ব্রজেন দাসের ইংলিশ চ্যানেল জয়ের ৬০ বছর
ইকরামউজ্জমান ১৮ আগস্ট ২০১৭ কা কন্ঠ
১৯৪৭ সালে অখণ্ড ভারত বিভক্ত হয়ে জন্ম হয়েছে দুটি দেশ—ভারত ও পাকিস্তান। আমরা পূর্ব বাংলার বাঙালিরা পূর্ব পাকিস্তানি হয়ে এক হাজার ১০০ মাইল দূরের উর্দুভাষী পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে মিলে হয়েছিলাম পাকিস্তানি।
বাঙালিদের জন্য পাকিস্তানের ঠিকানা ছিল ভুল। আর এই ভুলের স্বাদ গ্রহণ বাঙালির জীবনে শুরু হয়েছে প্রথম থেকেই। শুরু থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানিরা বাঙালিদের অন্য চোখে দেখেছে। রাজনীতি, অর্থনীতি, ক্রীড়াঙ্গন ও সংস্কৃতিজগতে বৈষম্য, অবহেলা, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য, বঞ্চনা, ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করার সর্বাত্মক চেষ্টা করা হয়েছে। আর এ সবকিছুই বাঙালি জনগোষ্ঠীর মানসে ছাপ ফেলেছে—রাজনীতি, অর্থনীতির মতো ক্রীড়াঙ্গনেও। বাঙালি ও অবাঙালির মধ্যে ক্রীড়াঙ্গনে ক্রমেই বেড়েছে রেষারেষি এবং ভিন্নধর্মী চিন্তাভাবনা। রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি করে একটি সময় থেকে ক্রীড়াঙ্গন কার্যকরী ভূমিকা পালন করেছে। অবদান রেখেছে স্বাধিকার আন্দোলনে।
দুঃখজনক হলেও সত্যি যে তৎকালীন ক্রীড়াঙ্গনের এই ভূমিকাটি তেমনভাবে কখনো আলোচনায় আসেনি। ক্রীড়াঙ্গনে অবিচার ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলনে শুধু ক্রীড়াজগতের মানুষ যে জড়িত ছিলেন তা নয়, জড়িত ছিলেন রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, ক্রীড়া সাংবাদিক, কিছু বাঙালি সরকারি কর্মকর্তা, বুদ্ধিজীবী ও সচেতন মহলের প্রতিনিধিরা। তাঁরা বছরের পর বছর লড়েছেন অন্যায় ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে।
আমাদের বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। স্বাধিকার আন্দোলনের ফসল আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধ আর যুদ্ধে জয়ী হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ অর্জন। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে।
নদীমাতৃক বাংলাদেশ। সাঁতারের সঙ্গে এই অঞ্চলের আপামর মানুষের নাড়ির সম্পর্ক। সাঁতার বাঙালিদের নিজস্ব খেলা। অথচ ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান সাঁতার ফেডারেশনের হেডকোয়ার্টার স্থাপন করা হয় পাঞ্জাবের রাজধানী লাহোরে, যেখানে নদী নেই। জাতীয় ফেডারেশনের প্রথম নির্বাহী কমিটিতে কোনো বাঙালির স্থান হয়নি! পূর্ব পাকিস্তানের ন্যায্য অধিকার ও সমতাকে প্রথম থেকেই অস্বীকার করা হয়েছে। পশ্চিমারা প্রথম থেকেই ক্রীড়াঙ্গনে বৈষম্যের রাজনীতি টেনে এনেছে। নোংরা রাজনীতির মাধ্যমে চেষ্টা করেছে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সাঁতারের প্রতিদ্বন্দ্বিতা চত্বর থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে।
১৯৫৪ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয় ন্যাশনাল অলিম্পিক। এই অলিম্পিকে সাঁতারে ১০০ মিটার ফ্রি-স্টাইলে প্রথম হন সাঁতারু ব্রজেন দাস। তাঁর জন্ম ঢাকার বিক্রমপুরের সিরাজদিখান থানার কুচিয়ামারা গ্রামে। বাঙালি যুবক ফ্রি-স্টাইল সাঁতারে প্রথম—এটা পশ্চিম পাকিস্তানের সাঁতারের বিচারকরা মেনে নিতে পারেননি। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাঁতারুকে পেছনে ফেলে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি সাঁতারু প্রথম—এটা হতে পারে না। অতএব বিচারকরা মনগড়া কারণ দেখিয়ে ব্রজেন দাসকে অযোগ্য ঘোষণা করেন। বিষয়টি নিয়ে তখন হৈচৈ হয়।
পরের দিন ইংরেজি ও বাংলা পত্রিকায় এই রায়ের বিরুদ্ধে লেখালেখি হওয়ায় এই ইভেন্টের আবার আয়োজন করা হয়। এবারও ব্রজেন দাস প্রথম হয়ে স্বর্ণপদক নিশ্চিত করেন। ১৯৫৫ সালের পাকিস্তান অলিম্পিকেও ব্রজেন দাস ১০০ ও ৪০০ মিটার ইভেন্টে প্রথম হন। স্বাভাবিকভাবেই ব্রজেন দাস আশা করেছিলেন ১৯৫৬ সালে মেলবোর্ন অলিম্পিকে পাকিস্তান দলে তাঁকে নেওয়া হবে—এর জন্য তিনি কঠোর অনুশীলনও করেছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ব্রজেন দাসকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি অলিম্পিক দলে। যাঁরা তাঁর সঙ্গে ন্যাশনাল অলিম্পিকে পেরে ওঠেননি—তাঁদের দলে স্থান দেওয়া হয়েছে।
দুঃখ পেয়েছেন কিন্তু ভেঙে পড়েননি ব্রজেন দাস। দৃঢ় মানসিক শক্তি আর আত্মবিশ্বাসী মানুষটি ঠিক করলেন ব্যক্তিগত পর্যায়ে আন্তর্জাতিক সাঁতার অঙ্গনে নৈপুণ্য প্রদর্শন করে সাঁতারে বাঙালির শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করবেন। তখন ইংলিশ চ্যানেলে সাঁতারের ছিল বিশ্ব ক্রীড়াচত্বরে আলাদা মর্যাদা, আবেদন ও জৌলুস। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে সেরা দূরপাল্লার সাঁতারুরা এই সাঁতারে অংশ নিতেন। ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেওয়া একটি বিশেষ একক কৃতিত্বের ব্যাপার ছিল তখন আন্তর্জাতিক সাঁতার অঙ্গনে। ব্রজেন দাস সাহায্য ও সহযোগিতা চাইলেন ক্রীড়ানুরাগী তাঁর ঘনিষ্ঠ মহলের কাছে। সবাই বুঝলেন ব্রজেন সফল হলে এটি হবে ক্রীড়াঙ্গনে বাঙালি ক্রীড়াবিদের বিশাল অর্জন।
অবহেলা, বঞ্চনার বিপক্ষে সমুচিত জবাব। গঠিত হলো চ্যানেল ক্রসিং কমিটি (সিসিসি)। কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক যথাক্রমে ক্রীড়া সংগঠক ব্যক্তিত্বদ্বয় প্রকৌশলী মাইনুল ইসলাম ও এস এ মহসিন। কমিটিতে আরো যাঁরা ছিলেন—সাংবাদিক এ বি এম মূসা, ক্রীড়া সাংবাদিক ও সংগঠক এস এ মান্নান (নাডু), সংগঠক মো. শাহজাহান, নূর হোসেন, মোল্লা আবদুল মজিদ, কাজী শামসুল ইসলাম, এফ এ করিম প্রমুখ। যুক্তফ্রন্ট সরকারের মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমানকে সিসিসির প্রধান পৃষ্ঠপোষক করা হয়।
কমিটি সিদ্ধান্তে উপনীত হলো ব্রজেন দাসকে পাঠানো হবে ইংলিশ চ্যানেলে সাঁতারে অংশ নিতে। প্রস্তুতি পর্বের জন্য একটি পরিকল্পনার ছক ঠিক করা হলো নেলের কন্ডিশনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়া এবং অনুশীলনের জন্য বেশ কিছুদিন আগেই ব্রজেনের যাওয়ার ব্যবস্থা করা হবে। প্রয়োজন বড় অঙ্কের অর্থের। সরকার, জাতীয় সাঁতার ফেডারেশন এমনকি ইপিএমএফও কোনো রকম সাহায্য করবে না। অর্থ সংগ্রহের প্রধান ভার পড়ল সভাপতির ওপর। তিনি বিভিন্নভাবে চাঁদা তুলে ‘ফান্ড’ জোগাড় করেন। ঢাকা-লন্ডন-ঢাকা রুটে পিআইএ সৌজন্য টিকিট দিতে রাজি হয়নি।
এস এ মহসিনকে ম্যানেজার আর প্রশিক্ষক মোহাম্মদ আলীকে নিয়ে ব্রজেন ঢাকা ছাড়লেন লন্ডনের উদ্দেশে। সেখানে পৌঁছেই শুরু করলেন আবার অনুশীলন, সাঁতার কেটেছেন চ্যানেলে। অংশ নিয়েছেন—ক্যাপ্রি দীপ থেকে নেপলস পর্যন্ত ৩৩ কিলোমিটার দূরপাল্লার সাঁতারে। ভালো প্রস্তুতি ব্রজেন দাসের আত্মবিশ্বাস আরো বাড়িয়ে দিল।
এরপর এলো সেই স্মরণীয় দিন ১৮ আগস্ট ১৯৫৮ সাল। ২৩টি দেশের ৩৯ জন প্রতিযোগীর সঙ্গে ঝাঁপ দিলেন পানিতে ফ্রান্স থেকে ইংল্যান্ড পর্যন্ত ইংলিশ চ্যানেল কৃতিত্বের সঙ্গে অতিক্রম করার দৃঢ় সংকল্প নিয়ে। ১৪ ঘণ্টা ৫২ মিনিটে দূরত্ব অতিক্রম করে প্রথম হলেন পাকিস্তানের ব্রজেন দাস। আন্তর্জাতিক সাঁতার অঙ্গনে এটিই কোনো পাকিস্তানির প্রথম একক সাফল্য। শুধু তা-ই নয়, ব্রজেন প্রথম এশিয়ান, যিনি কৃতিত্বের সঙ্গে ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রম করে প্রথম হয়েছেন। ব্রজেন পাকিস্তানের পতাকাকে আন্তর্জাতিক চত্বরে তুলে ধরেছেন গৌরবের সঙ্গে। পরিচিত করেছেন পাকিস্তানকে। অথচ এই ব্রজেন দাসকে বারবার অবহেলা করা হয়েছে। তাঁকে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া হয়নি সব রকম যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও। যে পাকিস্তানিরা বাঙালি সাঁতারুকে একসময় অবহেলা করেছে—তাঁকেই তারা পরে জাতীয় ‘বীর’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। প্রায় ছয় দশক আগে ব্রজেন দাসের সাহায্যে পুরো পাকিস্তানে আনন্দ-উৎসব হয়েছে।
মনে আছে, পূর্ব পাকিস্তানে অনেক স্কুল ও কলেজ এক দিন ছুটি দেওয়া হয়েছিল। অভিনন্দনের টেলিগ্রামে ব্রজেন দাসের কাঁধের ব্যাগ ভরে গেছে, এ কথা ১৯৭২ সালে আমার সঙ্গে এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন। পাকিস্তানে ফিরে আসার পর করাচির কমিশনার এন এম খান ব্রজেন দাসের জন্য বীরোচিত সংবর্ধনার আয়োজন করেন। আইয়ুব খান তাঁকে বুকে ছড়িয়ে ধরে বলেছেন, ‘ব্রজেন, তুমি পাকিস্তানের গর্ব। তুমি দেশকে একক প্রচেষ্টায় যেভাবে আন্তর্জাতিক ক্রীড়াচত্বরে তুলে ধরেছ, তা আর কেউ পারেনি। তুমি এখন পাকিস্তানের সাঁতারে সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা।
ব্রজেন দাস এরপর ১৯৫৯ ও ১৯৬০ সালেও চ্যানেল অতিক্রম করেছেন। সবশেষে ১৯৬১ সালের ২১ সেপ্টেম্বর ফ্রান্স থেকে ইংল্যান্ড অতিক্রম করেন। সময় নেন ১০ ঘণ্টা ৩৫ মিনিট। এটি ছিল বিশ্বরেকর্ড। এর আগে ১৯৫০ সালে মিসরের হাসান আবদুল রহিম ১০ ঘণ্টা ৫০ মিনিটে দূরত্ব অতিক্রম করে বিশ্বরেকর্ড করেছিলেন। ব্রজেন সেই রেকর্ড ভেঙে নতুন বিশ্বরেকর্ড করেছেন। ব্রজেন দাস ছয়বার চ্যানেল অতিক্রম করেছেন এটাও একটা রেকর্ড। তার আগে চারবারের বেশি কেউ চ্যানেল অতিক্রম করেননি।
১৯৬১ সালে বিশ্বরেকর্ড সৃষ্টির পর ইংল্যান্ডে পাকিস্তান হাইকমিশনে ব্রজেনকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। এই সংবর্ধনায় ব্রিটিশ ভারতের সর্বশেষ গভর্নর জেনারেল লর্ড মাউন্ট বেটেন উপস্থিত ছিলেন। ইংল্যান্ডের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ তাঁকে কৃতিত্বের জন্য অভিনন্দন জানিয়েছেন। ঢাকায় ফিরে আসার পর ঢাকা স্টেডিয়ামে ব্রজেন দাসকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। হাজার হাজার মানুষ উপস্থিত হয়েছিলেন। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর আজম খান ব্রজেন দাসকে অভিনন্দন জানিয়ে ‘বাঙাল কা শের’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। এরপর ইংল্যান্ডের রানি ও তাঁর মা পাকিস্তান সফরে এলে করাচিতে নাগরিক সংবর্ধনায় পূর্ব পাকিস্তান থেকে একমাত্র ক্রীড়াবিদ ব্রজেন দাসকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। সেই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে রানি ব্রজেন দাসকে অভিনন্দন জানিয়েছেন এবং তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন। রানির সঙ্গে ব্রজেন দাসের সেই ছবি পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। কালের চক্র বাঙালি সাঁতারুর সেই অসাধারণ সোনালি অধ্যায়ের ওপর এখন ধুলো জন্মিয়েছে!
লেখক : কলামিস্ট ও বিশ্লেষক