাশ টেপ মেরে ঢেকে রাখার পরও এদের দেশপ্রেম ক্রিকেটপ্রেমে এতটুকু চুলকানি উঠল না- এতো বিরাট আশ্চর্য কথা! এক সময় এক টিকিটে দুই ছবির পোস্টারগুলো কিছু কিছু জায়গা কাগজ মেরে ঢেকে দেয়া হতো। কারণ ওগুলো ছিলো অশ্লিল সাজপোশাক। মুশফিকসহ সিনিয়রদের কাছে বাংলাদেশ ক্রিকেট টিমের লোগোটি সেরকমই অশ্লিল বা আপত্তিকর!

নেট দুনিয়ার মুশফিকের বেয়াদপী ভাইরাল হবার পরও ক্রিকেটবোর্ড এবং সদা দেশপ্রেমে উদ্দেলিত সাংবাদিক সমাজ এ্ই বিষয়ে কোন কথা বলেনি। নভজৎ সিং সিধু বাংলাদেশকে কাংলাদেশ বললে শরীরে লাগলে একটা লোগোকে বিকৃত করাকে গায়ে লাগবে না কেন? মুশফিককে ডেকে এনে বোর্ডের উচিত ছিলো জিজ্ঞেস করার, এই লোগো পরে সে কি গর্ববোধ করে নাকি কোন রকম অস্বস্তিতে ভোগে? মুশফিকের এই ইতরামিটা এতখানিই গুরুত্বপূর্ণ যে বেশির ভাগ মানুষজনই সেটা বুঝতে পারছেন না। মুশফিকের ডানপন্থি অবস্থান আমাদের জাতীয় স্তরে বড় ধরণের প্রভাব ফেলতে পারে। আমাদের এমন অনেক জাতীয় প্রতিষ্ঠান আছে যার লগো পাখির আদলে, কোনটায় মানুষের আদল- যেমন পোস্ট অফিসের লোগোতে রানারের একটা ছবি আছে যেখানে একজন মানুষ বল্লম হাতে কাধে চিঠির বোঝা নিয়ে ছুটছে…। সবাই যদি নামাজের দোহাই দিয়ে এসব জাতীয় প্রতীক ডেকে রাখা শুরু করে একটা জাতির পরবর্তী নকশা ডিজাইন পুরোপুরি সাম্প্রদায়িক সংক্রীর্ণ দৃষ্ঠিভঙ্গিতে বদলে যাবে। মুশফিককে তাই ডেকে জবাব দেয়া উচিত যে বদমাইশির ইচ্ছা থাকলে বাড়িতে গিয়ে সে সেটা করতে পারে, কিন্তু ক্রিকেট টিমের পরিচয় যে লোগোতে সেখানে তার হাত দেয়ার কোন অধিকার নেই।

বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরই কুরআন তেলাওয়াত দিয়ে টেলিভিশন চালু করার রেওয়াজ, হাসপাতালেও মসজিদ বানিয়ে দেয়াটা ছিলো চরম হাস্যকর রকমের ধর্মনিরপেক্ষতার উদাহরণ। মুশফিকদের মত রাগ ছাগল জন্মানোর দায় রাষ্ট্রের। এই রাষ্ট্র ডানপন্থি তরুণদের বেড়ে উঠার সব রকম প্রচেষ্টা করে চলেছে। শুনেছি বাংলাদেশের মাধ্যমিক স্তরে সব স্কুলে নাকি অঘোষিতভাবে জোহরের নামাজ স্কুলের মসজিদে পড়ার উপর হেড মাস্টাররা ছাত্রদের চাপ দেয়া শুরু করেছে। স্কুলের বাচ্চাদের নামাজি বানানো শিক্ষকদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। এরকম প্রচেষ্টা বা চাপিয়ে দেয়ার ঘটনাগুলো দেখার কথা শিক্ষাবোর্ডের। কিন্তু সেখানেও তো মুশফিকের মত লোকজনই বসে আছে। সর্ষের মধ্যেই তো ভূত লুকিয়ে আছে…।

একটা সময় ছিলো ধর্মকর্ম করা মুসলিম না হলেও নিজেদের মুসলিম হিসেবে পরিচয় দিতো এদেশের সুশীল সমাজ। কারণ তারা মনে করত তাদের এই মুসলিম পরিচয়টি ইসলামী বিশ্বাসের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক না থেকেও সম্ভব কারণ তারা উপমহাদেশে একটি ঐতিহাসিক রাজনৈতিক সামাজিক পরিচয় এর মাধ্যমে বহন করেন। যে জন্য অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক, আহমদ ছফারা বাঙালী জাতীয়তাবাদের মাধ্যমে যে প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী উত্থান ঘটেছিলো ষাটের দশকে, দেশ স্বাধীন হবার পর তার বদলে ‘বাঙালী মুসলমান’ জাতীয়তাবাদ পুন:প্রতিষ্ঠা করেন। এ কারণেই আহমদ ছফা প্রগতিশীল লেখক হলেও তাকে সলিমুল্লাহ, ব্রাত্য রাইসুরা বিরাট করে স্মরণ করে কারণ বর্তমান ‘মুসলিম বাংলা’ পরিচয়ে যে সাহিত্য শিল্পসহ সামাজিক রাজনৈতিক অবস্থান গড়ে তোলার চেষ্টা চলছে আবদুর রাজ্বাক-আহমদ ছফা সেই ভিত্তিপ্রস্ত গড়ে দিয়েছিলেন। পাকিস্তান আমলে সাংবাদিকদের লাহোর করাচি লন্ডন ছুটাছুটি করতে হতো নানা কারণে। কিন্তু তাদের এরকম নামাজের জন্য মসজিদে ছুটাছুটি করতে দেখা যেতো না। ভাবাই যায় না তখনকার খেলার মাঠে প্রক্টিস সেকশনে ক্রিকেটাররা মাঠেই নামাজ পড়ছে! এখন সাকিব-মাহামুদুল্লাহ-মুশফিকদের এই চিত্র সবার কাছে পরিচিত। এগুলো এমনি এমনি হয়নি। ধর্মীয় পরিচয়ে যে জাতীয়তাবাদ গড়ে উঠে তার হাত ধরেই ফান্ডামেন্টালিস্ট জাতীয়তাবাদ তার অবস্থান দৃঢ় করে ফেলে।
#Susupto_Pathok