মরিচঝাপি:১৯৭৯ সাল।
জেনারেল ইয়াহিয়া খানের প্রেতাত্মা জ্যোতি পশুর হাতে হিন্দু গণহত্যার আরেক দফা।
জানুয়ারিতে শুরু উৎখাতের প্রথম পর্যায়।২৪ জানুয়ারি থেকে শুরু হলো অর্থনৈতিক অবরোধ। ৩০টি লঞ্চ অধিগ্রহণ করে মরিচঝাঁপিকে ঘিরে ফেললো জ্যোতি পশুর পুলিশ। সংবাদমাধ্যমের জন্য জারি হলো ১৪৪ ধারা, মরিচঝাঁপি তাদের জন্য অগম্য এবং নিষিদ্ধ। এ নিয়ে কিছু লেখা যাবে না, বলাও যাবে না। রিফ্যুজি হিন্দুদের টিউবওয়েল থেকে শুরু করে ক্ষেতি-জমি, মাছের ঘের, নৌকা সব নষ্ট করে ফেলা হলো। বৃষ্টির জল ধরে রেখে তা পান করে জান বাচানো চেষ্টা করছিলো তারা, সেখানে বিষ মেশানো হলো। সে বিষে মরলো অসংখ্য শিশু। বাইরে থেকে খাবার আনার জো নেই, রসদ পাওয়ার জো নেই। ৩১ জানুয়ারি কিছু মরিয়া যুবক পাশের কুমীরমারি থেকে খাবার আনতে সাঁতরে ব্যারিকেড ভাঙলো। পুলিশের গুলিতে মরতে হলো তাদের ৩৬ জনকে। রিফ্যুজি হিন্দুদের ততদিনে বাঁচার জন্য ঘাস খেতে শুরু করেছে!
বিপন্ন এই মানবিকতায় উদ্বিগ্ন হয়ে পশ্চিমবঙ্গের যারাই সাহায্যের হাত বাড়াতে উদ্যোগি হয়েছেন, তাদের সে হাত ঠেকিয়ে দিয়েছে বামফ্রন্ট। সরকারী এবং দলীয় তরফে। জগদ্দরদী মাদার তেরেসা পর্যন্ত অপারগতা জানালেন আক্রান্ত মরিচঝাঁপিতে কিছু করতে। সাহায্যপ্রার্থী সুব্রত চ্যাটার্জিকে বললেন, সর্যি উই কান্ট গো, নাইদার উই কান এক্সপ্লেইন হোয়াই উই কান্ট…।
এদিকে অনাহারে মরতে শুরু করেছে মানুষ। যা-তা খেয়ে অসুখে মরছে শিশু এবং বৃদ্ধরা। গুলিতে যাদের মারা হচ্ছে, তাদের লাশ নগদে গুম করে ফেলা হচ্ছে। হয় লঞ্চে তুলে জলে ফেলে দেওয়া হচ্ছে, নয়তো ডাম্প করা হচ্ছে টাইগার প্রজেক্টে। বাঘের আহার জোগাতে।
অবশেষে সাফ মরিচঝাঁপি। পুরা এলাকায় কোনো স্থাপনা নেই যা দাঁড়িয়ে আছে। ধংসস্তুপ কথাটার আক্ষরিক এক প্রদর্শনী চারদিক জুড়ে। পোড়া ছাইয়ের মাঝে হয়তো উকি মেরে আছে ঘুমের মধ্যেই লাশ হয়ে যাওয়া কোনো শিশুর রোস্ট। বামফ্রন্ট নিষেধাজ্ঞার ঘেরে ক্যাজুয়ালটির সঠিক সংখ্যাটা এখনও অজানা। কারো মতো শয়ে শয়ে, কারো মতে হাজারে হাজার। লাশ জলে ভেসে গেছে, বাঘে খেয়েছে, তুলে নিয়ে গেছে পুলিশ। সাংবাদিক তুষার ভট্টাচার্য্য তার এক প্রামান্যচিত্রে একটা হিসাব দিয়েছেন অবশ্য।
২৪ জানুয়ারি থেকে শুরু অবরোধ থেকে ১৩ মে পর্যন্ত অনাহারে ৭৪৪জন এবং বিনা চিকিৎসায় ৪৭৭৭ জন শিশু মারা গেছে।কমরেডদের সমাজতান্ত্রিক পাশবিক লিঙ্গের ঘায়ে ধর্ষিতা নারীর সংখ্যা ৮৪৫৪ জন, মারা গেছেন ৮৪২৬ জন। অনাহারে আত্মহত্যা করেছেন ৪৭২ জন। আহত ৫৮৫০, নিখোজ ৩৫৬৮ জন এবং গ্রেফতার হয়ে জেলে গেছেন ৮৫৬৯ জন। অন্যান্য ভাষ্যে সংখ্যাটা কয়েকগুণ। এদের অনেকেই দন্ডকে আবার ফিরে গেছেন। কেউবা পালিয়ে কলকাতায় এসে এখন ফুসকা বিক্রি করেন, হকারি করছেন। অনেকেই জানেন না তার স্বজনদের কে কোথায় আছে, বেচে আছে কিনা মরে গেছে। মেয়েরা হয়ে গেছেন পতিতা!
লাল সেলাম রক্তাক্ত লাল পতাকা!