বিবর্তণবাদ আগামীকালে মানুষ এতখানি চাক্ষুসভাবে মেনে নিতে বাধ্য হবে যে আদম হাওয়ার গল্প আর ধোপে টিকবে না।

যারা নিজেদের হিন্দু পূর্বপুরুষকেই অস্বীকার করে ফেলে তারা করবে মানুষের পূর্বপুরুষ বানর (এপ) প্রজাতীর কাউকে- এটা ভাবাও হাস্যকর। ৩৫ লাখ বছর আগের একটা মাথার খুলি সম্প্রতি আবিস্কার হয়েছে যেটা বিজ্ঞানীরা বলছেন এটি সম্ভবত মানুষের সব থেকে কাছের পূর্বপুরুষ। বিবর্তণবাদ একটি প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞান। মানুষসহ সমস্ত জীবজগত যে বিবর্তণের মাধ্যমে আজকের চেহারা লাভ করেছে এটি বিজ্ঞান প্রমাণ করেছে। যেটা নিয়ে বিজ্ঞানী মহলে তর্ক বিতর্ক আছে তা হলো বিবর্তণের ধারাবাহিকতা। আধুনিক মানুষ ঠিক কোন পূর্বপুরুষের সবচেযে কাছাকাছি সেই গবষণাই এখন চলছে। মাটির নিচে জীবশ্মা হয়ে আজো প্রমাণের অপেক্ষা বসে আছে আমাদের সবচেয়ে কাছের পূর্বপুরুষ যাকে কার্বণ টেস্টের মাধ্যমে প্রমাণিত হতে হবে তিনি ঠিক কতখানি প্রচীন ছিলেন। বিজ্ঞানের এই পরীক্ষাগুলোকে নিয়ে বিবিসির ফেইসবুক পাতায় কমেন্টে যারা ঠাট্টা তামাশা করছে তারা কিন্তু ঠিকই এক্সরে করতে ল্যাবে যায়! রক্ত পরীক্ষা, মুত্র পরীক্ষা… বিজ্ঞানের এই আবিস্কারগুলো কেমন করে সব নির্ভুল বলে দিতে পারে এটা তারা ভাবে না। রক্তের যে গ্রুপ আছে আর মানুষের মাঝে সবার রক্ত লাল হলেও যে গ্রুপ আলাদা- এটা তো মুসলমানদের ‘সর্বকালের সেরা বিজ্ঞানী’ হযরত মুহাম্মদও জানতেন না! কার্বন পরীক্ষার মাধ্যমে একটা হাড়কে পরীক্ষা করলে এই হাড়টি ঠিক কত বছর আগে জীবন্ত কোন মাংস পিন্ডের মধ্যে থেকে পৃথিবীতে বিচরণ করেছিলো তা বলে দেয়া যায়। যেমন আপনার মুত্র পরীক্ষা করে বলা যায় আপনার কোন রোগ হয়েছে কিনা। সেই রোগ নিশ্চিত করেই আপনাকে ঐষধ দেয়া হয়। সুরা ইখলাস, সুরা ফাতিয়া, তিনবার করে পড়ে কিন্তু চিকিৎসা নিশ্চিত করেন না। বিজ্ঞানের চিকিৎসা ব্যবস্থা আর পরীক্ষা নীরিক্ষায় আস্থা রেথেই ইন্ডিয়া সিংগাপুর দৌড়ান।

বিবর্তণবাদের যে কোন নিউজের নিচে মুমিনবান্দাদের কমেন্ট পড়ে যেমন হাসি আসে তেমনই ভেবে আশ্চর্য হতে হয় মুমিন মানেই কি গর্ধব আর আকাটমূর্খ? কুরআনের হিসাব অনুযায়ী মাত্র ৬০০০ বছর আগে আদম হাওয়া পৃথিবীতে এসেছিলো। তাওরাত অনুসারে যা ৪০০০ বছর আগে। কিভাবে হিসেবটা করা হয়েছে? তাওরাতে নবীদের তালিকা ধরে আদম যে ৪০০০/৬০০০ বছর আগে পৃথিবীতে এসেছিলো তা ইসলামী স্কলাররাই স্বগর্বে বলে এসেছিলেন। তারা হিসেব করে দাবী করেছেস তাদের নবী মুহাম্মদ আদম থেকে ৬০০০ বছর পর জন্মেছিলেন। বিবর্তণবাদ প্রতিষ্ঠিত হবার পর থেকেই বলা চলে ধর্মের প্রাণ ভ্রমরে প্রাণঘাতি আঘাত লেগে বসে। বিবর্তণবাদের বড় প্রমাণ হিসেবে ১৮৫৬ সালে জার্মানীর নিয়ানডার উপত্যকায় নিয়ান্ডারথাল ‘মানব’ ফসিল আবিস্কৃত হয়। কার্বন টেস্টের মাধ্যমে জানা যায় এরা ১,২০,০০০-৩,৫০,০০০  হাজার পূর্বে  পৃথিবীতে বিচরণ করত এবং ৩৫০০০ হাজার বছর পূর্বে সম্ভবত মানুষের পূর্বপুরুষ হোমো সেপিয়েন্সের সঙ্গে প্রতিযোগীতায় হেরে বিদায় নিয়েছিলো। আজ থেকে ৩৫০০০ বছর আগে মানুষ ছবি আঁকতে পারত তা আবিস্কৃত হয়েছে ফ্রান্সের গুহায়। অর্থ্যাৎ তখনি মানুষ যথেষ্ঠ জ্ঞান রাখত স্পষ্ট প্রমাণিত হয়। ৫০০০ হাজার বছর আগে ভারতে রীতিমত সভ্যতা বিরাজ করছিলো। ৩৫০০ বছর আগে মিশরে সভ্যতা ছিলো। অথচ ধর্মগ্রন্থ বলছে আদম হচ্ছে প্রথম মানুষ সে এবং তার স্ত্রী হাওয়া যখন পৃথিবীতে শাস্তি হিসেবে আকাশ থেকে নিক্ষেপ হলো তখন এই পৃথিবীতে কেউ ছিলো না। তাদের সন্তান হাবিল কাবিলের মধ্যমে মানব জাতি বংশবিস্তার করে। কেমন করে দুটি পুত্র সন্তান দিয়ে মানব বংশ বিস্তার ঘটল? যদি ধরেও নেই আদমের কোন কন্যা সন্তান ছিলো তাহলে কি আজাচার করেই মানব জাতির বিস্তার ঘটেছে? ধর্ম কিন্তু উপায় না পেয়ে সেটাই বলে। আর আমরাও ধর্মান্ধ হয়ে একটা আজাচার কুৎসিত যৌন সম্পর্কের ধারায় আমাদের বিকাশকে মেনে নেয় কিন্তু হোমো সেপিয়েন্সের মত কোন শিপাঞ্জীকৃতি পূর্বপুরুষের বিবর্তিত ফসল ভাবতে ঘৃণাবোধ করি!

বিবর্তণবাদকে পাঠ্য তালিকা থেকে বাদ দিতে চার্চ আমেরিকার মত জায়গায় হস্তক্ষেপ করেছিলো। ইহুদী পন্ডিতরা বিবর্তণবাদকে শয়তানের কাজকর্ম বলেছিলো। ডারউনকে খ্রিস্টান চার্চ সমাহিত করতে অস্বীকার করেছিল। মুসলিম বিশ্বে কোথাও বিবর্তণবাদের পড়ানো হয় না। যদিও বিবর্তণবাদের ধারায় উন্নত চিকিৎসা বিজ্ঞানের সমস্ত সুবিধা নিতে তাদের কোন আপত্তি নেই। বাংলাদেশের হেফাজত ইসলামের বাবুনাগরী বিবর্তণবাদ পাঠ্যবই থেকে বাদ দেয়ার দাবী করেছেন। আদম হাওয়া গল্প পাঠ্য বইতে সৃষ্টিতত্ত্ব হিসেবে দেয়ার দাবী করেছেন। আদমের সন্তানরা নিজেদের মধ্যে অজাচার করে বাবুনাগরি পর্যন্ত এসেছে- এমন কুৎসিত কিচ্ছা বাচ্চাদের পড়ানো হবে…। আদম হাওয়া গল্পের ফাকফোকড় ও আধুনিককালে মানুষের পূর্বপুরুষের একের পর এক ফসিল আবিস্কার হবার পর ধর্মবেত্তাদের মধ্যে কেউ কেউ ধর্মের আশুমৃত্যু কল্পনা করে ভীত হয়ে আদম হাওয়ার কাহিনীকে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করে বুঝাতে চাইছে আদম হাওয়া প্রথম মানুষ নয় তারও আগে আরো অনেক আদম পৃথিবীতে এসেছিলো। মির্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী সৃষ্টিতত্ত্বের এই ফাকফোকড়গুলো দেখে ভিন্ন গল্প ফেঁদেছিলো যে আদম হাওয়া পৃথিবীর প্রথম মানুষ ছিলো না। কাদিয়ানীদের মধ্যে তাই এরকম বিশ্বাস আছে যে আদম প্রথম মানুষ নয়। আদম প্রথম নবী ছিলো- মানুষ নয়। ইহুদী খ্রিস্টানদের মুমিনদের মধ্যে যারা বিজ্ঞানকে আধুনিক যুগে অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই মনে করেন তারাও হুবহু একই রকম দাবী তুলেছে বিচ্ছিন্নভাবে। তারা ব্যাখ্যা করেছে তাওরাতের নবীদের বংশ তালিকা আসলে রূপ অর্থে এসেছে। যেমন ‘দাউদের বয়স যখন ৪০ বছর ছিল তখন তিনি ঈসা মসীহ্র পিতা হন’ এই কথাটা দ্বারা বুঝায়  ৪০ বছর বয়সে তার সন্তান সোলায়মানের জন্ম হল যার বংশে ঈসা মসীহ্র জন্ম হল। তারা বলতে চাইছেন তাওরাতের বংশ তালিকাকে গ্রেগরি ক্যালেন্ডার ধরে হিসেবে করলে হবে না। অথচ তাওরাত ও কুরআন পড়লে এসব ধানাই পানাই সব উবে যায়। এখানে স্পষ্ট করে বলা আছে আদমকে বানাতে পৃথিবী থেকে কাঁদামাটি আনা হয়েছিলো। হাদিসে আছে আজরাইল পৃথিবী থেকে কয়েক রঙের মাটি নিয়ে এসেছিলো বিধায় মানুষ সাদা কালো বাদামীসহ নানা রঙের হয়ে থাকে। তারপর মাটি থেকে আদম বানানো হলে ইবলিশ তাকে সিজদা করতে অস্বীকার করলে তাকে আল্লাহ/জিহোবা বর্হিস্কার করেন ইত্যাদি। গন্ধম খেয়ে আদম ও হাওয়া বেহস্ত থেকে শাস্তি স্বরূপ পৃথিবীতে নিক্ষেপ হোন। গোটা তাওরাত ও কুরআনে, হাদিসে কোথাও বলা নেই তখন মানব জাতি পৃথিবীতে ছিলো বা তারও আগে মানুষ পৃথিবীতে এসেছিলো। দুই আড়াই বছর আগের কোন ধর্মবেত্তাও তাদের ধর্ম ব্যাখ্যায় এমন তথ্য লিখে যাননি। ইসলামের নবী মুহাম্মদের নামে চলা যত হাদিস আছে সেখানেও এরকম কোন তথ্য নেই। কিন্তু চতুর ধর্ম লেকচারকারীরা ধর্মের মত পরজীবীকে বাঁচিয়ে রাখতে আগে থেকেই প্রস্তু হয়ে থাকছে। কারণ তারা জানে বিবর্তণবাদ আগামীকালে মানুষ এতখানি চাক্ষুসভাবে মেনে নিতে বাধ্য হবে যে আদম হাওয়ার গল্প আর ধোপে টিকবে না। কেউ মনে করতে পারেন বিবর্তণবাদকে ধর্ম যদি মেনে নেয় সেটা তো ভালোই হবে। তখন আর বিবর্তণবাদ পড়াতে কোন সমস্যা হবে। সেটা হবে ঠিকই, কিন্তু ধর্মের প্রধান যে কাজ, মানুষে মানুষে সাম্প্রদায়িক বিভাজন, যুদ্ধ, ঘৃণা, জাতীয়তাবাদ রক্ষায় চিরস্থায়ী অবিশ্বাস সন্দেহ তৈরি করে রাখা- ধর্ম যদি টিকে যায় তাহলে এগুলোও টিকে যাবে। তখন বিবর্তণবাদ বাধাহীন পড়ানো হলেও মানুষের মানুষ হয়ে উঠা হবে কি?