বাঙালির শেকড় খুঁজে বের করা কি আদৌ দরকারী?

বাঙালির শেকড় খুঁজে বের করা কি আদৌ দরকারী?

যদি শেকড় খুঁজে না পান, তাহলে ইসলামের আগ্রাসন, পশ্চিমী আগ্রাসন, গোবলয়ের আগ্রাসন, কিচ্ছু আটকাতে পারবেন না, এটা একটা বড় উত্তর।

দ্বিতীয়ত, শেকড় ছাড়া বাঙালির সংজ্ঞা খুঁজে বের করা যায় না। বাঙালিকে সংজ্ঞায়িত করতে হবে, বাঙালিচর্চা করতে গিয়েই প্রথম মনে হয়েছিল। স্রেফ বাংলায় কথা বললেই বাঙালি, আর কোনও সংজ্ঞার দরকার নেই, এটা যুক্তিগ্রাহ্য মনে হয়নি। পৃথিবীতে কোথাও শুধু ভাষা দিয়ে জাতি নির্ধারিত হয় না, সংস্কৃতি দিয়ে, শেকড় দিয়ে, ইতিহাস ও ঐতিহ্য দিয়ে সেটা হয়ে থাকে। সার্বিয়ান আর ক্রোয়েশিয়ানরা একই ভাষায় কথা বলে, কিন্তু তারা দুটো আলাদা জাতি, কারণ সংস্কৃতি আলাদা। সার্বিয়ানরা অর্থোডক্স চার্চের অনুগামী, আর ক্রোয়েশিয়ানরা ক্যাথলিক চার্চের। সার্বরা কিরিলিক বর্ণমালা এবং ক্রোটরা রোমান বর্ণমালা ব্যবহার করে। একদল পূর্বের দিকে, রাশিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে, আরেকদল পশ্চিমের দিকে, পশ্চিমী খ্রীষ্টধর্মের দিকে তাকিয়ে আছে। ভাবুন, দুদলই খ্রীষ্টান, কিন্তু তাও এমন মারাত্মক বিভেদ।

প্রসঙ্গে ফিরি। আমরা জানি ইংরেজিতে কথা বললেই ইংরেজ হয় না। ইংরেজিতে কথা বলেই ইংরেজের চোদ্দপুরুষের বাপান্ত করতে তো কোনও বাধা নেই। কাজেই বাংলা ভাষায় কথা বললেই বাঙালি জাতিত্ব নির্ধারিত হয়ে যাবে, এমনটা মানা যাচ্ছে না। এখন, যদি সাংস্কৃতিক শেকড়ের কথা বলি, তাহলে, প্রথমেই বঙ্কিমের কথা মনে পড়ে। বঙ্কিম বলে গেছিলেন যে বাঙালির শেকড় সাংখ্যে, সাংখ্য দর্শনে। এই প্রকৃতি পুরুষ দ্বৈতবাদের যে দর্শন, যেখান থেকে শিব-শক্তির জনপ্রিয় উপাসনা এসেছে, তার মূল খুঁজতে গিয়ে কিন্তু সিন্ধু-সরস্বতী সভ্যতায় যেতে হচ্ছে।

আর্য আক্রমণ তত্ত্ব বাতিল হয়ে গেছে কারণ গত দশ হাজার বছরে ভারত ভূখণ্ডে কোনও নতুন জেনেটিক স্টক আসেনি বলে জানা যাচ্ছে। তার মানে এই নয় যে বৈদিক আর্য সভ্যতাই প্রাচীন ভারতে সর্বব্যাপী ছিল।  যারা বেদ পড়েছেন তারা জানেন, শিব আদতে অবৈদিক দেবতা। সঞ্জীব সান্যালের ল্যান্ড অভ সেভেন রিভার্স বইটি অতি চমৎকার যুক্তি দিয়ে বলছে, ভারতে আর্যভাষীদের সভ্যতা একটা ছিল গ্রামীণ, ঋগবেদভিত্তিক, অন্যটা ছিল শিব-শক্তির উপাসক, যেটাকে আমরা সিন্ধু সভ্যতা বলে জানি। সঞ্জীব সান্যাল বিষয়টার ভেতরে ঢোকেন নি, এবং বৈদিক বনাম অবৈদিক আর্যদের দ্বন্দ্বেও যান নি। কিন্তু বাঙালি যে অবৈদিক অ্যালপাইন আর্যদের উত্তরাধিকার বহন করে, সেটা আজ মোটামুটিভাবে প্রতিষ্ঠিত ও স্বীকৃত। এই প্রকৃতি-পুরুষ উপাসনা যে সেই অবৈদিক আর্যদের জীবনচর্যার অঙ্গ ছিল, যেখান থেকে পরবর্তীতে বজ্রযান আর সহজযান এসেছে, শাক্ত আর বৈষ্ণব এসেছে, তন্ত্র এসেছে, বাউল এসেছে, সেটা আমার অভিমত, এবং আমি বহুবার এ নিয়ে লেখালেখি করেছি, আরও করব।

আমরা জানি বাংলার বৈদ্যরা হলেন সারস্বত ব্রাহ্মণদের বংশধর, এমন একটা তত্ত্ব আছে। এদিকে বাংলায় সাতশতী বলে যে আদি ব্রাহ্মণরা ছিলেন বলে জানা যায়, এই কনৌজ টনৌজ থেকে বামুন আনার আগে, সেই সাতশতী কথাটা সংস্কৃত সপ্তশতী থেকে এসেছে, কুলুজিগ্রন্থগুলো তাই বলে, কিন্তু ও কথাটা সরস্বতী থেকে এসেছে, এই মতটা কিন্তু ক্রমশঃ শক্তিশালী হচ্ছে। গোয়ায় যে সব সারস্বত ব্রাহ্মণদের দেখি, তারা সবাই নিজেদের বাঙালিদের বংশধর বলে পরিচয় দেন। এমতাবস্থায়, বাঙালির শেকড়ের অনুসন্ধান যারা করবেন, এই সারস্বত অ্যাঙ্গল খুঁজে দেখা তাদের অবশ্যকর্তব্য।

বাঙালির এই দেশজ ঐতিহ্য, এই দেশজ উত্তরাধিকারই বাঙালির শেকড়। বাঙালি আত্মপরিচয়ের উৎস প্রকৃতি পুরুষ দ্বৈতবাদে, যার পুরোনো চেহারা দেখি ভারতভূমির প্রাচীনতম সভ্যতায়, সিন্ধু-সরস্বতী সভ্যতায়।

সরস্বতী শুকিয়ে গেছে বহুকাল আগেই। আজ বাঙালিকে সংজ্ঞায়িত করতে চাইলে গঙ্গা আর সাগরের সঙ্গমে এসে সাংখ্যকার কপিলের স্মৃতিকে ছুঁতে হবে। এখানে এই জাতির সহস্র সহস্র বছরের মণীষার সারবস্তু সংরক্ষিত রয়েছে।