রাধানাথ শিকদার (জন্মঃ- ১৮১৩ – মৃত্যুঃ- ১৭ মে, ১৮৭০)
তাতে ভারত বর্ষের খুটি নটি ম্যাপ তৈরি করতে হবে। স্যার এভারেস্টের অনেক প্রিয় পাত্র একজন বাঙ্গালী ক্লার্ক রাধানাথ শিকদার। ১৮১৩ সালে কলকাতার বিখ্যাত জোড়াসাকো তে জন্ম নেন। মাইকেল মধুসুদন দত্তের সমসাময়িক এই গনিত বীদ একই হেয়ার কলেজের ছাত্র। গনিত তার ধ্যান জ্ঞ্যান, গনিতের প্রেমে বিয়ে পর্যন্ত করে ওঠা হয়নি।
প্রচুর সরকারী অর্থে অসম সাহসী মাউন্টেনিয়াররা এমন জায়গায় যাচ্ছেন যেটা মানুষের কল্পনারো বাইরে। সাথে নিতে হচ্ছে থীওডোলাইট যন্ত্র যেটা একটা ক্যারি করতে ১২ জন শেরপার দরকার হয়। অসম্ভব আবহাওয়ায় বছরে মাত্র কয়েকমাস হিমালয় অঞ্চলে কাজ করা সম্ভব। ১৮৪৯ সালে জেমস নিকলসন হিমালয়ের তেরাই ট্রেক করে ফিরলেন। তার প্রাপ্ত ডাটা গুলো কর্নেল ওয়াহ (স্যার এভারেস্ট রিটায়ার্ড করে লন্ডনে ফিরে গেছেন) হাতে দিয়ে গেলেন। এগুলো নিয়েই গবেষনা। প্রায় ৪ বছর পরে রাধানাথ একদিন অবাক হয়ে টের পেলেন উনি বড় কিছু একটা করেছেন। ৪ বছর ধরে অপ্রয়োজনীয় কিছু ডাটা পরে আছে, সামরিক বা ব্যাবসায়ীক গুরুত্ব নেই দেখে কেউ তেমন ভাবে ঘেটে দেখেনি। হিমালয়ের অনেকগুলো শিখর আছে যেগুলোর কোন নামই নেই। কৌতুহলী রাধানাথ নামহীন এই ৮৯টা শৃঙ্গ নিয়ে হিসাব করতে গিয়ে ১৫ নাম্বার পিকের ফাইনাল হিসাবটা বার বার দেখলেন। ২৯০০২ ফুট। ভুল হয়নি তো। কাঞ্চনজঙ্ঘাতো দুরের কথা পৃথীবীর বুকে এত উচু একটা জায়গা কারো কল্পনায় আসে নি। এত উচু হতে পারবে। রাধানাথ শিকদার ছুটে গেলেন রয়েল রয়েল জিওগ্রাফিক সোসাইটিতে তার বস কর্নেল এন্ড্রু ওয়াহর কাছে। স্যার, পিক নাম্বার ১৫ পৃথিবীর উচ্চতম স্থান। জেমস নিকলসন একবারো বুঝতে পারেনি নেপালের তেরাই (তৃন ছাওয়া একধরনের ভ্যালি) থেকে বাইনোকুলার দিয়ে উনি যেই চুড়াটা দেখেছেন সেটা পৃথিবীর সব রোমাঞ্চপ্রিয় মানুষের ভবিষ্যতে স্বপ্নের তীর্থ। রাতারাতি হৈ হুল্লুর লেগে গেল। কর্নেল ওয়াহ বিদগ্ধ এই গনিতবীদকে হিমালয় রাজের নামকরনের দায়িত্ব দিলেন। পুরো মিশনের মুল পরিশ্রম কারী স্যার এভারেস্টের নামে উনি এর নাম দিলেন মাউন্ট এভারেস্ট। ১৮৭০ সালে নিখুত ভাবে এভারেস্টের উচ্চতা মাপা এবং পৃথীবীর সকল ট্রেকার, মাউন্টেনিয়ারদের তীর্থভুমী মাউন্ট এভারেস্টের নামকরন করা এই মহান বাঙ্গালী ত্রিকোনমিতিবীদ দেহত্যাগ করেন।
নামকরনের আগে কর্নেল ওয়াহ রাধানাথকে জিজ্ঞেস করেছিলেন পিক নাম্বার ১৫ এর কোন স্থানীয় নাম আছে নাকি। বাংলায় না থাকলেও তিব্বতী ভাষায় এর নাম ছিল কমুলুংমা, যার অর্থ পৃথীবীর জননী।
আবিষ্কারের ১০০ বছর পর ১৯৫৭ সালে স্যার হিলারী আর শেরপা তেনজিং এভারেস্ট জয় করেন। দুর্গমতা, চরম ভাবাপন্ন হাই অল্টিচিউড ওয়েদার এবং অনেক ব্যায়বহুলতা (অভিযানের জন্যে নেপাল সরকারকে প্রত্যেক অভিযাত্রি ২৫০০০ ইউ এস ডলার ট্যাক্স দিতে হয়)। এছাড়া প্রতি বছর অসংখ্য অভিযাত্রি প্রান হারায়। সাম্প্রতিক বছর গুলোতে আমাদের দেশের অনেক পটেনশিয়াল ট্রেকার হিমালয়ান ইন্সটিটিউট থেকে মাউন্টেনিয়ারিং এর কোর্স করছে। ইবিসি করা পুরুষ এবং মহিলা অভিযাত্রিকের সংখাও আশা ব্যাঞ্জক।
উনবিংশ শতাব্দীর ১ম ভাগে জরিপ কাজে ব্যবহৃত গণিত বিষয়ে চর্চা প্রয়োগ উদ্ভাবনে তিনি স্বকীয়তার সাক্ষ্য রেখেছেন। এইজন্য তিনি ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করেছিলেন। তিনি জার্মানির সুবিখ্যাত ফিলজফিক্যাল সোসাইটির ব্যাভেরিয়ান শাখার সম্মানীয় সদস্যপদ লাভ করেন ১৮৬২ সালে। গণিতে অসাধারণ পারদর্শিতার জন্য তাঁর এই সম্মান প্রাপ্তি।
রাধানাথ ১৮৫৪ সালে কলকাতা আর্ট অ্যান্ড ক্রাফট সোসাইটি স্থাপনের অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন। প্যারীচাঁদ মিত্রের সহযোগিতায় তিনি মহিলাদের জন্য বাংলা ভাষায় মাসিক পত্রিকা প্রকাশ ও যুগ্মভাবে সম্পাদনা করেন। এতেই প্যারীচাঁদের আলালের ঘরের দুলাল উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়।
১৮৭০ সালের ১৭ মে তাঁর মৃত্যু হয়।
২০০৪ সালের ২৭শে জুন তারিখে ভারতের ডাক বিভাগ চেন্নাইয়ে ভারতের ত্রিকোণমিতিক জরীপের প্রতিষ্ঠার স্মরণে একটি ডাকটিকিট প্রকাশ করে, যাতে রাধানাথ শিকদার এর ছবি প্রদর্শিত হয়েছে।