রামায়ণ (দেবনাগরী: रामायण) একটি প্রাচীন সংস্কৃত মহাকাব্য।

রামায়ণ (দেবনাগরী: रामायण) একটি প্রাচীন সংস্কৃত মহাকাব্য। হিন্দু বিশ্বাস অনুযায়ী, ঋষি বাল্মীকি রামায়ণের রচয়িতা। এই গ্রন্থটি হিন্দুশাস্ত্রের স্মৃতি বর্গের অন্তর্গত। রামায়ণ ও মহাভারত ভারতের দুটি প্রধান মহাকাব্য। এই কাব্যে বিভিন্ন সম্পর্কের পারস্পরিক কর্তব্য বর্ণনার পাশাপাশি আদর্শ ভৃত্য, আদর্শ ভ্রাতা, আদর্শ স্ত্রী ও আদর্শ রাজার চরিত্র চিত্রণের মাধ্যমে মানবসমাজের আদর্শ ব্যাখ্যা করা হয়েছে।

রামায়ণ নামটি রাম ও অয়ন শব্দদুটি নিয়ে গঠিত একটি তৎপুরুষ সমাসবদ্ধ পদ; যার আক্ষরিক অর্থ রামের যাত্রা। রামায়ণ ৭টি কাণ্ড (পর্ব) ও ৫০০টি সর্গে বিভক্ত ২৪,০০০ শ্লোকের সমষ্টি। এই কাব্যের মূল উপজীব্য হল বিষ্ণুর অবতার রামের জীবনকাহিনি। বিষয় গতভাবে, রামায়ণ-উপাখ্যানে বর্ণিত হয়েছে মানব অস্তিত্বের নানান দিক এবং প্রাচীন ভারতের ধর্মচেতনা।

রামায়ণের শ্লোকগুলি ৩২-অক্ষরযুক্ত অনুষ্টুপ ছন্দে রচিত। পরবর্তীকালের সংস্কৃত কাব্য এবং ভারতীয় জীবন ও সংস্কৃতিতে এই কাব্যের প্রভাব অপরিসীম। মহাভারত মহাকাব্যের মতোই রামায়ণও একটি কাহিনিমাত্র নয়: হিন্দু ঋষিদের শিক্ষা দার্শনিক ও ভক্তি উপাদান সহ আখ্যানমূলক উপমার মাধ্যমে উপস্থাপিত হয়েছে এই মহাকাব্যে। ভারতের সংস্কৃতি চেতনার মৌলিক উপাদানগুলিই প্রতিফলিত হয়েছে রাম, সীতা, লক্ষ্মণ, ভরত, হনুমান ও রাবণ চরিত্রগুলির মধ্যে।

হিন্দুধর্মের বাইরে ও বহির্ভারতেও রামায়ণের কয়েকটি পাঠান্তর প্রচলিত রয়েছে। এগুলির মধ্যে উল্লেখনীয় বৌদ্ধ রামায়ণ দশরথ জাতক (জাতক সংখ্যা ৬৪১) ও জৈন রামায়ণ এবং রামায়ণের থাই, লাও, ব্রহ্মদেশীয় ও মালয় সংস্করণ।

লোকবিশ্বাস অনুযায়ী, ভারতের আদিকবি বাল্মীকি রামায়ণ রচনা করেছিলেন। ভারতীয় সংস্কৃতিতে এই ব্যাপারে কোনো দ্বিমত নেই যে রামের সমসাময়িক তথা এই মহাকাব্যের অন্যতম চরিত্র ঋষি বাল্মীকি স্বয়ং এই মহাকাব্য রচনা করেছিলেন। সংস্কৃত ভাষায় রচিত রামায়ণের মূল পাঠটি বাল্মীকি রামায়ণ নামে পরিচিত। এই গ্রন্থের রচনাকাল আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দী। হিন্দু ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী, রামায়ণ-উপাখ্যানের পটভূমি ত্রেতাযুগ নামে পরিচিত পৌরাণিক সময়কাল।

বর্তমানে সুলভ বাল্মীকি রামায়ণের সংস্করণটি মোটামুটি ৫০,০০০ পঙক্তি সম্বলিত। কয়েক হাজার আংশিক ও সম্পূর্ণ পুথিতে এই পাঠটি বর্তমানে সংরক্ষিত। এই পুথিগুলি মধ্যে সর্বপ্রাচীন পুথিটি খ্রিষ্টীয় একাদশ শতাব্দীতে লিখিত হয়। মূল রামায়ণের একাধিক আঞ্চলিক পাঠান্তর, সংস্করণ ও উপসংস্করণ বিদ্যমান। পুথিবিশারদ রবার্ট পি. গোল্ডম্যান এই সংস্করণগুলিকে দুই ভাগে বিভক্ত করেছেন। যথা: (ক) উত্তর ভারতীয় ও (খ) দক্ষিণ ভারতীয়। এই সংস্করণগুলির মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য তামিল ভাষায় কম্বন কর্তৃক রচিত রামাবতারম্ (খ্রিষ্টীয় একাদশ-দ্বাদশ শতাব্দী), বাংলা ভাষায় কৃত্তিবাস ওঝা কর্তৃক রচিত শ্রীরামপাঁচালী বা কৃত্তিবাসী রামায়ণ (খ্রিষ্টীয় পঞ্চদশ শতাব্দী) এবং হিন্দি ভাষার অবধি উপভাষায় তুলসীদাস গোস্বামী কর্তৃক রচিত রামচরিতমানস (খ্রিষ্টীয় ষোড়শ শতাব্দী)। রামায়ণ বিশেষজ্ঞ তথা ইংরেজিতে রামায়ণের পদ্যানুবাদক রমেশচন্দ্র দত্ত লিখেছেন, “মহাভারতের ন্যায় রামায়ণও বহু শতাব্দীর ফসল। কিন্তু নিঃসন্দেহে বলা যায়, এই কাব্যের মূল আখ্যানভাগটি একক ব্যক্তির মস্তিস্কপ্রসূত।”

অবশ্য বাল্মীকি রামায়ণের প্রথম ও শেষ কাণ্ডদুটি মূল রচয়িতা কর্তৃক রচিত কিনা সেই বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। রঘুনাথন মনে করেন, এই দুই কাণ্ডের কয়েকটি প্রক্ষিপ্তাংশ বর্তমানে মূল রামায়ণের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে মনে করা হলেও, গ্রন্থের অন্যান্য অংশের সঙ্গে এই অংশগুলির শৈলীগত পার্থক্য এবং আখ্যানগত স্ববিরোধ পরিলক্ষিত হয়ে থাকে।

বাল্মীকি রামায়ণের রচনাকাল আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দী। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রমাণ (যেমন মহাভারতে সতীদাহ প্রথার উল্লেখ থাকলেও রামায়ণের মূল পাঠে তা নেই) থেকে অনুমিত হয় এই গ্রন্থ মহাভারতের পূর্বে রচিত হয়েছিল। হিন্দু বিশ্বাস অনুযায়ী, হিন্দু কালপঞ্জিতে উল্লিখিত যুগপর্যায়ের দ্বিতীয় যুগ ত্রেতায় এই মহাকাব্য রচিত হয়। কথিত আছে, ত্রেতা যুগেই ইক্ষ্বাকু বংশীয় রাজা দশরথের পুত্র রামের জন্ম হয়।

তবে ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকেও রামায়ণকে প্রাচীনতর গ্রন্থ মনে করা হয়। রামায়ণে উল্লিখিত কয়েকটি চরিত্রনাম (যথা: রাম, সীতা, দশরথ, জনক, বশিষ্ঠ, বিশ্বামিত্র) বৈদিক সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য অংশ ব্রাহ্মণ-এও পাওয়া যায়। এই গ্রন্থটি বাল্মীকি রামায়ণ অপেক্ষাও প্রাচীন। Rezaul Manik 

(জোড়-বাংলা মন্দির বা কেষ্টরায় মন্দিরের রামায়ণ মোটিফ (১৬৫৫ খ্রি.), বিষ্ণুপুর, বাঁকুড়া জেলা, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত। ছবি কার্টেসি বাপ্পাদিত্য বন্দোপাধ্যায়)